-মা, দেখো কী সুন্দর একটা পাখির বাচ্চা।
-এই সাত-সকালে পাখির বাচ্চা কোথায় পেলি?
-আমাদের উঠানে পড়ে ছিল। মনে হয় ডানায় ব্যথা পেয়েছে, তাই উড়তে পারছে না।
-রহিমা, রুটিটা একটু দেখতো।
বিলকিস বেগম রান্নাঘর থেকে বেরিয় ছেলের কাছে এসে দেখলেন, হলুদ রঙের ডানাওয়ালা সুন্দর একটি পাখির বাচ্চা চিঁ চিঁ করছে রুমির দুই হাতের ভিতর। আসলেই ডানায় আঘাত পেয়েছে, তাই নড়াচড়া করতে পারছে না বেচারা। বোধ হয় কোন গাছের ডাল থেকে অসাবধানে পড়ে গেছে। সামনে পিছনে জায়গা নিয়ে বিশাল একটা দুই তলা বাড়ি রুমিদের। পিছনে বাগান, আর সামনের উঠানও অনেক গাছপালায় ভর্তি। হয়তো বা তারই একটা গাছ থেকে পড়ে গেছে বাচ্চাটা।
ইতোমধ্যে রুটি বানানো শেষ করে রহিমা চলে এসেছে রান্নাঘর থেকে। দুনিয়ার কৌতূহল নিয়ে পাখিটা দেখে বললো, এ মা, কী সুন্দর পাখি! জানো রুমি ভাইয়া, আমাদের গ্রামেও এই রকম সুন্দর সুন্দর পাখি পাওয়া যায়। আমরা ছোট কালে কত খেলেছি।
মেয়েটা কিছু দিন হয় গ্রাম থেকে এসেছে। বয়স কতই বা হবে, সাত অথবা আট! আনোয়ার সাহেবের এক মক্কেল নিয়ে এসেছে। মেয়েটা খুব চঞ্চল এবং কৌতূহলী। সে যে আলাপই করুক না কেন, তার মধ্যে তাদের গ্রাম থাকবেই। আরও একটা ব্যাপার, তা হলো, মেয়েটা প্রচুর হাসে, কথা শুরুর আগে একবার এবং কথা শেষ করে আর একবার। তবুও এই অল্প দিনের মধ্যে বিলকিস বেগমের মনে জায়গা করে নিয়েছে সে। এখন বিকেলের অবসরে বিলকিস বেগমের একটি অন্যতম কাজ হলো, মাথায় তেল দিয়ে রহিমার চুল বেঁধে দেওয়া এবং রহিমার গ্রামের গল্প শোনা। হয়তো রহিমার গল্পের ভিতরে অবচেতন মনে বিলকিস বেগম খুঁজে পায় তার হারানো শৈশব, আর ফেলে আসা গ্রাম। তার কোনো মেয়ে নেই, দুইটি ছেলে, রন্জু ও রুমি। রন্জু ঢাকার একটি নামকরা কলেজে পড়ে, এবার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবে।
-মা, মহব্বত ভাইয়াকে বলো না একটা খাঁচা কিনে আনতে। আমি পাখিটা পুষবো মা।
-রহিমা, দেখতো মহব্বত কোথায়?
বিলকিস বেগমের কথা শেষ না হতেই রহিমা নিচে নামার সিঁড়ি পর্যন্ত চলে গেছে। মহব্বত হলো এ বাড়ির লজিং মাস্টার। স্থানীয় কলেজে পড়ে, রন্জুর বয়সী। রুমিকে পড়ানো এবং বাড়ির বাজার-ঘাট করা তার কাজ।
আজ শুক্রবার। ছুটির দিন, তাই সকালে ঘুম থেকে দেরি করে উঠেছে রুমি। দোতালার বারান্দায় এসেই পাখির বাচ্চাটাকে দেখতে পেয়েছে সে। শুক্রবার না হলে খেয়াল করার সময় পেতো না। কারণ, প্রতিদিন ভোরে ফজরের নামাজ পড়েই হুজুর চলে আসে রুমিকে কুরআন পড়াতে। তারপর স্কুলের পড়া, নাশতা করে করে সকাল আটটার মধ্যে স্কুলে যাবার জন্য রেডি হতে হয়। কোনো কিছু খেয়াল করার সময় থাকে না তার হাতে। আসলে এখনকার বাচ্চারাও বড়দের মতোই ভীষণ ব্যস্ত।

আজ কোর্ট বন্ধ। তাই আয়েশ করে বারান্দায় বসে চা পান করছেন আনোয়ার সাহেব। এই মফস্বল শহরের একজন নামকরা আইনজীবী তিনি। রহিমাকে হন্তদন্ত হয়ে নিচতলা থেকে আসতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
-কী রে রহিমা, এতো দৌড়াচ্ছিস কেন?
