সময়টা ২০২২ সালের জানুয়ারি শুরুর দিকে। শীতের আবহাওয়া তখন শেষ দিকে। শীতের শেষ দিকে আবহাওয়াটা খুবই সুন্দর থাকে। কনকনে শীত থাকে না। মৃদু বাতাসটা বেশ ভালো লাগে। এই সময়টাতে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। হুটহাট সিদ্ধান্তে আমরা পাঁচ বন্ধু সেন্টমার্টিন যাবো। মূলত এবার আমাদের লক্ষ্য ছেঁড়া দ্বীপ। এই দ্বীপে আমাদের প্রথমবার যখন সেন্টমার্টিন গিয়েছিলাম তখন যাওয়া হয়নি।
পাঁচ বন্ধু সময় ক্ষেপণ না করে পরদিনই রওনা দিলাম সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে। চট্টগ্রামের সিনেমা প্যালেস থেকে এস আলম বাসের টিকেট কাটলাম। চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফের টিকেট ৫০০ টাকা। রাতের ১২টায় গাড়িতে উঠলাম টেকনাফের উদ্দেশে। সারারাত গাড়িতে ঘুমিয়ে ভোর ৬টায় নেমে গেলাম টেকনাফে। আমরা বাস থেকে নেমেই প্রথমে জাহাজের টিকেট কেটে নিই। কেয়ারী জাহাজের তিনটা টিকেট নিয়েছি। ৮৫০ টাকা করে নিয়েছে। আসা-যাওয়ার জন্য এক টিকেট। টিকেট কাটার পর আমাদের দুই আড়াই ঘণ্টা সময় ছিলো। নাস্তা করা এবং ফ্রেশ হওয়ার পর আমরা জাহাজে উঠলাম প্রায় সাড়ে নয়টা-দশটার দিকে। আমরা জাহাজে উঠার ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে জাহাজ ছেড়ে দেয়। জাহাজের চারপাশে তখন গাঙচিল উড়ছিলো। জাহাজ যখন চলতে শুরু করে তখন হাজার হাজার পাখি জাহাজের চারপাশে উড়ছে। কী যে সুন্দর দৃশ্য! লিখে কিংবা বলে বোঝানো সম্ভব না। এই সাদা সাদা পাখিদের উড়তে দেখাটাই আপনার ভ্রমণের সার্থকতা ধরে নিতে পারবেন। এই দৃশ্য আর কোথাও পাবেন না। মজার বিষয় হচ্ছে যখনই জাহাজ নদী ক্রস করে সমুদ্রে নামলো তখনই গাঙচিলগুলো আর পিছু আসলো না। এটাই ওদের শেষ গন্তব্য।
এ ছাড়াও জাহাজ থেকে আপনি চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। মিয়ানমার সীমানা দেখতে পাবেন, বিভিন্ন জেলেদের মাছ ধরাও দেখতে পাবেন। সবমিলিয়ে প্রায় আড়াই ঘণ্টার বেশি এই জাহাজ ভ্রমণ আপনাকে এক সেকেন্ডও বিরক্ত করবে না। অনেকের কাছে সেন্টমার্টিন যাওয়ার বড় উপভোগ্য বিষয়-ই এটি।
আমরা আনুমানিক দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পৌঁছালাম সেন্টমার্টিন জেটিতে। আমাদের পরিচিত একটা রিসোর্ট ছিলো। যেখানে আমরা গতবারও ছিলাম। সেখানেই সোজা চলে গেলাম। পছন্দ মতো একটা রুম নিলাম পাঁচ জনের। ৬০০ টাকায় রুমটা আমাদের জন্য বেশ মানানসই এবং স্বল্প খরচেরও হয়েছে। এরপর আমরা তিনজন ফ্রেশ হয়ে নিয়েছিলাম। খুব ক্ষুধা লেগেছে। দুপুরের খাবার খেতে হবে। খাবার খেলাম সামুদ্রিক মাছ আর বেগুন ভাজা দিয়ে।
মুন্না আর কবির এবারই প্রথম সেন্টমার্টিন এসেছে। অন্যদিকে নাহিদ আর আবেদ এবার সহ তিনবার। তাই একেকজনের অনুভূতি একেকরকম। আমিও যেহেতু আরেকবার এসেছি তাই আমার কাছে আপাতত ঘুমটা বড়। তাই খাবার খেয়ে আমি, নাহিদ আর আবেদ দিলাম ভাতঘুম। অন্যদিকে মুন্না আর কবির বেড়াচ্ছে। আমরা ঘুমাতে ঘুমাতে কখন সন্ধ্যা সাতটা বেজে গেলো বলতে পারবো না। সবাই একসাথে সন্ধ্যার নাশতা সারলাম। হালকা নাশতা করলাম। রাতে আবার কোরাল মাছের বারবিকিউ করবো। একটা মাছ কিনলাম আড়াই হাজার টাকা দিয়ে। মাছের বারবিকিউ হওয়া পর্যন্ত বিচে বসে সময় কাটাচ্ছিলাম। একসময় খাবারের সময় হয়েছে। গরম গরম পরটা দিয়ে মাছের বারবিকিউ বেশ চমৎকার। খাওয়া শেষে হোটেলের মামাকে তার পরটা এবং বারবিকিউ বাবদ ২৬০ টাকা দিলাম।
