বছর ঘুরে প্রকৃতিতে আবার এসেছে শীত। পৌষ ও মাঘ শীতের সীমারেখা হলেও এর ব্যাপ্তি তিন চার মাস জুড়ে। শীতের আসা-যাওয়া আমরা দারুণভাবে উপভোগ করি। শীতের সাথে আমাদের সখ্যতা সৃষ্টির শুরু থেকে। প্রকৃতিই শীতের কথা বলে। শীতের বিচরণে সাড়া পড়েছে প্রকৃতিতে। শীত নিয়ে সমাজে চলছে আমেজ ও উৎসব। শীত ব্যাপক প্রসারিত কাল। উঁচু উচু গাছের মাথায় তার প্রলেপ কুয়াশার বিস্তার। আমাদের বাড়ি-ঘর কুয়াশার আবরণে সকাল ৯/১০টার আগে স্পষ্ট হয় না। গাছের পাতার হলদে রঙ। শোনা যাচ্ছে তাদের গাছের পাতা ঝরে পড়ার শব্দ। শুধু ভোর বেলায় গুটি কয়েক স্বাস্থ্য সচেতন মানুষ আর শীর্ণ দেহী, জীর্ণ পোশাকের পাতা কুড়ানীদের সঙ্গে দেখা মিলে। ও দিকে সূর্য মামা তড়িঘড়ি টুপ করে ডুব দেয়। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় হু হু কাঁপন, বাতাসে শীতে গন্ধ। গরম চা আর ধোঁয়া ওঠা ভাপা পিঠা পথে পথে। বদলে যাচ্ছে অনেক কিছু। হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে শীত।
শীতকাল আমাদের জীবন জীবিকার ক্ষেত্রে যতটা গুরুত্বপূর্ণ, অনুভব উপভোগ, যতটা স্বতন্ত্র, ততটা আলোচ্য বিষয় হিসেবে মূল্য পায়নি। গ্রাম জীবনে শীত আসে নানা মাত্রা নিয়ে। এর সঙ্গে একজন কৃষকের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা যুক্ত, কষ্টের ভেতরেও তার প্রাপ্তি আছে। ভূমিহীন, প্রান্তিক চাষী বা দরিদ্র-ক্লিষ্ট মানুষের জন্য সময়টা নিরানন্দময় তার অর্জনের ভান্ড একবারে শূন্য না হলেও চাহিদার তুলনায় প্রাপ্তি নগণ্য। যেখানে শ্রমের বিনিময়ে অর্জন কম, সেখানে ক্লেশের মূল্য কোথায়? শহরে জন্ম নেয়া মানুষ প্রকৃতির এই রূপ আর রং পরিবর্তনকে ততটা আমলে আনেন না।

কেননা তার জীবিকা কিংবা বিত্ত বসাতির সঙ্গে বিশেষ কোন ঋতু সরাসরি যুক্ত হয়। গাঁয়ে শিকড় রয়ে যাওয়া প্রথম প্রজন্মের শহরবাসী শীতকে বিস্মৃতির আড়ালে চলে যেতে দেন না সত্যি কিন্তু কর্মব্যস্ত সময়ের ভেতর একে নিয়ে দু’দণ্ড তাঁর ভাবার অবসর কম। অবশ্য শীতকালে গ্রামে যাওয়ার সুযোগ পেলে সেটা তাঁরা মাঝে মধ্যে কাজে লাগান। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টিতেও শীত ঋতুটা যেন ‘ব্রাত্যজন’। তাকে নিয়ে লেখা লেখি বেশি কিছু নয়, যদিও বাংলাদেশের ছয়টি ঋতুর প্রধান তিনটির একটি শীতকাল। শীত হলো সমৃদ্ধির প্রতিক। কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘শরত-হেমন্ত-শীতে মানুষের ফসলের ভান্ডার। সেই জন্য সেখানে তাহার তিন মহল, ঐখানে তাহার গৃহলক্ষী’ শরত-হেমন্ত হলো বর্ষা আর শীতের ক্রান্তিকাল। বস্তুত ওই দুই ঋতু ফসলের সমস্ত সম্ভার অবারিত-অকৃপন হাতে শীতের কাছে পৌঁছে দেয়। সে কারণে শীতকাল, বিশেষ করে এর দিনের বেলাটি কর্ম উদ্দীপনায় মূখর। আবার বৈপরীত্য এর রাতে, নির্জনতা স্তব্ধতার কাছে সে তখন নিজেকে সম্পূর্ণ করে। অবশ্য এই চিরাচরিত্র চিত্রও বদলে যাচ্ছে এখন। রাতও হয়ে উঠছে কর্মময়।

