শৈশবকাল মানে ছোটবেলার সময়টা প্রত্যেক মানুষের জীবনে চমৎকার আনন্দময় মধুর নানা ঘটনার সমাহার হয়ে থাকে। বড়বেলায় এসে এখন মনে হয়, আহা, কী দারুণ একটা সময় ছিল তখন। কত স্মৃতি এসে ভিড় করে মনের পর্দায়। সেই সময়গুলোতে ফিরে যাওয়ার যদি কোনো উপায় থাকতো। এখন বিভিন্ন সায়েন্স ফিকশন, গল্প, উপন্যাস, চলচ্চিত্রে দেখি- টাইম মেশিনে করে কেউ ইচ্ছে করলে শত বছর আগের কোনো সময়ে অথবা ভবিষ্যতের ১০০ বছর পরের সময়ে ঘুরে আসছে। সে রকম কোনো সুযোগ থাকলে ১০০ বছর নয়, আমি আমার শৈশবকালের সেই আনন্দময় ভুবনে ফিরে যেতাম। শৈশব মানেই আনন্দময়, উজ্জ্বল-উচ্ছল, প্রাণবন্ত, দুরন্ত একটা সময়। যখন জীবনের জটিলতা, দুশ্চিন্তা, অনিশ্চয়তা, ভয়, শঙ্কা কিছুই স্পর্শ করে না।

আমার শৈশব কেটেছে চট্টগ্রাম শহরে। তখন অবশ্য আজকের মতো এতোটা জনবহুল, ব্যস্ত, জমজমাট হয়ে ওঠেনি বন্দর নগরী হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রাম শহরটা। আমার প্রথম স্কুল ছিল হামিদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। প্রথম শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার সুযোগ ছিল সেখানে। বাসার কাছেই স্কুল। হেঁটে যেতে মাত্র কয়েক মিনিট লাগতো। তারপরও আগেভাগেই চলে যেতাম স্কুলে। স্কুলের সামনে মোটামুটি বড় আয়তনের একটি মাঠ ছিল। মাঠের দু’পাশে দুটি বড় বড় গাছ ছিল। স্কুলের ক্লাস শুরুর আগে সেই মাঠে অ্যাসেম্বলি হতো। আমরা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়াতাম। জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার পর শপথবাক্য পাঠ হতো। তারপর হালকা শরীর চর্চা মানে ড্রিল করানো হতো। এরপর সারিবদ্ধভাবে যার যার ক্লাসে সুশৃঙ্খল হয়ে চলে যেতাম। একটানা দুপুর পর্যন্ত ক্লাস হতো। স্যারদের কাছে আগের দিনের দেওয়া হোমওয়ার্ক জমা দিতে হতো ক্লাসের শুরুতে। হোমওয়ার্কের খাতা দেখে স্যার লালকালিতে স্বাক্ষর দিতেন। তারপর ক্লাসে পড়ানো শুরু করতেন। এর ফাঁকে আগে পড়ানো বিষয়গুলো থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতেন। পড়া শেখা থাকলে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে সমস্যা হতো না। যারা ঠিকমতো উত্তর দিতে পারতো না তারা কেউ কেউ স্যারের বকুনি খেতো। আবার অনেক সময় স্যার লম্বা বেত নিয়ে ক্লাসে আসতেন। স্যার পড়া জিজ্ঞেস করলে আর না পারলে সেই বেতের শপাং শপাং আঘাত পড়তো হাতে নয়তো পিঠে। বেত্রাঘাতের ভয়ে বেশির ভাগই পড়া শিখে ক্লাসে আসতো। কাছে বাসা হওয়ায় দুপুরে ভাত খাওয়ার জন্য যাওয়ার সুযোগ ছিল। দ্রুতই খেয়েই আবার চলে আসতাম স্কুলে। টিফিন পিরিয়ডে মানে দুপুরের বিরতিতে আমরা সবাই স্কুলের মাঠে খেলাধুলায় মেতে উঠতাম। কেউবা গাছের ছায়ায় বসে গল্প করতাম। তখন গরমের দিনে গ্রীষ্মকালীন ছুটি থাকতো স্কুলে। যাকে আমরা তখন ‘আম কাঁঠালের ছুটি’ বলতাম। তখন সত্যি সত্যি আম কাঁঠালের দিন থাকতো। আমরা তখন দাদাবাড়ি, নানাবাড়িতে বেড়াতে যেতাম। তখন গাছে গাছে আম-কাঁঠালের ছড়াছড়ি। এছাড়াও আনারস, জাম, লিচু, লটকন আরো কত কী ফল! গাছের নিচে বসে কাঁচা আমের চাটনি, ভর্তা খেতে খেতে প্রচণ্ড ঝালে দু’চোখ বেয়ে পানি বেরিয়ে আসতো। তারপরও ভর্তা খাওয়া চলতো। ভর্তা খেয়ে ঝাল লাগলে পানি খেতে চাইলে বাধা দিতেন মুরুব্বিরা। কারণ, তারা ভয় দেখাতেন ভর্তা খেয়ে পানি খেলে পেটে অসুখ করতে পারে। তারপরও লুকিয়ে লুকিয়ে পানি খেয়ে ফেলতাম।

