(গত সংখ্যার পর)

দু’তিন দিন পর আবার সেই মাছওয়ালা হারানের সাথে একটা টাকপড়া লোক এলো। এবার মনে হয় আটঘাট বেঁধেই এসেছে। লোকমান চাচা বললো- শোন গরুটা আমি ছাব্বিশ হাজার টাকা হলে ছেড়ে দেব। হারু বললো- বুলেন কি চাচা? গরু আপনার একেবারে ঝিল্লি। দুদিন পর মরবে যে। এ কথা শুনে চাচা চেঁচিয়ে বললো- এই কে আছিস আমার বন্দুকটা নিয়ে আয় তো। এই কথা শুনে হারান আর লোকটার পা কাঁপতে লাগলো। হারান বললো- হুজুর ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা করেন। লোকমান চাচা একটু নরম হয়ে বললো- থাক আমি এ গরু বেচবো না, তোমরা যাও। হারান আর ওই লোকটা কোন মতেই যাচ্ছিলো না ঠেস ধরে বসে ছিলো। শেষ পর্যন্ত লোকমান চাচা বললো- যাও গরু নিয়ে যাও। পঁচিশ হাজার পাঁচশ টাকা গুনে গুনে দিলো হারান। লোকমান চাচার চোখে পানি এলো। আমার ধলি মার চোখ ভিজলো। আমি মার দিকে তাকাতে পারলাম না। হারান লোকটা ফোকলা দাঁতে হেসে আমার ধলি মাকে খুলে নিয়ে গেল। আমি তার যাবার পথে তাকিয়ে রইলাম। মা বুঝি পিছন ফিরে একবার তাকিয়ে ছিলো।
মা চলে যাবার দু’দিন পর উদয় হলো বজলু। তবে তার একটা পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা, হাতে বন্ধুক নেই। তার বদলে দুই বগলে দুটো ক্রাচ লাঠি। তার এমন অবস্থা কেন হলো বুঝলাম দুদিন পর। বাড়ির কৃষক কাশেম আর নজরের মুখে গল্প শুনে। নিমতলায় দাঁড়িয়ে নজর বলছিলো-বজলু কার কাছে যেন জোর করে চাঁদা বাজি করতে গেছিলো। সেখানে প্রতিপক্ষ ধরে তার ঠ্যাং ভেঙে দিয়েছে। তাতে লোকমান চাচার কোন প্রতিক্রিয়া নাই। বরং কাজটা যেন ভালো হয়েছে এমন ভাব। বাবার প্রশ্রয় না পেয়ে বজলু এখন নিমতলায় চেয়ারে চুপ চাপ বসে থাকে। সাজুও বড় হয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। সাজুর বড় ভাই রাজু চুপ চাপ পড়াশুনা করে। গৃহস্থের প্রতি তেমন কোন উৎসাহ নাই। সেই মডার্ন হতে চায়। শহরে গিয়ে পড়াশুনা করতে চায়। তাই গরুর গোয়ালের আশেপাশে তাকে দেখা যায় না। জিন্সের প্যান্ট শার্ট পরে। চশমা চোখে দিয়ে মাঝে মাঝে গোয়ালের দিকে আসে। কারণ গোয়ালের পাশ দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ। সেই পথে দু’একবার হেঁটে আসে। একদিন রাজুকে দেখে ভেলু হঠাৎ চিনতে না পেরে ঘেউ ঘেউ করে ধাওয়া করে ছিলো। সেই ধাওয়া খেয়ে গরুর গোয়ালে ঢুকে গোবর ভরিয়ে একাকার অবস্থা। সেই থেকে রাজুটার ভাব অনেকটা কমে গেছে।
কদিন বাদে হেমন্ত কাল চলে এলো। চারিদিকে ধান কাটা আর মাড়াইয়ের সাজ-সাজ রব। হাশেম, নজর আলী দিন রাত মাঠে মাঠে। গোয়ালের পাশে যে আঙ্গিনা সেটাকে বলে খোলান। সেই খোলান ধানে ধানে ভরে উঠলো। গরুদের আর স্বস্তি রইলো না। ধান মাড়াই শুরু হলো।
