গগনে গগনে বরষণ শেষে / মেঘেরা পেয়েছে ছাড়া /
বাতাসে বাতাসে ফেরে ভেসে ভেসে / নাই কোনো কাজে তাড়া॥
সত্যিই বর্ষা শেষ হতে না হতেই প্রকৃতিতে আগমনী বার্তার জানান দেয় ঋতুরাণী শরৎ। ঋতুর রাণী শরৎ। রত্নগর্ভা ঋতু বটে। প্রকৃতিকে নিসর্গ করতে এই ঋতুর জুড়ি নেই।
‘‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাক তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি’’
বাংলাদেশের অনন্য সৌন্দর্যের এবং অনবদ্য প্রাচুর্যের পশ্চাতে সর্বাধিক অবদান হয়ত এই শরতেরই। শরৎ ঋতু যে প্রাচুর্যেরই প্রতীক। এ প্রাচুর্য সুন্দরের। এ প্রাচুর্য অনন্যতার। এ প্রাচুর্য স্বচ্ছতার এবং শুভ্রতার। স্নিগ্ধ আর উদারতায় পরিপূর্ণ আমাদের ঋতুরাণী শরৎ।
শরৎ বাংলার তৃতীয় ঋতু। গ্রীষ্ম এবং বর্ষা ইতোমধ্যে অতিক্রান্ত। বৃষ্টির বাড়াবাড়ি একদম থমকে গেছে। আকাশে ঘন মেঘের দৌড়াদৌড়ি একেবারেই ফিকে হয়ে এসেছে। নিকট আকাশে তবুও দেখা মেলে পেঁচানো তুলার মতো মেঘের কুণ্ডলী। যেন আকাশে ভেসে বেড়ায় থোকা থোকা তুলা। কী যে অনিন্দ্য সুন্দর সে দৃশ্য! শরতের প্রকৃতি প্রকৃতই যেন সুকোমল, সুনির্মল। প্রকৃতির সর্বত্র কেবলই স্নিগ্ধতা, উদারতা। নেই রৌদ্রের তাপদাহ, নেই জীবনকে থামিয়ে দেয়া একঘেয়েমি বৃষ্টি। প্রকৃতির কোনায় কোনায় কেবলই শান্তির পরশ। ঘন বরষা নেই আছে বৃষ্টির রিনিঝিনি। তীব্র তাপদাহ নেই আছে আকাশের উজ্জ্বলতা। বাতাসে উষ্ণতার ছোঁয়া নেই আছে সমীরণের মিষ্টতা। পরিবেশে ঝড় নেই, তুফান নেই আছে মৃদু পবনের স্নিগ্ধতা। এটিই তো শরতের চিরচেনা রূপ।
শরৎ তোমার শিশির ধোওয়া কুন্তলে
বনের-পথে-লুটিয়ে-পড়া অঞ্চলে
আজ প্রভাতের হৃদয় উঠে চঞ্চলি॥
বর্ষাকালের তুমুল বৃষ্টিপাত বিদায় নিয়েছে। তবে রেখে গেছে পুকুর-হাওর-বাঁওড়ে স্বচ্ছ পানির জলাধার। সেই শুভ্র জলাধারে শোভা পায়- এই শরতে শাপলা-পদ্মের জীবন্ত সৌন্দর্য। প্রস্ফুটিত শাপলার হাসি বিমোহিত করে যে কাউকে। প্রেমিক হৃদয়ে তোলে ভালোবাসার তুফান। প্রেয়সীর হাসির সাথে শাপলার হাসির সৌন্দর্য যেন মিলেমিশে হয় একাকার। প্রদোষকালের শিশিরসিক্ত শিউলি ফুলের সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয় প্রাতে ভ্রমণকারীর দল। শিউলি ফুলের সতেজ ডগায় শিশিরের কুারা যেন এক একটি হীরের টুকরো। অরুণ প্রাতের কাঁচা রোদ যেন সবুজ দূর্বার উপর গলিত স্বর্ণের নৈসর্গিক প্রস্রবণ। এই তো আমার শরতের বাংলা!