বর্ষার দিনে দাদাবাড়িতে নৌকায় চড়ে যেতে হতো। চারদিকে থৈ থৈ পানি। এর মধ্যে দিয়ে আমাদের নিয়ে ছইয়ের নৌকাটি তর তর করে ভেসে যেতো। আমরা নৌকার ছইয়ের ভেতর বসে থাকতাম ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে। কারণ, শহর থেকে গিয়ে বর্ষায় গ্রামে বিলের টইটম্বুর এত পানি দেখে ভয় পেয়ে যেতাম। তারপরও সেই ভয় দূর করে সাহস জাগাতে নৌকার ছইয়ের ভেতর থেকে আমাদের ভাইবোনদের বাইরে কোলে নিয়ে এসে দাঁড়াতেন আব্বা। বর্ষায় গ্রামের বিলের অপরূপ দৃশ্য দেখাতেন আর কত কী গল্প বলতেন। যা শুনতে শুনতে অদ্ভুত এক অনুভূতি ছড়িয়ে পড়তো মনে। ধীরে ধীরে সব ভয় শঙ্কা কেটে যেতে। নৌকায় বসে বিলের শাপলা ফুল, কচুরিপানা, লতাপাতা দেখতাম মুগ্ধ হয়ে। হাত দিয়ে নৌকার আশপাশের ভেসে থাকা শাপলা, কচুরিপানা, লতাপাতাগুলো স্পর্শ করতাম। তখন কেবলই মনে হতো- আহা, এভাবে যদি নৌকায় চড়ে সারাটি জীবন বর্ষার বিলে ঘুরে বেড়াতে পারতাম।

শীতের সময় বার্ষিক পরীক্ষা শেষে দাদাবাড়ি, নানাবাড়ি, মামা-ফুপুদের বাড়ি বেড়াতে যেতাম। কুয়াশায় চাদর মোড়ানো শীতের সকালে গরম গরম পিঠার আয়োজন থাকতো। সারারাত ধরে পিঠা বানানোর কত কী প্রস্তুতি চলতো। কিছুক্ষণ কৌতূহলী হয়ে দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়তাম। সকালবেলা ঘুম ভাঙতেই গরম গরম নানা পিঠার পসরা সাজানো দেখতাম। সেই গরম গরম ভাঁপা পিঠার মধ্য থেকে ধোঁয়া উড়ছে। আব্বা, আম্মা কিংবা দাদা-দাদি, চাচা, জ্যাঠা-জেঠি সেই গরম গরম পিঠা আমাদের মুখে তুলে দিতেন। কী অদ্ভুত স্বাদ সেই পিঠার! সেই হরেক রকম পিঠার স্বাদ আজও যেন মুখে লেগে আছে। শীতের সময় গ্রামের ধানক্ষেতের আল ধরে অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে যেতাম। তখন ধান কাটা শেষ হয়েছে। সেই ফসলের মাঠগুলোতে গ্রামের ছেলে-মেয়েরা কত কী খেলাধুলায় মেতে উঠতো। কেউ ঘুড়ি ওড়াতো। কারো ঘুড়ি কাটা যেত। কাটা ঘুড়ি ধরতে তখন সবার মধ্যে কী হুড়োহুড়ি, ছুটোছুটি। কেউ আবার হাডুডু, দাড়িয়াবান্ধাসহ নানা ধরনের খেলায় মেতে উঠতো। সেই সব খেলায় কখন অংশ নিয়ে আবার কখনও দর্শক হয়ে অনাবিল আনন্দ উপভোগ করতাম। নির্মল বিনোদনের পাশাপাশি শরীর চর্চার চমৎকার উপায় ছিল সেই সময়ে গ্রামীণ খেলাধুলাগুলো।

