ছেলেবেলার কথা খুব আবছা মনে পড়ে। চোখের পর্দা ভেদ করে সেই ছবি যখন জ্বলজ্বল করে তখন যে কী আনন্দ পাই তার কোনো তুলনা নেই। দু’টি বিষয় স্পষ্ট জেগে আছে মনে আমার। একটি আব্বার সঙ্গে শুক্রবারে জুমার নামাজ পড়তে যাওয়া। নামাজের জন্য মন যেমন টানতো তেমনি মনের ভেতরে বাতাসা বা ক্ষীরের বাসনাও আমাকে খুব টানতো। শুক্রবার তাই ছিলো আমার কাছে খুব আনন্দের দিন। নয়াবাড়ি নামে আমাদের একটি বাড়ি আছে, সেই বাড়ির দক্ষিণ পাশে ছিলো মসজিদ। আমাদের বাপ-দাদারাই ওই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। সেই মসজিদের সামনে চত্বরে একটি বড় আমগাছ ছিল। তারপরই বিশাল এক পুকুর। সেই পুকুরের ঘাটে নামাজিরা অজু করে মসজিদে ঢুকতেন। গতবার যখন বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখন দেখলাম পুকুরটি কিছুটা জৌলুশ হারিয়ে ক্ষীণকায় হয়েছে আর একটি টিউবওয়েল বসেছে অজুর জন্য। আর সেই বিশাল আমগাছটি চোখে পড়লো না।
আমার মনে আছে, ওই গাছের ছায়ায় পাড়ার ছেলেমেয়েরা জড়ো হতো। আমরা নামাজ পড়ে এলে কোনো না কোনো বাড়ি থেকে আসা ক্ষীর বা পায়েস নিতো তারা। হয়তো মানত করা সেই খাবার, সেটা আমরা বুঝতাম না। আমাদের মনের মধ্যে কেবল এটাই থাকতো যে আজ জুমার দিন আজ খাবার আছে। নামাজের সঙ্গে শিশুমনে এই লোভ মিশে একাকার হয়ে যেতো। কিংবা আসতো গুড়ের বাতাসা। নামাজের পর সেগুলো দিতেন তারা। আমরা হাত পাততাম বা কলার পাতা দিতো, তাতে ক্ষীর নিতাম।
আহা! সেই সব সোনালি দিনগুলো, বেড়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কিভাবে গেলো তা টের পেলাম না। আব্বা ছিলেন সামাজিক নেতা। আমাদের কিশোরবেলায় তিনি ছিলেন ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান বা প্রেসিডেন্ট। কিংবা গ্রামের মেম্বার। ফলে তিনি ব্যস্ত থাকতেন সব সময়ই। তার ওই ব্যস্ততার ফাঁক গলিয়ে আমরা বেরিয়ে এলাম নতুন দুনিয়ায়। মানে গ্রাম আর শহরের যৌথ জীবনে আমাদের নামাজ পড়াটা ধুয়ে গেলো। আমরা নাগরিক চেতনার বাতাস খেয়ে রাজনৈতিক চরিত্রে উঠে এলাম। হারালাম আমাদের শিশুজীবনের আনন্দবেদনার শৈশবকাল।
এটা গেলো আমার শৈশবের প্রাথমিক জীবনের ভাললোবাসা ও হারানোর কথা। আমার দাদিবুজি যেদিন মারা গেলেন, আমি তখন আরো ছোটো। বাড়ির লোকজন, পাড়ার লোকজন ভেঙে পড়েছে বাড়িতে। আমিও কাঁদছিলাম। আবার মন টানছিলো বাইরের দিকে যেতে। সকাল বেলায়ই এই ঘটনাটি ঘটেছিলো।
