খেতে বসে আলিম মৃৃধা হঠাৎ ধমকে উঠলো ছেলে-মেয়েদের ওপর। খাওয়ার সময় এতো গোলমাল কিসেররে? প্রত্যেক দিন এতো যে মাছ মাংস খাস-তোদের পেট ভরে না! মৃধার বৌ বললো, তোমার সাওয়াল মিয়ার পেট ভরলি কি হবি; আত্মা ভরে না। মনিরুল কাল রাইতে মুরগির রান দিয়ে ভাত খায়ছে। আর একটা রান বদিরুলের পাতে দেয়া দেখেই মনিরুলের আর সহ্য হচ্ছে না।
মৃধা মনিরুলের দিকে চোখ বড় বড় করে বললো, তুই বড়, তুই ক্যারে সব খাবার চাস! একটা মুরগির কয়টা রান হয়। তারপর বৌকে বললো, মেয়েটাকে কি দিছো!
– মাইয়েডারে যা দেই তা দিয়েই খেয়ে ওঠে। আকলি তো তাদের বড় বোন, ওর কি ইচ্ছে করে না একদিন একটা রান খাই।
– আমার মাইয়া মুখ ফুটে কিছু বলে না বলেই যে ভালো-মন্দ কিছু দিবা না-তা তো হয় না। এরপর মুরগি জবাই হলেই আমার আকলিমারে রান দিবা।
আকলি বললো না আব্বা রান আমার ভালো লাগে না। আমার পছন্দ ডানার মাংস। বাবা বললো, তোরা সবাই স্কুলে যাস, লেখাপড়া করিস। যখন যা হয় সবাই ভাগ করে খাবি। ভালো খাবো ভালো পরবো বলে জিদবাদ করতে হয় না। কতো মানুষ দিন কে দিন আলু ভর্তা দিয়ে ভাত খায়ে ওঠে। কেউ তরকারি কিনতে পারে না বলে খিচুরি খায়। কেউ আবার এক বেলা উপোস করে কাটায়। আল্লাহর ইচ্ছায় আমরা তো ভালোই আছি। আল্লাহ যখন যেভাবে রাখে সেভাবেই খুশি থাকতে হয়।
মৃধার ছোট ভাই জালাল ও ঘর থেকে জামা কাপড় পরে-ঘরে ঢুকেই বললো, ভাবী জলদি ভাত দাও। ভাবী বললো, বসো দেই-প্যান্ট শার্ট পরছো, কোনোখানে যাবা?
– ঢাকা যাবো। ভাবছিলাম আর দুটো দিন থাকি। আমার বন্ধু জাকির ফোন করছে। ঢাকা গিয়ে পথে পথে দ্বারে দ্বারে ঘুরে রোহিঙ্গাদের জন্য টাকা জোগাড় করতে হবে। সেই টাকায় চাল-ডাল আটা-তেল সাবান বিস্কুট ইত্যাদি কিনে ট্রাক বোঝাই দিয়ে যেতে হবে চিটাগাং বান্দরবান। যেখানে শরণার্থীদের ক্যাম্প করা হয়েছে। রোহিঙ্গা মুসলমানদের বড় কষ্টরে ভাবী। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা আর ঘটে নাই।
– শুনছি বার্মা না কোন দেশের তে মুসলমানদের গুলি করে মারতাছে, ঘর বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়াচ্ছে। ওরা জানডা নিয়ে পালায়ে বাংলাদেশে আসতাছে। মুসলমানরা ওদের কি ক্ষতি করছে! ওরা নাকি একটা পিঁপড়েও মারে না-তাহলে মানুষ মারে কেমনে।
মৃধা বললো, তুমি থামো-আগে ওর ভাত দাও। তারপর ভাইকে বললো, জালাল তুই টাকার কথা বলছিলি কিন্তু আজই যে রওনা দিবি তা তো জানতাম না। জালাল বললো, আমার কাছে যে টাকা আছে তা দিয়ে ঢাকা যাওয়া যাবে কিন্তু ভাই বলছিলাম ঢাকা গিয়ে তো ছোটাছুটি করতে হবে। তাছাড়া আমাকেও তো রোহিঙ্গাদের সাহায্যের জন্য কিছু টাকা দিতে হবে। মৃধা বললো, একশবার দিবি। ওরা যে দেশেরই হোক ওরা তো আল্লাহ্রই বান্দা-শেষ নবীর উম্মত। ওদের কথা ভাবলে মনের মধ্যে বড় কষ্ট হয়। কেন হয়-কারণ মুসলমান ভাই ভাই। গত সপ্তাহে মসজিদে হুজুর যেসব কথা বয়ান করলেন, শুনে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। তুই খাতি থাক আমি বাজারতে একটা পাক দিয়ে আসি।
জালাল ভার্সিটির ছাত্র। ওরা কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে অসহায় রোহিঙ্গাদের জন্য কাজ করছে। দুদিনের জন্য এলাকায় এসে প্রতিটি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বলে এসেছে দেশ ছাড়া, ভিটেমাটি ছাড়া, সর্বস্বান্ত রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাহায্যের জন্য আমাদের সকলের এগিয়ে আসতে হবে।