তখন শৈশব কৈশোরে সারল্য আর নিষ্পাপ বন্ধুত্বের বন্ধনে জড়িয়ে থাকতো সবাই। হিংসা, বিদ্বেষ, হানাহানি, অসুস্থ প্রতিযোগিতা, ধনী-গরিবের বৈষম্যমূলক মনোভাব ছিল না কারো মনের মধ্যে। নিঃস্বার্থভাবে একজন আরেকজনের বিপদে-আপদে, সমস্যা-সঙ্কটে ছুটে যেতাম। আনন্দ-বেদনা সবই ভাগাভাগি করে নেওয়াটাই যেন ছিল প্রকৃত সুখ। কেউ কাউকে কিছু দিয়ে প্রতিদানে কিছু পাওয়ার আশা করতোনা। বন্ধুর জন্য, প্রতিবেশীর জন্য, আত্মীয়, প্রিয়জন, স্বজনের জন্য নিজেকে নিবেদন করাটাই যেন ছিল ধর্ম। একজনের পাশে আরেকজনের নিঃস্বার্থ সহযোগিতাই ছিল সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

আমি বিশ্বাস করি, আজকের শিশুরাই আগামী দিনে জাতির ভবিষ্যৎ। আগামী দিনে দেশ গড়ার নেতৃত্ব দেবে আজকের শিশুরাই। তাই তাদেরই গড়ে তুলতে হবে আগামীর উপযোগী করে। শৈশব-কৈশোরে বই পড়ার অভ্যাস ছিল আমার। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই গল্প উপন্যাস ছড়া কবিতার পড়ার অভ্যাস শুরু। আজকের শিশু, কিশোর-কিশোরীরা কম্পিউটার, ইন্টারনেট, ফেসবুক, মোবাইল আর এসব এমএস কালচারে যতটা মগ্ন, সে তুলনায় তাদের বই পড়ার সময় যেন একেবারে কমে গেছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ক্রমেই প্রযুক্তির প্রতি নির্ভরতা বাড়ছে। আর যুক্তিহীন বহু প্রযুক্তির ভিড়ে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে যুক্তি-বুদ্ধির রসদ জোগানো বই পড়ার অভ্যাসটি।

