‘মোরগের মাথায় গণ্ডগোল হলো নাকি রে, রবিন? এই দিন-দুপুরেও ডেকে যাচ্ছে!’ রবিনের দাদী কুলসুম বেগম গ্রাম থেকে এসেছেন রবিনদের বাসায়। চোখের ছানি অপারেশনের জন্য কিছুদিন ঢাকায় থাকবেন। কুলসুম সারাজীবন দেখেছেন মোরগ ডাকে ভোরে কিন্তু রবিনদের বাসায় এসে দেখছেন রাত নাই দিন নাই মোরগ ডেকে যাচ্ছে!
রবিন জবাব দিলো, ‘দাদী, এটা মোরগ ডাকছে না, ডাকছে টিয়া পাখি।’
কুলসুম রাগান্বিত স্বরে বললেন, ‘এখন তো দেখছি তোরই মাথায় গণ্ডগোল! টিয়া পাখি কখনো কক কক করে?!’
রবিন বোঝানোর চেষ্টা করল, ‘দাদী, এটা আসলে কথা-বলা টিয়া, আফ্রিকান গ্রে প্যারট। ময়না-শালিকের মতো আমার এই টিয়া পাখি কথা বলতে পারে। পাশের বাসায় একটা মোরগ রোজ সকালে ডাকে, তার ডাক নকল করে শিখে ফেলেছে।’
রবিনের কথায় সন্তুষ্ট হলেন না কুলসুম। বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘এভাবে ভকভক করে সারাদিন কক কক ডাকলে আমার কানেরও চিকিৎসা করাতে হবে!’
রবিন দাদীকে কিভাবে বোঝাবে যে পার্সি তার কত প্রিয়! সে আফ্রিকান গ্রে প্যারটটির নাম রেখেছে পার্সি। ধূসর কালো রঙের পাখিটির ভীষণ বুদ্ধি। শুধু যে কথা বলতে পারে তা নয়, মানুষকে সহজেই বন্ধু বানিয়ে ফেলে! রবিনদের বাসায় গেলে যে কেউ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাবে। কিছুদিন আগে পার্সি রিকশার ঘণ্টির আওয়াজ করত! তখন সারাদিন মনে হতো রবিনদের বাসার মধ্যে রিকশা ছুটছে।
মজার একটি ঘটনা ঘটেছিল মাস দুয়েক আগে। রাত দুটোর দিকে রবিনদের বাসায় চোর ঢুকল। অন্ধকারে চোর যখন ড্রয়িংরুমের দামি জিনিসপত্র থলেতে ভরায় ব্যস্ত, তখন হঠাৎ শুরু হলো ট্রাকের হর্নের আওয়াজ! আওয়াজ শুনে চোরের আত্মা শুকিয়ে গেল। তার মনে হলো ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে আস্ত ট্রাক; এখনই উঠে পড়বে ঘাড়ের ওপর! ট্রাকের হর্নের মতো আওয়াজ করছিল সোফারুমে মূল দরজার পাশে একটি টেবিলের ওপরে থাকা পার্সি।
অন্ধকারে কোন দিক থেকে ট্রাক ছুটে আসছে কিছুই বুঝতে না পেরে তালগোল পাকিয়ে চোর চেঁচানো শুরু করল, ‘মাগো, বাঁচাও! বাবাগো, বাঁচাও!’ ব্যস, এই চিৎকারেই জেগে গেল রবিনদের পুরো পরিবার। অবশ্য রবিনের বাবার মায়া হলো চোর বেচারার জন্য। তিনি চোরকে পুলিশে না দিয়ে ছেড়ে দিলেন।
রবিনের দাদী কুলসুম বেগমের কথা পার্সি বুঝতে পারল কিনা কে জানে, পরদিন থেকে কক কক আওয়াজ বন্ধ করে দিলো; তবে শুরু হলো আরেক যন্ত্রণা। পার্সি কা-কা ডাকা শুরু করল! এর মধ্যেই পার্সি কাকের ডাক শিখে ফেলেছে।
কুলসুম বেগম রবিনকে ডেকে বললেন, ‘এর চেয়ে মোরগের ডাকই তো ভালো ছিল। তোর টিয়াটারে রিকোয়েস্ট করে কাকের ডাক বন্ধ করা যায় না?’
রবিন বলল, ‘পার্সিবাবু রিকোয়েস্ট বোঝে না, দাদী। তবে ভালো খাওয়ালে হয়তো ওর বুদ্ধি খুলবে।’ আদর করে রবিন মাঝে মাঝে পার্সিকে বলে পার্সিবাবু।
দাদী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী খায় দুষ্টুটা?’
