কবি গোলাম মোস্তফা ‘কিশোর কবিতায় বলেছেন-
‘ভবিষ্যতের লক্ষ আশা মোদের মাঝে সন্তরে,
ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুরই অন্তরে’।

আজকের শিশু আগামী দিনের দেশ তথা একটি রাষ্ট্রের যোগ্য জনসম্পদ হয়ে গড়ে উঠবে আমরা এমনটা প্রত্যাশা করি। প্রত্যাশা করলেই যোগ্য সম্পদ হয়ে যাবে তা নয়। আজকের শিশুদের জ্ঞান, সুপ্ত বুদ্ধিমত্তার পূর্ণ বিকাশ সাধনে পরিবার, সমাজ তথা রাষ্ট্রের রয়েছে যথেষ্ট ভূমিকা। এ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলে শিশুদের জীবন হবে নোঙরবিহীন নৌকোর মতো। শুধু ঘূর্ণিজলে ঘুরপাক খাবে। তাই শিশুদের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে যেখানে যার যতটুকু দায়িত্ব-কর্তব্য তা যথাযথভাবে পালন করতে হবে। তাদের বাঞ্ছিত চরিত্রগঠনে দিতে হবে সুন্দর পরিবেশ।

পিতা-মাতার দায়িত্ব ও কর্তব্য

শিশুর জন্ম দেয়াই পিতা-মাতার একমাত্র কাজ নয়। তাদের পরিচর্যা, ভরণ পোষণের ব্যবস্থা রেখে এবং সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে আলোকিত দেশ গড়ায় পিতা-মাতার ভূমিকাই প্রধান।
যে পরিবারের শিশুরা অবহেলায় ও অযতেœ বেড়ে তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তারা পরিবারের বোঝা এবং দেশের বোঝা। সর্বজনস্বীকৃত যে, মায়ের কাছ থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে ভাষা শেখে, পরিবেশে বিভিন্ন উপাদানের নাম বলতে শেখে। মায়ের শিখন শেখানো কার্যাদি পরিচ্ছন্ন, পরিশুদ্ধ হলে শিশুর জীবন সুন্দর হবে বলে আশা করা যায়। আর যদি এখানে গলদ থাকে তবে শিশুর ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবার সম্ভাবনাই বেশি। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পিতা-মাতা রোজ সন্তানের সামনে অশুদ্ধ, অশ্লীল, কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তবে শিশুরা কী শিখবে? শিশুর মুখে ভালো কথা, শিশুর কাছে ভালো আচরণ কিভাবে আশা করা যায়! তাই প্রতিটি মুহূর্তে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শিশুদের সামনে ইতিবাচক কথা ও উত্তম আচার আচরণ প্রদর্শন করা একান্তই বাঞ্ছনীয়। মনে রাখতে হবে, ‘পাত্র উৎকৃষ্ট না হলে সোনার অলঙ্কারও ছাই হয়ে যেতে পারে।’

প্রাথমিক শিক্ষা ও পরিবেশ

রাষ্ট্রীয় বিধি বিধান অনুযায়ী শিশুর বয়স পাঁচ বছর না হওয়া পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা যায় না। শিশুরা পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত পিতা-মাতার তত্ত্বাবধানে থাকে। তারপর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হবে এবং শিক্ষকগণ সরাসরি শিশুদের দেখভাল করবে। বিদ্যালয়ের পরিবেশ চিত্তাকর্ষক হলে, বিষয়ভিত্তিক পাঠ আনন্দময় হলে শিশুকে কোনোভাবেই ঘরে আটকিয়ে রাখা যাবে না। নিরাপদ শিখন পরিবেশ শিশুদের জন্য অপরিহার্য বিষয়। এ বিষয়ে বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যথেষ্ট দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে। শিক্ষকদের আদর সোহাগ স্নেহ মমতা এক অস্পর্শনীয় সম্পদ। যা বাটখারা দিয়ে পরিমাপ করা অসম্ভব। শিশুরা এই সম্পদের প্রতি প্রবল আকর্ষণ অনুভব করে। শিশুদের চরিত্র গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা অনস্বীকার্য। শিশুরা নৈতিক জ্ঞান, যেমন ভালো কাজ করার আদেশ এবং মন্দ কাজ করা নিষেধ শিক্ষকদের কাছ থেকে শেখে। ফলে শিক্ষকগণ হয়ে ওঠে শিশুদের অনিবার্য পথপ্রদর্শক। কথায় বলে ‘শিক্ষকগণ হলেন জাতি গড়ার কারিগর।’

জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য পাঠ্যপুস্তকের ভূমিকা

শিশুদেরকে দেশের যোগ্য সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে পাঠ্যপুস্তকের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে। বাস্তবভিত্তিক কর্মমুখী বিষয়ের পাশাপাশি এবং আদর্শিক চেতনায় গড়ে তোলার সব উপাদান পাঠ্যপুস্তকে থাকা বাঞ্ছনীয়।
বয়স, মেধার ধারণ ক্ষমতা বিবেচনায় নিয়ে পাঠ্যপুস্তকের ভাষাশৈলী সন্নিবেশিত না হলে বিদ্যালয় থেকে অধিকাংশ শিশুদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এজন্য শিক্ষকদের কাছ থেকে তথ্য উপাত্ত ও পরামর্শ নেয়া জরুরি বলে মনে করছি। কাল্পনিকভাবে অথবা অধিকতর পণ্ডিতদের দিয়ে বিষয়গুলোকে বিন্যস্ত করতে হবে এমন কোনো কথা নয়। স্তর অনুযায়ী যাকে দিয়ে যে কাজ করালে ফলপ্রসূ হবে তাকে দিয়েই সেই কাজটি করানো উচিত।

সামাজিক পরিবেশ ও তার প্রভাব

মানুষ সামাজিক জীব। মানুষ একাকী ভালোভাবে বাঁচতে পারে না। মিলেমিশে থাকাতেই আনন্দ। সমাজের মানুষ শিক্ষিত ও সজ্জন হলে শিশুরা সমাজের কাছ থেকে জীবন চলার বহু উপাদান অর্জন করতে পারে। শিশুরা আদব কায়দা, নীতি রীতি, সুষ্ঠু সংস্কৃতির ধারা রপ্ত করে নিজকে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হিসেবে পরিচয় দিতে গৌরববোধ করে। সুশৃঙ্খল সমাজব্যবস্থা শিশুকে প্রচ্ছন্নভাবে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে।
সর্বোপরি বলতে পারি, আজকের শিশু আগামী দিনের দেশকাণ্ডারি। আমরা শিশু সন্তানকে সর্বাধিক পরিচর্যার মাধ্যমে গড়ে তুলতে বদ্ধপরিকর। সমাজে যাতে কোনো কুসংস্কার বাসা বাঁধতে না পারে সেদিকে সবার দৃষ্টি দিতে হবে।

Share.

মন্তব্য করুন