মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্যে চলছে মানবিক বিপর্যয়। মিয়ানমার সরকার ব্রিটিশ আমলে তদানীন্তন ভারত থেকে যাওয়া মুসলিমদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ায় এই বিপর্যয়। ফলে সেখানকার দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলিম নিদারুণ কষ্টের মধ্যে পড়েছে। উগ্র বৌদ্ধরা তাদের ঘরবাড়িতে হামলা চালাচ্ছে, নারী-শিশুসহ সবাইকে নির্বিচারে হত্যা করছে। এমন পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী প্রেরণ করা হলে তারাও সেখানে নৃশংস হত্যাকা-ে অংশ নিচ্ছে। রাখাইনে নির্যাতিত-নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের জন্য অস্থায়ী শিবির খোলা হয়েছে। সেখানে প্রয়োজনীয় মানবিক সুযোগ সুবিধা ছাড়াই তারা অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে। এমনকি তারা সেখানেই হামলার শিকার হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। যারা জীবন বাঁচাতে পালাতে বাধ্য হচ্ছে তারা অনেকে পথিমধ্যে বর্মী বাহিনীর গুলিতে মারা যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ নৌকাযোগে পালাতে গিয়ে সাগরে ডুবে প্রাণ হারাচ্ছে। অতিসম্প্রতি দুই দেশের সীমান্তে নাফ নদীতে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের এক নৌকাডুবিতে ২০ জন মারা গেছে, তাদের মধ্যে ১২ জনই শিশু।
মিয়ানমারে সর্বশেষ উগ্র বৌদ্ধ হামলা ও সেনা অভিযানে প্রায় ৫০ হাজার রোহিঙ্গা তাদের ঘরবাড়ি থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছে। এদের মধ্যে ২৭ হাজার পাশর্^বর্তী বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পেরেছে, ২০ হাজার নো-ম্যানস্ ল্যান্ডে আটকে আছে এবং ৫ শতাধিক উগ্র বৌদ্ধ ও বর্মী সেনাদের হাতে নিহত হয়েছে।
চলতি বছরে সীমাহীন নির্যাতন-নিপীড়নের কারণে বহু রোহিঙ্গা মুসলিম মিয়ানমারের রাখাইন (আরাকান) রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এদের মধ্যে আছে বহু শিশু। যাদের অনেকেই নৃশংস ও ভয়ঙ্কর দৃশ্যপট অতিক্রম করে এসেছে। আমরা এখানে ১১-১২ বছর বয়সের কিছু ছেলেমেয়ের প্রত্যক্ষদর্শী বিবরণ শুনাবো। এদের কেউ কেউ বলেছে, বর্মী নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদের সহোদর ভাইবোনদের অনেককে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালের অক্টোবরে প্রায় ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম উদ্বাস্তু রাখাইন থেকে পালিয়ে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়। আরএফএ-এর সাথে যুক্ত অনলাইন নিউজ সার্ভিস বেনারনিউজের একজন প্রতিনিধি সম্প্রতি এখানকার উদ্বাস্তু শিবিরের এরকম ১৯ জন শিশুর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। আমরা এখানে সেই সাক্ষাৎকারগুলো তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
তাসমিন খাতুন (১১) মহিলাদের ধর্ষণ বুঝায় এমন একটি পরিভাষা ব্যবহার করে বলে, সৈন্যরা আমার ভাইকে তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে হত্যা করেছে, আমাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে এবং মহিলাদের নির্যাতন করেছে।
এই রোহিঙ্গা মেয়েটি উখিয়া উপজেলার রেজিস্ট্রিবিহীন কুতুপালং শিবিরে বাস করে। সে বলে, আমরা কাছের একটি জঙ্গলে পালিয়ে ছিলাম। এটা মনে হলে আমি এখনো ভয়ে কেঁপে উঠি। আমি রাতে ঘুমাতে পারি না।
মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী প্রায়ই সীমান্তে সন্দেহভাজন জঙ্গিদের হামলায় কিছু সংখ্যক বর্মী সীমান্ত রক্ষী নিহত হওয়ার অভিযোগ তুলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নৃশংস অভিযান চালায়। এসব অভিযানে তারা রোহিঙ্গাদের বেছে বেছে হত্যা করে, নারীদের ধর্ষণ করে এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়।
