আমাদের বাড়ির পাশেই কবরস্থান। গ্রামে কেউ মারা গেলে এখানে এনে দাফন করা হয়। দাফন করার সময় আমার রুমের জানালা দিয়ে সরাসরি দেখা যায়। যেদিন কেউ মারা যায় সেদিন আর আমার ঘুম হয় না। প্রচণ্ড ভয় করে। আজ শুক্রবার। স্কুল নেই। স্কুল নেই বলতে স্কুল বন্ধ। জুমার নামাজ পড়ে এসে রুমে বসে আছি। এমন সময় কিছু একটা মনে পড়লো। কিন্তু কি মনে পড়লো সেটা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছি না। কেমন জানি অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। কিছুই ভালো লাগছে না। মন ভালো করার জন্য আহসান হাবিব ইমরোজের লেখা ‘মোরা বড় হতে চাই’ বইটি পড়তে শুরু করলাম। কয়েক লাইন পড়তেই মন ভালো হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম বইটা পড়ে খুব আনন্দিত হচ্ছি। আমি বইয়ের প্রতি আরো মনোযোগ দিলাম। হঠাৎ কানে ভেসে এলো কেউ আমাকে ডাকছে, ‘সাজ্জাদ! এই সাজ্জাদ!’ আমি বই রেখে বাইরে গেলাম। গিয়ে দেখি বড় আপু এসেছে। আজ অনেকদিন পর আপু এসেছে। আমি কিছু বলার আগেই আপু বলে উঠল, ‘কিরে কেমন আছিস?’
আমি মুচকি হেসে বললাম, ‘হ্যাঁ ভালো আছি। তুই কেমন আছিস? আর তোর স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির সবাই কেমন আছে?’
‘হুম আমিও ভালো। আর শ্বশুরবাড়ির সব্বাই ভালো আছে। আহ্ কত দিন পর আমার ভাইটাকে দেখলাম।’
‘হইছে আর পাম্প দিতে হবে না।’
‘মা-বাবা কোথায় রে?’
‘ঘরে আছে।’
আপু বড় হলেও তাকে তুই করেই ডাকি। কারণ তুই ডাকের মধ্যে একটা অন্যরকম অনুভূতি আছে। আগে যখন আপু তুই বলে ডাকতাম তখন মা বলতো, ‘বড় আপুকে কেউ তুই বলে ডাকে?’ তখন আপু একটু রেগে যেত আর বলতো, ‘বোনকে তুই বলে ডাকবে নাতো আর কাকে ডাকবে? তুই শব্দটা কি আর সবাইকে ডাকা যায়। তাছাড়াও তুই করে ডাকলে মনে হয় সে আমার খুব কাছের মানুষ।’ তারপর থেকে আপুকে তুই বলেই ডাকতাম আর এখনো ডাকি।
আপু মা-বাবার ঘরে গিয়ে মা-বাবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করলো। আপুকে দেখে মা-বাবা এতটা খুশি হয়েছে যে বলে বোঝানো যাবে না। কোন পরিবারে যখন পরিবারের সকল সদস্য একসাথে হয় তখন যেন পরিবারে প্রাণপাখি ফিরে আসে, আর সবচেয়ে বেশি খুশি পরিবারে কর্তা। আপু মা-বাবার সাথে গল্প করতে লাগলো আর আমি আমার রুমে গিয়ে আবার ‘মোরা বড় হতে চাই’ বইটি পড়তে শুরু করলাম।
কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম কবরস্থানে মানুষের হইচই। আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে কেউ মারা গেছে। আমি জানালা বন্ধ করে দিয়ে আপুর কাছে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি আপুর সাথে মা-বাবাও বসে আছে। আমি আপুর কাছে গিয়ে বসে বললাম, ‘আপু আজকে যে এখানে থাকবি সেটা বলে এসেছিস তো?’
