দুই পাশ থেকে নৌকার হাল ধরেছে মিলন ও সজীব, মাঝখানে বসেছে শাহীন, সিয়াম ও মিঠুন। হালকা বাতাস বইছে, আবহাওয়াটা ভালোই। নদী একেবারে শান্ত, স্রোত নেই পানিও কম, আর এ জন্য নৌকা বাইতেও কোনো সমস্যা হচ্ছে না। নদীটা খুবই ছোট, এটাকে নদী না বলে শাখা নদী বলাই ভালো। এক তীর থেকে অন্য তীরের দূরত্ব গড়ে মাত্র ১২৫ মিটার।
গ্রাম পেরিয়ে চলে এসেছে ওরা, জঙ্গলের দিকে যাচ্ছে পাখি শিকারের জন্য। বাড়ি থেকে বলে দিয়েছে ওদের, যেন ওরা সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে আসে আর জঙ্গলের গভীরে প্রবেশ না করে । মিলন সিয়ামের খালাতো ভাই। এবার গরমের ছুটিতে সিয়াম ও তার বন্ধু শাহীন বেড়াতে এসেছে। সজীব ও মিঠুন মিলনের বন্ধু। ৫ মিনিটের মধ্যেই নৌকা জঙ্গলের মধ্যে চলে এলো। নৌকা চলেছে, দুই পাশে শুরু হয়েছে জঙ্গল। আরেকটু ভেতরে চলে আসার পর নৌকাটা রেখে উপরে উঠে এলো ছেলেরা। গাছপালা নদীর ধারে ততটা ঘন নয়, তবে ঝোপঝাড় অনেক বেশি এখানে। নদী থেকে যতই দূরে যাচ্ছে ওরা গাছপালা ততই ঘন হচ্ছে। পাখির অভাব নেই জংগলে, নানা প্রজাতির পাখির গানে মুখরিত জংগলটা। একটা পাখি দেখে ওটাকে ধরার জন্য এগোচ্ছে সজীব। কিন্তু সে খেয়ালই করলো না তাকে ছোবল মারার জন্য ফণা তুলেছে ভয়ঙ্কর এক সাপ। সবার আগে বিষয়টা খেয়াল করলো সিয়াম। এখন লাঠি খোঁজা বা সজীবকে সতর্ক করতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। ততক্ষণে সজীবকে কামড় বসাবে সাপটা। আর এক মুহূর্তও দেরি করলো না সে, লাফিয়ে পড়লো সাপের ওপর। বিপদের সময় প্রায় এমন দুঃসাহসী হয়ে ওঠে সে। সাপের মাথা শক্ত করে চেপে ধরলো সে, সিয়ামের হাত পেঁচিয়ে নিয়েছে সাপটা, মাথা ঘুরিয়ে তাকে কামড় দেয়ার চেষ্টা করছে। টিভিতে দেখেছে সিয়াম কিভাবে সাপকে কব্জা করতে হয়। তা ছাড়া বই পড়ে জেনেছে সাপের ঘাড়ের কাছে যে নার্ভ সিস্টেম আছে সেটাতে চাপ দিলে সাপ দুর্বল হয়ে যায়। নার্ভ সিস্টেমটা খুঁজছে সিয়াম, কোন বিপদ হওয়ার আগেই নার্ভ সিস্টেম টিপে দিলো সে। পেরেছে সে, সাদা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে সিয়ামের। মুখে বিজয়ের হাসি।
একটুর জন্য সাপের কামড় খায়নি সজীব, এ জন্য সিয়ামকে বার বার ধন্যবাদ জানালো। সিয়ামের সাপ ধরা দেখে একটু রসিকতা করে শাহীন বললো, বাহ! তুমি বিয়ারগেলসকেও হার মানাবে দেখছি, তা এটাকে কী করবে এখন? ওর মতোই রানড়বা করে খাবে নাকি?
– ওয়াক থু, ছি ছি কী বলো এসব, আমি খাবো কেন? এটা তো তোমাকে খাওয়াবো, যাতে তুমি এটা খেয়ে চিকন থেকে মোটা হয়ে যাও! ওর কথা শুনে হেসে ফেললো সবাই, হাসলো শাহীনও।
– সিয়ামের পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললো, মিঠুন, অসাধারণ সাহসী ছেলে তুমি সাপের কামড় খেলে ডাক্তারের কাছে যাবার আগেই পরকালের টিকেট পেতে তা সত্ত্বেও বন্ধুর বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছো। এটা শুনে দুই ধাপ পেছনে সরে গেল সিয়াম এবং বললো, হায় আল্লাহ এটা তো আমার একটুও মনে ছিলো না।
ওর বলার ধরন আবার দেখে হেসে ফেললো সবাই। পরিবেশটাও বেশ হালকা হয়ে গেল। এই সাপের বিষ দিয়ে ঔষধ তৈরি হয়, ওরা এটা বিক্রি করলে ভালো দাম পাবে এ জন্য সাপটাকে না মেরে ব্যাগে ভরে, ব্যাগটা নিজের হাতে রাখলো শাহীন। ব্যাগের মধ্যে ওটাকে এমনভাবে রাখলো যেন ওটা কোনো ক্ষতি করতে না পারে। এবার খুব সাবধান হয়ে গেল সবাই। জঙ্গলে হিংস্র প্রাণী নেই কিন্তু বিষাক্ত সাপ আছে অনেক। জঙ্গলের একটু ভেতরে চলে এসেছে ওরা, এতেই নদীটা গাছপালার আড়ালে চলে গেছে, এখন আর দেখা যাচ্ছে না। এক সময় ওরা তিনটা বনমুরগি দেখে ধরার জন্য ধাওয়া করলো । কিন্তু ওদের দেখে তিনটা তিন দিকে পালালো। সিয়াম ছুটলো একটার পেছনে আর বাকিরা অন্যটার পেছনে। বন মোরগের পেছনে ছুটছে সিয়াম, কিন্তু ওটাকে ধরতে পারছে না, কাছাকাছি গেলে আরো দূরে পালাচ্ছে ওটা। বনমোরগের পেছনে ছুটতে গিয়ে সে একটু অসাবধান হয়ে গেল। তার লক্ষ্য এখন মুরগিটাকে ধরা। মনে হচ্ছে সে কোন ভিডিও গেম খেলছে, মুরগিটাকে ধরতে পারলেই গেমের লেভেল পার করতে পারবে। এক পর্যায়ে এসে বনমুরগিটাকে আর দেখতে পেলো না সে। কিছুক্ষণ পর একটা ঝোপের মধ্যে থেকে বের হলো ওটা, আবার তাড়া করলো সে। আবার হারিয়ে গেল ওটা, এবার আর খুঁজে পেল না ওটাকে। একটা গাছের নিচে বসে পড়লো সিয়াম। মুখ দিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে, হাঁফিয়ে উঠেছে। এতক্ষণে খেয়াল হলো তার, একা বসে আছে সে, আশপাশে তার বন্ধুরা কেউ নেই।

অপারেশন-ডেথ-হাউজ

দুই.