সোনা সোনা রোদ পড়ে যে শুভ্র শিশিরে
কুা কুা হীরে ঝড়ে ঘাসের উপরে॥
শিউলি-ঋতু বাংলার মানসেও প্রভাব ফেলে অতিমাত্রায়। সুকোমল শরতের স্নিগ্ধ আবেশ ছুঁয়ে দেয় বাংলার মনন ও মানস। এক নব উদ্যমতা লক্ষ করা যায় সবার মাঝে। বর্ষা যেন জীবনের কলরবে একরাশ বিরতি টেনে দিয়েছিল। বিরতির পর এবার শরৎ স্পন্দন সঞ্জীবিত করে বাংলার মানস। শরতের ফুলেদের নতুন জীবনের সাথে যেন বাঙালির জীবনেও লাগে নতুনের স্পর্শ। শুভ্রতা আর সুন্দরের সফেদ স্পর্শ। ঋতু পরিক্রমায় শরতের আগমনই যেন জীবনকে সুন্দর করতে, সফেদ সৌন্দর্যে জীবনকে ভরিয়ে দিতে, জীবনের নতুন অর্থ খুঁজে পেতে শরৎ যেন উদ্বোধনের প্রতীক। এই তো আমার বাংলার শরৎ।
বর্ণিল রঙে বর্ণালি, স্বপ্নিল দৃশ্যে স্বর্ণালি আমাদের শরৎ। রঙের বৈচিত্র্যে, সৌন্দর্যের বৈভিন্নে বিচিত্ররূপিণী বাংলার শরৎকাল। শরতের রঙে মিশে থাকে হৃদয়ের আকুতি। শরতের রৌদ্রে থাকে কাঁচা সোনার পরশ। আর শরতের অঙ্গে থাকে কাশের তুলতুলে কোমলতার স্পর্শ। আল-মাহমুদের আবেগঘন উচ্চারণ-
ভাসছে হৃদয় কাশের ফুলে ঘাস যেখানে
ঘন হয়ে ছড়িয়ে আছে কুঞ্জবনে
আসছে শরৎ আবার দেখ ভাসছে হৃদয়
হাসছে একা কাশের ফুলে সঙ্গোপনে॥
শরতের বৈচিত্র্যে কেবল কবি সাহিত্যিক নয় এ বাংলার সবাই সমান আপ্লুত হয়। এই আমার শরৎ ঋতু। বাংলার শরতের প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই নয়নাভিরাম। শরৎ বন্দনায় বাংলার প্রাগ্রসর প্রতিটি কবি। শরতের আকাশ যেন ফুল দিয়ে সাজানো, শরতের মুখ যেন প্রফুল্ল পদ্মের মতো প্রস্ফুটিত। শরৎ নূপুরের ঝংকার যেন হংসের প্রভাত আহ্বান। যেন কোনো নব পরিণীতার ফিসফিস আলাপন। পাকা শাইল ধানের মতোই ক্ষীণ যার দেহ বল্লরি। আলতা-নূপুর-মেহেদি রাঙানো, টিকলি-বালা-হার-নথ-কঙ্কণ-বিছা দিয়ে মোড়ানো। ঠিক নববধূর মতোই অপরূপ যে ঋতু সে ঋতুরই নাম শরৎ ঋতু। শরতের নীলাকাশ যেন নববধূর নীলাম্বরী। শরতের গগনে উড়তে থাকা ঝাঁক ঝাঁক পাখি যেন নীলাম্বরীতে এক একটি বুটিক। সাদা কাশের বনে ফুটন্ত লালিম শিউলি কেবল আমাদের নয়নই জুড়ায় না আমাদের মনটাকেও প্রফুল্ল করে দেয়। শরতের প্রত্যুষে তাই কিশোর-কিশোরীরা ভিড় জমায় শিউলিতলায়, মাঠে মাঠে কাশবনে। এই হলো বাংলার শরৎ! এই হলো কিশোর-কিশোরীর শরৎ!