-খালুজান, মহব্বত ভাইরে খালাম্মা বাজারে পাঠাইছে পাখির খাঁচা কেনার জন্যি। তাই বলতি গিছিলাম।
-পাখির খাঁচা দিয়ে তোর খালাম্মা কী করবে?
-খালাম্মার জন্যি না। রুমি ভাইয়ার জন্যি। রুমি ভাইয়া একটা পাখির বাচ্চা পাইছে, তারে পোষার জন্যি একটা খাঁচা লাগবে।
-রুমি কোথায়? ডাক।
-রান্নাঘরের বারান্দায়, খালাম্মার সাথে কথা বলতিছে। আমি এক্ষুনি ডেকে দিচ্ছি।
রহিমা চলে যাবার পর রুমি এসে হাজির হলো।
-আব্বা, আমাকে ডাকছিলে?
-হ্যাঁ, সকাল সকাল কী নিয়ে ব্যস্ত তুমি?
-কিছু না, আব্বা।
-কিছু না, মানে? তাহলে পাখির খাঁচা দিয়ে কী হবে?
-না, মানে আব্বা, একটা ছোট পাখির বাচ্চা উঠানে পড়ে কাঁদছিলো, তাই ভাবলাম …
-তা তুমি বুঝলে কী করে, যে কাঁদছিলো?
রুমি আর কোনো কথা বাড়ালো না। চুপচাপ মাথা নিচু
করে দাঁড়িয়ে থাকলো। যদিও আনোয়ার সাহেব খুব রাশভারী মানুষ, কম কথা বলেন, কিন্তু রুমিকে কখনই মারেন না। তবু রুমি আব্বাকে প্রচুর ভয় পায়। অথচ সেই তুলনায় মায়ের হাতে প্রায়-ই হালকা-পাতলা পিটুনি খায় সে। তবু মা-কে মোটেও ভয় পায় না এবং মনের কথা নির্দ্ধিধায় বলতে পারে সে। রুমি মনে মনে ভাবতে থাকে, ‘আচ্ছা, পৃথিবীর সবার বাবা-ই কি তার আব্বার মতো। যাকে দেখলেই ভয় লাগে!’
আসলে শিশুদের মনস্তত্ত্ব বড়ই অদ্ভুত।
আজ রুমি বন্ধুদের সাথে খেলতে যায়নি। সারা দিন খুব ব্যস্ততার মধ্যে কাটলো তার। খাঁচার ভিতরে যাতে বাচ্চাটা থাকতে পারে, তাই কাগজ কেটে একটা মোটা পাটাতন বানিয়ে দিলো মহব্বত ভাইয়া। পানি এবং খাবার খাওয়ার জন্য দু’টি ছোট বাটি খাঁচার ভিতরে ঢুকিয়ে দিয়ে, বারান্দার দুই পিলারে আড়া-আড়ি একটি দড়ি টানিয়ে, সেই দড়িতে খাঁচাটা ঝুলিয়ে দিলেন ভাইয়া, যাতে বাচ্চাটার কোনো ক্ষতি না হয়।
-জান রুমি, তোমার মতো ক্লাস ফোর-এ থাকতে একবার আমার নানার সাথে পাখি শিকার করতে গিয়েছিলাম। নানার একটা ছররা বন্দুক ছিলো। ঐ বন্দুক দিয়ে পাখির ঝাঁকের উপর গুলি করলে, এক গুলিতে অনেক পাখি মারা যেতো। তো নানা ভাই যখন গুলি করলো, আমরা দৌড়ে গেলাম পাখি খুঁজতে। অনেক পাখি পেয়েছিলাম, তার ভিতরে এই রকম একটা ছোট পাখি মরে পড়ে ছিলো। তাই দেখে আমার মনটা খুব খারাপ হয়েছিলো। তারপর থেকে আমি আর কোনদিন পাখি শিকারে যাইনি।
-ভাইয়া, পাখিটা বাঁচবে তো?