শাহীন ও বাকি তিনজনের চেষ্টায় একটা বনমুরগি ধরা পড়লো। সিয়াম যে ওদের সাথে নেই সবার আগে খেয়াল করলো মিলন।
– আচ্ছা, সিয়াম কোথায়? ও তো নেই আমাদের সাথে।
– তাই তো এটা তো খেয়াল করিনি, শাহীন বললো।
– চলো আমরা নৌকার কাছে গিয়ে খুঁজে দেখি, হয়তো কোন সমস্যার জন্য সে ওখানে চলে গেছে, সজীব বললো।
– কিন্তু কাউকে না বলে কোথাও যায় না সিয়াম, তবুও চলো দেখি, শাহীন বললো।
নৌকাটা আগের মতোই বাঁধা আছে, নৌকার কাছে পাওয়া গেল না সিয়ামকে, জোরে জোরে সিয়ামের নাম ধরে ডেকেও কোন সাড়া মিললো না। যেখান থেকে বনমুরগিটাকে তাড়া করেছিলো, সেখানে আবার ফিরে এলো ওরা।
– আর একটু পর সন্ধ্যা নেমে আসবে তার আগেই ওকে খুঁজে বের করতে হবে, না হলে বিপদে পড়ে যাবে সে, মিঠুন বললো।
সিয়ামকে না পেয়ে ভয় পেয়ে গেল ওরা, ওকে ছাড়া বাড়ি ফিরলে, ভীষণ বকা খেতে হবে ওদের। আর সময় নষ্ট না করে সিয়ামকে খুঁজতে শুরু করলো।
শাহীন বললো, আমরা চারজন চার ভাগ হয়ে খুঁজবো, সবাই সবার থেকে এমন দূরত্বে থাকবো যেন একে অপরের ডাক শুনতে পাই। চারজন চার জায়গায় ছড়িয়ে পড়লো, সবাই সিয়ামের নাম ধরে ডাকতে লাগলো। আস্তে আস্তে বনের গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করছে ওরা কিন্তু সিয়ামের দেখা নেই। সবার মনে একই প্রশ্ন- কোথায় গায়েব হয়ে গেল সে, সে কি কোন বিপদে পড়লো? অজানা শঙ্কা উঁকি দিতে লাগলো ওদের মনে।
বনমুরগির পেছনে ছুটে পথ ভুল করেছে সিয়াম। বনমুরগিটাকে তাড়া করার সময় বেখেয়াল হওয়ার জন্যই এমনটা হয়েছে। চারপাশে এখন ঘন গাছপালা, তার মানে ঘন জঙ্গলে চলে এসেছে সে, চারপাশের গাছগুলো একই রকম মনে হচ্ছে সিয়ামের। নিজের ওপর ভীষণ রাগ হলো তার। সন্ধ্যা এখনো হয়নি, কিন্তু ঘন জংগলে এখনই অন্ধকার নেমে এসেছে, সূর্যের আলো এখানে পৌঁছাতে পারে না ঘন গাছপালার জন্য। কোন দিকে যাবে বুঝতে পারছে না সে, দৌড়ানোর সময় কোন দিক খেয়াল করে দৌড়ায়নি সে, তার খেয়াল ছিল বনমুরগির দিকে। এবার ভয় পেতে শুরু করলো সে। গত রাতে রফিকুল আংকেলের বলা কথাগুলোর কথা মনে হতে লাগলো, জংগল থেকে গভীর রাতে উদ্ভট সব শব্দ শোনা যায়, জংগলের ভেতর নাকি একটা পোড়োবাড়ি আছে, যেটাকে ডেথ হাউজ বলে সবাই কারণ ওখানে গেলে নাকি কেউ আর ফিরে আসে না। সন্ধ্যার পর জংগলের নদীটাও এড়িয়ে চলে সবাই। ওদিকে কেউ যায় না। এখন যদি বাড়িটার সামনে পড়ে যায় সে? তাহলে কী হবে আর ভাবতে পারছে না সিয়াম। ভয়ে হার্টবিটের কাঁপুনি বেড়ে গেছে ।
কিন্তু ভয় পেলে চলবে না, তাকে বের হতে হবে এই জংগল থেকে। ফুসফুস ভরে শ্বাস নিয়ে মুখ দিয়ে জোরে জোরে ছাড়তে লাগলো সে, এতে ভয় কিছুটা দূর হলো। পকেট থেকে মোবাইল বের করে টাইম দেখেছে সে, মাগরিবের আজান হতে ৪৫ মিনিট বাকি আছে, বন্ধুদের ফোন করার চেষ্টা করলো সে কিন্তু ফোনে একটা নেটওয়ার্কও নেই, সম্ভবত ঘন জংগলের ভেতর নেটওর্য়াকের এমনি সমস্যা হয়। আপাতত ফোনে যোগাযোগের চিন্তা বাদ দিলো সে। জংগলের মধ্যে এখনো অল্প অল্প আলো আছে। দ্রুত বের হতে হবে এখান থেকে, রাতের কালো আঁধার নামার আগেই। জংগলের সবদিকের গাছ একই রকম লাগায় কোন দিকে যাবে এটা ভেবে আরো দুই মিনিট সময় নষ্ট করলো সে। তারপর ভালোভাবে খেয়াল করলো সূর্য কোন দিকে আছে। আল্লাহর নাম নিয়ে পশ্চিমে হাঁটা শুরু করলো সে। জংগল না শেষ হওয়া পর্যন্ত একই দিকে এগিয়ে যাবে সে, একসময় তাহলে বেরোতে পারবে জংগল থেকে, আর জংগল থেকে বের হতে পারলে গ্রামটাও খুঁজে পেতে আর সমস্যা হবে না। দ্রুত হাঁটা শুরু করলো সে, যতটা সম্ভব নিঃশব্দে হাঁটছে