এসো শারদ প্রাতে পথিক এসো
শিউলি বিছানো পথে
এসো ধুইয়া চরণ শিশিরে
এসো অরুণ কিরণ রথে॥
কিশোরদের ঋতু শরৎঋতু। বয়স বিবেচনায় শরৎও যে কিশোর ঋতু। ঋতুর ছয় ধাপের তৃতীয় ধাপ শরৎ। তেমনি জীবনেরও ছয় ধাপের তৃতীয় ধাপ কিশোরকাল। শিশু, বালক, কিশোর, যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ। এর তৃতীয় স্তরেই কিশোরকালের অবস্থান। শরতের সাথে কিশোরের এ সম্পর্ক কাকতালীয় মাত্র নয়। এ সম্পর্ক মণিকোঠার, এ সম্পর্ক ভালোবাসার, অভিযোজনার।
প্রিয় কিশোর বন্ধুরা! তোমাদেরকেই বলছি- শরৎ যেমন ঋতুকে সুন্দর করে সাজায়। তেমনি তোমরাও তোমাদের জীবনকে সুন্দরতম করে সাজাবে এই শরতে। জীবনকে কলঙ্কমুক্ত করে গড়ে তুলবে এই শরতে। তোমাদের জীবন হোক শরতের কাশফুলের মতোই ধবধবে সাদা, তুষারের মতো শুভ্র।
উড়ে যায় কাশফুল উড়ে যায় শরতের হাওয়া
শূন্যডাঁটির কাছে নেই কারো চাওয়া পাওয়া
আকাশের সাদা মেঘ দূরে ভেসে যায়
শুভ্র কাশের ফুল কোথা যে হারায়॥
প্রিয়তম কিশোর বন্ধুরা! তোমরা অবস্থান করছ জীবনের এক মাহেন্দ্রক্ষণে। জীবনকে পরিচ্ছন্ন করবার শুভ মুহূর্তে। তোমার জীবন কোনদিকে পরিচালিত করবে সে সিদ্ধান্ত নেয়ার যথার্থ সময় এটিই। অপরাধের সাথে সম্পৃক্তি এখনও তোমার হয়নি বলেই বিশ^াস করি। অপরাধীর সংশ্লেষ এখনও তুমি পাওনি। অপরাধ ও অপরাধী হতে দূরে থাকার জন্য সর্বতোভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে এখনই। তবেই তোমার জীবন হবে শাপলা-পদ্মের মতো প্রস্ফুটিত।
তোমরা যারা কিশোর! জীবনকে সাজাতে হবে ভালোর পসরা দিয়ে। আর জীবনকে গড়তে হবে সুন্দরের ফল্গুধারায়। সর্বক্ষেত্রে সত্যবাদিতার অবলম্বন, মিথ্যার বর্জন, বন্ধুত্বের সংরক্ষণ, প্রতিশ্রুতির পরিপালন, কাউকে ঠকানোর মনোবৃত্তি পরিহার করে চলতে হবে। সত্যের আলোতে জীবন করতে হবে আলোকিত। নৈতিকতার পরিপালনে জীবন করতে হবে সুশোভিত। সমুন্নত আচরণে জীবন হবে উদ্ভাসিত। তবেই তোমার আগামীর জীবন হবে শিউলি ফুলের মতো রঙিন, পলাশের মতো লালিম। আর তুমি হবে সমাজের জন্য আলোকবর্তিকা। তোমাদের কণ্ঠে আমরা শুনতে চাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সুদীপ্ত উচ্চারণ-
আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ
আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা
নতুন ধানের মঞ্জুরি দিয়ে