পল্লী এলাকায় শরতের শেষেই কুয়াশা পড়া শুরু হয়, হেমন্তে তা প্রসারিত হয় গোটা জনপদকে। সূর্য মকরক্রান্তি বরাবর অবস্থান নেয়ার ফলে দিন ক্রমশ ছোট হয়ে আসে। শীতার্ত উত্তুরে বাতাস ধেয়ে এসে মানুষের শরীরে যেন হুল ফোটায়। শহরের দালান কোঠার ভীরে শীতল হাওয়ার সঙ্গে কুয়াশার জঙ্গল একাকার হয়ে যায়। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে বোঝার উপায় থাকে না এতে কতটুকু কুয়াশা আর কতটুকু কার্বণডাই অক্সাইড। কিন্তু শহর ছাড়িয়ে গাঁয়ে পা রাখলেই যে কুয়াশা আলিঙ্গন জানায় তা বিশুদ্ধ এবং তরতাজা। শীতে মাঠ থেকে পানি নেমে যাওয়ার দিগন্ত জোড়া মাঠ গাঁয়ের মানুষের কাছে চলাচলের যোগ্য হয়, যা বর্ষায় ছিল অগম্য। খটখটে পায়েচলা কাঁচা সড়ক ধরে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে যেতেও বাঁধা নেই। মানুষের চলাচলও বেড়ে যায় এ সময়। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যাওয়া-আসা ও দূর গাঁ থেকে বাপের বাড়িতে বেড়াতে আসা বধূর প্রতীক্ষার অবসান ঘটায় এ শীত ঋতু। গাঁয়ের বাজারগুলোও জমজমাট হয়ে ওঠে। চারদিকে ইচ্ছেমত বেড়ানোর সুযোগে গ্রাম বাংলা প্রকৃত পক্ষেই শীতে উৎসব মুখর হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশে যে সবজি উৎপাদিত হয় তার শতাংশ মেলে শীতকালে। হাট বাজারগুলোতে এখন শীতকালীন শাক-সবজিতে ভরপুর। সীম, মুলা, ফুলকপি, বাঁধাকপি, লাউ, লালশাক, পালংশাক, টমেটো ইত্যাদি। গ্রামীণ হাটে বসেছে সবুজের মেলা। শীতে গ্রামীণ বধুরাও বসে নেই। শীতের পিঠে-পায়েশ তৈরির ধূম পড়েছে তাদের মধ্যে। ধানভানা আতপ চাউল তৈরি করা, ঢেঁকিতে কিংবা মেশিনে চাউলের গুঁড়া বানানো ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত কৃষাণীরা। আবহাওয়ার পরিবর্তন হেতু দেশের উত্তরাঞ্চলে শীতের তীব্রতা প্রতিবছরই বেশি অনুভব হয়। রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী, লালমনিরহাট, গাইবান্ধাসহ উত্তরাঞ্চলের অনেক জেলায় রাতের তাপমাত্রা বেশ হ্রাস পায়। ফলে সেখানে হাড় কাপনো শীতের হাত থেকে বাঁচার প্রস্তুতিও বিচিত্র।

