এখনো আমার মনে আছে সেই ছোটবেলার কথা। বাবা-মায়ের সেই কঠোর শাসন, যখন আমরা দুরন্ত কিশোর ছিলাম! কত রকমের দুষ্টুমি করতাম তার কোনো হিসাব ছিলো না। এসব দুষ্টুমি করতে করতে কখনো কখনো অপরাধও করে ফেলতাম। এসব অপরাধ করে আবার অপরাধগুলো লুকিয়ে বা ঢাকা দিতে চাইতাম। অপরাধ লুকাতে হলে ভুল কথা বা মিথ্যা কথা বলতে হতো। কিন্তু মিথ্যা বলে ঠিক ঠিক ধরা পড়ে যেতাম। তখন বাবা-মা দু’জন মিলে খুব করে শাসাতেন। বলতেন- যা-ই করো না কেনো, যত বড় অপরাধ করো না কেনো সবসময় সত্য কথা বলতে হবে। বাঁচার জন্য বা শাস্তির ভয়ে কখনো মিথ্যা কথা বলবে না। তারপরে যে কথাটা বলতেন সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ! অবশ্য তখন কথাটার অর্থ বুঝতাম না। এখন বুঝি কি যে দরকারি কথা ছিলো এটা। আর তা হলো- বাঁচার জন্য যদি মিথ্যা কথা বলো, তাহলে বাঁচতে তো পারবেই না! বরং উল্টো এমন ধরা খাবে যেখান থেকে ছুটে আসা বড়ই কঠিন হয়ে যাবে। সেই ছোটবেলায় বাবা-মায়ের এ কথার অর্থ বুঝতাম না বলে কখনো কখনো শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য মিথ্যা কথা বলে ফেলতাম। কিন্তু মিথ্যা কথা বলতাম যেসব ঘটনার ক্ষেত্রে সেখানেই ধরা পড়ে যেতাম। আর তখন ঘটতো ভয়ঙ্কর বিষয়! তখন শাস্তির পরিমাণ হয়ে যেতো ডাবল। এক হলো ঘটনা ঘটানোর অপরাধ। আরেকটা হলো মিথ্যা বলার অপরাধ। এই দুই অপরাধ একসাথে মিলে দ্বিগুণ শাস্তি ভোগ করতে হতো। এভাবে একবার দুবার বা তিনবার ঘটার পর সিদ্ধান্ত নিলাম- নাহ্ আর কখনো মিথ্যা কথা বলবো না। এবং বলিওনি। তখন থেকে মিথ্যার প্রতি মনে একটি ঘৃণা সৃষ্টি হয়ে গেছে। এতে যে উপকারটা হয়েছে তা হলো- এখন ইচ্ছা করেও আর মিথ্যা বলা যায় না।

আমাদের ছোটকালটা কেটেছে ঘরে বাইরে বনে মাঠে আর নদীর পাড়ে বিকালের পড়ন্ত আলো দেখে দেখে। নদীর পাড়েই সন্ধ্যার আঁধার সাথে নিয়ে রাত আসতো। নদীর পাড় থেকে ফিরতে ফিরতে মনে ভয় হতো, যদি পড়তে বসতে দেরি হয় তো মায়ের হাতে খেতে হবে পিটুনি। এই ভাবনায় জোরে হাঁটতাম। কখনও কখনও দৌড়াতাম। মায়ের হাতে বেত ওঠার আগে যে করেই হোক বাড়িতে পৌঁছাতে হবে। নইলে চিকন বেতের একটি বাড়িও পিঠ থেকে নিচে পড়বে না। অবশ্য আমাদের ছোটবেলায় বাড়িতে সন্ধ্যায় কোনো টিচার ছিলো না। আমরা নিজেরা নিজেরা পড়তাম স্কুলের পড়া। একটি টেবিলে সব ভাই-বোন মিলে টেবিলের চারপাশ ঘিরে বসতাম। হারিকেনের মিনমিনে আলোর ভেতর আমাদের পড়ালেখা হতো। পড়া শেষ করে উঠে যেতাম যে যার মতো করে।

এখনকার ছেলেমেয়েদের মতো আধুনিক যন্ত্রপাতির সমাবেশের মধ্যে আমাদের কিছুই ছিলো না। এখনকার কিশোর-কিশোরীদের হাতে যেমন মোবাইল, আইপ্যাড, ল্যাপটপ, কম্পিউটার এবং ভিডিও গেমিংয়ের বিভিন্ন ডিভাইস সারাক্ষণ থাকে। আমাদের চারপাশে ছিলো গাছগাছালির বন আর সবুজের হাতছানিতে সুখের এবং মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ। পাখপাখালির কলকাকলিতে আমরা ছিলাম একেবারেই গ্রামের অজপাড়াগাঁয়ে। আমাদের প্রতিটি ভোর হতো নানারকম পাখির ডাক ও গান পাখিদের অভয়ারণ্যে জাগ্রত থাকা পক্ষীদের ডাকে।