-দেখে মনে হচ্ছে আঘাত গুরুতর না। দু-এক দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যাবে।
মহব্বত ভাইয়ার কথা শুনে রুমি কিছুটা আশ্বস্ত হলো। কিন্তু তারপরও মনের মধ্যে একটা সন্দেহ খচখচ করতে লাগলো, ‘বাচ্চাটা যদি আর উড়তে না পারে?’ চিন্তা করতে করতে রাতে ঘুমিয়ে পড়লো রুমি।

পাখির বাচ্চাটা পাওয়ার পর দুই দিন কেটে গেছে। এই দুই দিনে রুমির দৈনন্দিন জীবনে এসেছে এক পরিবর্তন। আগে যে রুমি বিকালে বন্ধুদের সাথে পাড়ার মাঠে খেলতে যেতো, এখন সে স্কুল থেকে এসে পাখির বাচ্চাটা নিয়ে পড়ে থাকে। তাকে খাওয়ানো, ছাদে খোলা বাতাসে নিয়ে যাওয়া, এই সব করতেই রুমির দিন পার হয়ে যায়। তারপর সন্ধ্যায় মহব্বত ভাইয়ার কাছে পড়তে বসে। ইতোমধ্যে বাচ্চাটা পাওয়া থেকে শুরু করে, এ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া যাবতীয় ঘটনা বর্ণনা করে ভাইয়াকে চিঠি দেয়া হয়ে গেছে। মোটকথা রুমির জীবন এখন স্কুল-পড়া এবং পাখি। আসলে এই বয়সের বাচ্চারা নতুন কিছু পেলে, তাই নিয়েই পড়ে থাকে, সেই ভাবে তাদের চিন্তার জগৎ সাজায়ে নিয়ে, সেই জগতে বসবাস করতে শুরু করে। রুমিও এর ব্যতিক্রম নয়।

প্রতিদিনের আদালতের নথি প্রস্তুত করে উপরে আসতে রাত ১১টা থেকে সাড়ে ১১টা হয়ে যায় আনোয়ার সাহেবের। বাড়ির নিচতলায় উনার বিশাল চেম্বার। ইতোমধ্যে রুমি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বিলকিস বেগম স্বামীর প্লেটে ভাত বেড়ে দিচ্ছেন,
-তোমার রুমির খবর কী?
-খবর কী মানে? ভালো, রোজ স্কুলে যাচ্ছে, মন দিয়ে লেখাপড়া করছে।
-সব ঠিক আছে, কিন্তু পাখি নিয়ে পাগলামিটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না?
-বেশি হবে কেন? ছেলেমানুষ, একটা আহত পাখির বাচ্চা পেয়েছে, তাকে যত্ন করছে।
-ওকে, কিন্তু শুনলাম ইদানীং সব কিছু বাদ দিয়ে শুধু পাখির পিছনে পড়ে আছে তোমার ছেলে।
বিলকিস বেগম বুঝতে পারলেন, স্বামী সব খবরই রাখেন। তবু ছেলের পক্ষ নিয়ে বললেন, এই বয়সে পাখির বাচ্চা নিয়ে খেলবে না তো কী নিয়ে খেলবে? তা ছাড়া জীবনটা তোমার আদালতের এজলাস নয়, যে সব সময় যুক্তি দিয়ে কাজ করতে হবে। জীবনে আবেগেরও দরকার আছে।
-ও আচ্ছা, তাহলে আমার কোনো আবেগ নেই!
