ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লড়াই করেছিল আমার দাদা, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমার বাবা, আর এখন ভারতের বিরুদ্ধে লড়ছি আমি- সদ্য আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ভারতের বিরুদ্ধে সেমিফাইনালের আগে সামাজিক মাধ্যমে এমন ধরনের একটি মন্তব্য ব্যাপক প্রচার পেয়েছে। ইংল্যান্ড ও পাকিস্তানের প্রসঙ্গ আসার কারণ, ওই দুই দলও সেমিফাইনালে খেলেছিল। ভারতকে হারিয়ে ফাইনালে ওই দুই দলের একটির মুখোমুখি হবে- এমন সম্ভাবনাকে সামনে রেখে ওই বক্তব্যটি ব্যাপক সাড়া ফেলে। সেমিফাইনালে বাংলাদেশ হেরে গিয়েছিল। ইংল্যান্ডও হেরেছিল। ফাইনাল হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে। আর তাতে ভারতকে শোচনীয়ভাবে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল পাকিস্তান।
ভারতের বিপক্ষে সেমিফাইনালের আগে দিয়ে আরো কিছু ফটোশপ কারুকাজ, ভিডিও আপলোড হয়। সবগুলোতেই রয়েল বেঙ্গল টাইগারের হুঙ্কারে ভারতের নাজেহাল অবস্থা ফুটে ওঠে। ফেসবুক-পাগল তরুণ প্রজন্ম খেলা শুরুর আগেই খেলা শুরু করে দিয়েছিল। এই লড়াইয়ে তারা হারতে নারাজ। ভারত যত বড় প্রতিপক্ষই হোক না কেন, বাংলাদেশই জয়ী হবে- এটাই ছিল তাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ স্লোগান।
ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচটির ফলাফল যা-ই হোক না কেন, বর্তমান ক্রিকেট বাংলাদেশে নতুন মাত্রার সৃষ্টি করেছে। এটা আর খেলা নয়। আমাদের জাতিসত্তার একটি পরিচিতি ফলকে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ হলে সেটা নতুন মাত্রার সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার আগে এখানকার মানুষ কাকে সমর্থন করতো? পাকিস্তান বা ভারতকে। যারা ‘পাকু’ বা ‘ভাকু’ গালি শুনতে রাজি ছিলেন না, তারা শ্রীলঙ্কাকে সমর্থন করতেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের সাথে সাথে বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্দান্ত শক্তিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করার পর পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। একসময় ব্রাজিলের মানুষ ফুটবলকে কেন্দ্র করে যেমন উপনিবেশ লড়াইয়ে শামিল হয়েছিল, ফুটবলই তাদের দৈনন্দিন যন্ত্রণা থেকে মুক্তির পথ দেখাতো, ক্রিকেট সম্ভবত তার চেয়ে আরো বড় করে বাংলাদেশের মুক্তির দিশা দিতে এগিয়ে এসেছে। এ দেশের মানুষ স্মরণাতীত কাল থেকেই সা¤্রাজ্যবাদবিরোধী। সেটাই এখন ফুটে উঠেছে ক্রিকেটের মাধ্যমে। ক্রিকেটকে কেন্দ্র করেই বাংলাদেশের নতুন জাতীয়তাবাদের ভিত গড়ে উঠছে। আমরা অন্য কারো নই, আমরা বাংলাদেশী। আমরা এগিয়ে যাবোই। কারো আধিপত্য আমরা মেনে নেবো না।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সামনে সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ শক্তি হলো ভারত। আর এ কারণে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ হলে রক্তকণিকায় থাকা সেই প্রতিরোধচেতনা বের হয়ে আসে। ফাইনালে পাকিস্তান জয়ী হওয়ার পরও এখানকার মানুষ খুশি হয়েছে। এই খুশির মূল কারণ ভারতের পরাজয়।
একসময় খুব সহজেই বাংলাদেশকে হারাত ভারত। ছবিটা বদলে যায় ২০০৭ সালের বিশ্বকাপ থেকে। সেবার ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ থেকে ‘টিম ইন্ডিয়া’কে খালি হাতে ফিরতে হয়েছিল, বাংলাদেশের কাছে নাস্তানাবুদ হতে হয়েছিল সৌরভ-শচিনদের। তারপর ২০১১ বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে হেরে যায় বাংলাদেশ। কিন্তু ২০১৫-র বিশ্বকাপে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। কোয়ার্টার ফাইনালে ফের মুখোমুখি হয় ভারত-বাংলাদেশ। ম্যাচের আগেই জায়ান্ট স্ক্রিনে দেখানো হয় ‘জিতেগা ভাই জিতেগা, ইন্ডিয়া জিতেগা’। এ হেন বিজ্ঞাপন মেনে নিতে পারেননি তদানীন্তন বাংলাদেশের আইসিসি প্রেসিডেন্ট মুস্তাফা কামাল। তিনি নিজে আইসিসি-র সিইও ডেভিড রিচার্ডসনকে ডেকে এই বিজ্ঞাপন বন্ধ করতে বলেন। তারপরও তা বন্ধ হয়নি। মাঠের ভেতরেও ছড়ায় উত্তাপ। রুবেল হোসেনের বলে ক্যাচ তুলেও আম্পায়ারের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে বেঁচে যান রোহিত শর্মা। রিপ্লেতে দেখা যায়, বলটি কোমরের নিচেই ছিল। বাউন্ডারি লাইনের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে মাহমুদুল্লার ক্যাচ নিয়েছিলেন শিখর ধাওয়ান। তা নিয়েও বিতর্ক তৈরি হয়। ওই সময় ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি ছিলেন এন শ্রীনিবাসন। তার একগুঁয়েমি, আধিপত্যবাদী মানসিকতা বাংলাদেশে ভারতবিরোধী চেতনা প্রবল করে তোলে। আইসিসি সভাপতি এবং মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল (লোটাস কামাল) পর্যন্ত শ্রীনিবাসনের সা¤্রাজ্যবাদী লালসার বিরোধিতা করেন প্রকাশ্যে। সরকারের কেউ তার বিরোধিতা করেনি। তারপর চ্যাম্পিয়ন দলকে ট্রফি দিতে তাকে না ডেকেও আরেকটি অবমাননাকর ঘটনার জন্ম দেন ভারতের এন শ্রীনিবাসন।
বিশ্বকাপের পরই বাংলাদেশ সফরে যায় ভারত। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে মহেন্দ্র সিং ধোনির দল হেরে বসে ১-২-এ। প্রথম দু’টি ম্যাচ ‘কাটার মাস্টার’ মোস্তাফিজের সৌজন্যে জিতে নেয় বাংলাদেশ। এই সিরিজে মোস্তাফিজকে ধাক্কা মেরে ব্যাপক সমালোচিত হন ধোনি। ২০১৬ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ব্যাঙ্গালুরুতেও ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচটি উত্তাপ ছড়িয়েছিল। জেতা ম্যাচ মুশফিকুর রহীমরা ছুড়ে দিয়ে চলে আসেন। ১ রানে ম্যাচ জেতে ভারত। এখানে জয় বা পরাজয় বড় কথা নয়। আমরা লড়াই করবো- এটাই শেষ কথা। এই একটি জায়গায় বাংলাদেশের সব মানুষ এক।

Share.

মন্তব্য করুন