সাজিয়ে এনেছি বরণ ডালা॥
কিশোর বন্ধুরা! সাহচর্য কিশোর জীবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তুমি কার সাহচর্যে সময় পার করছ? কোন সহপাঠীর কর্মগুণ তোমাকে আনন্দিত ও আন্দোলিত করে? হ্যাঁ, ভালো বন্ধু ও ভালো সহপাঠীর কথা বলছি। যে ভালো নয় সে কখনও আমার চলার সাথী হতে পারে না। যে কল্যাণকামী নয় সে আমার বন্ধু হতে পারে না। যে নির্দ্বিধায় আমার সুখ-দুঃখের অংশীদার হতে পারে সেই তো আমার পরম বন্ধু।
বন্ধু যদি এমন হয় তাহলে তোমার সামনের পথচলাও সহজতর হবে নিশ্চয়ই। সংগ্রাম মুখরতার প্রতিটি পর্বই উতরাতে পারবে নির্বিঘ্নে ।  কারণ সাথে আছে তোমার পরীক্ষিত বন্ধুরা। যেমনটি শরতের আকাশে উড়ে চলে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির দল। সবাই তারা বন্ধুসম। কেউ কারো বাধা নয়। কিশোর বন্ধুরা! চলো সবে, একসাথে, উড়ে চলি শরতের আকাশে। সবাই সবার বন্ধু হয়ে। বন্ধুর কল্যাণকামী হয়ে।
জীবনের বালক অধ্যায় শেষ করে যারা পা রাখলে কিশোর অধ্যায়ে। বড় মূল্যবান জীবনের এ অধ্যায়। যাবতীয় অপচিন্তা, কুচিন্তা, দুশ্চিন্তা হতে দূরে হবে তোমাদের অবস্থান। মন, মনন এবং মানসকে অপ কিংবা কু যুক্ত সকল কদর্য হতে নিজেকে অনেক দূরে রাখতে হবে। মনে রাখবে অপচিন্তা মানুষের জীবন সংহারক। শরতের নীলাকাশ যেমন নীলে ছাওয়া, কোনো কলঙ্ক তিলক তাতে পাওয়া যায় না। তেমনি তোমার জীবনকে দোষমুক্ত করতে জীবন সংহারী দুশ্চিন্তা ও কুচিন্তা হতে মস্তিষ্ককে মুক্ত রাখতে হবে।
শুভ্র কাশের উছল হাসি
শাপলা বিলে রাশি রাশি
উড়ছে মাঝির পাল,
তাই দেখে খোশ রাখাল চাষী
চলছে দু’জন পাশাপাশি
কান্ধে নিয়ে জাল॥
এই শরতে কিশোরদের কাছে আমার প্রত্যাশা একটি মানবিক বাংলাদেশের। মানবতা আর মানবিকতার বড় আকাল চলছে যেন আমাদেরই মাঝে। মানবতার আকাল এবং অমানবিকতার অশনি মুক্ত একটি উচ্ছল সমাজের কামনা আমার দেশের কিশোর বন্ধুদের কাছে। মনুষ্যত্বের লালন আর মানবিকতার বিকাশে সৌন্দর্যময় হয়ে উঠুক আমাদের আগামীর পৃথিবী।
‘বিন্দু হতে সিন্ধুর সৃষ্টি
শত পাতার বইয়ের সৃষ্টি
তেমনি মানুষের সৃষ্টি হয় মনুষ্যত্বে

তেমনি মানুষের পরিচয় তার মনুষ্যত্বে

তেমনি সমাজ আলোকিত তার মনুষ্যত্বে
মানুষের এই মনুষ্যত্ব
জীবন গড়ার প্রথম শর্ত॥’
তোমাদের জীবন হোক শরতের নীলাকাশের মতোই নির্দোষ সৌন্দর্যের প্রতিকৃতি।

Share.

মন্তব্য করুন