‘তাহলে এই কথা রইলো। নিয়মিত তুমি স্কুলে যাবে। সময়মতো খাবে। বিকেলে একটু খেলবে।’
বড় ভাইয়ের ঝাঁঝালো কণ্ঠের ওপর সায় দিয়ে সিয়াম মাথাটা উপর-নিচ করলো। ভাইয়া যা বোঝার বুঝে ফেললেন। তিনি চলে গেলেন। সিয়াম তার বেডে সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। সিয়ামের মাথায় এখন ভাইয়ার শেষ কথাগুলো ঘুরছে। স্কুলে যাওয়া, খাওয়া এবং বিকেলে একটু খেলা।
এতদিন ভাইয়া বাড়ি ছিলেন না। সিয়াম ভালোই স্বাধীন ছিলো। যেমন মন চাইতো তেমন চলতে পারতো। আম্মুর ধমক কোনো কাজে লাগতো না। রাগে কখনো আম্মু মারধর করলে হিতে বিপরীত হতো। ভাইয়া ঢাকার এক কলেজের হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করেন। খুব একটা বাড়ি আসতেন না। কলেজে কী এক গ্যাঞ্জাম হয়েছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য কলেজ বন্ধ। বোধ হয় অনেকদিন বাড়ি থাকবেন। ভাইয়া আসার সাথে সাথেই আম্মু এক বস্তা নালিশ মেলে ধরলেন ভাইয়ার কাছে। সেই থেকেই ভাইয়া সিয়ামের ওপর ক্ষ্যাপা। ভাইয়ার চোখ দেখে তো সিয়াম স্পষ্ট বুঝে ফেলেছে। এবার এর ব্যতিক্রম হলে আর রক্ষে নেই।
সিয়াম দুষ্টু হলে কী হবে, পড়াশোনায় পাকা। বুদ্ধিসুদ্ধিও আছে বেশ। এ ধরনের দুরন্ত ও মেধাবী ছেলেরাই বড় হলে দেশ ও জাতির কাজে আসে যদি তাদের মেধা ভালো কাজে ব্যয় করে। তবে ওর দুষ্টুমিটা মাত্রা ছাড়িয়ে যায় কখনো। তখন অন্য মানুষের বকাঝকা শুনতে হয় ওর জন্য।
সেদিন বল খেলতে গিয়ে বাজিয়েছে মহাকা-। বাড়ির উঠোনে বল খেলছে ওরা তিনজন। সিয়াম, দেলোয়ার ও হৃদয়। এই ছোটো ছোটো ছেলেরা যে বল পিটিয়ে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি নিয়ে যেতে পারে তা কল্পনাতীত। দেলোয়ার ব্যাট করছিলো। বল পেয়ে হাঁকালো ও। বল গিয়ে পড়লো পাশের বাড়ির নয়নের মা’র ঠিক কোলে। তিনি খোলা আকাশের নিচে বসে রান্না করছিলেন। বল খুঁজতে গিয়ে নয়নের মা’র বকুনি শুনে ওরা বাড়ি ছাড়া। সন্ধ্যার পরও বাড়ি ফেরার নামগন্ধ নেই। যার ভেতর এত ভয় সে কিনা সারাক্ষণ দুষ্টুমি করে বেড়ায়।
ঠিক তার দু’দিন পর। নয়নের মা’র ছাগল হারিয়ে যায়। খুঁজতে খুঁজতে মহিলা অস্থির। শেষমেশ দূরে এক জঙ্গলে পেলেন। ছাগল তো পেলেন কিন্তু ঘটলো আরেক বিপত্তি। ছাগলের গলায় তাবিজের মতো কী যেনো ঝুলানো। কাঁপা হাতে খুললেন। এক টুকরো কাগজে বড় বড় অক্ষরে লেখা, ‘ও নয়নের মা! আর যেও না বেড়ে, ফের কাহিনী করলে আবার খাইবো ছাগল কেড়ে।’ পরিশেষে স্বীকার গেলো এটা সিয়ামদেরই কাজ।
সব রিপোর্ট তো ভাইয়ার কাছে। ভাইয়ার আজকের উত্তেজিত কথায় সিয়াম বেশ চিন্তিত। ভাবছে। একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হলো। সব ঠিকই থাকবে। গাড়ির মোড় অন্য দিকে ঘুরিয়ে দিবে।
পরদিন স্কুলে গেলো। লাঞ্চের সময় ওরা স্কুলের পেছনটায় একসাথে বসলো। সিয়াম, দেলোয়ার, হৃদয়, দীনার ও সাকিব। উদ্যোগটা সিয়ামের। ওদেরকে ওই ডেকে এনেছে। বড়সড় কোনো দুষ্টুমি করলে ওরা এভাবে শলাপরামর্শ করে। সবাই একযোগে বললো, আজকে কোনো স্পেশাল দুষ্টুমি আছে নাকি সিয়াম? ও মুচকি হাসলো। এরপর ও মনের কথাগুলো খুলে বললো। দেখ, আমরা আজ কিশোর হলেও আগামীর কর্ণধার কিন্তু আমরাই। আমরা এতদিন অনেক দুষ্টুমি করেছি। যা বলার মতো নয় এমন কাজও করেছি। এখন যে সম্পূর্ণ ছেড়ে দিবো, তাও নয়। দুষ্টের শিরোমণি ছিলাম আমরা। আজকে থেকে শিষ্টের শিরোমণি হতে চাই। এখন থেকেই আমরা সমাজে অবদান রাখতে চাই। হৃদয় কথা বলে উঠলো, বুঝলাম। কিন্তু কিভাবে? সিয়াম বললো, আরে বাবা! সে কথাই তো বলতে যাচ্ছিলাম। দীনারের থাতানি, ওকে বলতে দাও। সিয়াম আবার বলতে লাগলো, আমাদের স্কুল থেকেই শুরু করবো। কেউ কারো ওপর জুলুম করতে পারবে না। ছোটোদের মারপিট করা। বসার ক্ষেত্রে শক্তিমানরা দুর্বলদের সাথে যে বৈষম্যমূলক আচরণ করে তা করতে পারবে না। চুরি বা দুষ্টুমি করে কারো টিফিন খেয়ে ফেলা। আমাদের শিষ্টের দল তার একটা বিহিত করে ছাড়বে। আমাদের কেউ অসুস্থ হলে আমরা তার সেবায় এগিয়ে যাবো।
এমন সময় ঘণ্টা পড়লো ক্লাসের। সব বন্ধু উঠে সুষ্ঠু এক প্রতিজ্ঞা নিয়ে ক্লাসের দিকে ছুটলো।