দাদি ছিলেন আমার প্রাণের উৎস। দিনের একটা সময় হলেই দাদিবুজি ইশারায় ডাকতেন আমাকে। আমি কাছে গেলেই তার টোনার ভেতর থেকে বের করতেন সবরিকলা। বলতেন, তোমার টিয়ায় দিয়া গেছে। কল্পনায় দেখতাম একটি সবুজ টিয়া পাখি ঠোঁটে করে কলা নিয়ে উড়ে এসে দাদির হাতে নামছে। তার হাতে কলাটি দিয়ে আমার নাম বলে আবার চলে গেছে। তখন একবারও মনে হতো না যে কেন অন্য ভাইদের কথা বলে কিছু তাদের দিতো না। কিংবা সেই ভাবনা আমার মনে কখনোই জাগতো না। দাদির টার্গেট ছিলাম আমি। তাই আমি কিছু চাইলেই তিনি কিছু না কিছু বের করে দিতেন তার বিশাল কাঠের সিন্দুক থেকে। তিনি ঘুমাতেন ওই সিন্দুকের ওপর। তার যত অস্থাবর সম্পদ ছিলো সে সবই থাকতো ওই সিন্দুকের ভেতর। আমি আব্বা-মায়ের সঙ্গে যতটা না ঘুমাতাম, তার চেয়ে বেশি শুতাম দাদির সঙ্গে, তার সিন্দুকের বিছানায়।
শালকাঠের সিন্দুক ছিলো সেটা। আমি ছাড়াও আমার কোনো না কোনো চাচাতো ভাই বিশেষভাবে অনুরোধ করে দাদির কাছে শুতে আসতো। হয়তো সেটা মাসে একবার। কিন্তু আমি ছিলাম তার প্রাণের তরফের সঙ্গী। সেটা আজ বুঝতে পারি। তখন বুঝতাম না।
সংসারের কাজ করতে করতে আমার মা যখন খুব ক্লান্ত হয়ে যেতেন তখন বিশ্রাম নিতেন আমাদের উঠোনের চিতল আমগাছের নিচে পাটি বিছিয়ে। গরমের দিন, হয়তো চৈত্র মাস বা বৈশাখ মাস। গাছে কাঁচা আম ঝুলছে। আমি হয়তো কালাচারা নামের গাছে উঠেছি আম পেড়ে ভর্তা খাবো বলে। চৈত্রের মেলা থেকে আম কাটার ছুরি কিনেছিলাম তামার ছেঁদা পয়সা দিয়ে বা দুই পয়সা দিয়ে। চিনিসাজ কিনেছিলাম। হাতিঘোড়া মাছ ইত্যাদির সাজ। তা খেতে নিয়ে কোনো ভাইয়ের সঙ্গে হয়তো ঝগড়া করেছি। সেই সব রাগ গিয়ে পড়লো আমার ওপর, দুপুরবেলা গাছে উঠার অপরাধের জন্য। মায়ের কাছে পাটিতে গিয়ে আম রেখে কাঁসার থালা আনতে গেছি। সঙ্গে নিয়ে এসেছি নুন আর কাঁচামরিচ। মা হঠাৎ করেই আমার পিঠে কিল বসালেন। আমি চিৎকার দিতেই রা রা করে উঠতেন দাদিবুজি।
গরমের দিনে আমাদের স্কুল হতো খুব ভোরে, বেলা উঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই। হাত-মুখ ধুয়ে কিছু মুখে দিয়েই স্কুলে চলে যেতাম। দশটায় ছুটির ঘণ্টা বাজলে, প্রায় দৌড়েই বাড়িতে ফিরতাম। আমাদের ছোটো পগারে (পুকুর) ঝাঁপিয়ে গোসল সারতাম। তারপর এসে গরম ভাত আর তরকারিতে খাবার শেষ করতাম। এটাই ছিলো প্রতিদিনের ঘটনা। তো, দুপুরের দিকে ক্ষুধা না লাগলেও শিশুর জিবে আমের টক আর কাঁচা বাসনা এসে হামলে পড়তো। আমাদের