মালয়েশিয়ার দশম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন আনোয়ার ইবরাহিম। দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে বহুল আলোচিত, লড়াকু নেতা আনোয়ার ইবরাহিম ২০২২ সালের মাসে প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হয়েছেন। বারবার তিনি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার হাতছানি পেলেও শেষ পর্যন্ত তা অধরাই থেকে গেছে। উল্টো মিথ্যা মামলায় জেল খাটাই যেন তার নিয়তি হয়ে উঠেছিল। দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি নানা উত্থান-পতন ও চড়াই-উতরাইয়ের সম্মুখীন হয়েছেন। দীর্ঘদিন জেলে কাটানো, নানা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার পর অবশেষে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তার। তিনি ক্ষমতাসীন পাকাতান হারাপান জোটেরও চেয়ারম্যান। আনোযার ইবরাহিমের স্ত্রী ওয়ান আজিজাহ ওয়ান ইসমাইলও একজন সুপরিচিত রাজনীতিবিদ। এই দম্পতির রযেছে ৬ সন্তান।
দেশটির দীর্ঘদিনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের শাসনামলে উপ-প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেছেন আনোয়ার। ২০০৮ সাল থেকে ২০১৫ ও ২০২০ থেকে ২০২২ সালের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে পর্যন্ত পার্লামেন্টে বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে দাযিত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়্যেব এরদোগানের পর আনোয়ার ইবরাহিমকে মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আনোয়ার ইবরাহিম ১৯৪৭ সালে মালয়েশিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় পেনাং রাজ্যের চিরোক তক্কুন গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা ইবরাহিম আবদুল রহমান ছিলেন রাজনীতিবিদ। তিনি পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হযেছিলেন। পরে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় সচিবের দায়িত্বও পালন করেন। আনোয়ারের মা চে ইয়েন হোসেন একজন গৃহিণী হলেও সক্রিয় রাজনীতি করতেন।
আনোয়ার ইবরাহিমের শিক্ষাজীবন শুরু হয় তার নিজ গ্রামেই। পরে তিনি মালয় কলেজ কুয়ালা কানজার থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করেন। ইউনিভার্সিটি অব মালয় থেকে মালয় স্টাডিজে অনার্স পাস করেন। ১৯৭৪ সালে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের কারণে তাকে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় দুই বছর জেল খাটেন তিনি। ১৯৭৪-৭৫ সালে জেলে থাকা অবস্থায় মাস্টার্স ডিগ্রি সমাপ্ত করেন।
আনোয়ার ইবরাহিম ১৯৬০ এর দশকের শেষ দিকে কুয়ালালামপুরে মালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকার সময় থেকেই একজন ইসলামপন্থী ছাত্রনেতা হিসেবে নিজের পরিচিতি গড়ে তোলেন। তিনি ১৯৬৮-৭১ সাল পর্যন্ত ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মালয়েশিয়ান মুসলিম স্টুডেন্টসের সভাপতি ছিলেন। একই সময়ে তিনি ইউনিভার্সিটি অব মালয়া মালয় ল্যাংগুয়েজ সোসাইটির সভাপতি ছিলেন।
আনোয়ার ইবরাহিম ১৯৭১ সালে মুসলিম ইয়ুথ মুভমেন্ট অব মালয়েশিয়া প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন। ঐ সময়ে আনোয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের নেতৃত্বাধীন ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (বারিসান ন্যাশনাল) সরকারের একজন কঠোর সমালোচক ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি ১৯৮২ সালে মাহাথির মোহাম্মদের আমন্ত্রণে তার উদারপন্থী দল ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ও সরকারে যোগ দেন এবং সংস্কৃতি মন্ত্রীর দায়িত্ব লাভ করেন। এরপর থেকে তার রাজনৈতিক জীবনে দ্রুত পরিবর্তন ঘটতে থাকে। ১৯৮৩ সালে যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী, ১৯৮৪ সালে কৃষিমন্ত্রী এবং ১৯৮৬ সালে শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পান। শিক্ষামন্ত্রীর পদ লাভ ভবিষ্যতে তার উপপ্রধানমন্ত্রী হওয়ার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়।
শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার পর আনোয়ার ন্যাশনাল স্কুল কারিকুলাম প্রণয়ন করেন। একই সাথে তিনি মালয়েশিয়ার জাতীয় ভাষার নাম ‘বাহাসা মালয়েশিয়া’ থেকে ‘বাহাসা মেলায়ু’ করেন। ১৯৮৮ সালে আনোয়ার আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় মালয়েশিয়ার দ্বিতীয় প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব লাভ করেন এবং ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯১ সালে আনোয়ার ইবরাহিমকে অর্থমন্ত্রী ও ১৯৯৩ সালে উপপ্রধানমন্ত্রী করেন মাহাথির। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত আনোয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব সামাল দিয়েছেন। অর্থমন্ত্রী হিসেবে তার দায়িত্ব পালনকালে মালয়েশিয়ার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি বিশ্ববাসীর নজর কাড়ে এবং আনোয়ার সর্বত্রই প্রশংসিত হন।
