অলিম্পিক গেমসকে বলা হয় দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ। বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ক্রীড়া আসরটি নিয়মিত চার বছর পরপর একেকটি দেশে অনুষ্ঠিত হয়। সে হিসেবে ২০২০ সালের জুলাইয়ে জাপানে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিলো আধুনিক অলিম্পিক গেমসের ৩২তম আসরটি; কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে সেটি এক বছর পিছিয়ে দেয়া হয়। নতুন সময়সূচি ঠিক করা হয় ২০২১ সালের ২৩ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট; তবে আসরের নাম ‘টোকিও অলিম্পিক ২০২০’-ই বহাল রয়েছে। অবশ্য এই লেখা যখন লিখছি, ততদিনেও নিশ্চিত নয় যে, সঠিক সময়ে আসরটি শুরু হবে কি না। করোনাভাইরাস মহামারী বিশ্বকে এমনই এক দুর্যোগে ফেলেছে যে, ক্রীড়াঙ্গনসহ সব কিছুই স্থবির হয়ে পড়েছে। অলিম্পিক গেমস সঠিক সময়ে হোক বা না হোক- বিশ্বের সবচেয়ে বড় এই ক্রীড়া আসরটি সম্পর্কে তোমাদের বিভিন্ন তথ্য জানিয়ে রাখি।
অলিম্পিকের ইতিকথা
অলিম্পিক গেমসের ইতিহাস জড়িয়ে আছে প্রাচীন গ্রিসের সাথে। গ্রিক দেবতা জিউসের জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত অলিম্পিয়া নামক জায়গায় খ্রিস্টপূর্ব ৭৭৬ সালের দিকে একটি ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হতো। ওই সময় স্থানীয়ভাবে নগর রাষ্ট্রগুলোর মাঝে সম্প্রীতি স্থাপনের লক্ষ্যে খেলাধুলা আয়োজন করা হতো। এক সময় দেখা গেল এই খেলা চলার সময় বিভিন্ন পক্ষ যুদ্ধ-বিগ্রহ স্থগিত রাখতে শুরু করে। এর ফলে বিষয়টি সম্প্রীতি স্থাপনে ক্রমশ আরো কার্যকর হয়ে ওঠে। রোমান স¤্রাটদের দ্বারা এক পর্যায়ে এই খেলা বন্ধ হয়ে গেলেও, পরবর্তীতে আবার চালু হয়।
আর আধুনিক যুগে ১৭ শ’ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডে বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ইউরোপের আরো কিছু দেশেও বিভিন্ন খেলাধুলা সাংগঠনিক রূপ লাভ করে। ১৮৬০ সালে ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হয় অলিম্পিয়ান সোসাইটি। এরপর ১৮৯৪ সালে ফরাসি শিক্ষাবিদ পিয়েরে ডি কুবার্টিন আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি গঠন করেন। উদ্দেশ্য ছিলো এই কমিটির মাধ্যমে খেলাধুলার প্রসার ঘটিয়ে বিশ্বব্যাপী সম্প্রীতি ছড়িয়ে দেয়া। কুবার্টিনকেই আধুনিক অলিম্পিকের জনক বলা হয়।

কুবার্টিনের উদ্যোগে ১৮৯৬ সালে অলিম্পিকের উৎপত্তিস্থল গ্রিসেই আয়োজন করা হয় আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম আসর। গ্রিসের ২০০ ও অন্য ১৩টি দেশের ৪৫ জন ক্রীড়াবিদ অংশ নিয়েছিল সে আসরে। এরপর প্রতি চার বছর পরপর অলিম্পিক আয়োজন শুরু হয়। ক্রমশ খেলার পরিধির সাথে বেড়েছে প্রতিযোগী ও অংশগ্রহণকারী দেশের সংখ্যা। মাঝখানে প্রথম বিশ^যুদ্ধের কারণে ১৯১৬ সালে এবং দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের কারণে ১৯৪০ ও ১৯৪৪- এই তিনটি আসর অনুষ্ঠিত হয়নি। সর্বশেষ ২০১৬ সালে গেমস অনুষ্ঠিত হয়েছে ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও শহরে। সেবার অংশ নিয়েছে ২০৬টি দেশের ১১ হাজার ২৩৮ জন ক্রীড়াবিদ।
সাধারণত অলিম্পিক গেমসের মূল আসরটিকেই বলা হয় গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক (ইংরেজিতে সামার অলিম্পিক)। এছাড়া এই গেমসের আরো দুটি সংস্করণ রয়েছে সেগুলো হলো : শীতকালীন খেলাধুলা নিয়ে উইন্টার অলিম্পিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী প্রতিযোগীদের জন্য প্যারা অলিম্পিক। শীতকালীন খেলাধুলা বলতে বরফের মাঝে খেলাধুলাকেই বোঝায় যেমন, আইস হকি।

এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র সর্বোচ্চ চারবার গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের আয়োজন করেছে। গ্রেট ব্রিটেন করেছে তিনবার। গ্রিস, ফ্রান্স, জার্মানি ও অস্ট্রেলিয়া করেছে দুইবার করে। এছাড়া একবার করে অলিম্পিক গেমস আয়োজন করেছে সুইডেন, বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডস, ফিনল্যান্ড, ইতালি, জাপান, মেক্সিকো, কানাডা, সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমানে রাশিয়া), দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, চীন ও ব্রাজিল। জাপান এর আগে আয়োজন করেছিল ১৯৬৪ সালে। ২০২৪ সালের অলিম্পিক আয়োজিত হবে ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে এবং ২০২৮ সালে হবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস শহরে।
এবারের টোকিও অলিম্পিকে ৩৩টি পৃথক খেলায় ৩৩৯টি ইভেন্টে স্বর্ণ, রৌপ্য ও ব্রোঞ্জ পদকের জন্য লড়বেন ১৮০টি দেশের ক্রীড়াবিদরা। এছাড়া সারা বিশে^র উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত রিফিউজি অলিম্পিক টিমের ক্রীড়াবিদরাও সুযোগ পাবেন এবার।

সফল যারা
অলিম্পিক গেমসের ইতিহাসে ২০১৬ আসর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি স্বর্ণপদক জিতেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির ক্রীড়াবিদরা ১০২২টি স্বর্ণ, ৭৯৫টি রৌপ্য ও ৭০৫টি ব্রোঞ্জ পদক জিতেছে। এই তালিকায় যুক্তরাষ্ট্রের ধারে কাছে কেউ নেই। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সোভিয়েত ইউনিয়নের ৩৯৫টি স্বর্ণসহ ১০১০টি পদক। গ্রেট ব্রিটেনের স্বর্ণ ২৬৩টি।
ব্যক্তিগতভাবে সবচেয়ে বেশি পদক জিতেছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাঁতারু মাইকেল ফেলপস। ব্যক্তিগত প্রতিযোগিতায় ১৩টি ও দলীয় প্রতিযোগিতায় ১০টি মিলে মোট ২৩টি স্বর্ণপদক জিতেছেন সুইমিং পুলের এই কিংবদন্তি। যা অলিম্পিক ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি স্বর্ণ জয়ের রেকর্ড। এছাড়া আছে তিনটি রৌপ্য ও ২টি ব্রোঞ্জ পদক। ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকের এক আসরেই জিতেছেন রেকর্ড ৮টি সোনা। ২০০০ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে প্রথম অলিম্পিকে এলেও কোনো পদক জিততে পারেননি ফেলপস। তবে এরপর ২০০৪, ২০০৮, ২০১২ ও ২০১৬ আসরে একের পর এক রেকর্ড গড়েন।
তালিকার দুই নম্বরে আছেন সোভিয়েত ইউনিয়নের সাবেক জিমন্যাস্ট লারিসা লাতিনিনা। ১৯৫৬, ১৯৬০ ও ১৯৬৪ এই তিন আসরে অংশ নিয়ে তিনি ৯টি স্বর্ণপদকসহ ১৮টি পদক জিতেছেন।

অলিম্পিকে বাংলাদেশ
এখন পর্যন্ত ৯টি গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমসে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ। তবে কোনো পদক জিততে পারেনি কোনো বাংলাদেশী ক্রীড়াবিদ। ১৯৮৪ সালে প্রথমবার অ্যাথলেট সাইদুর রহমান ডন ১০০ মিটার দৌড়ে অংশ নেন। হিটে তার অবস্থান ছিলো ৮২তম। যে কারণে সেমিফাইনাল বা ফাইনালে অংশ নেয়া হয়নি।
বাংলাদেশের একটি লজ্জার রেকর্ডও রয়েছে। সেটি হলো- সবচেয়ে জনবহুল দেশ যাদের কোন অলিম্পিক পদক নেই। এখন পর্যন্ত ১৪৫টি দেশ অলিম্পিকে পদক জিতেছে। এর মধ্যে আছে লিকটেনস্টেইনের মতো দেশও। যার আয়তন ১৬০ বর্গকিলোমিটার (ঢাকা শহরের প্রায় অর্ধেক)। জনসংখ্যা ৩৮ হাজার। দু’টি করে সোনা ও রুপা, ৬টি ব্রোঞ্জ জিতেছে ইউরোপের ছোট্ট দেশটি। দুই লাখ জনসংখ্যার সামোয়া, সাড়ে ৫ লাখের সুরিনাম কিংবা এক লাখ জনসংখ্যার ভার্জিন আইল্যান্ডও অলিম্পিক পদক জিতেছে। আমাদের প্রতিবেশী শ্রীলঙ্কাও দুটি রৌপ্য পদক জিতেছে। প্রতিবেশীদের মাঝে ভারত জিতেছে ২৮টি, পাকিস্তান ১০টি পদক।
এমনকি বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদরা সরাসরি অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতাও অর্জন করেন না। তাদের খেলতে হয় অলিম্পিক কমিটির বিশেষ বিবেচনা বা ওয়াইল্ড কার্ড নিয়ে। ২০১৬ সালে গলফার সিদ্দিকুর প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে সরাসরি অলিম্পিকে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন। এবারের টোকিও অলিম্পিকে তীরন্দাজ রোমান সানা দ্বিতীয় বাংলাদেশী হিসেবে সেই যোগ্যতা অর্জন করেছেন।

Share.

মন্তব্য করুন