সারা দিন ছিটানো কাটা ধানের উপর আমাদের দলবেঁধে ঘুরানো শুরু হলো। আমরা ধানের উপর ঘুরছি। নজর আর কাশেম আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। বলদ আর ষাঁড়গুলোকে ঘুরাতে নজরের অবস্থা খারাপ। ষাঁড়গুলোকে দড়ির সাথে বেঁধে মাড়াইয়ের কাজ করা কম কষ্টের না। গোঁয়ারের মতো ঠেলা ঠেলি লাগিয়ে দিচ্ছে। আমি এখন বলদ তাতেই কাজ এসে কাঁধে চেপে বসেছে। ভবিষ্যতে কি পরিমাণ কাজ করতে হবে বোঝায় যাচ্ছে। খোলানের পাশে বিশাল বৈঠকখানায় পাড়ার যত কৃষান, ধান কাটার শ্রমিক লাইন ধরে আমাদের ধান মাড়াই দেখছে। সাথে আছে পাড়ার ছোট বাচ্চারা, যেন একটা উৎসব। ধান কাটা, মাড়াই কৃষকের জীবনের এক ধরনের বড় উৎসব। এসবের মধ্যে গরুদের আছে মস্ত অবদান। তারপর গোলা থেকে ধান বস্তায় ভরে, গাড়িতে করে হাটে বেচা কেনা, সব খানেই আমাদের কাজে লাগতে হয়। ধান মাপার সময় নজর আলী যখন মুখে বলতে থাকে- পাঁচের পাঁচ- ছয়ের ছয়- তখন তার মুখে ফেনা জমে যায়। কাশেম বস্তা ধরে বসে থাকে আর নজর ধান মেপে মেপে বস্তায় ভরে।
এই ভাবে মানুষের যাতায়াত, কোলাহল, ধান মাড়াই চলেলো পুরো কার্তিক অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত। আমরা গরুরা পুরাই খাটনির মধ্যে কাটালাম। গরুদের কাজের কোন বিশ্রাম নাই। আবার নতুন করে নতুন ফসলের জন্য মাঠে চাষ দেওয়া। একদিন আমাকে নজর কি মনে করে বারান্দার খুঁটিতে বেঁধে রাখলো। আমি চুপ চাপ ধানের খড় চিবুচ্ছি। খেয়াল করে দেখলাম, বারান্দায় একটা বই হাতে বজলুর বড় ছেলে রাজু এসে দাঁড়ালো। তার পর বললো বজলু ভাই আমি যেটা বলবো সেটা তুমি দেখাবা, বলে গরুর রচনা পড়তে শুরু করলো। গরুর দুটি শিং আছে বলে বললো- এ গরুটার শিং খুব ছোট? নজর হেসে বললো- রাজু ভাই এ হলো ছোট গরু শিঙ এখনও ছোট। গরুর দুধের ছানা, দই, মিষ্টি, ঘি এসব হয়। এ পর্যন্ত পড়ে রাজু বললো- মাস্টার মশাইয়েরা ভুল লিখেছে। এ গরুটার তো দুধ হয় না, হবেও না। নজর হেসে বললো- জি ভাতিজা। সব গরু এক হয় না। ওইযে লাল গাভীটা আছে, ওকে নিয়ে আসলে তোমার পড়ার সাথে মিলে যাবে। শোন-শোন ঠিক আছে, কিন্তু বইয়ে এমন কথা তো লেখা নাই যে গরুর বিভিন্ন প্রকার হয়। গাই গরু, বকন গরু, এঁড়ে গরু, বলদ গরু, কই এসব তো লেখা নাই। হাশেম বললো- সে তোমার মাস্টার মশাইকে শুধালেই হয়।
রাজু খেপে গিয়ে বললো -নিয়ে যাও এ গরু দিয়ে রচনা হবে না। তুমি গাভীটা নিয়ে আসো। নজর তখন আমাকে কাঁঠাল গাছের সাথে বেঁধে। লাল গাভীটাকে নিয়ে গেল। আমি দেখে তো হেসেই মরি।
মাঠে রোজ চরতে যাই। আকাশ জোড়া ফসলের মাঠ। কোন জমিতে ধান, কোন জমিতে মশুর, বুট খেশারি, কোন জমিতে সবজি। রাখালরা সব সময় ব্যস্ত থাকে কোন গরু ছাগল যেন ফসল খেয়ে না ফেলে। তার পরও মজার খাবার পেলে খাওয়ার ইচ্ছে জাগবে। কেননা রোজ রোজ এক খাবার খেতে কত আর ভালো লাগে। আমারও ইচ্ছে জাগে মশুর অথবা বুট ক্ষেতে একটু নেমে পড়ি। তাই একদিন মজনুর চোখ ফাঁকি দিয়ে মশুরের জমিতে নেমে পড়লাম। বাহ্ কুচুর মুচুর শব্দ। আর খেতে কত মিঠা। মনের আনন্দে মশুরের গাছগুলো চিবিয়ে পাকস্থলীতে চালান দিচ্ছিলাম। এমন সময় চেঁচামেচি শুরু হলো। মজনুর ডাকটা একটু দূরে, কিন্তু জমিওয়ালা বোধ হয় খুব কাছেই ছিলো। সে এসে আমার গলার দড়িটা ধরলো।
