ঘড়িটা এলার্ম দিয়েই যাচ্ছে তবু মেয়েটার ওঠার নামটি পর্যন্ত নেই। রান্নাঘরে নাস্তা রেডি করতে করতে মিনি বকেই যাচ্ছে। ওর দুটো মেয়ে আফ্রা আর নোভা। রোজ সকালে তার প্রথম ও প্রধান কাজ মেয়ে দুটোকে পরিপাটি করে সাজিয়ে, গুছিয়ে স্কুলে নিয়ে যাওয়া। সে জন্য তার সারা বেলার কষ্টটাও কম হয় না !
সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিকে পড়ছে ওরা। শাহেদ বিজনেসের কাজে এত ব্যস্ত থাকে যে মেয়েদের সববেলাকার সমস্ত আবদার মিনিকেই দেখতে হয়।
টেবিলে নাস্তা গুছিয়ে রেখে মেয়েদের ধাক্কা দিয়েই উঠাল। নোভা উঠেই তাড়াতাড়ি ওয়াশরুমে চলে গেল। কিন্তু আফ্রা গড়িমসি করছে। মিনির বুঝার বাকি রইল না যে ও এতক্ষণ ইচ্ছে করেই উঠছিল না।
– আফ্রা, নোভা রেডি হয়ে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি কর, উঠছ না কেন?
– মা, আজ না গেলে হয় না।
– এমনটি করতে হয় না। অসুস্থ থাকলে মানা যেত। কিন্তু তুমিতো সুস্থ।
– আমার যেতে ইচ্ছে করছে না। আজ না যাই (মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে)।
– উঁহু! একদম না, তাড়াতাড়ি রেডি হও।
এই ফাঁকে নিজেও রেডি হয়ে নিলো। আজ মেয়েদেরকে স্কুলে নামিয়ে মিনি মার্কেটে যাবে। মেয়েদের জন্য কেনাকাটা করতে।
সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আফ্রা বলছে- মা এমনওতো হতে পারে আমি আজ হারিয়ে গেলাম।
– কিভাবে? আমি আছি না! হারাতে দিলে তো। বেরোবার সময় এসব বলতে নেই।
মাকে জড়িয়ে ধরে প্রথমে আফ্রা চুমু খেল। নোভা দেখে হিংসার সুরে-
– শুধু তুমি একাই দিবে! এই বলে সেও চুমু খেল।
মেয়েদের স্কুলের গেটে ঢুকিয়ে মিনি হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কত দুশ্চিন্তা মাথায় খেলে যাচ্ছে তার। মনটা ভার হয়ে গেল। যাচ্ছেতাই মাথায় আসছে। পরক্ষণে হালকা হওয়ার চেষ্টা করল। আফ্রা বাসা থেকে বের হবার আগে হারিয়ে যাবার কথা বলার জন্যই এমনটি ঘটেছে। আফ্রার উপর রাগ হলো মিনির।
মেয়েটা যে কী? এসব বলে কেউ ঠাট্টা করে? মায়ের চোখের সামনে সন্তান হারিয়ে যাওয়া যে কতটা কষ্টের তা মা না হওয়া পর্যন্ত বোঝা যায় না। একটা দীর্ঘশ্বাস বুকের ভিতর জমে ছিল অনেকক্ষণ। মিনি সেটাকে ছেড়ে দিয়ে হালকা হওয়ার চেষ্টা করল।
স্কুলের ঘণ্টা পড়তেই সে বাসে উঠার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল। রোজ রোজ বাসে চড়ে এভাবে মেয়ে দুটোকে আনা-নেয়া করতে মিনির ভালো লাগে না। তাছাড়া ওরা বড়ও হচ্ছে। বাসে কত ধরনের লোক যে চড়ে তা কোন মেয়ে নিজে না যাতায়াত করলে বুঝবে না।
শাহেদের ব্যবসাটা ভালো করে দাঁড়িয়ে গেলেই একটা গাড়ি কিনবে ওরা। এ বছরের শেষদিকে একটা ব্যাংক লোন পাওয়া যাবে। আর তো কটা মাস। তারপর একটা গাড়ি কিনলে একটু শান্তিতে যাতায়াত করা যাবে।
মিনি এক এক করে লিস্ট মিলিয়ে কেনাকাটা করছে। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেল। এখন যাওয়া দরকার। হঠাৎ মনে পড়ল আফ্রা রাতে কমলা চেয়েছিল কিন্তু বাসায় ছিল না। সে হন্তদন্ত হয়ে কমলা কেনার জন্য এগুচ্ছে। ছুটি হওয়ার আগেই পৌঁছুতে হবে। দরদাম না করেই দোকানদার যা চেয়েছে তা দিয়ে এক ডজন কমলা কিনে বাসে চাপল। ছুটির পাঁচ মিনিট বাকি থাকতেই স্কুলে এসে পৌঁছেছে বলে মিনির ভালো লাগছে। মেয়েদেরকে বাইরে তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়নি।
নোভা মাকে দেখে দৌড়ে এসে জিনিসপত্র খুঁটিয়ে দেখতে চাইল। মিনি বারণ করল।
– বাসায় গিয়ে দেখ, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। রান্না করা হয়নি আজ, গিয়ে খাবে না?
রেডিও কলোনির সামনে বাস থামতেই তিনজনেই নামল।
– মা আজ আমার হাতটা ধরবে কেমন করে?
– আমার হাতে অনেকগুলো বাজার। নোভার হাত ধর। তারপর আমার সাথে পার হও।
তিনজনই এগুচ্ছে। পথিমধ্যে আফ্রার স্কেলটি পড়ে যাওয়ায় নুয়ে নিতে গিয়ে পিছনে পড়ে গেল সে।
হঠাৎ একটা শব্দ হলো। ততক্ষণে মাথাটার উপর দিয়ে চলে যাওয়া বাসটি শোঁ শোঁ শব্দ করে দূরে হারিয়ে গেল। আর আফ্রা হারিয়ে গেল জীবন থেকে। কি যে এক নির্মম যন্ত্রণার সাক্ষী ওরা জীবন্ত দু’জন, নোভা আর মিনি। মৃত্যুর পর মেয়েটার মাথাটা বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতেও দিলো না মানুষগুলো। ওরা হয়ত বুঝতে পারেনি কতটা দরদে আগলে রেখেছিল জীবন্ত আফ্রাকে মিনি। ওর হাতটাও আর ধরা হলো না। আর কোন দিনও ধরতে পারবে না।

Share.

মন্তব্য করুন