মানুষের সাথে সর্বপ্রথম পরিচয়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম পরিচয়ের সময়কাল আজীবন স্মৃতির দর্পণে থাকে সংরক্ষিত। প্রথম সাক্ষাতের ওপর ভিত্তি করে মানুষ জীবনের পরবর্তী ভবিষ্যৎ দেখতে থাকে। সুতরাং কারো সাথে প্রথম পরিচয়টা যদি শুভ হয় তাহলে দু’জনের মাঝে ভালোবাসা ত্বরিতগতিতে বাড়তে থাকে। তবে যদি পরিচয়পর্বে অশুভ সন্ধ্যা নামে বিদঘুটে আঁধারে ছেয়ে থাকে, তাহলে পরস্পরের আগ্রহটা মন্থরগতিতে কমতে থাকে।
প্রিয় সালমানের প্রথম সাক্ষাৎ অভূতপূর্ব ও আনন্দময় ছিল। যেদিন আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল মসজিদের বেলকনিতে দু’জনই বেশ মুগ্ধ হয়েছিলাম। আমাদের অবস্থান তখন মসজিদ ভবনের তৃতীয় তলায় ছিল। সালমান খুবই সহজ-সরল দুরন্ত স্বভাবের ছেলে। নেহাত শান্তসুশীল ও ভদ্র বালক। তখন উভয়ই কৈশোরের ঘোরলাগা জীবনে পায়চারি করছি। নতুনের প্রতি ছিল আলাদা মুগ্ধতা। যেন চোখ ফেরানো অসম্ভব। নতুন মানুষ, নতুন জিনিসের ভালোবাসায় মায়ার টান বাড়তে থাকে।
প্রথম সাক্ষাতের পর টুকটাক আলাপ হতো। এরপর স্মরণে স্মরণে শুরু হয় গল্পের দিন। অল্পদিনেই আত্মার আত্মীয় বানিয়ে ফেললাম সালমানকে। মনের আলপনায় অঙ্কিত হয় একটি নাম ‘সালমান ফার্সী’। আমরা গল্প করতাম। গল্পের রেশ যেন শেষ হতো না লেগেই থাকতো। নামাজের কাতারে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে, হাঁটা-চলায় কতসব গল্পই না করেছি। লুকিয়ে চুরিয়ে কত কী যে করেছি এর কোনো ইয়ত্তা নেই। বিকালে হাঁটতে বের হওয়া, ফুটওভারে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ‘ভালো না লাগা’ সময়গুলো কাটানো, রাত সাড়ে দশটার পর চায়ের আড্ডা দেওয়া, আরো কত কী!
এভাবে কেটে গেল একটি বছর। মাদরাসা ছুটি হলো রমজানের। দীর্ঘ ছুটি। তার ওপর আবার করোনার কারণে ছুটি দীর্ঘ থেকে হলো আরো দীর্ঘতর। এই দীর্ঘসময়ে যে আমাদের কথা হতো না এমন নয়, কথা হতো মোবাইলে। এরপর অপেক্ষার প্রহর কেটে একদিন ঘোষণা হলো মাদরাসা খোলার। আমরা মাদরাসায় এলাম। সালমানও এসেছে। এসে অসুস্থ হয়ে ফের বাসায় চলে গেল। ওর আম্মুকে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম ও ভীষণ অসুস্থ। আইসিইউ-তে অবস্থান করছে। এভাবে মাস দেড়েক পার হলো। আল্লাহর অশেষ কৃপায় সুস্থ হয়ে ইলমের বাগানে ফুলকলি হয়ে ফুটলো আবার। আমরা যে ভালোবাসার বীজ বুনে ছিলাম সেটা বৃক্ষ হয়ে শাখা-প্রশাখায় রূপ নিতে লাগলো। আমরা পূর্বের চরিত্রে আবার হারিয়ে গেলাম।
সালমান আমলের প্রতি খুব মনোযোগী ছিল। এমনকি আমার আমলেও ত্রুটি-বিচ্যুতি হলে কোমল মৃদু স্বরে শাসাতো। চোখ রাঙিয়ে ভয়ের আভাস ছড়াতো। নিয়মিতই তাগিদ দিতো দোয়া করো, আজানের জওয়াব দাও, সুন্নত পড়ো।
সালমান প্রায় সময়ই শুধু বলতো, ‘ভালো লাগে না-ভালো লাগে না’। যখন কৌতূহলী হয়ে উঠতাম। জিজ্ঞাসা করতাম কী হয়েছে, কেন ভালো লাগছে না? প্রতি-উত্তরে কেবল বলতো, জানি না। নিজের না ভালো লাগার জানান ও কখনো দিতে পারেনি। এভাবেই কত শত রাত ফুরিয়ে দিন হলো। সকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো। আর আমাদের স্মৃতির গল্প হতে লাগলো বেশ লম্বা-চওড়া। স্মৃতিতে মধুর মধুর গল্প জমা হতে লাগল।
এরপর দ্বিতীয় বর্ষ শেষ হয়ে পদার্পণ করলাম তৃতীয় বছর। এ বছরও ভালোই চলছিল। হঠাৎ একদিন শুনি আমাদের স্মৃতির নাকি অসুখ হয়েছে। খুব অসুখ। যার ভালো হওয়ার সম্ভাবনা নেই। অতঃপর অসুখে অসুখে মারা গেল। খুব কাঁদলাম আমি। জানি না সেদিন সালমানও আমার মতো কেঁদেছিল কিনা! হয়তবা কেঁদেছে। বহুদিনের লালিত-পালিত স্মৃতির মৃত্যুকে মেনে নেওয়া অসম্ভব প্রায় হয়ে উঠেছিল। দাফন হলো আমার স্মৃতির। প্রকৃতি ততক্ষণে থেমে গেছে। আকাশে ভেসে যাচ্ছে মেঘের উড়ন্ত কাশফুল। দু’চোখ ছাপিয়ে বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ল। সেই জলে যেন আকাশ কাঁদলো, জমিন ভিজলো। হারিয়ে গেল স্মৃতি, দূরে সরে গেল চিরচেনা সেই মুখ…

Share.

মন্তব্য করুন