‘নারে ভাই! আজকে থাকবো না। কিছুক্ষণ পর চলে যাবো। তোদেরকে দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল তাই দেখতে এলাম।’
মা একটু মন খারাপ করে বলল, ‘এত দিন পর এলি আর এসেই চলে যাবি?’
‘মা আমার শ্বশুর খুব অসুস্থ তাই তাই চলে যেতে হবে।’
আপু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবার বলল, ‘মা আমার এখন যেতে হবে। পাঁচটা বেজে গেছে।’
‘আচ্ছা মা সাবধানে যাস!’
‘বাবা আমি এখন যাই’ আপু বলল।
বাবা পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে বলল, ‘এইনে মা গাড়ি ভাড়াটা নিয়ে যা।’
আপু বাবার কাছ থেকে টাকা নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সাজ্জাদ আমাকে একটু এগিয়ে দিয়ে আয় তো ভাই।’
‘আচ্ছা চল।’
আমি আপুর সাথে বাড়ি থেকে বের হলাম আপুকে এগিয়ে দেওয়ার জন্য। বাড়ি থেকে কিছুদূর যেতেই আপু হাতে কিছু একটা নিয়ে বলল, ‘এই নে! এটা ধর!’
‘কিন্তু এটা কি?’ আমি গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করলাম।
আপু বলল, ‘এটা হাতে নে।’ আমি হাতে নিয়ে দেখি, বাবা আপুকে যেই টাকাটা দিয়েছিলো সেই টাকা। গুনে দেখলাম পুরো একশ বিশ টাকা। আমি আপুকে বললাম, ‘এটা তো বাবা তোকে দিয়েছিলো!’
আপু মুচকি হেসে বলল, ‘হ্যাঁ দিয়েছিলো। কিন্তু এখন আমি তোকে দিলাম।’
আমি তো মহাখুশি। পুরো একশ বিশ টাকা পেয়ে গেলাম। ইচ্ছে হচ্ছে এখানেই লাফালাফি শুরু করে দিই। কিন্তু রাস্তায় তো আর লাফালাফি করা যাবে না। আপুকে এগিয়ে দিয়ে আসতে আসতে সন্ধ্যা ছয়টা বেজে গেছে। বাড়ি এসে হাত মুখ ধুয়ে পড়তে বসলাম।
হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি দশটা বিশ বেজে গেছে। পড়তে পড়তে কখন যে এত রাত হয়ে গেল ঠাওর করতে পারলাম না। শুনতে পেলাম রাতের খাবার খাওয়ার জন্য মা ডাকছে। বই রেখে খেতে চলে গেলাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রুমে এলাম। রুমে এসে এগারোটা পর্যন্ত বই পড়লাম। এখন ঘুমানোর সময় হয়ে গেছে। লাইট অফ করে শুতে যাবো এমন সময় বিছানার দিকে তাকাতেই শরীরটা কেঁপে উঠল। মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারছি না যে, আমার বিছানায় কেউ শুয়ে আছে। চারপাশটা খুব ভয়ানক লাগছে। একটা দমকা হাওয়া এসে জালানাটা খুলে ফেলল। দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা ছবিগুলো পড়ে গেলো। চারপাশ থেকে ভেসে আসছে ভায়ানক শব্দ। ভয়ে আমার পা কাঁপতে শুরু হলো। এই শীতে শরীর থেকে ঘাম বেয়ে বেয়ে পড়ছে। আমি দৌড়ে গিয়ে লাইট অন করলাম। লাইট অন করে অবাক হওয়া ছাড়া আর কোন উপায়ই থাকলো না। আমার বিছানায় কেউ নেই। জানালা ঠিকই আছে বন্ধ করা, দেয়ালের ছবিটাও ঠিক আছে। তাহলে আমার সাথে এতক্ষণ কি হলো? কি ঘটলো আমার সাথে? প্রশ্নগুলো মনে জাগলো।
ইতোমধ্যে আমার দরজায় এসে কেউ নক করলো। আমি আরো ভয় পেয়ে গেলাম। ভীত কণ্ঠে বললাম, ‘কে? কে ওখানে?’ কিন্তু কোনো জবাব এলো না ওপার থেকে। আবার নক করলো। ভয়ে ভয়ে এক-দু পা করে এগিয়ে গেলাম দরজার দিকে। দরজা খুলে দেখি বড় আপু দাঁড়িয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘কিরে আপু তুই? তুই কখন এলি?’
