বৈশাখ মাস চলে এসেছে। ছোট্ট গ্রামের পাশে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের খেত। খেতের আইলে দাঁড়িয়ে ঘুড়ি ওড়ায় গাঁয়ের ছেলেরা। দুপুরের কাঠফাটা রোদ কমতেই নাটাই-সুতো হাতে দেখা যায় ওদের। শিশু-কিশোরদের চেঁচামেচিতে মুখরিত হয়ে থাকে জায়গাটা। আজ নতুন ঘুড়ি কিনে এনেছে আলিফ।
কাটাকাটি খেলায় যোগ দিয়েছে সে। লতিফের ঘুড়ির সাথে লড়াই জমে উঠেছে।
কিন্তু হঠাৎ বিনা উসকানিতে আলম এসে বাগড়া দিল। আলিফের সুতোয় বাঁধিয়ে দিলো নিজের সুতো। একেই বলে সাপ-বেজির সম্পর্ক। দু’জন একসাথে থাকলে ঝামেলা হয় না এমন খুব কমই হয়েছে । একদিকে লতিফ, অন্যদিকে আলম। দুজনের সাথে লড়াই করে কি আর টেকা যায়? আলিফ ঘুড়ি সোজা করতে পারল না। কেটে গেল ঘুড়িটা। বিজয়ী হাসি দিল লতিফ, বত্রিশটা দাঁত বেরিয়ে পড়তে দেখা গেল আলমের। সুতো অনেক ছেড়েছিল আলিফ; ঘুড়িটা আর এ তল্লাাটে থাকল না। গলাকাটা মুরগির মতো কাঁপতে কাঁপতে দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেল। মন খারাপ হয়ে গেল ওর। আলমের সাথে কয়েকজন ছেলে ওকে নিয়ে হাস্যকর ছড়া কাটতে লাগল। ওরা সংখ্যায় বেশি। আলমকে একা পেলে নাক ফাটিয়ে দিতো আজ।
আলমের কাছে দামি গেমিং ফোন আছে; ওর আব্বু বিদেশ থেকে পাঠিয়েছে। ওটা দেখিয়ে ছেলে-মেয়েদের মাতিয়ে রাখে। গেমস খেলার লোভে অন্যরা পেছনে ঘুরঘুর করে। এজন্য আলিফের চাইতে ওর বন্ধু বেশি- আলম ঝামেলা না করলে সে-ই জিতে যেত- ধ্যাত! দিনটাই মাটি হয়ে গেল। কান্না পাচ্ছে আলিফের, নিজের হাতে বানানো ঘুড়িটা এভাবে হারিয়ে নষ্ট হলো। আজ আর ঘুড়ি ওড়ানো হবে না। আলমের সাথে কয়েকজন ছেলে এখনো হাসাহাসি করছে। এখানে থাকারও কোনো মানে হয় না। আলমকে পরে দেখে নেয়া যাবে। অগত্যা বাড়ির পথ ধরল ও।
আলিফের মন খারাপ দেখে ছোটো কাকু জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী হয়েছে তোর? মুখ গোমড়া করে আছিস কেন?’
‘আলমের জন্য আজ আমার ঘুড়িটা কেটে গেছে। সাথে অনেকগুলো সুতো।’
আলিফের কথা শুনে হাসলেন ছোটো কাকু। ‘ও, তাহলে এই ব্যাপার? আচ্ছা মন খারাপ করিসনে, আমি আগামীকাল শহর থেকে ভালো ঘুড়ি ও অনেক সুতো এনে দেব।’
দু’ চোখে খুশির ঝিলিক দেখা গেল আলিফের, ‘সত্যি এনে দেবে কাকু?’