আমি পড়িমরি করে ছুটে পালানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু জমিওয়ালার হাত থেকে ছুটতে পারলাম না। এরই মধ্যে মজনু এসে পড়েলো। সে আমাকে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। ক্ষেতের মালিক খুব হুমকি ধমকি দিয়ে মজনুকে সরিয়ে দিলো। মজনু নিরুপায় হয়ে হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো- আমি চাচার কাছে কি জবাব দিবো? ক্ষেতওয়ালা বললো- খোঁয়াড়ে দিয়ে দিবো। সেখান থেকে ছাড়ান লিয়ে আসিস। দ্যাখ কেমন রাখাল গিরি। আমি খোঁয়াড়ের কথা অনেক শুনেছি। কিন্তু জিনিসটা কী এবার তা দেখার ভাগ্যে জুটলো। ক্ষেতওয়ালা লোকটা বেশ জোয়ান আর কালো। গায়ে গতরে বেশ শক্তি। আমাকে সে টেনে হড় হড় করে নিয়ে চললো। আমিও চললাম খোঁয়াড় দেখতে। লোকটা আমাকে জমির মালিকের খোলানে নিয়ে বেঁধে ফেললো। তার পর আমার পেছনের কোমর বরাবর ছড়ি দিয়ে দুই তিনটা পটাপট মার দিলো। আমি তো লাফিয়ে উঠে ওমা গো- বাপগো বলে হাম্বা হাম্বা করে উঠলাম। জমির মালিক এসে ধমক না দিলে হয়তো। কপালে আরো মার ছিলো। যা হোক “এই কুতুব থাম” এই কথাটা খুব পছন্দ হলো। মানে শক্ত কালো লোকটার নাম ‘কুতুব’। জমির মালিক এসে জিজ্ঞেস করলো- কার গরুরে কুতুব? কুতুব জবাব দিলো- মজনু রাখাল, উত্তর পাড়ার লোকমান চাচার গরু চরাই।
-লোকমানের গরু?
-জি জমির চাচা।
-সেতো ভালো মানুষ- কিন্তু কি করা যায়?
-কিন্তু না আপনার ফসল নষ্ট করেছে এরে খোঁয়াড়ে দেব।
-ঠিক আছে খোঁয়াড়ে দে, না হলে রাখালের শাস্তি হবে না।
জমির মালিক জমির চাচা চলে গেল। আমি বাঁধা থাকলাম খোলানে। আমাকে দেখতে এলো আশপাশে থাকা মেয়ে-পুরুষ, ছোট বাচ্চাদের দল। যেন মজার ঘটনা ঘটেছে। অনেকে অনেক রকম কথা বললো, কেউ বললো- এডাতো ছোট একটা বাছুর। কেউ বললো-পাকা বলদ, কেউ বললো-ক্ষেত খাও, খোঁয়াড়ে যাও। এসব বলে হাসা হাসি করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর কুতুব ঢেকুর তুলতে তুলতে বাড়ির বাইরে এলো। তারপর দড়ি খুলে নিয়ে চললো খোঁয়াড়ের উদ্দেশ্যে। সাথে উঠতি কটা ছোকরা কিছু দূর এগিয়ে এসে ফিরে গেল। খোঁয়াড় কোথায় জানি না। একটা কাঁচা সড়ক হয়ে হেঁটে চললাম। দুই পাশে ধান, কাওনের জমি। বিরান জমি। আকাশে অনেক মেঘ। এসব দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম খোঁয়াড়ে। বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা খোঁয়াড়। তার মধ্যে একটা চালতোলা মাচা। সেখানে হাসি হাসি মুখ করে বসে আছে দুজন লোক। খোঁয়াড়ে আমার মতো ক্ষেত খাওয়া অনেক গরু-ছাগল পাওয়া গেল। আমাকে ঢুকিয়ে রাখা হলো গরুদের মধ্যে।