সে। বন্ধুদের ডাকতেও ভয় পাচ্ছে সে, যদি কেউ শুনে ফেলে এই ভয়ে, ভূতে বিশ্বাস করে না সিয়াম, কিন্তু তাহলে কার জন্য বাড়তি এই সতর্কতা, সেটা নিজেও জানে না সে। শুধু জানে এখান থেকে বের হতে হবে। মাত্র এক মিনিট হেঁটেছে সে অথচ এই এক মিনিটই ওর কাছে এক ঘণ্টা মনে হলো। তার মনে হচ্ছে সে যেন আমাজানের গহিনে প্রবেশ করেছে, জংগল আর কোনদিনই শেষ হবে না। মোবাইলের ফ্ল্যাশের আলোয় দেখলো সে একটা সাপ সরে যাচ্ছে তার সামনে দিয়ে। ক্রমেই অস্বস্তি বেড়ে চলেছে সিয়ামের, জংগলের এই একাকিত্ব ভালো লাগছে না তার। মনে মনে ভাবছে সে একবার বেরোতে পারলে আর এ মুখো হবে না। বিশ মিনিট হাঁটার পরও জংগল শেষ হচ্ছে না। এই, জংগলের যেন শেষ নেই।
সিয়াম! সিয়াম! তার নাম ধরে ডাকছে কেউ, হ্যাঁ ওটা তো শাহীনের কণ্ঠ। বন্ধুর ডাক এ রকম মধুর লাগেনি কখনো সিয়ামের। ডাক শুনে সেদিকে দৌড়ে গেল সে। সিয়ামের মনে হলো অনেকদিন পর বন্ধুদের সাথে দেখা হলো। মনে হচ্ছিলো কোন দিন বেরোতে পারবো না জংগল থেকে, অবশেষে রক্ষে,
কিন্তু তোমরা কোথায় ছিলে? সিয়াম বললো।
– আমরা এক সাথেই ছিলাম, মিলনের হাতের বনমুরগিটা দেখিয়ে বললো শাহীন, এটাকে তাড়া করেছিলাম। ধরার পর খেয়াল করলাম তুমি নেই। কোথায় গিয়েছিলে?
– আমিও তো একটা বনমুরগিকে তাড়া করেছিলাম, কিন্তু যখন ওটা হাতছাড়া হয়ে গেল তখন দেখলাম তোমরা সাথে নেই, সিয়াম বললো।
– এরকম বেখেয়াল হলে চলে? তোমাকে না পেয়ে তো আমরা ভয় পেয়ে গেছিলাম, মিঠুন বললো।
– চলো এবার যাওয়া যাক, সন্ধ্যা প্রায় হয়ে এলো, সন্ধ্যার আগেই জংগল ছাড়তে হবে, নইলে বলা তো যায় না কোন বিপদ চলে আসে।
এবার বাড়ি ফিরার উদ্দেশে হাঁটা শুরু করলো ছেলেরা। মিঠুন, সজীব ও মিলন এদের কেউই জংগলের এই সাইডে আসেনি, তার ওপর শেষ বিকেলের অল্প আলো। তাই বিপদ কাটাতে পারলো না ওরা। সহজেই পথ ভুল করলো। ঝোপঝাড় মাড়িয়ে এগিয়ে চলেছে ক্ষুদ্র দলটা। জংগলে অল্প আলোও ফুরিয়ে আসছে, অন্ধকার যেন দ্রুত নেমে আসছে। নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলো আর পথ চলছিলো ওরা তাই কখন যে পোড়োবাড়িটার সামনে চলে এলো তা বুঝতেই পারলো না, ৪০ মিটার দূরে বাড়িটাকে দেখে চমকে উঠলো ছেলেরা। ঘন জংগল পেরিয়ে একটু খোলা জায়গা, তারপরই পোড়োবাড়িটা।
পোড়োবাড়িটার কাছে খোলা জায়গার কারণে এখানে আলো এখনো আছে। ঘন জংগল আর আলোস্বল্পতার জন্য পোড়োবাড়িটা আগে থেকে চোখে পড়েনি ওদের। কারোরই বুঝতে বাকি রইলো না এটা সেই কুখ্যাত ডেথ হাউজ। বাড়িটার চারপাশটা চার ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা, যার কিছু কিছু যায়গায় দেয়াল ভেঙে গেছে, দেয়ালের খুব অল্প জায়গাতেই প্লাস্টার আছে, অধিকাংশ জায়গায় লালচে ইট বেরিয়ে পড়েছে। বাড়ির দেয়ালের অবস্থাও একই, দেয়ালের কোন কোন জায়গায় শ্যাওলাও দেখা যাচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে বাড়িটা আনুমানিক আড়াই বা তিন বিঘা জমি দখল করে আছে। দোতালা বাড়িটার একপাশে রানড়বাঘরের মতো। বাড়িটা অবহেলা অযত্নে নষ্ট হয়ে গেছে তবুও দেখে অনুমান করা যায় এক সময় চমৎকার একটা বাড়ি ছিলো এটা।
পোড়োবাড়ির আশপাশে ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ, কোন বাধা ছাড়াই বড় হয়েছে এগুলা, পরিষ্কার করার মতো কেউ নেই। আসলেই কি কেউ নেই এখানে? প্রশড়বটা নিজেই নিজেকেই করলো শাহীন। সন্ধ্যার অন্ধকারে পোড়োবাড়িটাকে অনেকটা কালো দেখাচ্ছে, যেন কোনরূপ কথার দানব ওদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে।