ফেসবুকের এই যুগেও মননশীল বই, গল্প উপন্যাস নতুন কিছু সন্ধান দিতে পারে। অনেকেই হয়তো ভাবছো, সবাই বই পড়ার উপদেশ দেয়। তাদের জন্যও বিষয়টা নতুন করে খানিকটা ভাবনার বৈকি। তোমার আশপাশে কেউ বই পড়ে না, কিংবা এখন মুভি দেখা, গান শোনা, ফেসবুকে ঢুঁ মেরে মোবাইলে ঘণ্টার পর কথা বলে ঘণ্টা সময় পার করে। বিনোদন বা অবসর কাটানোর জন্য বেশি সহজলভ্য উপায় ইত্যাদি যুক্তিতে হয়তোবা সেভাবে বই পড়ার চেষ্টাটা কখনও করে দেখোনি। কিন্তু অন্যের কথা না শুনে যদি বছরে অন্তত দু’একটা ভালো বইও পড়ে দেখতে তাহলে হয়তো আজ এই কথা বলার প্রয়োজন হতো না । তা ছাড়া অন্যের কথা শুনে বা অন্যরা করে না এই অজুহাতে বই পড়ার আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত করাটাও হয়তো বুদ্ধিমানের কাজ নয়। অনেকেই হয়তো যুক্তি দেখিয়ে বলতে পারো, পড়াশোনায় টিকে থাকার প্রয়োজনে এমনিতেই অনেক অনেক পাঠ্য বইপত্র পড়তে হয় তাতেই আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। তার উপর বাড়তি কোন পড়ার ঝামেলায় নিজেকে জড়ানো মানেই বাড়তি সমস্যায় পড়া। তবে এসবই কিন্তু যারা বই পড়ে না তাদের খোঁড়া যুক্তি। নইলে প্রতিটি গল্প উপন্যাসের বই মনের জানালাটাকে যেভাবে প্রশস্ত করে সেই জানালা গলিয়ে পৃথিবীটাকে দেখা যায় ছোট পর্দায় চাইতেও বড় আঙ্গিকে। আবার আজ তোমার যে বন্ধুরা সবার আগে কোন মুভি দেখে গর গর করে কাহিনীর ‘টুইস্ট’ বলে বাহবা কুড়াচ্ছে, তাদের সামনে একবার তোমার বই পড়–য়া জ্ঞানটা জাহির করেই দেখিয়ে দাও না। নেহাত বোকা কিংবা অহঙ্কারী কেউ না হলে তোমার এই জ্ঞান বন্ধুদের মুগ্ধ করতে বাধ্য। আবার পড়ার অভ্যাসটা ভালো করে রপ্ত করতে পারলে সেটা আখেরে কাজ দেবে তোমার অ্যাকাডেমিক পারফরম্যান্সেও। এ কথা হয়তো ঠিক যে আজকালকার প্রযুক্তিনির্ভর বিনোদনের মাঝে বই সংগ্রহ করে বা বই কিনে পড়াটা মোটেও সহজসাধ্য কাজ নয়। কিন্তু একবার চেষ্টা করে হলেও নিজের রুচিমতো একটা বই যদি আপনি পড়তে পারো তবে ‘বই পড়া’র প্রেমে না পড়ার কোনো কারণই নেই। এ ক্ষেত্রে তোমার পাল্টা যুক্তি থাকতে পারে, এত কিছু থাকতে বইয়ের প্রেমেই কেন জোর করে পড়তে হবে। উত্তরটা যদি একবাক্যে জানতে চাও তাহলে বলব, একটা ভালো বই তোমাকে যেভাবে জীবন নিয়ে ভাবতে শেখাবে মুভি কিংবা ফেসবুকে ঢুঁ মেরে, হেডফোন লাগিয়ে এফএম রেডিও কিংবা এমপি থ্রি শুনে তা পারবে না কোনোভাবেই। সেগুলোর সে সাধ্য নেই বললেই চলে। টিএনএজ বয়সের হৈ হুল্লোড়ের মাঝে জীবন নিয়ে ভাববার প্রয়োজনও হয়তো তোমাদের নেই। বই পড়া মানেই কিন্তু মুখ গম্ভীর করে ইন্টেলেকচুয়াল ভাব নেয়া নয়। বরং একটা অ্যাকশন মুভির পরিবর্তে নজরুল, ফররুখ, আল মাহমুদের বই, ফেলুদা, জেমস বন্ড বা মাসুদ রানা সিরিজের বইগুলো কিন্তু কম আনন্দময়, রোমাঞ্চকর নয়। বই পড়তে গিয়ে টিভি, মুভি, গান, ফেসবুক ইত্যাদিকে নির্বাসনে পাঠাতে হবে তারও কোন যুক্তি নেই। বরং এসব কিছুর পাশাপাশিই বই পড়া চলতে পারে। যেখানে তোমার আর সব বন্ধু-বান্ধবীই মুভি আর গানের ভাবনায় আপনার চাইতে কোন অংশে কম যায় না। সেখানে বই পড়া তোমাকে একটা দিকে হলেও এগিয়ে রাখতে পারে অন্য সবার চেয়ে। আর বই কেন পড়বে এ নিয়ে তারপরও যদি তোমার মনে দ্বিধা থাকে তাহলে দ্বিধা কাটাতে না হয় নিজের পছন্দের আর ভালোলাগার একটা ব্যতিক্রমধর্মী জায়গা তৈরি করতে বরং এসবের পাশাপাশি অন্য কোনো বই একবার পড়েই দেখোনা।

Share.

মন্তব্য করুন