আপু খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল, ‘এই তো! এই মাত্র এসেছি। তোর জন্য বিরিয়ানি নিয়ে এসেছি। সাথে চকোলেটও আছে।’
‘আরে আপু আমার জন্য এসব আনার কি দরকার ছিলো। আয় ঘরে আয়!’
আপু ঘরে এসে চেয়ারে বসল। আমিও আপুর সামনে বসলাম। আপু ব্যাগ থেকে দুইটি বিরিয়ানির প্যাকেট আর সাথে কিছু চকোলেট বের করে আমাকে দিলো। আপু আমাকে দেখেই বুঝতে পারল যে আমি ভয় পেয়েছি। আপু বলল, ‘কিরে তুই এভাবে ঘামছিস কেন? আর দেখছি তোর শরীরও কাঁপছে। কী হয়েছে তোর?’
‘আপু তেমন কিছু হয়নি একটু ভয় পেয়েছি।’
‘আমি জানতাম তুই এটাই বলবি, সেই ছোটবেলা থেকেই তো দেখছি তুই ভয় পেলেই ঘামতে থাকিস।’
আপু কিছুক্ষণ থেমে আবারও বলল, ‘চল সাজ্জাদ আমরা ছাদে গিয়ে গল্প করি।’
‘এত রাতে ছাদে যাবো।’
‘হ্যাঁ চল। এখন আর তোর ঘুম হবে না।’ এই বলেই আপু আমাকে টেনে ছাদে নিয়ে গেল। আপু বলল, ‘এখানে বস।’ পিছনে ফিরে দেখি দুটো চেয়ার কিন্তু আমরা যখন ছাদে এলাম তখন তো চেয়ার দুটো এখানে ছিলো না। আপুকে কিছু না বলে চেয়ারে বসে পড়লাম। আপুর সাথে তার শ্বশুরবাড়ির সম্পর্কে কথা বলছি। কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম সিঁড়ি দিয়ে কেউ উঠে আসছে। হাতে একটা টর্চলাইট তাই বুঝতে পারলাম না কে আসছে। কাছে আসার পর বুঝতে পারলাম মা-বাবা। আমি বলতে যাবো এমন সময় বাবা ধমক দিয়ে বলল, ‘সাজ্জাদ তুই এত রাতে একা একা ছাদে কী করিস? এখন রাত ২টা বাজে বুঝতে পারলি।’ বাবা বলে শেষ করতে না করতেই মা বলল, ‘আমি কখন থেকে লক্ষ করছি তুই বারবার বাইরে যাচ্ছিস। এখন পর্যন্ত তুই চারবার বাইরে এসেছিস, আর এখন ছাদে। তাও আবার একা একা।’ আমি তাদের কথা শুনে কিছুই বুঝতে পারলাম না। পাশে তাকিয়ে দেখি আপু নেই। আমি বললাম, ‘আমার সাথে এতক্ষণ আপু ছিলো।’ বাবা আরো জোরে ধমক দিয়ে বলল, ‘তোর আপু তো বিকালেই চলে গিয়েছে, আর তুইই তো গিয়ে দিয়ে এলি।’ তাহলে এতক্ষণ কার সাথে ছিলাম? আর আমাকে বিরিয়ানি কে এনে দিলো? আমি মা-বাবাকে ছাদে রেখেই দৌড়ে রুমে গেলাম। রুমে ঢুকে দেখি বিরিয়ানিগুলো এখনো টেবিলের উপর রাখা।

Share.

মন্তব্য করুন