রবিন উত্তর দিলো, ‘বাদাম, ফল, সবজি, ডিম।’
পার্সির খাবার কেনার জন্য কুলসুম রবিনকে একশ টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিলেন। টাকা পেয়ে রবিন খুব খুশি। কারণ, টিফিনের টাকা থেকে বাঁচিয়ে পার্সির জন্য খাবার কিনতে হয়। সবুজ সবজি পার্সির প্রথম পছন্দ, সঙ্গে ক্যাশুনাট, পিনাট, বিচি ছাড়া তরমুজ, আপেলসহ নানা ফল, সেদ্ধ ডিম ইত্যাদি।
রবিনের সংগ্রহে আফ্রিকান গ্রে প্যারট ছাড়াও আছে বাজরিগার, ককাটেল এবং রিংনেক টিয়া পাখি। টাকা জমিয়ে রবিন প্রথমে কিনেছিল একজোড়া বাজরিগার পাখি। তা থেকে হয়েছে বিশাল দল। এক সময় কিছু বাজরিগার পাখি বিক্রি করে রবিন অন্য পাখিগুলো কিনেছে। আফ্রিকান গ্রে প্যারট কিনতে গিয়ে তাকে বিক্রি করতে হয়েছে অনেকগুলো পাখি; সঙ্গে আরও লেগেছে টিফিন ও ঈদের সালামি থেকে জমানো টাকা; শেষমেশ বাবা-মা দিয়েছেন বাকি টাকা। সব মিলিয়ে গ্রে প্যারটটির দাম পড়েছিল চল্লিশ হাজার টাকা! এত দাম; তবু রবিনের খুব শখ। কারণ, গ্রে প্যারটের অনেক বুদ্ধি। ছোট ছোট শব্দ বলতে পারে, যেকোনো আওয়াজ নকল করতে পারে, খেলতে পারে, হাতে-কাঁধে বসতে পারে, আর পারে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতে।
পার্সি কা-কা ডাকার পর কেটে গেল আরও এক মাস। রবিনের দাদীর চোখের অপারেশন সাকসেসফুল হলো। সেই খুশিতে রবিন তার বাসায় বন্ধুদের দাওয়াত করল। অবশ্য দাওয়াতের দিন একটি জরুরি কাজে বাবা-মাকে বাসার বাইরে যেতে হলো। সব বন্ধু চলে এলো ঠিক সময়ে; শুধু খগেন করল দেরি। খগেন ক্লাসে যেমন দেরি করে; দাওয়াতেও তেমনি দেরি করল। রবিনরা সব বন্ধু মিলে একসঙ্গে যখন রান্নাঘরে নাশতা তৈরি করছিল, তখন খগেন এসে কলিংবেল বাজাল। কিছুক্ষণ আগে ইলেকট্রিসিটি চলে যাওয়ায় কলিংবেল ব্যাটারির সাহায্যে আওয়াজ করল ঠিকই; কিন্তু ভীষণ আস্তে। কলিংবেলের আওয়াজ রান্নাঘরে থাকা রবিনদের কানে না পৌঁছলেও শুনতে পেল দরজার পাশে টেবিলের ওপরে থাকা পার্সিবাবু! পাখিটি বড় মানুষের মতো ভরাট কণ্ঠে বলল, ‘কে?’
রবিনের পাখি সম্পর্কে জানত না খগেন। তাই বিনয়ের সঙ্গে বলল, ‘আমি খগেন।’
পার্সি আবার বলল, ‘কে?
‘আমি খগেন।’
‘কে?’
‘আমি খগেন।’
‘কে?’
‘আমি খগেন।’
এভাবে নিজের পরিচয় দিতে দিতে খগেন অস্থির হয়ে উঠল। কী ঘটছে বুঝতে না পেরে সে মোবাইল বের করে কল দিলো রবিনকে। ঘটনাটি বুঝতে পেরে রবিন হেসে উঠল। বলল, ‘আগে কল দিলেই পারতি। কে-কে তো করছে আমার পোষা পাখি পার্সি।’ এসব ঘটনা বন্ধুরা জানতে সময়ই লাগে না! সবাই হাসাহাসি শুরু করল। খগেন ঘরে ঢুকে পার্সিকে দেখতে পেল। এতক্ষণ রেগে থাকলেও পার্সিবাবুর মায়া মায়া চেহারা ও চোখ দেখে পাখিটির বন্ধু হয়ে গেল। কিন্তু বন্ধুদের দুষ্টামি বন্ধ হলো না; বন্ধ হলো না পার্সিবাবুর দুষ্টামিও। এবার পার্সি বলে চলল, ‘আমি খগেন, আমি খগেন…।’
পরের একদিনের ঘটনা। ঘটনাটি দুঃখের। রবিনের বাবা যে চোরকে ক্ষমা করেছিলেন, সেই চোর এক রাতে আবারও ড্রইংরুমের জানালার গ্রিল কেটে ঢুকে পড়ল রবিনদের বাসায়। এবার আর অন্য কিছু নেওয়ার চেষ্টা করল না; শুধু চুরি করে নিয়ে গেল মিষ্টি পার্সিবাবুকে। তারপর থেকে রবিনদের বাসার কারও মন ভালো নেই। কেউই জানে না পার্সিবাবু এখন কোথায় আছে, কেমন আছে। তোমরা কেউ পার্সিবাবুর খোঁজ পেলে প্লিজ রবিনকে খবরটি জানিও।

Share.

মন্তব্য করুন