মেঘের ডাকের কাছে পৃথিবীর সমস্ত ধ্বনি জমা রেখে যখন পথ ধরেছি, সবকিছু কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়েছে। কোথাও উজ্জ্বল রোদ নেই। এমন দিনে ভিজে যাওয়ার কথা। শীতলে অথবা স্মৃতিতে। আমি ভিজে গেলাম, বছর দশেক আগের দিনের কোনো এক ভেজা দুপুরের সাথে। রাঙ্গামাটিয়ার পূর্বপাশে যে বিস্তর জলাশয়, ওটাকে আমরা বড়বিলা বলেই চিনতাম। সেই বড়বিলায় ফুটতো শত সহস্র পদ্মফুল। ফলত বড়বিলা থেকে ধীরে ধীরে তার নাম হয়ে যায় পদ্মবিল। কতজনের মুখে কতরকম গল্প যে শুনেছি এই পদ্মবিল নিয়ে! একজন মহিলা তার অসুস্থ স্বামীকে সুস্থ করার প্রতিজ্ঞায় কবিরাজের পরামর্শে পদ্মবিলে গিয়েছিল গভীর রাতে হিজলগাছ আনতে। সেই দুঃসাহসিনী মহিলা তার দুই ছেলেকে সাথে নিয়ে গভীর রাতে গিয়ে হিজলগাছে টান দিতেই তারা তিনজনই হিজলগাছ হয়ে যায়। গাছ হয়ে তারা আজও জীবন্ত। সেই তিন হিজলগাছে চিমটি কাটলে এখনও তরতাজা রক্ত গড়িয়ে পড়ে। কোনো এক শুক্রবারের ভোরে আমরা কয়েকজন অবুঝ কৌতূহল নিয়ে ছুটে গেলাম পদ্মবিলে। মা, ছেলের তিন হিজলগাছ ও অসংখ্য পদ্মের গায়ে নিজস্ব গন্ধ মেখে দিয়ে আসব বলে।

প্রখর রোদ। বিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কয়েকটা তালগাছ। আমরা যারা গিয়েছিলাম প্রথমবার, গাছের ছায়ায় বসে বিলের শীতল জলের বুক ছুঁয়ে বয়ে আসা হাওয়ার কাছে মেলে ধরেছি। যেহেতু শুক্রবার, তেমন লোকজন ছিল না বিলে। আমরা মন খুলে গান গাইছি। হঠাৎ আমার বিশেষ অঙ্গের আশপাশে শীতলতা অনুভব হলো। যেন বরফ লেগে আছে। হাত দিয়ে আবিষ্কার করলাম একটা জোঁক। সদ্যই ভালোভাবে ধরে কামড় বসিয়েছে রক্ত তেমন খেতে পারেনি তখনও। গ্রামাঞ্চলে বেড়ে ওঠার ফলে জোঁক আমার কাছে ছোটবেলা থেকেই একটা পিঁপড়ের মতোই ভয়ডরহীন প্রাণী বলে মনে হয়। কিন্তু এ জোঁকটা এমন জায়গায় কামড় বসিয়েছে, না পারছি কাউকে দেখাতে, না পারছি নিজে টেনে ছাড়াতে। যদি অঘটন ঘটে যায়! প্রায় কেঁদেই দিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত বন্ধু আব্দুল্লাহর অভিযানে সেই জোঁক নাস্তানাবুদ হয়।

জনমানবশূন্য বিল। লোকেরা তাদের ব্যক্তিগত নৌকাগুলো কেউ কেউ তালা লাগিয়ে কেউবা আবার পানিতে ডুবিয়ে রেখে চলে গেছে। আমরা গিয়েছিলাম সহস্র পদ্মের কাছাকাছি হবো বলে। আর পদ্মের বসবাস বিলের প্রায় অনেকটা মাঝে যেখানে গভীর জল। যেখানে দুই তিন জন মানুষ অনায়াসে ডুবে যাওয়া কোনো ঘটনাই না। সেই গভীরে যাওয়ার জন্য আমরা নৌকো পেলাম না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পেলাম একটা কলাগাছের ভেলা। ভেলাটি ছিল তুলনামূলক ছোট। পাঁচজনের তিনজন চড়লে দুইজন পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আমরা ঘুরলাম ভেলায় চড়ে, বিলের মাঝে গিয়ে ভেলা থেকে নেমে সাঁতরিয়ে পদ্মা তুলে। বিলের মাঝে কোথাও কোথাও বাঁশের মাথায় লাল লাগিয়ে নিশানা লাগিয়ে চিহ্নিত করে রেখেছে বিপজ্জনক স্থান। সেসব স্থান নিয়েও মুখরোচক গল্পের স্বল্পতা নেই। অনেক বছর আগে নাকি একটা উড়োজাহাজ এই পদ্মবিলে তলিয়ে গিয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় হলো সেই জাহাজ আর পাওয়া যায়নি। এই সব চিহ্নও বিপদসীমার ভেতর। কেউ নৌকো নিয়ে একবার পৌঁছে গেলে নাকি আর ফেরত আসতে পারে না। আমরা অদম্য সাহস নিয়ে সেইসব বিপদসীমার পাশ ঘেঁষে সাঁতরিয়ে সাঁতরিয়ে পদ্মফুল তুললাম। তুললাম পদ্মফল।

বিকেল উতরে যেতে যেতে সুতোয় টান পড়ে। ফলত ফিরে আসতে হয় আমাদের। তবে মন পড়ে থাকে সহস্র পদ্মের ভিড়ে। কুড়িয়ে নিয়ে আসি মুঠো মুঠো মুগ্ধতা। আজও সেসব স্মৃতি যেন মেঘের কাছে গচ্ছিত ধ্বনি থেকে ফিরে আসে পৃথিবীর এইখানে। ঝরে পড়ে অজস্র ধ্বনির পরাগ। এই যে মেঘ ডাকছে এতকাল পর, মনে হচ্ছে সেইসব স্মৃতির বীজ অঙ্কুরিত হচ্ছে মেঘের নিস্বনে, শঙ্খের নিনাদে, ঢেউয়ের চ্ছলচ্ছলে। আবারও কি কোনোদিন ফিরতে পারব সেইসব অবাক অমলিন নিষ্কলঙ্ক নিসর্গের কাছে!

Share.

মন্তব্য করুন