তিন.

অপারেশন-ডেথ-হাউজভুতুড়ে পোড়োবাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে ওরা। কয়েক মুহূর্ত কেউ কোন কথা বলতে পারলো না, সবার আগে নিজেকে সামলে নিলো শাহীন। শাহীন ওদের প্রস্তাব দিলো পোড়োবাড়িটা আরো একটু কাছ থেকে দেখার জন্য। কিন্তু কেউ ওর কথায় রাজি হলো না। ওরা এখান থেকে পালাতে পারলে বাঁচে। শাহীন পোড়োবাড়িটা সম্পর্কে শোনার পর এখানে আসতে চেয়েছিল এক সময়, কিন্তু তা দিনের আলোতে। এসেই যখন পড়েছে তাই একটু কাছ থেকে দেখেই ফিরবে সে।
একবার কোন কৌতূহল হলে সেটা মিটিয়ে ছাড়ে। কোনো রহস্য পেলেও সেটার সমাধান না করে ক্ষান্ত হয় না। এই পোড়োবাড়ির রহস্যও বারবার ওকে হাতছানি দিয়েছে। পোড়োবাড়িটা সম্পর্কে ভালোভাবে জেনেছে সে, জানার পর ঠিক করেছে এর রহস্যটা দেখে ছাড়বে। ওর সাথে কেউ যেতে না চাইলে ওর বন্ধুদের রেখে একাই যেতে চাইল সে। বন্ধুকে একা ছাড়তে চাইলো না সিয়াম, তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও ওর পিছু নিলো। শাহীনও সিয়ামকে রেখে বাড়ি ফিরতে পারবে না মিলন, তা ছাড়া সজীবও বন্ধুদের একা ছাড়তে চাইলো না। মিঠুন একা থাকাটা নিরাপদ মনে করলো না তাই বাধ্য হয়ে ওদের সাথে চললো। ভয়েভয়ে এগোচ্ছে অন্যরা, শাহীনও ভয় পাচ্ছে তবে অন্যদের থেকে কম।
পোড়োবাড়ির ওয়াল টপকে অন্যপাশে প্রথমে নামলো শাহীন তারপর অন্যরা। পোড়োবাড়ির ভেতরেও গাছপালা অল্প তবে ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ।বাড়িটা বেশ নির্জন। বাড়ির বারান্দার কাছাকাছি যেতেই হঠাৎই ওরা একটা মানুষের সামনে পড়ে গেল। দেখতে দেখতেই আরো দু’জন হাজির
হলো সেখানে, ঘিরে ফেললো ছেলেদের। তিনজনের গায়েই কালো কাপড়, মুখও দেখা যায় না কারোর, কালো মুখোশ দিয়ে ঢেকে রাখার জন্য। দু’জনের হাতে বড় দুইটা ছুরি। ধরা পড়ে গেছে ওরা, আরো বেশি ভয় পেয়ে গেল ছেলেরা।
শাহীন হাতের ব্যাগটা বন্ধুদের দেখালো, চোখে চোখে কথা হয়ে গেল ওদের। অল্পসময়েই এক সাথে দুটো ঘটনা ঘটলো। মানুষের মূর্তিগুলো ওদের দিকে এগোতেই, শাহীন তার হাতের ব্যাগটার মুখ খুলে দিয়ে ছুড়ে দিলো একজনের দিকে, যেটাতে সাপ ছিলো। সাপটা গিয়ে পড়লো একটা মুখোশধারীর গায়ে, এতে করে চিৎকার করে উঠলো সে, বাকি দু’জন সেদিকে খেয়াল করলো, সুযোগটা নিলো ছেলেরা, আর এক সেকেন্ডও দেরি করলো না ওরা, একজন মুখোশধারীকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে দৌড় দিলো। প্রাণপণে ছুটছে ওরা, যেন স্কুলের দৌড় প্রতিযোগিতায় মেতেছে। দেয়াল টপকানোর পরও গতি কমালো না ওরা। মানুষের মূর্তি তিনটা দ্রুত নিজেদের সামলে নিয়ে তাড়া করেছ ছেলেদের। সবার আগে দৌড়াচ্ছে মিলন আর সবার শেষে মিঠুন। কালো মুখোশধারী তিনজন অসম্ভব জোরে দৌড়াচ্ছে, ক্রমেই দূরত্ব কমছে ওদের মাঝে। এভাবে চলতে থাকলে ধরে ফেলবে ওদের, ধরলে আর রক্ষে নেই, ওদের হাতে যে ধারালো ছুরি, এক কোপে দুই টুকরো করে দেবে।
মুখোশধারীদের একটু আড়াল করে এক ঝোপের মধ্যে ঢুকে পড়লো চারজন। মিঠুন এখনো পৌঁছাতে পারেনি, সবার থেকে পিছিয়ে পড়েছে সে, এর মধ্যেই একটা গাছের শেকড়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল মিঠুন, ঠোঁট ফেটে রক্ত বের হতে লাগলো তার, হাঁফিয়ে উঠেছে সে, উঠে পালানোর আগেই ওদের হাতে ধরা পড়লো মিঠুন। মুখোশধারীর শক্ত হাতের মুঠো থেকে কোন ক্রমেই নিজেকে ছাড়াতে পারলো না সে। ঝোপে লুকিয়ে ওর বন্ধুরা দেখলো শুধু, কিছুই করতে পারলো না। এমনিতেই কিছু করতে পারতো না তার ওপর ওদের হাতে ধারালো ছুরি আছে, সন্ধ্যার অল্প আলোতেও ওটাকে চিনতে তুল হয়নি ওদের। মুখোশধারী লোকগুলো শক্তিশালী হলেও বুদ্ধি কম বোঝা গেল। অন্যদের খুঁজে পেল না আর, আলোস্বল্পতার জন্যও সুবিধে হলো ছেলেদের। মিঠুন ছাড়া অন্যরা এ যাত্রায় বেঁচে গেল।

 

চার.

এই তো সেদিন মিঠুনের বাবা অসুস্থ হয়ে পড়লো, চিকিৎসা করানোর টাকা জুটলো না। ওর বাবা অসুস্থ হওয়ার পর, সংসার চালানোই দায় হয়ে পড়লো। এমন অবস্থায় মিঠুনের স্কুলে যাওয়া অনেকটা বিলাসিতার মতো মনে হলো, স্কুলে আর যাওয়া হলো না তার। পরিবারের হাল ধরতে হলো মিঠুনকে, মিঠুনের মাও অন্যের বাড়িতে কাজ করতে লাগলো। খুব কষ্টে ওদের দিন কাটছিল। কিন্তু এতেও মুখে হাসি লেগে থাকতো তার। সময় পেলেই বন্ধুদের সাথে ঘুরতো, খেলতো, কারো সাথে ঝগড়াও হতো না তার। মিঠুনকে না পেয়ে ওর মা ভীষণ ভেঙে পড়েছে। কথাগুলা বার বার মনে হচ্ছে শাহীনের। রাত ১০টা পার হয়ে গেছে। মিলনের ঘরে বসে আছে ওরা তিনজন। কারো মুখে কোনো কথা নেই, আজ সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরেছে ওরা চারজন। শুধু মিঠুন রয়ে গেছে পোড়োবাড়িতে। মিঠুনের জন্য মন খারাপ ওদের। মিঠুনের বিপদের জন্য শাহীন নিজে দায়ী, তার জন্যই ছেলেটা বিপদে পড়েছে।অথচ সে স্বার্থপরের মতো পালিয়ে এসেছে। ওর জন্য কিছুই করতে পারেনি।
বাড়ি ফিরে অনেক বকা খেয়েছে ওরা, ভূতের ভয়ে ভীত গ্রামের কেউ মিঠুনের সাহায্যে যেতে রাজি হয়নি। শাহীনের অনুরোধে পুলিশকে খবরটা জানিয়েছে মিলনের আব্বু রফিকুল ইসলাম। কিন্তু পুলিশ তেমন কোন গুরুত্ব দেয়নি। কারণ আগেও পোড়োবাড়িতে নিখোঁজ হওয়া এক ছেলেকে ওখানে গিয়েও খুঁজে পায়নি। ওরা বলেছে কী একটা জরুরি কাজে ওরা ব্যস্ত, বিষয়টা কালকে দেখবে। পুলিশের আশায় বসে থাকতে রাজি নয় শাহীন। যা করার ওদেরই করতে হবে। বন্ধুদের সাথে কথা বলা হয়ে গেছে। দিনের বেলা ওদিকে যেতে পারবে না ওরা তাহলে বড়দের নজরে পড়ে যাবে, তা ছাড়া দিনের আশায় বসে থাকলে দেরিও হয়ে যাবে। তাই আজ রাতেই যাবে ডেথ হাউজ অপারেশনে। অন্যরাও মেনে নিয়েছে তার এ সিদ্ধান্ত।

পাঁচ.

