এই চল এখানে থাকা যাবে না। এই ম্যাডাম প্যাক প্যাক করে। মনে হয় একটা হাঁস। সারাদিন কেবল এটা করো না, ওটা করো না। ভাল্লাগে না! কামাল পিকুকে সমর্থন করে হাত ধরে টেনে বাইরে চলে গেলো। বাকি ছাত্ররা ক্লাসে উসখুস করছে। বের হতে পারছে না, কিন্তু ম্যাডামের কথায় মন নেই। সাজেদা ব্যাপারটি লক্ষ্য করেও চেপে গেলো। তার বাজখাই গলার স্বর খানিকটা বদলে গেলো। কী যেন চিন্তা করলো, তারপর বললো- জীবনটাই একটা জ্যামিতি বুঝলে বাচ্চারা? এবার ছাত্ররা একে অপরের মুখচাওয়াচাওয়ি শুরু করলো। আজ সূর্য কোন দিক দিয়ে উদয় হলো কে জানে! নাকি কোন কঠিন শাস্তির পূর্বাভাস? তারা কিছুটা ভয় কিছুটা অভয় নিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।
সাজেদা গণিতের বই বন্ধ করলো। ত্রিভূজের তিন কোণের সমষ্টি দুই সমকোণের সমান। এটাই আজ আমরা প্রমাণ করবো। কিন্তু তার আগে চলো গল্প করি। ছাত্ররা নড়েচড়ে বসলো। ঘটনা কী? ম্যাডাম গল্প করবে? যার মুখ থেকে কখনো হাসি বের হয় না, সে গল্প করবে? কেউ বলতে পারবে না যে, ম্যাডাম কখনো হাসে। কবে কোন শিক্ষার্থীকে ঠিকমতো নাম ধরে ডেকেছে- এমনও কেউ বলতে পারবে না। আজ কিনা গল্প বলবে! সবাই ভয়ে ভয়ে বললো, ম্যাডাম আমরা পড়বো।

সাজেদা ধীর কন্ঠে বললো, গল্পটি তোমাদের শোনা উচিত। শোন বলছি। শিক্ষার্থীরা চোখ-মুখ মুছে অবাক হয়ে সাজেদা ম্যাডামকে দেখছে এবং শোনার জন্য প্রস্তুত হলো।
‘এখন থেকে আরো পঞ্চাশ বছর আগের কথা। তখনো আমাদের দেশটি স্বাধীন হয়নি। হাবীব, করিম, রহিম, ময়না চার ভাই-বোন ছিলো। তারা পড়াশোনায় খুব ভালো ছিলো। ক্লাসে তারা বেশ মনোযোগী ছিলো। বরাবরই ভালো রেজাল্ট করতো। ময়না সবার ছোট। সে তেমন ভালো ছিলো না ভাইদের তুলনায়। সে গান করতে ভালোবাসতো। কিন্তু পরিবার তা চাইতো না। ময়নার তবুও শখ যায় না। চুপে চুপে সে গান করে, কবিতা আবৃত্তি করে, নিজেও লেখার চেষ্টা করে। পরিবারের অন্যান্য সদস্য তা কোনভাবেই মেনে নিতে পারে না।’ সাজেদা দম নেয়ার জন্য থামে। শিক্ষার্থীরা কৌতূহলী হয়ে ওঠে।
‘রহিম শহরের নামীদামী কলেজে চান্স পায়। বাবা-মা সকলেই থাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে। করিম এতোই মেধাবী ছিলো যে তাকে নিয়েও কারো ভাবনা ছিলো না। কিন্তু সে নামী দামী স্কুলে চান্স পায়নি। কারণ জানো?’
চন্দন হাত তুললো, ‘ম্যাডাম সে পরীক্ষাই দেয়নি।’