মিয়ানমারের সরকার ব্যাপক আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে নিজের পক্ষে সাফাই গায় এবং রাষ্ট্রবিহীন রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তার বাহিনীর নৃশংসতা চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করে।
বেনারনিউজ কক্সবাজারের উদ্বাস্তু শিবিরে ৫৪ জন রোহিঙ্গা মহিলার সাক্ষাৎকার নেয়, তাদের মধ্যে ১৭ জন জানায়, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা তাদের ধর্ষণ করেছে।
আগুনে নিক্ষেপ
টেকনাফ উপজেলার লেদা উদ্বাস্তু শিবির থেকে রোহিঙ্গা তরুণ আব্দুল মালেক বলে, সে নিজের চোখে দেখেছে, মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী তার ভাইকে পরিবারের জ্বলন্ত ঘরের মধ্যে ছুড়ে ফেলে হত্যা করলো। সে আরো বলে, মিলিটারি আমার যমজ ভাইকে আগুনে নিক্ষেপ করল… তারা যাকেই পাচ্ছিল তাকেই আগুন ধরিয়ে দিয়ে হত্যা করছিল।
আব্দুল মালেক আরো বলে, সে ও তার পরিবারের অবশিষ্ট সদস্যরা নদীতে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়, আর তখনও নিরাপত্তা বাহিনী তাদের লক্ষ্য করে গুলি করে।
জহুর আলী (১২) কুতুপালং শিবিরের উদ্বাস্তু। সেও একই রকম ঘটনার স্মৃতিচারণ করেছে। সে বলেছে, নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা তার মায়ের কোল থেকে তার দুই সহোদরকে ছিনিয়ে নেয় এবং তাদের আগুন দেয়া বাড়িতে তাদেরকে ছুড়ে মারে।
জহুরের মা রহিমা খাতুন (৩৫) বলেন, জহুর এমনকি ঘুমের মধ্যেও কাঁদে। আমি জানি না কবে সে এ থেকে আরোগ্য লাভ করবে।
নাজিম উদ্দিনের (১২) মা সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে কয়েক মাস আগে মারা গেছেন। সে বলে, তার চার সহোদর ভাইবোন এবং এক চাচা সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে আসার আগে সে দেখেছে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা তার পিতাকে প্রহার করে ও গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে।
নাজিম বলে, তার সহোদর ভাইবোনদের মধ্যে দু’জন, দুই বছরের মোহাম্মদ ইয়াছিন ও চার বছরের উম্মে সালমা (যাদেরকে সে লালন পালন করছে) এখনো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে আছে।
গণনা চলমান
জাতিসংঘ উদ্বাস্তু সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) ঢাকা অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, ২০১৬ সালের অক্টোবরের পর দক্ষিণ-পূর্ব বাংলাদেশে আগত প্রায় ৬৫ হাজার রোহিঙ্গার যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। কয়েক বছর আগে রাখাইন রাজ্যের সহিংসতা থেকে কক্সবাজারের শিবিরগুলোতে পালিয়ে আসা কমপক্ষে ৩ লাখ রোহিঙ্গার সাথে এই সংখ্যা অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইউএনএইচসিআরের এক কর্মকর্তা বলেন, নবাগত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা নিরূপণে আমরা একটি জরিপ চালাচ্ছি। এ পর্যন্ত ১২ হাজার নবাগত উদ্বাস্তুর নাম তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ৫ হাজারই শিশু।
কক্সবাজার জেলার ডেপুটি কমিশনার আলী হোসেন বলেন, সরকার নতুন করে বাংলাদেশে প্রবেশকারী রোহিঙ্গার সংখ্যা এখনো নিরূপণ করতে পারেনি। তবে সরকার শিবিরগুলোতে পাঁচ বছর ও তার কম বয়সী শিশুদের টিকা দিচ্ছে এবং ভিটামিন এ খাওয়াচ্ছে।
লেদা শিবিরের ব্লক বি’র নেতা মোহাম্মদ আলম বলেন, সরকারি কর্মকর্তারা ক্যাম্পের সকল শিশুকে খাবার খাওয়ানোর ব্যাপারে হিমশিম খাচ্ছে। তিনি বলেন, মানসিক সমস্যা পরিচর্যার সময় কই?
উদ্বাস্তুবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক সি আর আকবর বলেন, এসব শিশু মানসিকভাবে বিপর্যস্ত কেননা তারা ভয়ঙ্কর বাস্তবতা অতিক্রম করে এসেছে। তাদের মানসিক আরোগ্যের জন্য কাউন্সেলিং অত্যাবশ্যক। কিন্তু সুযোগ সুবিধা কোথায়? তাদের অনেকেই বেঁচে থাকার মতো পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না।