অপারেশন-ডেথ-হাউজএখন রাত ১২টা, মধ্যরাত। গ্রামের মানুষগুলো গভীর ঘুম আচ্ছন্ন। ঘুমায়নি শুধু ওরা চারজন। নদীর তীরে এসে হাজির হয়েছে ওরা। ঘাটে নৌকা আগেই রেডি করে রেখেছিলো সজীব। সবাই একটা করে টর্চলাইট, একটা করে পকেট নাইফ এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়েছে। বয়সের তুলনায় অনেক বড় ঝুঁকি নিতে যাচ্ছে ওরা। শেষবারের মতো দেখে নিলো শাহীন সবকিছু ঠিক আছে কি না। তারপর আল্লাহর নাম নিয়ে যতটা সম্ভব নিঃশব্দেই নৌকাতে এসে বসলো ওরা। এবারও বৈঠা ধরলো মিলন ও সজীব। জ্যোৎস্না রাত। জ্যোৎস্নার আলোয় রাতের অন্যরকম ভয় মিশ্রিত সৌন্দর্য। কেমন যেন মায়াময় এক রাত। সেই সাথে আছে হালকা বাতাস, মাঝে মাঝে কুকুরের ডাক ভেসে আসছে।
এমন রাতে নৌকা নিয়ে বেড়ানোর মজাই আলাদা, মনে হবে যেন অনন্তকাল ধরে নৌকা চলুক। কিন্তু এসবের প্রতি খেয়াল নেই ওদের, একটাই প্রশ্ন এখন, মিঠুনকে যথাসময়ে উদ্ধার করতে পারবে তো? চাঁদটা যেন অসহায়, মাঝে মাঝেই মেঘের আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা লুকোচুরি খেলার মতো। মেঘের আড়ালে চাঁদটা হারিয়ে গেলে গাঢ় অন্ধকার ঘিরে ধরছে ওদের। নৌকার যাত্রীরা সবাই চুপ করে আছে, পানিতে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে এগিয়ে চলেছে নৌকা। আস্তে আস্তে গ্রামের সাথে দূরত্ব বেড়ে চলেছে ওদের। দূরত্ব কমছে জংগলের সাথে। যতই এগোচ্ছে ততই উত্তেজনা কাজ করছে ওদের মধ্যে, সেই সাথে যোগ হয়ছেভয় ও অজানা শঙ্কা। এভাবে এক সময় জংগলের মধ্যে চলে এলো নৌকা, দুই ধারে এখন জংগল। গ্রাম থেকে দূরে সরে এসেছে ওরা। এখানে কোন বিপদে পড়লে কেউ এগিয়ে আসবে না সাহায্য করতে, ওদের চিৎকারও গ্রামে পৌঁছাবে না। নিজেদের খুব অসহায় মনে হচ্ছে শাহীনের।
গাছপালাগুলা যেন একেকটা দৈত্য, ওদেরকে গিলে খাবার অপেক্ষায় আছে। আরো কিছুদূর এগোনোর পরে ইঞ্জিনচালিত নৌকার শব্দ শুনতে পেল ছেলেরা। ওরা যেখানে এসেছে এখান থেকে তীরে উঠে দেড় কিলোমিটার হাঁটলেই পোড়োবাড়িটা পাওয়া যাবে। আস্তে আস্তে বাড়ছে ইঞ্জিন চালিত নৌকার শব্দ অর্থাৎ নৌকাটা এদিকেই আসছে। হার্টবিট বেড়ে গেছে ওদের, কোন সন্দেহ নেই এটা পোড়োবাড়ির সাথে যোগাযোগের জন্যই আসছে। দ্রুত ওদের নৌকাটা কোথাও লুকোতে হবে, নইলে ধরা পড়ে যাবে। কাছেই একটা ঝোপ পাওয়া গেল যেখানে ঝোপের ডালপালা পানিতেও গিয়ে পড়েছে। নৌকাটা সেখানে লুকিয়ে উপরে উঠে এলো ওরা। একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো। নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে ছেলেরা, যেন নিঃশ্বাস নিতেও ভয় পাচ্ছে। নদীর ধারে গাছপালা কম হওয়ায় জ্যোৎস্নার আলো এখানে আসছে, এতে সবকিছু ভালভাবে দেখা যাচ্ছে। ওরা যেখানে থেমেছিলো নৌকা নিয়ে, তার একটু সামনে এসে থেমে গেল ইঞ্জিন চালিত নৌকাটা। মাঝারি সাইজের নৌকার মাঝখানে ছাউনি আছে তার নিচে একটা চার্জার লাইট জ্বলছে। মোট তিনজন মানুষ ও কিছু মালামাল আছে নৌকাটিতে। এক ধরনের সাইরেন বাজলো নৌকা থেকে, তার মানে এটা দিয়ে সঙ্কেত দিলো। সাইরেনটা শুনলেই ভয় লাগে। মিলন তো দৌড়ে পালাতে চাইলো, শাহীন খপ করে ওর হাত ধরে ফেললো, ভয় শাহীনও পাচ্ছে কিন্তু এখন ঝোপ থেকে বের হলে লোকগুলার চোখে পড়ে যাবে। তখন কেমন বিপদ হতে পারে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ঝোপের মধ্যে জমে গেছে ছেলেরা, সুযোগ পেয়ে মশা ওদের গায়ে সুচ ফুড়ছে, যেন অনেক বছর পর সুযোগ পেয়ে প্রতিশোধ নিচ্ছে। ঝোপের মধ্যে ভ্যাপসা গরম আর মশার কামড় খুব অসহ্য লাগছে ওদের কাছে। বেশ কিছুক্ষণ পর পোড়োবাড়ির দিক থেকে দুটো মানুষের ছায়া উদয় হলো। দুইজনের হাতে দুইটা বাক্স। নৌকা থেকেও কতগুলো বাক্স নামানো হলো। এরপর দুই পক্ষের বাক্স বিনিময় করা হলো।
কোন সন্দেহ নেই, চোরাই মাল নেয়া ও দেশীয় মাল পাচার করা হয় এখান থেকে। জংগল শেষে এই নদীটা অন্য একটা নদীর সাথে মিশেছে, ঐ নদীর ওপারে সীমান্ত। চোরাই মালগুলা সীমান্তের ওপার থেকে এখানে আনা হয়। পরিত্যক্ত পোড়োবাড়িটা ওদের জন্য আদর্শ স্থান। নৌকা আরোহীদের অদ্ভুত সাইরেন ভুতুড়ে শব্দ মনে করে মানুষে, এ জন্য এই এলাকাটাকে আরো ভয় পায় তারা। রহস্যটা তাড়াতাড়িই সমাধান হয়ে গেল, তবে এখন জানতে হবে এরা কী কারবার করছে, কিন্তু এসবের আগে মিঠুনকে উদ্ধার করতে হবে। ইঞ্জিনচালিত নৌকা ও পোড়োবাড়ির দিক থেকে আসা লোক দুইটা তাদের কাজ সেরে চলে গেল, যার যার পথে। আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তারপর ঝোপ থেকে বের হলো ছেলেরা।অপারেশন-ডেথ-হাউজ

ছয়.