সাজেদা বললো, ‘না । সে ভালো ছাত্র এ অহংকারে মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা দেয়নি। সে ভেবেছে সে যা লিখছে তাই সঠিক। তার চেয়ে ভালো কেউ লিখতে পারবে না। রেজাল্ট হওয়ার পর লজ্জায় সে ঘর থেকে বের হতে পারছিলো না। ময়না ছোট হলেও বুদ্ধিমতী। সে ভায়ের কাছে যায়। ভায়ের মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। কিন্তু অহংকারী করিম বোনকে পাত্তা দেয় না- যা এখান থেকে! চিৎকার করে ষাঁড়ের মতো। তারপর কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর ভাণ করে। ময়না চলে আসে। কিছুই বলে না। আসলে করিম নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করে। হাবীব সবার বড়। ইতোমধ্যে সে কলেজ শেষ করে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে। সেও ভালো ছাত্র। কিন্তু ভার্সিটিতে যাবার পর সে যেন কেমন হয়ে গিয়েছে। বাসায় ফেরে অনেক রাতে। কোন কোন দিন ফিরে না। বলতে পারো কেন ফেরে না?’
ছাত্ররা উসখুস করে। তারা বললো, ‘কেন ম্যাডাম?’

‘দেশে তখন অস্থির অবস্থা। রাত জেগে তারা পোস্টারিং করে, শ্লোগান লেখে। দলেদলে মিটিং করে। সবই গোপনে। কারণ সরকার বুঝতে পারলে আর রক্ষা নেই। পাকিস্তানি সরকার আমাদেরকে দাবিয়ে রাখার জন্য নানান ফন্দি আঁটে। কিন্তু আমাদের ছাত্ররা তা মানতে নারাজ। তারা মিছিলে মিছিলে শহর কাঁপিয়ে তোলে। হাবীব তাদের নেতা। কষ্টের ব্যাপার হলো ভার্সিটিতেও একটি পক্ষ আছে, যারা পাক সরকারের তাবেদার। যারা লেখাপড়া করে না, টেন্ডারবাজি করে, চাঁদাবাজি করে, সাধারণ ছাত্রদের অত্যাচার করে। হাবীব প্রতিবাদী। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে হবে। একদিন দু’পক্ষের ভেতর তুমুল মারামারি হলো। হাবীব হারিয়ে ফেললো তার ডান হাত। এখন হাবীব কী করবে, বলতে পারো?’
নাবিল বলে, ‘ম্যাডাম, ভিক্ষা করা ছাড়া আর উপায় নেই।’
সাজেদা বললো, ‘আসলেই তাই। ডান হাত নেই তো দুনিয়া আঁধার, তাই না?’
‘তাই তো মনে হয়।’