খোঁয়াড়ওয়ালা গরু পেয়ে খুব খুশি। কুতুবও খোঁয়াড়ে দিয়ে খুশি। কেননা খোঁয়াড়ি তাকে গুনে পঞ্চাশ টাকা দিলো এবং লিখে রাখলো কার গরু, নাম ঠিকানা। খোঁয়াড়ের এক দিকে একটা গাভী, ষাঁড় আর একটা বলদ ছিলো। অন্য দিকে ছাগল, ভেড়া, হাঁস। আমাকে দেখে ষাঁড়টা বললো- তুই কি খেলিরে ছোকরা? আমি বললাম-মশুর আপনি কি খেলেন? ষাঁড়টা শুনে বললো- ছোকরার আদব আছে। আমাকে আপনি বলে ডাকলো শুনলিরে বলদ। বলদ শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছিলো, তাই ষাঁড়টা কি বললো বুঝতে পারেনি। প্রশ্ন করলো- কি বললে শুনতে পাইনি। একথা শুনে ষাঁড়ের প্রেসটিজে লেগে গেল, তাই এলো তেড়ে- আমি একটা ষাঁড়, কথা কানে যায় না? ফোঁস করে শিং ঘোরালো। বলদটা ভয় পেয়ে ধড়-ফড় করে উঠে দাঁড়ালো। আশপাশে দুটো ছাগল চ্যাঁচালো ব্যাঁ ম্যাঁ করে। খোঁয়াড়ি ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে লাঠি নিয়ে ঢুকলো খোঁয়াড়ে, তারপর ষাঁড় টাকে কষে কয়েকটা ঘা বসিয়ে দিলো। তাতেই ষাঁড়টার প্রেস্টিজ ঠিক। খোঁয়াড়ে সবাইকে আলাদা বাঁধা থাকলেও এ ওর সাথে ফুঁসফাঁস করে। ঠেলা-ঠেলি করার চেষ্টা করে। খোঁয়াড়িকে কুতুব পরেশ দাদা বলে ডাকছে। বোঝা গেল আগে থেকেই গলায় গলায় ভাব। দু’জন মিলে বিড়ি ধরিয়ে খি-খি, হিহি করে কি হাসি। আমার তো রাগে- গা শির শির করছিলো। কিন্তু আমি কেবল ছোট বলদ বলে কিছু বলছি না। সুযোগ পেলে কুতুবকে ঢুশিয়ে দিতাম। এসব ভাবনার সাথে দুঃখও লাগে। ষাঁড়কে যখন বলদ করা হয়, তখন দিন দিন রাগও কমে যায়। গাভীটার জন্য একটা বিধবা মেয়ে এসে কান্না-কাটি করছিলো, সেদিকে খেয়াল হলো। তার গরুটায় একমাত্র সম্বল। সেটার দুধ বেচে সংসার চালায়। কেঁদে কেঁদে তাই বলছিলো। কিন্তু গরু ছাড়ান নিতে একশ টাকা লাগবে, সে টাকা তার কাছে নাই। পরেশ দাদা বললো- আমি তো লস দিতে পারবো না। যে গরু খোঁয়াড়ে দিয়ে গেছে তাকে তো পঞ্চাশ দিতে হয়েছে। তোমাকে তো ফ্রি ছেড়ে দিতে পারি না। বিধবার কাছে শুধু পঞ্চাশ টাকা ছিলো। সেই টাকাটা নিয়ে বসে বসে কাঁদছিলো। আমিও হতাশ হচ্ছি। আমার কোন জামিনদার আসে না। না মজনু, না লোকমান চাচা। পাশের খোঁয়াড় ঘরে ছাগল, ভেড়া সবগুলো ঝগড়া লাগিয়েছে- তোর জন্য আমি খোঁয়াড়ির জমিতে গেলাম, অন্যজন বললো- দুজনই খেসারি খেয়েছি, দোষ দুজনেরই, এই নিয়ে তর্ক করার কিছু নাই। একটা ভেড়া একটা খাসি ছাগলকে ঢুশিয়ে দিয়েছে, তাই নিয়ে ঢিশাঢিশি শুরু হলো- সেগুলো দেখছিলাম, চার পাঁচটা হাঁস ধান খেয়ে আটকা পড়ে আছে। সেগুলো প্যাঁক প্যাঁক করে বেড়ার দিকে সরে গেল। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের শব্দ শুনলাম। দেখলাম বজলুর বাইকে চড়ে আসছে মজনু। তার মধ্যে কান্না কান্না ভাব।