গতকাল এ পথে এসেছিলো ওরা, তা ছাড়া সজীব একবার কোন পথে এলে রাতেও সেটা ভুলে না। বিরক্তিকর ঝিঁ ঝিঁ পোকা বিরতিহীনভাবে ডেকে চলেছে। জংগলের গভীরে জ্যোৎস্নার আলো পৌঁছায়নি, গাঢ় অন্ধকারে জমে আছে সবখানে। যেন কোন অন্ধকারের রাজ্যে প্রবেশ করেছে ছেলেরা। গা ছমছমে ভুতুড়ে পরিবেশ। মাঝে মাঝে পেঁচার ডাক আরো ভুতুড়ে করে তুলছে পরিবেশটাকে।
নিশাচর প্রাণীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে জংগলে। টর্চ জ্বালাচ্ছে না কেউ, কারো নজরে পড়ে যাবে এই ভয়ে। মোবাইলের অল্প আলোয় পথ চলছে ওরা। এতে পথ চলতে যেমন অসুবিধা হচ্ছে তেমনি দেরিও হচ্ছে। সবার আগে চলেছে শাহীন তার পেছনেঅন্যরা। ওদের সামনে সড়সড় শব্দ করে মাঝারি সাইজের একটা সাপ সরে গেল। নদী থেকে একটু দূরে সরে এসে থামলো ওরা।
শাহীনের পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করে দিলো সবাই। প্রমে করাত দিয়ে গাছের মোটা একটা ডাল কাটা হলো, ছোট দুইটুকরো করা হলো ডালটাকে। ডালের একেকটা টুকরোর ওজন একজন পূর্ণ বয়স্ক মানুষের ওজনের দ্বিগুণ। মোটা দড়ি দিয়ে ফাঁদ তৈরি করলো শাহীন, দড়ির এক মাথা কাটা ডালটার সাথে বেঁধে সেটাকে অন্য একটা গাছের উঁচু ডালের সাথে ঝুলিয়ে রাখা হলো। দড়ির আরেক মাথা বেঁধে রাখা হলো একটা গাছের শেকড়ে। এ রকম দুইটা ফাঁদ বানানো হলো। সিদ্ধান্ত হলো শাহীন ও সিয়াম পোড়োবাড়িতে ঢুকবে। মিলন ও সজীব ফাঁদের কাছে থাকবে, তা ছাড়া সবাই একসাথে পোড়োবাড়িতে যাওয়াটা ঝুঁকিপূর্ণ, এক সাথে ধরা পড়লে সব শেষ। শাহীনের পরিকল্পনা সফল নাও হতে পারে, আল্লাহ ভরসা, এ ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই। দলটা দুই ভাগ হয়ে গেছে এখন। জংগলের পথ ধরে আরো ২৫ মিনিট হাঁটার পর পোড়োবাড়ির কাছে পৌঁছে গেল শাহীন ও সিয়াম।
শাহীনের মনে হচ্ছে পোড়োবাড়িটা যেন ওদেরকে গিলে খাওয়ার অপেক্ষায় আছে। রাতে পোড়োবাড়িটা আরো ভুতুড়ে আর নির্জন মনে হচ্ছে। শাহীনের ধারণা এই বাড়িতে বেশি হলে ৪-৫ জন মানুষ আছে। আর সে অনুযায়ী সে পরিকল্পনা নিয়েছে। মনে হচ্ছে অচেনা কোন দেশে চলে এসেছে ওরা, এই নিস্তব্ধতা যেন ওদের চিৎকার করে বলছে বাঁচতে চাইলে পালাও এখান থেকে। পোড়োবাড়ির কাছে গাছপালা কম হওয়ার কারণে জ্যোৎস্নার আলো আসছে এখানেও ।
আল্লাহর নাম নিয়ে পোড়োবাড়ির পেছনের দেয়াল টপকে ঢুকে পড়লো ওরা। ইংরেজি অক্ষর খ আকৃতির বাড়িটা, দোতলা পোড়োবাড়িটার সামনে বারান্দা, অনেকগুলো রুম রয়েছে বাড়িটাতে। কেউ লুকোলে সহজে খুঁজে বের করা যাবে না। পুরো বাড়িটাতেই জ্যোৎসড়বার আলো ছাড়া অন্য আলো নেই। দেখে মনে হচ্ছে ওরাই প্রম এসেছে এখানে। সুনসান নীরবতা এখানে, ফিসফাস কথাও জোরে মনে হচ্ছে ওদের কাছে। খুব সাবধানে প্রম রুম থেকে খোঁজা শুরু করলো ওরা। প্রথম দুইটা রুমের দরজা নেই, মাকড়সার জালে পরিপূর্ণ, ধুলোর আস্তরণ জমে আছে, দেখেই অনুমান করা যায় বহুদিন ধরে এই ঘরে কেউ পা রাখেনি। তৃতীয় রুমটাতেও একই অবস্থা, টর্চের আলো পড়তেই কিছু চামচিকা উড়ে গেল। তৃতীয় রুমের পর একটা সিঁড়ি দোতলায় চলে গেছে। সিঁড়ি বেয়ে দোতালায় চলে এলো দু’জন, সন্দেহজনক কোন কিছুই পাওয়া গেল না। আবার নিচের রুমগুলো দেখতে লাগলো শাহীন ও সিয়াম। প্রায় সব কয়টা রুমই একই রকম, মানুষ চলাচলের কোন চিহ্ন পাওয়া যায় না। শেষের দিকের রুমগুলো একটু আলাদা। দেখে বোঝা যায় সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের চলাচল ছিলো। একটা রুম থেকে বের হওয়ার পর ওরাএকটা লোককে দেখলো বারান্দা দিয়ে হেঁটে শেষ রুমটার দিকে যাচ্ছে। তাড়াতাড়ি ওরা বারান্দার নিচে একটা গাছের আড়ালে সরে গেল দু’জন।
লোকটা চলে যাবার পর ১০ মিনিট হয়ে গেল কিন্তু তাকে আর ফিরতে দেখা গেল না, এমনকি অন্য কাউকেও আর দেখতে পেলো না ওরা। খুব সাবধানে সেই রুমটাতে চলে এলো দু’জন। পুরনো দুইটা চেয়ার আর একটা টেবিল ছাড়া আর কোন আসবাবপত্র নেই রুমটাতে। রুমের কোনায় একটা সিঁড়ি আছে সেটা নিচে নেমে গেছে। নিচে আরেকটি রুম। অন্যগুলোর মতো এই রুমটাও অন্ধকার। পুরনো একটা আলমারি, আর একটা বুক সেলফ আছে শুধু এই রুমে। খুব অবাক হলো ওরা লোকটা এদিকে এসে কোথায় গায়েব হয়ে গেল? লোকটা এখান থেকে কোথাও যায়নি, গেলে ওদের চোখে পড়তো। একে অপরের দিকে তাকাল দু’জন। কোন গোপন পথ আছে কিনা খুঁজতে শুরু করলো শাহীন ও সিয়াম। নিচের রুমে কোন কিছু পাওয়া গেল না, ওপরের রুমটাতেও না। আবার নিচে নেমে এলো ওরা। এবার একটা জিনিস চোখে পড়লো শাহীনের, ৭ নম্বর সিঁড়ির ধাপটা একটু বড় করে বানানো হয়েছে। মিস্ত্রিরা এরকম একটা ভুল করবে কেন বুঝতে পারছে না শাহীন। সিয়াম শাহীনের ওপর ক্ষেপে গেল এতে, সে বললো দেখো সবখানেই তোমার এমন খুঁতখুঁত করা আমার সহ্য হয় না, তুমি কি বাড়িটার ওপর গবেষণা করতে এসেছো নাকি? যত দ্রুত পারি মিঠুনকে নিয়ে এখান থেকে চলে যাবো। এখানে আমার একটুও ভাল লাগছে না।
– ভাল লাগছে না না বলে বলো ভয় পাচ্ছো, এ জন্য থাকতে চাচ্ছো না। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সিয়াম কিন্তু থেমে গেল, ৭ নম্বর ধাপে ছোট একটা লোহার আংটা আছে, খুব ভাল করে না দেখলে চোখেই পড়ে না, সিয়ামও দেখলো জিনিসটা।
শাহীনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সেটা খুঁজে পেয়েছে। ওটা ধরে টান দিতেই সিঁড়ির কাছের দেয়ালের গা থেকে খুলে এলো একটা পাথর, পাথর আর দেয়ালের রঙ এক হওয়ায় আগে থেকে বোঝার উপায় নেই এটা পাথর। এর পেছনেই তেল দেয়া একটা লোহার লিভার। লিভারে চাপ দিলো শাহীন, নিঃশব্দে ফাঁক হয়ে গেল সিঁড়ির কাছের দেয়ালের একাংশ। সেখান থেকে শুরু হয়েছে একটা সুড়ঙ্গ। সিয়ামের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলো শাহীন, লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরালো সে। টর্চ নিয়ে আগে নামলো শাহীন, তার পেছনে নামলো সিয়াম।