আবারও বিচে গেলাম। বিচে গিয়ে ডাবল সিট নিয়ে পাঁচ বন্ধু বিশ্রাম নিলাম আর সাগরের জলরাশির শব্দ শুনছিলাম। এরপর আমরা ঠিক করলাম রুমে গিয়ে লুডু খেলবো। লুডু খেলতে খেলতে রাত ১১টা বেজে গেলো। আমাদের ভোরে উঠতে হবে। কারণ আমাদের গন্তব্য ছেঁড়াদ্বীপ। এই ছেঁড়াদ্বীপে যাওয়ার জন্যই আরেকবার আসা। সবাই যথারীতি ঘুমিয়ে পড়লাম। ভোর সাতটায় উঠে গেলাম। এরপর জেটি ঘাটে চলে এলাম তাড়াহুড়ো করে। ট্রলার প্রতিজন ২০০ টাকা আসা-যাওয়ার ভাড়া। আমরা ৫ জন এক হাজার টাকা দিয়ে উঠে পড়লাম। আমাদের সাথে আরও সাত-আটজন পর্যটকও ট্রলারে উঠেছেন। ট্রলারের যাত্রী পুরোপুরি হওয়ার পর ট্রলারটি ছাড়া হয়। এটি ছাড়তে ছাড়তে আটটা বেজে যায়।
ট্রলারে জীবনে প্রথমবার উঠলাম। ভয়ঙ্কর বিষয় হচ্ছে এই ট্রলার ছেঁড়াদ্বীপের পাড় পর্যন্ত যাবে না। পাড়ের অনেক দূরে সাগরেই দাঁড়াবে। কারণ পাড়ের কাছে গেলে পাথর এবং শৈবালে আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এই অল্প পথটুকু আবার ডিঙি নৌকা দিয়ে আসতে হবে। যারা সাঁতার জানে না তাদের জন্য এটা বেশ ভয়ঙ্কর বিষয়। আমি, নাহিদ, কবির আর মুন্না ডিঙ্গি নৌকায় উঠলে আবেদ ভয়ে আর নৌকায় ওঠেনি। সে ট্রলারেই বসে ছিলো। আমরা অনেক জোর করেছি। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা। আসবে না। তাই আমরাও বাধ্য হয়ে তাকে রেখে ছেঁড়াদ্বীপের পাড়ে চলে আসলাম।
ট্রলারের যাত্রাটা যেমন ভয়ঙ্কর রকমের অ্যাডভেঞ্চার ছিলো ছেঁড়াদ্বীপেও তেমনি। এক প্রকার ট্রাকিং করতে হবে। বড় বড় পাথর আর শৈবালে ভরা ছেঁড়াদ্বীপের পাড়। কোনো অবস্থাতেই এখানে খালি পায়ে হাঁটা যাবে না। তাহলে নিশ্চিত আপনার পা কাটা পড়বে। অনেকের জুতা থাকা অবস্থাও অসাবধানতায় পা কেটে যায়। কারণ এইসব মরা শৈবালের উপরিভাগ বেশ ধারালো। আস্তে আস্তে আমরা বিপদমুক্ত রাস্তায় চলে এলাম। যেন চারদিকে সমুদ্র আর মাঝখানে একখণ্ড জমিতে আমরা। এক অদ্ভুত সুন্দর এখানকার পরিবেশ।
গাছপালা আছে অল্প অল্প, আছে চারপাশে সমুদ্রের পানি। সেইসাথে পাথর আর পাথর তো আছেই। এখানে বাতাসের তীব্রতা অনেক। বিষমুক্ত বাতাস শরীরকে শীতল করে তোলবে। ছেঁড়াদ্বীপ সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পাথর, প্রবাল এবং নারিকেল গাছে পরিপূর্ণ। জোয়ারের সময় ছেঁড়াদ্বীপের এক-তৃতীয়াংশ সাগরের পানির নিচে তলিয়ে যায়। সাগরের নীল ঢেউ যখন পাথরের গায়ে আছড়ে পড়ে তখন এক মোহনীয় দৃশ্যের অবতারণা হয়। সুনীল সাগর, আকাশ আর সূর্যাস্তের মিতালি দেখতে প্রতি বছর হাজার হাজার পর্যটক ছেঁড়াদ্বীপে বেড়াতে আসে। এ ছাড়া ছেঁড়াদ্বীপে চাঁদের আলোয় জাদুকরী মুগ্ধতার সৃষ্টি হয়। তাই অনেকে পূর্ণিমার রাতে ক্যাম্পিং করতে আসেন এই অপূর্ব ছেঁড়াদ্বীপে। সবমিলিয়ে এই ছেঁড়াদ্বীপের রূপের বর্ণনা অল্প কথায় করা সম্ভব না। নিজ চোখে দেখার স্বাদটাই যেন আলাদা।
আমরা যেহেতু দুপুরেই ফিরে যাবো তাই বেশি সময় ব্যয় করলাম না। সাড়ে দশটার দিকে সবাই ফিরে আসলাম ট্রলারে। আমরা ঘণ্টা দুয়েক ছিলাম আর ছবি তোললাম। ট্রলারে ফিরে আবেদকে সেসব সৌন্দর্যের ছবি দেখাচ্ছিলাম। যদিও আবেদ আর নাহিদ এর আগে আরেকবারও ছেঁড়াদ্বীপ এসেছিলো। সেবার তারা সাইকেলিং করে এসেছিলো। এবার ট্রলারের স্বাদটাও নিলো।
য্ইাহোক আমরা ফেরার সময় সাগর সামান্য উত্তাল ছিলো। পানিতে শরীর প্রায় ভিজে গিয়েছে। ঢেউয়ের তালে তালে ট্রলারের উঠা বেশ ভয়ঙ্কর এবং উপভোগ্যও ছিলো। আমরা আধাঘণ্টার মধ্যে ফিরে এলাম সেন্টমার্টিনের জেটিতে। ট্রলার থেকে নেমে আমরা রুমে চলে আসলাম। সবাই ফ্রেশ হয়ে সব গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। রিসোর্টের রুমের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে আমরা গেলাম খাবারের হোটেলে। দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা চা পান করতে করতে কখন যে ঘড়ির কাঁটা আড়াইটা পেরিয়ে গেলো বলতে পারবো না। জাহাজ চলে এসেছে।
এবার ফেরার পালা। ফেরার সময় আমরা জাহাজে প্রচুর ছবি তোললাম। আর বসে বসে সমুদ্রযাত্রা উপভোগ করছি। এভাবে আমরা টেকনাফ এরপর চট্টগ্রাম চলে এলাম। বাসায় আসতে আসতে রাত হয়েছিলো।