– এলাকার অর্থ একত্রিত করে-রোহিঙ্গা তহবিলে পাঠাতে হবে-সরকার বরাবর। একথায় সবাই সাড়া দিয়েছে। তারা তো প্রতিদিন টেলিভিশন, খবরের কাগজে সবই দেখছে-পড়ছে।
জালালের খাওয়া শেষ হতেই ভাবী বললো, মানুষ এমন পশু হয় তা এর আগে আর জানতাম না। মেম্বারের টিভিতে একদিন দেখলাম, ছোট ছোট ছেলে মেয়ে, বুড়ো মা বাবারে নিয়ে হাঁটু সমান কাঁদা মাড়ায়ে দলে দলে মানুষ আসতাছে এদেশে। রোহিঙ্গাদের গ্রামকে গ্রাম আগুন দিয়ে পুড়ায়ে দেছে। সারা জীবন কতো কষ্ট করে সুখের বাড়ি ঘর করছে, সব শেষ। এখন রাস্তার ফকির। কতো লাশ পড়ে আছে পথেঘাটে-নদীর ভাঙনে। সৈন্যরা ছোট ছোট পুলাপানগুলো কাটে দুভাগ করে রাখছে। যারা এ দেশে আয়ছে-তারাও দিনকে দিন না খায়ে কাটাচ্ছে। একি ভাবা যায়রে ভাই।
মনিরুল বদিরুল আর আকলি চাচার পাশে বসে মায়ের কথা শুনছিলো। টিভির এসব দৃশ্য ওরাও দেখেছে। মনিরুল বললো, মা আমিও দেখছি-আমার মতো পুলাপাইনের সৈন্যরা গুলি করে মারতাছে। কারোর আবার আগুনের মদ্দি ফালায়ে দেছে। মা বললেন, তোরা সব সময় ভালো খাবারের জন্নি হইচই করিস-রোহিঙ্গারা ছোট বড় সবাই না খায়ে দিন কাটাচ্ছে।
ওগারো বাড়িঘর ছিলো-তিন বেলা ভালো-মন্দ খাইতো। আর অহন না খায়ে দিন কাটাচ্ছে। কারো বাপ মরছে, ভাই মরছে। কারো স্বামী মরছে জোয়ান ছেলে, কোলের ছোট বাচ্চাও মরছে। অহন আমরা বাংলাদেশের মানুষরা তাগের খাওনের ব্যবস্থা করতাছি। আল্লাহ আমাগের যদি এমন বিপদ দিতো তাইলে কি অবস্থা হতো-একবার ভাবতো তোরা।
তিন ছেলে মেয়ে চুপচাপ শুনছিলো মায়ের কথা। মনিরুল বললো, মা তুমি আর মুরগি কাইটো না। তুমি আব্বাকে বলো, মাছ, মুরগির টাকা জমায়ে আমরা রোহিঙ্গাদের জন্য পাঠাবো। আমি আর ভালো খাওয়ার জন্য কখনো অশান্তি করবো না। ওদের জালাল চাচা বললো, সাবাস এই তো আমার ভাতিজার মতো কথা। দেশের অসহায় মানুষদের যারা ভালোবাসে না, দুঃখীজনের পাশে গিয়ে দাঁড়ায় না সে কিসের মানুষ? দুধের শিশুদের ওরা মায়ের কোল থেকে নিয়ে আছড়ে মেরেছে। আরো যে কতো জঘন্য অন্যায় অত্যাচার করেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
আকলির চোখ দুটো তখন অশ্রু টলোমল। আকলি কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো, ছোট চাচা ঐ শয়তানদের কেউ শাস্তি দেচ্ছে না কেন?
– এখন মানুষ কি আর মানুষ আছেরে মা! আল্লাহ একদিন ঠিকই এর বিচার করবে। অত্যাচারী নমরুদের তিনি বিচার করেছেন। নূহ নবীর অবাধ্য লোকদেরও এমন শাস্তি দিয়েছেন যা ভাবলে আজও মানুষ শিউরে ওঠে। আল্লাহর ইচ্ছে হলে তেমনটিই হবে একদিন।
এবার ভাবী বললো, সে কাহিনী জানি কিন্তু তাদের চেয়েও একশত গুণ খারাপ ওরা। এর মধ্যেই মৃৃধা ফিরে এসে বললো, জালাল কিছু টাকা পাওয়া গেছে, এই নিয়ে যা। লাগলে ফোন দিস আমি বিকাশ করে দেবো। জালাল ভাই এবং ভাবীর কাছ থেকে দোয়া নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছে মাত্র। ঠিক তখনই বদিরুল দৌড়ে এসে চাচার হাতে একটা টাকা দিয়ে বললো, চাচা ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের দুধ কিনে দিও।
জালাল অবাক হয়ে বদিরুলের মুখের দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ বদিরুলকে বুকে জড়িয়ে ধরে যেনো ভাষা হারিয়ে ফেললো। তারপর চোখ মুছে বললো, বদিরে আমি বিশ্বাস করি আজ থেকে তোর মতো ছোটরাও অসহায় রোহিঙ্গাদের সাহায্যে এগিয়ে আসবে।

 

Share.

মন্তব্য করুন