‘কিন্তু না, হাবীব থেমে থাকেনি। একহাত ছাড়াই সে এগিয়ে চললো। পড়াশোনা এবং মিছিল শ্লোগান চলতেই লাগলো। একদিন দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। হাবীব দুঃখ পেয়েও পায়নি। মুক্তিযুদ্ধের জন্য তার নানান কাজ রয়েছে যা সে করতে পারে। সে চলে গেলো মানুষের কাছে। মানুষকে বোঝানোর, সংগঠিত করার দায়িত্ব সে নিজেই নিলো। দেশ স্বাধীন হলো। হাবীব ফিরলো। স্বাধীন দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে বললো, দেশ স্বাধীন হলেও দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আনা এতো সহজে সম্ভব নয়। হাবীব মানুষের কল্যাণে কাজ করতেই লাগলো। তার হাত নেই বলে সে থেমে যায়নি। মানুষ ইচ্ছা করলে নিজেকে পাল্টে দিতে পারে। হাবীব বাম হাতে লেখা শিখলো। বাম হাতে লিখেই পড়াশোনা শেষ করলো। সে চাকুরিতে যায়নি। হাত নেই বলে হয়তো তার চাকুরি নাও হতে পারে। বাবার কাছ থেকে নামমাত্র কিছু টাকা নিয়ে সে কয়েকটি সেলাই মেশিন নিয়ে ছোট একটি হাউজ খুললো, যেখানে কাজ করে অবহেলিত-নিপীড়িত নারীরা। ধীরে ধীরে তার ব্যবসা দাঁড়ালো। সে অনেক মানুষের জীবন ও জীবিকার জন্য কাজ করতে শুরু করলো। এখন বলো, হাবীবের পক্ষে দাঁড়ানো কীভাবে সম্ভব হলো?’
তুহিন চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দিলো- ‘ম্যাডাম আমাদের মাফ করুন। আমরা সুস্থ-সবল হয়েও দুষ্টুমীতে ব্যস্ত থাকি।’ তার দেখাদেখি সবারই মন বিষন্ন হয়ে গেলো।
সাজেদা গল্পের দ্বিতীয় অংশে চলে যায়।
‘রহিম নামীদামী স্কুল থেকে ভালো ফলাফল করেও কোথাও তার চাকুরি হয়নি। সে বেকার। হাত নেই যে হাবীবের তারই প্রতিষ্ঠানে কাজ করে। বলো, কেন রহিমের এ অবস্থা হলো? কেন সে কোথাও কিছুই করতে পারলো না?’
ছাত্ররা এবার নড়েচড়ে বসলো। তাই তো কেন পারেনি!
‘স্কুলের পড়া পাখির মতো মুখস্ত করে তোমরা অনেকেই অনেক নাম্বার পাও, ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড হও, এটা খুবই ভালো, কিন্তু সেই সাথে তোমাদেরকে পড়তে হবে অনেক বাইরের বইও। পত্রিকা দেশ-বিদেশের খবর রাখতে হবে। রাজনৈতিক সচেতনতা থাকতে হবে। শিল্প-সাহিত্য জানতে হবে। আমাদের ঐতিহ্য ও মূল্যবোধ লালন করতে হবে। মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে হবে। এককথায় চৌকশ হতে হবে। রহিম স্কুলের বাঁধাধরা নিয়মানুযায়ী পড়া শিখেছে, বাকি সময় সে হেলায়-ফেলায় কাটিয়েছে। যে সময় চলে যায় তা আর ফিরে না! এখনই তোমাদের উপযুক্ত সময় সমাজের জন্য উপযুক্ত হয়ে ওঠার। কামাল এবং পিকু কোথায় আমি জানি। তোমরা বলতে পারবে?’
তুহিন বললো, ‘বাইরে ম্যাডাম।’
‘বাইরে কোথায়?’
‘সবাই মাথা নিচু করে বসে আছে।’
সাজেদা বললো, ‘আমি জানি। তারা স্কুলের পেছনে সিগারেট টানছে। হয়তো গাঁজাও। সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ, গাঁজা আরো খারাপ। তোমরা যদি নেশা করো তাহলে দেশ কে গড়বে? কে অন্যায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলবে? ময়নার খবর জানো? সে স্কুলও ভালো পাশ করেনি। মানে সে এসএসসিও ভালো রেজাল্ট নিয়ে পাশ করেনি। তাহলে তার অবস্থা কী? সবাই তার জন্য লজ্জা পেতো কিন্তু ময়না তার উদ্ধেশ্যে অটল ছিলো। স্কুলের সকল প্রোগামে সে অংশ নিতো এবং কালচারাল সকল ইভেন্টে সে ফার্স্ট হতো। এ নিয়ে তার বাবা তাকে হেনস্তা করতো। কিন্তু কী করা তার তো গাইতে ভালো লাগে, আঁকতে ভালো লাগে। তার স্কুলের মধুবালা ম্যামের কাছে গোপনে সে তালিম নিতে শুরু করে। একবার ছবি এঁকে সারা দেশের মাঝে সে ফার্স্ট হয়। তাকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় হইচই পড়ে যায়। একটি প্রতিষ্ঠান তাকে স্কলারশিপ দেয়- কারণ তার পড়াশোনা বন্ধ করে দেয় তার বাবা। স্কলারশীপ পেয়ে সে বাবা-মাকে ছেড়ে নতুন করে নিজেকে গড়ার স্বপ্ন দেখে। ঠিকই সে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে। এখন যার গান শুনে তোমরা নাচতে থাকো সেই রুমকিই হলো ময়না। রুমকির গান পছন্দ করে না এমন কেউ আছো? আবার ছবি আঁকায়ও সে শিল্পাচার্য জয়নুলের মতো। পৃথিবীর নানান দেশে তার প্রর্দশনী চলেছে। সে চিত্রকলার নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করেছে। রুমকি এখনও বাবা-মায়ের কাছে আসেনি। কেন জানো?’
ছাত্ররা মাথা নাড়ে- না, জানে না। সাজেদা বললো, ‘এখনো তার বাবা তাকে ডাকেনি। কিন্তু সে থেমে নেই। টিভি চ্যানেল খুললে যাকে বেশি দেখা যায় সে কে?’
সবাই বলে, ‘রুমকি?’