সাত.

অপারেশন-ডেথ-হাউজঅন্ধকার সুড়ঙ্গটা ১০ হাতের মতো গিয়ে ডানে মোড় নিয়ে একটা রুমের দরজার কাছে শেষ হয়েছে। ছোট একটা রুম প্লাস্টার করা দেয়াল, কিছু জায়গায় প্লাস্টার খসে পড়েছে, রুমটা অন্ধকার, টর্চের আলোয় দেখলো দু’জন। কিছু বাক্স রাখা আছে এখানে, যেসব জিনিস রাখা আছে তার অধিকাংশই এর আগে দেখেনি শাহীন ও সিয়াম। এই রুমের শেষ মাথায় একটা দরজা, সেখান দিয়ে আরেকটা রুমে চলে এলো ওরা, এই রুমটা একটু বড় আগেরটার চাইতে, মাঝখানে একটা বাতি জ্বলছে, এখানে বিভিনড়ব রকম জিনিস রাখা আছে, কাচের বোতল, অনেক রকম তরল পদার্থ চোখে পড়ল এখানে। ওরা রুমে প্রবেশ করতেই হাততালি শুনে চমকে উঠলো দু’জন। রুমের এক পাশে হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে মিঠুনকে তার পাশে চেয়ারে বসে আছে মোটাসোটা একটা লোক। টাক মাথা, মুখে বড় গোঁফ আর ভুঁড়িটা সামনে একটু বেশিই ঝুঁকে পড়েছে। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আরো দু’জন। ওরা যে দরজা দিয়ে ঢুকেছিলো সেখানে এসে দাঁড়ালো আরেকজন লোক। অর্থাৎ আটকা পড়ে গেছে শাহীন ও সিয়াম। মোটা লোকটাই আগে কথা বলা শুরু করলো-
– বাহ! অসাধারণ সাহসী আর বুদ্ধিমান ছেলে তোমরা দুজন, রাতের বেলা ভয়ে এদিকের নদী পথেই কেউ যায় না অথচ তোমরা এসেছো পোড়োবাড়িতে, আবার গোপন ঘরটাও খুঁজে পেয়েছো। তা কি জন্য এসেছো, নিশ্চয় বন্ধুকে উদ্ধার করতে?
সে কথার জবাব না দিয়ে শাহীন বললো, আপনিই তাহলে এই পোড়োবাড়ির ভূত? এতদিন মানুষকে বোকা বানিয়ে রেখেছিলেন?
– আমার কি দোষ বলো? গ্রামের মানুষ তো সব গাধা, ভয়ে এদিকে আসেই না যাচাই করে দেখতে। একবার অবশ্য এক ছেলে তোমাদের মতো দুঃসাহস দেখাতে এসেছিলো, কিন্তু ছেলেটার ভাগ্য খারাপ ছিলো, বাড়িটা সম্পর্কে যে কথা প্রচলিত আছে, সেটাই করতে হলো।
– যতটুকু বুঝতে পারছি আপনারা এখানে খুবই বাজে কাজ করছেন, কোন কিছু পাচার করা আর অন্য অবৈধ কিছু দেশে সরবরাহ করছেন। দেশের ক্ষতি আপনি কিভাবে করছেন? নিজ দেশের প্রতি ভালোবাসা তো পশুরও থাকে।
– শোনো দেশের প্রতি ওসব ভালোবাসা দিয়ে কিছু হয় না বুঝলে? বাঁচতে চাইলে দরকার টাকা, এ জন্য যা করা দরকার আমি সেটাই করছি। যাইহোক, তোমাদের এসব বলার এখন প্রয়োজন নেই আমার, এমনিতেই অনেক কিছু জেনে ফেলেছো তোমরা, এখানে আর রাখা যাচ্ছে না তোমাদের, তবে চিন্তা করো না তোমাদের বাঁচিয়েই রাখবো। মোটা লোকটা বললো, মানিক এদেরকে নিয়ে চল, একটু পর আরেকটা নৌকা আসবে, ওটাতে এদেরকে পাঠিয়ে দেবো, এরা কচি ছেলে একবার ব্রেন ওয়াশ করে দিলে অনেক কাজে লাগবে ছেলেগুলা, এমন সাহসী ছেলে আমাদের দরকার।
মোটা লোকটার আদেশে মিঠুনের বাঁধন খুলে দিলো মানিক। বস এদেরকে বেঁধে নিলে হয় না? যদি কোন ঝামেলা করে আবার? শাহীন ও সিয়ামকে দেখিয়ে বললো, সন্ধ্যা বেলা তো ঝামেলা করে এরা দুইজনসহ আরো দুই ছোকরা পালিয়ে গেছিলো।
– মোটা লোকটা হাতের পিস্তল দেখিয়ে বললো, এটা আছে না? কথা না শুনলে ওদের কপাল পুড়বে। এটা দিয়ে কত বাঘা বাঘা লোককে সোজা করেছি, আর এরা তো কয়েকটা পিচ্চি ছেলে। শাহীনকে বললো মোটা লোকটা, জানি বুদ্ধিমান ছেলে তোমরা, যেদিকে যেভাবে যেতে বলবো যাবে, কোন গোলমাল হলেই, পিস্তল দেখিয়ে বোঝাল কী হবে। কোন উপায় না দেখে আদেশ মানতে বাধ্য হলো শাহীন ও সিয়াম। ছেলেদেরকে তিনজন গার্ড দিয়ে নিয়ে চললো। আগে হাঁটা শুরু করলো মোটা লোকটার দুইজন সহকারী তাদের পেছনে ছেলেরা, সবার পেছনে মোটা লোকটা, পিস্তল ছেলেদের দিকে ধরে হাঁটছে। পোড়োবাড়ি থেকে বেরিয়ে নদীর দিকে চলেছে এখন দলটা। পোড়োবাড়িটা থেকে বেশ দূরে চলে এসেছে ওরা। একটা ছোট লেকের পাশ দিয়ে যাচ্ছে এখন।
শাহীন মোটা লোকটার সামনে আছে তাই কিছু করতে হলে তাকেই করতে হবে। সিয়ামকে খোঁচা মেরে সতর্ক করলো শাহীন। দলটা লেকের শেষ মাথায় পৌঁছে গেছে। হঠাৎ করে শাহীন পেছন ঘুরে মোটা লোকটার হাতে জোরে বাড়ি মারলো, পিস্তলটা ছিটকে ঘপাং করো পড়লো লেকের পানিতে, সিয়াম আর শাহীন জোরে মোটা লোকটার ভুঁড়িতে ধাক্কা মারলো, দু’জনের ধাক্কায় সে লেকের পাড়ে চিৎ হয়ে ধপ করে পড়ে গেল, ব্যথায় আউ করে উঠলো সে। ওকে ফেলেই সিয়াম, মিঠুন ছুটলো একদিকে, শাহীন আরেকদিকে। বসের নির্দেশে তার দুই সহকারী দুইদিকে ছুটলো তাদের ধরার জন্য। এক দৌড়ে এসে গাছের আড়ালে লুকোলো শাহীন। সেখানে আগেই ফাঁদ পাতা ছিলো লোকটা ফাঁদের মধ্যে পা দিতেই মিলন দড়ির বাঁধন খুলে দিলো, লোকটার পা ফাঁদে আটকা পড়লো, দড়ির অন্য মাথায় বাঁধা গাছের ডালটা সড়াৎ করে মাটিতে নেমে গেল। ফাঁদে আটকানো লোকটা সাথে সাথে পা উপরে মাথা নিচে দিয়ে গাছের উঁচু ডালের সাথে ঝুলে পড়লো। বাদুড় যেভাবে ঝুলে থাকে সেভাবে।
এই অবস্থা দেখে মিলন ও শাহীন হাসি চাপিয়ে রাখতে পারলো না। লোকটা রাগে ওদের গালাগাল করতে লাগলো। সিয়াম ও সজীব মিলে অন্য আরেক জনকেও ফাঁদে আটকিয়েছে। মোটা লোকটা ব্যথায় উঠতে পারছে না। এমনিতেই মোটা তারপর ভুঁড়িতে আঘাত পেয়েছে। মিঠুন গিয়ে আরেক ঘা বসালো। তার সাথে খারাপ ব্যবহারের প্রতিশোধ যাকে বলে। তারপর দু’জন মিলে মোটা লোকটাকেও বেঁধে ফেললো। তিনজনকে বাঁধার পর ওরা নৌকার জন্য অপেক্ষা করলো। নৌকাতে করে একজন মাঝি এলো শুধু। পাঁচজন মিলে তাকে সহজেই কাবু করে ফেললো, পর্যাপ্ত দড়ি নিয়ে এসেছিলো শাহীন। তাকেও বেঁধে ফেললো ছেলেরা। এখান থেকে চিৎকার করলেও পোড়োবাড়ির কেউ শুনতে পাবে না, তাই লোকগুলোর সাহায্যেও কেউ আসবে না। তবুও ঝুঁকি নিতে চাইলো না শাহীন, বাঁধার পর চারজনের মুখে চারটা রুমাল গুঁজে দিলো। শাহীন ও মিঠুন ছুটলো পুলিশ আনতে, বাকিরা জংগলে রয়ে গেল।