বাড়ি ভর্তি আম আর জাম গাছ। তিন শরিকির বিশাল বাড়ি আর বড় বড় উঠান। দাবড়িয়ে বেড়াবার জন্য যথেষ্ট। তাই যখন যে গাছের আম ভালো লাগবে ভাবতাম সেই গাছেই উঠতাম। দরবারি নামের একটি গাছ ছিলো মেজ চাচার শরিকি ভাগে। ঝুনকি নামের একটি গাছে ধরতো অনেক আম, ঝোপা ঝোপা, অনেকটাই লিচুর মতো ঝুলতো। কাঁঠালিচাপা নামেও আরেকটা ভালো জাতের আমের গাছ ছিলো। আমাদের বারবাড়ির চৌচালা ঘরের ওপরে ঝুঁকে পড়া আমগাছের আমগুলো হতো বেশ বড়। পাকলে রসে টইটম্বুর। কিন্তু আঁশওয়ালা। সেই আম চিপলে থালা ভরে যেতো। আমরা আম আর দুধ দিয়ে মিশিয়ে খেতাম। সেটা মূল খাবার ভাত খাবার পর। অনেকটাই আজকের ডেসার্টের মতো। আমাদের জন্য রোজিনা করা থাকতো গাভীর দুধ। আমাদের বাড়িতে কখনোই গরু পালতে দেখিনি কাউকে। আমাদের ধানী জমিগুলো ভাগী (বর্গা) দিয়ে চাষাবাদ করা হতো। বর্গাদাররা ধান কেটে এনে উঠোনে পালা দিয়ে রেখে যেতো। তারপর এক দিন কি দুই দিন পর এসে আমাদের উঠোনেই মলন দিয়ে ধান উঠাতো। তখন তারা গরু নিয়ে আসতো। চার-পাঁচটি গরুর মলনের পিছনে পিছনে আমরা বা আমি ঘুরে ঘুরে হাঁটতাম। এতেও মা খুব রেগে যেতেন। আমার দাদিও রেগে যেতেন। তিনি বারান্দায় মোড়ায় বসে গজ গজ করতেন। বলতেন, কতবার কইচি ওরে মলনে যাইতে দিবা না। রইদের মধ্যে কেমুন লাল অইয়া গেছে।
আমার গায়ের রং ফর্সা ছিলো। আজকে যেটুকু আছে তা ছেলেবেলার অর্ধেকেরও কম। লাল টকটকে, দুধে আলতায় মেশানো রং। আমার নানি বলতো লাল বলদ আমার। আমার মাও ছিলেন ধবধবা সাদা রঙের মানুষ। সুন্দর আর কুরআনের অসম্ভব ভালো তেলাওয়াতকারিণী। মায়ের কাছে পাড়ার অনেক তরুণী মেয়ে আসতো সিপারা পড়তে বা শিখতে। সুর করে, মাথা দুলিয়ে তারা সিপারা পড়তো। আমার নানাও ছিলেন মওলানা ও বিয়ের কাজি। নানা বাড়ির প্রত্যেকেই ছিলেন ফর্সা ধবধবা। সেই সুবাদে কিংবা আমার নানির সুবাদে মাও ছিলেন ধবধবা সুন্দরী। কিন্তু আমার দাদি ছিলেন তেলতেলে চামড়ার কালো রঙের শ্যামলা সুন্দরী। তাই আমার দাদার গায়ের রঙ পায়নি আব্বা। তিনি ছিলেন মসৃণ তুলতুলে শ্যামলা। আমি বা আমরা তার হাত ধরে সেই মসৃণতার সুখ পেতাম। একটা স্নিগ্ধতা সর্বদা লেগে থাকতো তার মুখে। তিনি ভালো ইংরেজি, ফারসি আর আরবি জানতেন। আমাকে, বিশেষ করে রাতের বেলায় তিনি বড় ভাই, মেজো ভাই এবং আমাদের ইংরেজি শব্দ শেখাতেন। অর্থ শেখাতেন। তাঁর সেই গলার আওয়াজ আমি আজো শুনতে পাই।