কিন্তু ১৯৯৭ সালে এশিয়ায় হঠাৎ করেই অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দিলে তা থেকে রেহাই পায়নি মালয়েশিয়াও। এই সঙ্কট কাটিয়ে ওঠার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন কিভাবে করা হবে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের সাথে মতবিরোধ শুরু হয় আনোয়ারের। এই বিরোধের কারণেই ১৯৯৮ সালে আনোয়ারকে বরখাস্ত করেন মাহাথির এবং দুর্নীতির অভিযোগ এনে তার বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে। মিথ্যা ও যড়যন্ত্রমূলক এই মামলায় ১৯৯৯ সালে আনোয়ার ইবরাহিমকে জেলে যেতে হ।
প্রধানমন্ত্রী মাহাথির আনোয়ারকে উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করার পর আনোয়ার ও তার সমর্থকরা ‘সংস্কার আন্দোলন’ শুরু করেন। এই আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা বারিসন ন্যাশনাল সরকারের নীতিবহির্ভূত কর্মকাণ্ড বিলোপ করা।
সংস্কার আন্দোলনের নেতাকর্মীদের নিয়ে ১৯৯৯ সালে আনোয়ার ন্যাশনাল জাস্টিস পার্টি গঠন করেন এবং এ বছরের নির্বাচনে অংশ নিতে পার্টি সি মালয়েশিয়া, ডেমোক্র্যাটিক অ্যাকশন পার্টি ও নবগঠিত ন্যাশনাল জাস্টিস পার্টি নিয়ে ‘বারিসান অলটারনেটিভ নামে’ জোট গঠন করেন। এরপর ২০০৩ সালের আগস্টে আনোয়ারের পরামর্শে তার স্ত্রী ওয়ান আজিজাহ ন্যাশনাল জাস্টিস পার্টি ও মালয়েশিয়ান পিপলস পার্টি একীভূত করে পিপলস জাষ্টিস্টস পার্টি গঠন করেন।
২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে পিকেআর, পাস ও ডিএপি এই তিন দল মিলে পাকাতান রাকাত নামে নির্বাচনী জোট গঠন করে। এই জোট ২০০৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশ নিয়ে ৩১টি আসন লাভ করে বিরোধী দলে পরিণত হয়। আনোয়ার বিরোধী দলীয় নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০১৪ সালের নির্বাচনে যখন আনোয়ারের নেতৃত্বাধীন জোটের জয়ের সম্ভাবনা উজ্জ্বল, ঠিক তখনই আবারও মিথ্যা মামলায় জেলে পাঠানো হয় তাকে। এরপর ২০১৮ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে মাহাথির ও আনোয়ারের নেতৃত্বে দলের মধ্যে গঠিত রাজনৈতিক জোট দেশটিতে সাত দশক ধরে ক্ষমতায় থাকা দল ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনকে পরাজিত করে নাটকীয় জয় পায়। এই জোট ২২২ আসনের পার্লামেন্টে ১১২ আসনে বিজয়ী হয়। এর মধ্যে আনোয়ারের পিকেআর পায় ৪৮ আসন। নির্বাচনে আনোয়ারের জোট বিজয়ী হওয়ার পর মাহাথির মোহাম্মদ তাকে সাধারণ ক্ষমার আওতায় মুক্তির ঘোষণা দেন। মুক্তি পেয়েই আবারও রাজনীতির মাঠে সক্রিয় হন আনোয়ার।
জোট গঠনের আগে মাহাথিরের সাথে আনোয়ার ইবরাহিমের লিখিত চুক্তি হয় যে, তারা জয়ী হলে পরবর্তী সরকারের দুই বছরের জন্য নেতৃত্ব দেবেন মাহাথির। এরপর আনোয়ারের কাছে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। কিন্তু তা আর শেষ পর্যন্ত হয়নি। আনোয়ারের সাথে সমঝোতা অনুসারে মাহাথিরের নেতৃত্বে সরকার চলে আসছিল। গত বছরের মে মাসে এই সরকারের দু’বছর মেয়াদ পূর্ণ করার কথা ছিল।
ঠিক এর আগে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে জটিল এক অবস্থা তৈরি হয়। মাহাথির পূর্ব সমঝোতা অনুসারে ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে গড়িমসি করতে থাকেন। এ সময় মাহাথিরের দলের নেতারা দাবি করতে থাকেন যে, মাহাথিরকে পুরো মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে দিতে হবে। এ নিয়ে ক্ষমতাসীন জোটে ভাঙন দেখা যায়। এর জেরে মাহাথির পদত্যাগ করেন। এরপর রাজা মুহিউদ্দীন ইয়াসিনকে অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেন। মুহিউদ্দিন ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের আগস্ট পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করেন।
কিন্তু তার দলে রাজনৈতিক অস্থিরতায় তার সরকারের পতন হলে নতুন প্রধানমন্ত্রী হন ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশনের নেতা ইসমাইল সাবরি ইয়াকুব। তিনি ২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ১৮ নভেম্বরের পার্লামেন্ট নির্বাচনে নতুন সরকার গঠন না হওয়া পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এই নির্বাচনে আনোয়ার ইবরাহিমের নেতৃত্বাধীন পাকাতান হারাপান জোট ২২২ আসনের পার্লামেন্টে ৮২টি আসন পায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মুহিউদ্দিন ইয়াসিনের নেতৃত্বাধীন জোট পায় ৭৩ আসন।
সাবেক দুই বারের প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদের দল একটি আসনও পায়নি। এমনকি মাহাথির ও তার দলের সব প্রার্থীর জামানত হারান। সরকার গঠনের জন্য ১১২টি আসন দরকার হলেও মালয়েশিয়ার রাজা সবদিক বিবেচনা করে আনোয়ার ইবরাহিমকেই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। পূরণ হয় এই সংগ্রামী ও লড়াকু রাজনীতিকের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন। আনোয়ার ইবরাহিম বাংলাদেশসহ বিশে^র বিভিন্ন অঞ্চলের মুসলমানদের কাছে একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা। তার সংগ্রমী জীবন থেকে অনেকেই প্রেরণা লাভ করেন।

Share.

মন্তব্য করুন