আট.

তিন দিন পর আবার সেই পোড়োবাড়িতে যাচ্ছে ওরা। কিছু অপরাধী চক্র সেখানে আস্তানা গেড়েছিলো। সীমান্তের ওপার থেকে নেশাজাতীয় দ্রব্য এনে পোড়োবাড়িতে জমা রাখতো, তারপর সুযোগ বুঝে দেশের অভ্যন্তরে সাপ্লাই দিতো। দেশের মূল্যবান সম্পদও পাচার করতো ও পথে। পুলিশ সবকিছু জব্দ করেছে। এর সাথে জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কিছু চিহ্নিত অপরাধীকেও গ্রেফতার করা হয়েছে, যাদেরকে আগে থেকে খুঁজছিলো পুলিশ। এ জন্য পুলিশ চিফ বারবার ছেলেদের ধন্যবাদ দিয়েছে। সবার চোখে ছেলেরা এখন হিরো, সবাই ওদের সাহসের প্রশংসা করছে। এত বড় একটা চক্র ধরা পড়ার জন্য ও ছেলেদের সাহসের স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার থেকে ওদের পাঁচজনের প্রত্যেককে ৫০,০০০ হাজার টাকা পুরস্কার দিয়েছে। মিলন, শাহীন, সিয়াম ও সজীব কেউই এই টাকা নেয়নি, মিঠুনের আম্মুর হাতে তুলে দিয়েছে, মিঠুনের আব্বুর চিকিৎসার জন্য। মিলন ও সজীবের আব্বুও খুব খুশি হয়েছেন ছেলেদের এমন কাজে, ওরা যেটা পারেনি সেটা ছেলেরা করে দেখিয়েছে। মিঠুন বা তার আম্মু কেউই নিতে রাজি হয়নি, ওরা নিতে বাধ্য করেছে। গতকাল মিঠুনের বাবাকে চিকিৎসার জন্য শহরে পাঠানো হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, অল্প দিনেই তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবেন।
পোড়োবাড়িটা আর ফাঁকা রাখা হবে না, প্রত্ন বিভাগ বাড়িটা মেরামত করে পর্যটন স্পটের উপযোগী করে তুলবে। গ্রামের ছেলেরা ওদের অভিযানের কথা শুনে, ওদেরকে ধরেছে ওখানে পিকনিক করার জন্য। ওরাও রাজি হয়েছে যেতে। আজকে আবার সেই ডেথ হাউজে যাচ্ছে ওরা তবে আজকে কোন ঝুঁকি নিতে নয় স্রেফ আনন্দ করতে।অপারেশন-ডেথ-হাউজ

Share.

মন্তব্য করুন