শীত উৎসব এবং এর আহার্যের সঙ্গে খেজুর রসের সম্পর্ক নিবিড়। একেবারে জলাভূমি ছাড়া এবং কিছু পাহাড়ি ভূমি বাদে এর বাংলাদেশে এমন কোন অঞ্চল নেই যেখানে খেজুর গাছ জন্মে না। তবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খেজুর গুড় উৎপাদিত হয় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে। বিস্তর মজুর যুক্ত হন খেজুর গাছ কাটা, রস সংগ্রহ, তা জ্বাল দেয়া ও গুড় তৈরির কাজে। যে কোন চাষীই খেজুর গাছে কাটতে পারেন রস আহরণের জন্য কিন্তু এক্ষেত্রেও আছে কিছু কৌশল। যা শিখতে সময় নেই, তাই দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বহুকাল ধরে পেশাদার গাছ কাটিয়ে আছে। স্থানীয় ভাষায় এদের বলা হয় গাছি। কার্তিক মাসের শুরু থেকে চৈত্রের শেষ পর্যন্ত এরা খেজুর গাছ কাটায় নিয়োজিত থাকেন। যে সব চাষীর স্বল্প সংখ্যক খেজুর গাছ আছে তাঁরা নিজেরাই তা কাটেন, রস পাড়েন এবং বাড়িতে এসে জ্বাল দিয়ে গুড় তৈরির কাজও সেরে নেন।
শীতের প্রকোপ যত বেশি পড়ে, রসও হয় তত বেশি। তাই শীতকালে খেজুর গাছ আছে এমন অঞ্চলে গেলে দেখা যায় তীব্র শীতের মধ্যেও রাতের পরিবেশে একটা পার্থক্য আছে। সকালে গাছ থেকে রস পাড়ার পর তা জ্বালিয়ে শেষ করা হয়ে যায় দুপুরের মধ্যে। এ হলো ‘জিরান কাট’ রস, স্বাদে এবং গন্ধে সবচেয়ে উত্তম। ‘জিরান কাট’ রস নামানোর পর আবারও রসের ভাড় বা কলস গাছে টাঙ্গানো হয়, এ থেকে যে রস পাওয়া যায় তা উলাকাটা। শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন গভীর রাতে রস জ্বালানো উনুনের আগুন খেজুর বনের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারে, বহু দূর থেকে বোঝা যায় ওখানে স্তব্ধতার মধ্যেও জীবনের স্পন্দন আছে। উনুনের পাশে থাকে গাছি আর মজুরদের থাকার জন্য বানানো কুড়ে ঘর, খেজুরের পাতা কিংবা বিচালি দিয়ে ছাওয়া। গাছিয়া নিঃসঙ্গত কাটাতে গ্রাম এলাকায় চালু নানা ধরণের ‘দেহতত্ত্ব’গান গেয়ে চলেছেন। লালন, পাগলা কানাই কিংবা নাম না জানা গ্রাম্য পদকর্তার এসব পদ বিকৃত হয়েছে স্থানীয় উচ্চারণে কিংবা যুগ থেকে যুগে মুখে মুখে গীত হবার কারণে। কিন্তু সুরে আছে অদ্ভুত প্রাণময়তা ও আবেগ যা সহজেই হৃদয়ে ছুঁয়ে যায়। যে গাছি কয়েক মাসের জন্য দূর গাঁ থেকে এসেছেন, ঘরে যার আছে ‘বালিকা বধু’ তিনি দেহতত্ত্ব গান না গেয়ে পুরনো যাত্রাপালা কিংবা লোকগীতির সেই সঙ্গীতগুলো উচ্চারণ করেন, যাতে আছে বিরহ মেশানো। নৈঃশব্দ নিঃসঙ্গতা এবং বিরহ পরস্পরের সম্পর্কযুক্ত হাওয়ায়, প্রাণের গভীর থেকে উঠে আসা ওই সঙ্গীত শীতের অনঢ় বৃক্ষগুলোও যেন কেঁদে ফেলে। এই শীতে খেজুর গাছিদের অন্যতম বিনোদন হলো রেডিও। তারা রেডিওতে অন্যের গান শোনেন, কিন্তু নিঃসঙ্গতা ভুলতে স্বকন্ঠের সঙ্গীতের কোন বিকল্প আছে কিনা তা জানা নেই। গাছিদের জীবনের সুখ-দুঃখের বিরহ গাঁথাও হারিয়ে যাচ্ছে যান্ত্রিক জীবন ও তার হিসাব নিকাশের আড়ালে।

শীত তার বিচিত্র রূপ ও রস নিয়ে হাজির হয় গ্রাম বাংলায়। নবান্ন উৎসব কিংবা শীতের পিঠা পায়েশ তৈরি উৎসব এখন তেমন ঘটা করে হয় না। তারপরেও শীতের যা কিছু চিরায়ত রূপ তা উপলব্ধি করতে হলে গ্রামে যেতে হবে। গাঁয়ের মেঠোপথের দু’ধারে দুর্বাঘাসের ডগায় জমে থাকা শিশির বিন্দুর উপর শীতের সূর্যের সোনালি রোদ পড়লে অর্পূব দৃশ্যের অবতারণা হয়। গ্রাম বাংলায় শীত আসে ফসলের সম্ভারের সঙ্গে যেমন সমৃদ্ধি আনে তেমনি পাশাপাশি আনে প্রকৃতিতে অসীম শূন্যতা। ফসলবিহীন আমন জমি পড়ে থাকে এক এক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে। ঝরা পাতাকে বিদায় জানায় পত্রমোচী বৃক্ষ, সেখানেও তার অব্যক্ত বেদনা যেন মূর্ত হয় সংগোপনে, যা শুধুমাত্র অনুভবের বিষয়।
শীতের নির্জনতার মধ্যে নীরব অস্তিত্বের প্রকাশও সৌন্দর্যমণ্ডিত। প্রতিটি ঋতুরই নিজস্ব বৈশিষ্ঠ্য আছে। শীতের কর্মব্যস্ত দিনের সমস্ত কোলাহলকে আড়ালে করে যখন রাত গভীর থেকে গভীরতর হয়, তখনই খুঁজে পাওয়া যায় শীতের আসল রূপটি। এই রূপ তার নিজের চোখ দিয়ে হৃদয় দিয়ে একে অনুভবের ব্যাপার। শীত আসে শীত যায় ডুবিয়ে কুয়াশায়। নগরজীবনে এ সময় ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়। নতুন নতুন মেলা উৎসব ছড়িয়ে পড়ে পাড়া মহল্লায়। বাজারে ভীড় বাড়ে, বদলে যায় দিনের হিসাব। নতুন ফ্যাশনের সাজ পোশাক কেনা কাটা বেড়ে যায়। শীতের তীব্রতা জীর্ণ কুঠিরে অনাহারী প্রাণ হারায়। আমরা এমন শীতের স্বপ্ন দেখবো যে শীতের উত্তাপে সকলে মিলে মিশে থাকবো দুধে ভাতে।

Share.

মন্তব্য করুন