কিভাবে যাবেন?
ঢাকা থেকে সরাসরি শ্যামলী, হানিফ, রিলেক্স, সেন্টমার্টিনসহ বিভিন্ন বাসে করে টেকনাফে যাওয়া যায়। নন-এসি বাসের ভাড়া ৯০০ টাকা আর বেশির ভাগ এসি বাসের ভাড়া ১৫৫০ টাকা। চট্টগ্রাম থেকে টেকনাফের ভাড়াও ৫০০ থেকে এক হাজার।
এরপর দমদমিয়া ঘাট থেকে বেশ কয়েকটি শিপ ছাড়ে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশে সকাল সাড়ে ৯টায়, যা দ্বীপে পৌঁছায় ১২টার মধ্যে। এগুলো ফিরে আসে বিকেল ৩টার দিকে সেন্টমার্টিন থেকে। শিপ ও ক্লাস ভেদে এগুলোর ভাড়া ৫৫০ থেকে ১৭০০ টাকা পর্যন্ত। তবে অফ সিজনে (এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) শিপগুলো চলে না, এই সময়টাতে সেন্টমার্টিন যাওয়ার একমাত্র উপায় হলো ট্রলার।
সেন্টমার্টিন থেকে ছেঁড়াদ্বীপ
সেন্টমার্টিনের জেটি থেকে ছেঁড়াদ্বীপ যাওয়ার স্পিড বোট ও ইঞ্জিনচালিত ট্রলার পাওয়া যায়। ছেঁড়াদ্বীপ যাওয়ার ভাড়া সাধারণত সিজনের উপর নির্ভর করে। পর্যটনের মৌসুমভেদে জনপ্রতি ১০০ থেকে ২০০ টাকায় ছেঁড়াদ্বীপ থেকে ঘুরে আসতে পারবেন। আর যদি হাতে পর্যাপ্ত সময় থাকে তবে জোয়ার ভাটার সময় জেনে পায়ে হেঁটে কিংবা সাইকেল ভাড়া নিয়ে ছেঁড়াদ্বীপ থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেন।

খাবেন কী?
এই দ্বীপে বেশ কিছু ভালো মানের খাবারের হোটেল আছে। সেইসাথে এখানে পাবেন বিচিত্র রকমের মাছের স্বাদ। নানান জাতের মাছ যেমন, কোরাল, সুন্দরী পোয়া, ইলিশ, রূপচাঁদা, লবস্টার, কালাচাঁদা, সুরমা, স্কুইড, সেলমন, কাঁকড়াসহ নানান রকমের সামুদ্রিক খাবার। এ ছাড়াও এখনকার ডাব বিখ্যাত। সেন্টমার্টিন গেলেন আর মাছ-ডাব খেলেন না তা যেন না হয়।

থাকবেন কোথায়?
সেন্টমার্টিনে রাতে থাকার জন্য নানান মানের রিসোর্ট, হোটেল ও কটেজ রয়েছে। ছুটির দিনে গেলে আগে থেকে বুকিং করে যাওয়া সুবিধাজনক। তবে চাইলে সেখানে গিয়েও পছন্দমত রিসোর্ট ঠিক করতে পারবেন।
সর্বনিম্ন ৪০০ থেকে ১০-১৫ হাজারের রুমও আছে প্রতি রাতের জন্য।

Share.

মন্তব্য করুন