‘ওদিকে করিমের অবস্থা জানো? দামী স্কুলে চান্স না পাওয়ায় ডিপ্রেশনে ভুগতে ভুগতে সে তলিয়ে যায়। পরিবারের সকলে তাকে অবহেলা-অবজ্ঞা করায় একদিন সে বিষ পান করে। কারণ অপমান সইতে পারছিলো না। সে দিন তার পাশে কে দাঁড়িয়েছিলো জানো? ময়না। ভাইকে সাপোর্ট দিয়ে বাঁচিয়ে তোলে। অসহায় মানুষের মানসিক সাপোর্ট বেশি প্রয়োজন। সবাই যখন ঘৃণা করেছে ময়না তখন ভাইকে আশার আলো জুগিয়েছে। তার নিজের বাঁধা গান গেয়েছে। কবিতা শুনিয়েছে। ছবি এঁকে দেখিয়েছে। করিম ধীরে ধীরে আলোয় ফিরেছে এবং সেও হাবীবের মতো চৌকশ হয়ে উঠেছে। এখন করিম সরকারি কর্মকর্তা।’
সাজেদা থামে। ‘তোমরা বলো- তোমাদের কাজ কী?’
সবাই চুপচাপ বসে আছে। সাজেদা ম্যাডামকে কেউ পছন্দ করে না। অথচ ম্যাডাম সকলের ভালো আর মঙ্গলের জন্যই বকাবকি করে। এটুকু তারা উপলব্ধি করতে পেরে লজ্জিত হলো এবং একই সাথে বললো, ‘ম্যাডাম আমরা মনোযোগ দিয়ে পড়বো। আপনি আমাদের গাইড।’
সাজেদার চোখ ভিজে উঠেছে। তার নিজের সস্তান নেই। শিক্ষার্থীদের সে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে। আজ যারা শিক্ষার্থী, তারা আগামী দিনের রাষ্ট্রনায়ক। তারা চৌকশ না হলে রাষ্ট্র অধঃপতনে পড়বে। সাজেদার চোখে জল দেখে শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এলো। আমরাই আপনার সন্তান। আপনার স্বপ্ন আমাদের চোখে আপনার কাজলেই এঁকে দিন।
সাজেদা সবাইকে বুকে জড়িয়ে নেয়- ‘তোরাই আমার দুনিয়া আমার সব।’ ততোক্ষণে কামাল এবং পিকুও এসে গিয়েছে। তারা তাদের ভুল বুঝতে পেরেছে। তারা পণ করলো আর কোনদিন সাজেদা ম্যাডামকে হাঁস বলবে না। তাঁর নির্দেশনা মেনে চলবে। হাবীবের মতো না হলেও চেষ্টা করবে তারা যা পছন্দ করে তা মনোযোগ দিয়ে করতে এবং কাজে প্রত্যয়ী হতে। কারণ, দৃঢ় মনোবলই মানুষকে জয়ী করে।

Share.

মন্তব্য করুন