-আমিতো তা বলিনি। আর কয়েকটা দিন যাক। পাখিটা সুস্থ হোক, ওড়ার মতো হলেই ছেড়ে দেবো। তুমি চিন্তা করো না।
বিগত দশ দিন যাবৎ রুমির সারা দিনের রুটিনে আজ ছেদ পড়েছে। প্রতিদিন স্কুল থেকে এসে, বইয়ের ব্যাগ ঘরে রেখে, পাখিটাকে খাবার দেওয়া ও পানি পান করানোই ছিল রুমির প্রধান কাজ। তারপর সে গোসল করে দুপুরের খাবার খেতে যেতো। কিন্তু আজ স্কুল থেকে এসে সে দেখতে পেলো, পাখির খাঁচা খোলা পড়ে আছে, ভিতরে পাখি নেই। রুমির মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। হাত-পা ছেড়ে সে বারান্দার মেঝেতে শুয়ে কান্না শুরু করে দিলো।
-মা, আমার পাখি কোথায়?
মা আগে থেকে প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। ছেলেকে কিছু বুঝতে না দিয়ে, ছেলের সাথে কষ্ট পাবার অভিনয় করতে লাগলেন। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ছেলেকে গোসল করিয়ে খাবার দিতে বসলেন। রুমির মন তখনও খারাপ, খেতে চাচ্ছে না।
-আচ্ছা রুমি, কেউ যদি তোকে জোর করে আটকে রেখে বলে, ‘তোমাকে রোজ আইসক্রিম খাওয়াবো, কিন্তু মায়ের কাছে যেতে পারবে না। এখানে বন্দি থাকতে হবে’ তুই রাজি হবি?
-না, মা।
-তবে? পাখিটারও তো একটা পরিবার আছে, মা আছে। ওরও তো অধিকার আছে মায়ের কাছে থাকার। ঠিক কি না?
-ঠিক, মা।
-তা ছাড়া একটা পাখি যদি স্বাধীন ভাবে উড়তে না পারে, সারা জীবন যদি খাঁচায় বন্দি থাকে, তবে সেটা তো পাখি নয়। বল্, ঠিক কি না?
-ঠিক, মা।
-বিশাল আকাশে পাখিরা যখন ডানা মেলে ইচ্ছে মতো ওড়াউড়ি করে, কেবল তখনই তারা পাখি, তারা সুন্দর, খাঁচায় বন্দি অবস্থায় না।
মা সব সময় আদর করে যুক্তি দিয়ে বোঝায় বলে, সে যত দুষ্টুমি করুক না কেন, শেষে মায়ের সব কথা মেনে নেয়। আজও মেনে নিলো। তবুও সে বুকের ভিতরে কোথায় যেন একটা কষ্ট অনুভব করে।
রুমির যখন মন খুব খারাপ হয়, তখন সে একা ছাদে গিয়ে বসে থাকে। তাই সে খাওয়া শেষ করে ছাদের যে দিকটায় চিলেকোঠার ছায়া পড়েছে সে দিকে গিয়ে মন মরা হয়ে বসে থাকলো। কিছুক্ষণ পর আকাশে পাখিদের ওড়াউড়ি দেখে সে অনুভব করে আকাশটা আসলেই বিশাল। অথচ এতো দিন সে এটা খেয়াল করেনি। আর এই বিশাল আকাশে ডানা মেলে ইচ্ছে মতো উড়ে চলা পাখিরাই সুন্দর, খাঁচায় বন্দি পাখিরা নয়। রুমির মন ভালো হয়ে গেলো। বিকালে রুমি মাকে বললো, মা, আমি খেলতে যাচ্ছি।
-ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি ফিরিস কিন্তু রুমি।
-জি, মা।
বিলকিস বেগম দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তার অবুঝ ছেলের দিকে তাকিয়ে মনে মনে এক মায়াময় হাসি হাসলেন। যে হাসি শুধু মায়েরাই হাসতে পারেন।

Share.

মন্তব্য করুন