‘দেব, আকাশে উড়লে সবাই তাকিয়ে থাকবে। এবার যা, খেয়ে- দেয়ে পড়তে বস।’
পরদিন সত্যিই খুব সুন্দর রঙিন একটা ঘুড়ি এনে দিলেন ছোটো কাকু। সাথে ধারালো সুতো।
এবার আলমকে দেখে নেবে সে।
অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো। প্রতিদিনের মতো আজও খেতের আইলে সবাই একত্রিত হয়েছে। সবকটা চোখ আলিফের ঘুড়ির দিকে। এমন ঘুড়ি কারো কাছে নেই।
আলিফের সুতো দেখে কেউ আর খেলতে এলো না। ভয় না পেয়ে এগিয়ে এলো আলম। শুরু হলো ঘুড়ি কাটাকাটি খেলা। একটুতেই হার মানলো আলমের ঘুড়ি। সব ছেলে-মেয়েরা হাততালি দিয়ে হই হই করে উঠল। আলিফের মুখে প্রতিশোধের হাসি- আলম কিছু বলল না। জমির আইলে বেড়ে ওঠা খেজুর গাছের নিচে গিয়ে বসে পড়ল-
সন্ধ্যা হয়ে আসছে, একে একে সবাই ঘুড়ি নামিয়ে বাড়ির পথ ধরল- আলিফও ঘুড়ি নামাল। আলম তখনও বসে আছে। ঘুড়িটা নিয়ে ওর কাছে এগিয়ে গেল আলিফ- মুখ নিচু করে বসে আছে সে। সান্ত্বনা দিতে নিজের ঘুড়িটা আলমের দিকে বাড়িয়ে দিল- মুখ তুলে তাকালো আলম। মৃদু হাসি দেখা গেল ঠোঁটে। ‘ঘুড়ির আর দরকার হবে না। আগামীকাল চলে যাচ্ছি এখান থেকে।’
‘মানে? কোথায় যাচ্ছিস?’ চোখ কপালে তুলে বলল আলিফ।
‘শহরে, ওখানে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেবে। সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে।’
‘ও, এজন্যই মন খারাপ।’ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল আলিফ, ‘আশা করি ভালো কিছু হবে।’
আবার মুখ নিচু করল আলম।
দেরি হলে বকা শুনতে হবে, আর কিছু না বলে ঘুড়ি নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটা ধরল আলিফ। দূরে এসে একবার পেছনে তাকিয়ে দেখল, ওর দিকে তাকিয়ে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে আলম। অন্ধকার হয়ে আসছে, ঢেকে যাচ্ছে ওর মুখ। এই জায়গাটার মায়া ছাড়তে পারছে না সে। আরো দূরে সরে এলো আলিফ। অন্ধকারে পুরোপুরি ঢেকে গেছে আলমের অবয়ব।
পরদিন আলমের বন্ধুরা তাকে বিদায় দিতে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এলো। সবার পেছনে, বেশ দূরে দাঁড়িয়ে হাত নাড়লো আলিফ। জবাবে হাত নেড়ে মলিন হাসি দিলো আলম। এই প্রথমবারের মতো আলমের জন্য খারাপ লাগছে। বাস চলতে শুরু করল। জানালায় দেখা আলমের মুখচ্ছবি হারিয়ে গেল রাস্তার বাঁকে। ওরাও হাঁটা ধরল। বাড়ির কাছে চলে এসেছে আলিফ। এ সময় দৌড়ে ওর দিকে লতিফকে আসতে দেখা গেল। ওর হাতে একটা ছোট্ট গিফট বক্স ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল। আলম রেখে গেছে। বেশ অবাক হলো আলিফ। কী রেখেছে এর মধ্যে কে জানে। দেখা যাবে বক্স খুলতেই বেরিয়ে পড়বে ফুলে থাকা কুনো ব্যাঙ। ভয়ে ভয়ে বক্সটা খুলল আলিফ। আশ্চর্য! ভেতরে আলমের সেই গেমিং ফোন। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো ওটার দিকে। সাথে একটা চিরকুট। পড়তে শুরু করল,
‘এভাবে চলে যাব ভাবিনি কোনোদিন। তোদের সাথে কাটানো সময়গুলো ভালো ছিল। তোর সাথে অনেক ঝামেলা করেছি। এখন বেশ কষ্ট হচ্ছে তোদের ছেড়ে যেতে। সবচেয়ে বেশি তোর কথা মনে পড়ছে। দূরে গেলেও যেন আমার কথা মনে থাকে। তাই গেমিং ফোনটা দিয়ে গেলাম। এখন থেকে ওটা তোর। ছুটি পেলে আসবো গ্রামে। তখন আবার হবে, দূর আকাশে ঘুড়ির খেলা।’
-ইতি, চিরশত্রু আলম।
চিরকুট পড়া শেষ হলেও চোখ কাগজে আটকে রইল আলিফের। বিয়োগের ক্লেশ চেপে ধরেছে ওকে- পাশ থেকে ছোটো কাকুর ডাকে সম্বিত ফিরে পেল ও । ততক্ষণে অশ্রুতে চিরকুটের কিছু অংশ ভিজে গেছে-

Share.

মন্তব্য করুন