পুবের আকাশ তখন কী সুন্দর লালিমা ছড়িয়ে ছড়িয়ে ধীরে ধীরে আলোকোজ্জ্বল হয়ে উঠতো। মেঘের গায়ে কত রঙ কত রকমের হয়ে ফুটে থাকতো তার কোনো হিসাব ছিলো না। কেমন ফালি ফালি হয়ে মেঘের ভেতর উত্তর থেকে দক্ষিণে লম্বালম্বি থাকতো ভোরের আকাশ। ঘুম থেকে চোখ ডলাডলি করে উঠে পাখির গান শোনার জন্য কান খাড়া করে রাখতাম। এবং আকাশের রূপ দেখার লোভে চলে যেতাম নদীর পাড়ে। আমাদের বাড়ি থেকে নদীটা দূরে তো ছিলোই না বরং অতি নিকটের হয়ে বয়ে যেতো। নদীর পাড়ে গিয়ে দেখতাম আমার মতো আরও অনেকেই আমারও আগে থেকে দাঁড়িয়ে থাকতো অথবা বসে বসে দেখতো পুবের রঙিন আকাশের লাল নীল হলুদ বেগুনি মেরুন আকাশি বাদামি কমলা ছাই ও আরও আরও কত কত রঙ। নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালেই শীতল বাতাস এসে আমাদের শরীর মন এবং প্রাণ জুড়িয়ে দিতো। খুব ভালো লাগতো তখন। মনে হতো সারারাতের সকল আলস্য এবং অবসাদ এই দক্ষিণের শীতল বাতাস মুছে দিয়ে আমাদের সক্রিয় করে দিতো।

কিছু সময় এমন করে নদীর পানি আর ভোরের আবহের মধ্যে থেকে ফজরের নামাজ আদায় করতে চলে যেতাম মসজিদে। যারা নদীর পাড়ে যেতো বা উপস্থিত থাকতো তাদের দু’চারজন নামাজে আসতো না। কিন্তু বেশির ভাগ নামাজে হাজির হতো। তবে একটি মজার ব্যাপার ছিলো এই যে, নামাজের পর সবাই হুজুরের কাছে মক্তবে পড়তে বসে যেতাম। তখন যারা নামাজে আসতো না তাদেরকে তলব করতেন ওস্তাদ। বলতেন- আজ জামাতে নামাজ আদায় করোনি যারা দাঁড়াও। ধীরে ধীরে খুব ভয় নিয়ে নখ দিয়ে জামা খুঁটতে খুঁটতে নিচের দিকে মুখ রেখে নামাজে অনুপস্থিত যারা দাঁড়াতো। কিন্তু এদের মধ্যে দু’একজন ছিলো যারা নামাজে আসেনি অথচ দাঁড়াতোও না। ভীষণ ভয় নিয়ে মুখ নিচু করে বসে থাকতো। কিভাবে যেনো হুজুর ধরে ফেলতেন অনুপস্থিত এসব বেনামাজিকে। তিনি তখন নাম ধরে বলতেন- এই যে অমুক তুমি দাঁড়াও। ঠিক তখনই ওদের গায়ে কাঁপন ধরে যেতো। কারণ ছিলো যারা নামাজে আসেনি এদের সবাইকে দাঁড় করালেও যারা সত্য বলতো তাদের শাস্তি দিতেন খুবই কম। কিন্তু যারা নিজে থেকে দাঁড়াতো না বা ভান ধরে বসে থাকতো তাদেরকে শাস্তি দিতেন দ্বিগুণ তিনগুণ কখনও কখনও চারগুণ। হুজুরের একটি চিকন লম্বা বেত ছিলো। বেতটা দিয়ে পিঠের ওপর এমনভাবে বাড়ি দিতেন যে গোটা পিঠের ওপর লম্বা হয়ে দাগ কেটে যেতো। তিনি বলতেন- নামাজ না পড়ে অপরাধ করেছিস। আবার মিথ্যা বলে ডাবল অপরাধ হলো। তাই শাস্তিও ডাবল হবে। ফলে কিছু দিনের মধ্যে নামাজ পড়ুক না পড়ুক কেউ আর মিথ্যা কথা বলতে সাহস করতো না। এই করে করে শেষ পর্যন্ত বেনামাজিও আর ছিলো না। সময় মতো সবাই নামাজের জামাতে হাজির হয়ে যেতো। এই মক্তবের হুজুরের কাছেও আমরা সবাই সত্য বলার অভ্যাস গড়ে তুলেছিলাম। আমাদের একটি দল ছিলো প্রায় পনেরো-বিশ জনের। এদের কেউ আর শেষ পর্যন্ত মিথ্যা কথা বলতো না বা বলার চেষ্টাও করতো না। বরং কেউ মিথ্যা বললে সবাই মিলে ওকে তিরস্কার করতাম।
আমাদের পিতা-মাতাও আমাদেরকে বলে দিয়েছিলেন যে তোমরা যা করবে করো কিন্তু কখনও মিথ্যা কথা বলবে না। শিক্ষকও একই কথা বারবার বলে দিতেন- খবরদার কোনো দোষ করলেও কেউ মিথ্যা বলো না। আমরাও আর বলতাম না। সেই যে অভ্যাস হলো মিথ্যা না বলার সেই অভ্যাসই আজীবন সত্য বলার পরিবেশ করে দিলো আমাদের।

Share.

মন্তব্য করুন