আমি যে খুব বেশি মার খেয়েছি মার হাতে, তা কিন্তু নয়। আব্বা কখনোই চড়-থাপ্পড় দেননি বা হাত তোলেননি। তিনি ওই কাজগুলো করতে জানতেন না। বাংলাঘরে সকাল থেকেই লোক আসতো নানা অভিযোগ নিয়ে। কখনো আব্বাকে দিয়ে কোনো দরখাস্ত লেখার জন্যও আসতো গ্রামের মানুষেরা। আব্বা বিনা ওজর-আপত্তিতে ওই সব কাজ করে দিতেন। আমরা ওই সময় বাংলাঘরে যেতাম না। বরং মায়ের কাছেই থাকতাম, তার আঁচলের নিচে থাকতেই বেশি ভালোবাসতাম। বেশি বিরক্ত করলে বা মায়ের কাছে অসুবিধা হলেই তিনি রেগে যেতেন। হয়তো তখন তিনি আমার পিঠে দুমদাম করে দুটো কিল বসিয়ে দিতেন। আমার কান্না আর চিৎকারেই দাদিবুজি বুঝে যেতেন কী ঘটেছে। তিনি সেখান থেকেই উঁচু গলায় বলতেন, তুমারে না কইছি ও তুমার শ্বশুরের লাগান হইছে। তুমি শ্বশুররে মারলা?
আমি বুঝলাম আমার দাদা লোকমান হাকিম খান ছিলেন ফর্সা সুন্দর চেহারার মানুষ।

২.
আব্বা আর মায়ের পড়ার রোগ ছিলো। একটু সুযোগ পেলেই আলমারিতে রাখা বই তিনি বের করে পড়তেন। আনোয়ারা নামের একটি বই মায়ের খুব প্রিয় ছিলো। আর ছিলো বিষাদসিন্ধু। আরো কয়েকটি উপন্যাসও তিনি পালা করে পড়তেন। বড় হয়ে আমাদের সেই গ্রামের লাইব্রেরিটি শূন্য হয়ে গেলেও, বাড়িতে অন্য বইয়ের তাক তৈরি হয়ে সেখানে জমেছিলো অনেক বই। অধিকাংশই বাংলা সাহিত্যের বই এবং উপন্যাসই তার মধ্যে বেশি। তখন বড় ভাই ড. মাহবুব সাদিক অনার্স পড়ছিলেন বাংলায়। সেই সুবাদে বই আসতো। তবে আমরা গ্রাম ছেড়ে টাঙ্গাইলের বাসায় উঠে আসলে বইগুলোও আমাদের সঙ্গে এলো। তখন মা পড়তেন বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাস।
আব্বার কাছে আসতো কলকাতা থেকে সেই পাকিস্তানি আমলে দৈনিক আজাদ আর কিছু ফারসি ভাষায় লিখিত বুকলেট। বোধ করি, সেগুলো হেকিমি দাওয়াই তৈরির রেসিপি। আব্বা সামাজিক কাজের পাশাপাশি হেকিমি করতেন। অনেকেই তার কাছে আসতেন দাওয়াই নিতে। তিনি টাকা নিতেন না। আমাদের আলমিরাতে সারা বছরই হজমির গুঁড়ো বয়ামে ভরা থাকতো। আমরাই ছিলাম সেই তেতো আর ঝালে মেশানো হজমির খাতক এবং সেই প্রস্তুতিতে আমরা ছিলাম আব্বার সহকারী। বিটলবণ, জষ্ঠীমধুসহ গাছ-গাছড়ার অনেক পদ তিনি টাঙ্গাইল শহরে গিয়ে কিনে আনতেন। সেগুলো হামান দিস্তায় ছেঁচে, গুঁড়ো করে হজমি হতো। পেটে সামান্য গোলমাল হলেই এক চিমটি হজমি নিয়ে জিভে দিতাম। পেটে গোল না বাধলেও হজমির স্বাদ রসনায় পড়তো। আর সেই সঙ্গে প্রায় রোজই আমরা আজাদ পত্রিকার ঘ্রাণ শুঁকে দেখতাম।

Share.

মন্তব্য করুন