বজলুর ঠ্যাংটা তাহলে সেরে উঠেছে। মজনু এসে খোঁয়াড়ি দাদার সাথে কথা বললো। দেখলাম একশ টাকার নোট দিয়ে ছাড়ের কাগজ নিতে। কিন্তু বিধবা মহিলার জন্য খারাপ লাগছে। তার টাকা কে দিবে? মনে হলো আমিতো গরু অত কিছু ভাবার দরকার কী? শুনলাম বজলু জিজ্ঞেস করছে- এই মেয়েটা কাঁদে কেন? দাদা বললো-গাই গরু, একশ টাকা লাগবে আছে পঞ্চাশ। বজলু বললো -ছেড়ে দাও এই বিশ টাকা রাখো। শুনে খুব ভালো লাগলো। বজলু একটা বদ ছেলে। বদ ছেলেরাও মাঝে মাঝে ভালো কাজ করে। মেয়েটার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো- দাদাও আমতা আমতা করে শেষ পর্যন্ত সত্তর টাকায় গায় গরুটা ছেড়ে দিলো। বজলু মোটরবাইক চালিয়ে উধাও হলো। মজনু বিরস মুখে আমাকে নিয়ে সেই কাঁচা সড়কে উঠে এলো। আমার মনে খুব আনন্দ। কেননা আমি বন্দিদশা ছেড়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছি। মজনুও দড়ি ছেড়ে দিলো। আমি হেঁটে হেঁটে একাই ফিরতে লাগলাম। মজনু পিছনে পিছনে একটা দড়ি হাতে করে হেঁটে হেঁটে আসতে লাগলো। জানি না আমার আর শাস্তি বাকি থাকলো কিনা।
হাঁটতে হাঁটতে যখন বুঝে ফেললাম আমার বাড়ির রাস্তা আমি চিনে ফেলেছি, তখন দৌড়ে দৌড়ে ফিরতে লাগলাম। পিছনে মজনু চিৎকার করতে করতে আমার পিছু পিছু দৌড়ে আসছে। তার শঙ্কা আমি যদি আবার হারিয়ে যাই। আকাশে অনেক মেঘ করে- ছিলো। সেখান থেকে ফুট ফাট বৃষ্টি শুরু হলো। আমিও ছুটছিলাম জোরে, পেছনে মজনু। এবার বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য- আরো জোরে ছুটে চললাম। এক সময় তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। দুজনই ভিজে সারা হয়ে বাড়ি ফিরলাম। তখন মনে পড়লো ধলি মাকে। আবার ছোটবেলার কথা মনে হলো। দৌড়ে গোয়ালের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। তারপর কদম গাছটার দিকে তাকিয়ে মার কথা মনে হলো। এতদিন হয়তো মা পৃথিবী ছেড়ে কোন সুদূরে হারিয়ে গেছে।
আমি দিনে দিনে বলদ হয়ে উঠেছি। আমাকে দিয়ে গাড়ি বহানোর চিন্তা চলছে। গোয়ালের ষাঁড় দুটোর দুদিন থেকে কথা-বার্তা শুনে বোঝা গেল, গোয়ালে শোকের ছায়া। তাদের কোরবানির হাটে তোলা হবে। আর আমাকে লাঙ্গল জোয়ালে। ষাঁড় দুটো রোজ গল্প করছে, আর চোখের পানি ফেলছে। এসব দেখে আমাকে বলদ করার যে দুঃখটা হয়েছিল, সেটা কমে গেল। কেননা বেশির ভাগ ষাঁড় দাঁত উঠলেই হাটে তোলা হয়। তার পর মানুষের খাদ্য হয়ে যায়। বেশি ভাগ গাই গরু আর বলদ গরুদের পৃথিবীতে একটু বেশি থাকা হয়।
দুদিন পর চারিদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। কোরবানির ঈদ, গরু-ছাগল বেচাকেনার হাট। ষাঁড় দুটোকে বেচতে নিয়ে যাবে। সাথে যাবে পাশের গোয়ালের দুটো খাসি আর ভেড়া। দুদিন থেকেই শোকের মাতন জুড়ে দিয়ে ভ্যা ভ্যা-ম্যা ম্যা, ব্যাব্য করে চেঁচামেচি করছে। সেদিন মজনু আমাদের মাঠে নিয়ে গেল না। ষাঁড় দুটোকে গোসল করানো হলো। শিঙে তেল মাখানো হলো। জীবনে এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা গরুদের ভাগ্যে জোটে না। বেশি দাম পাবার জন্য এমন পরিষ্কার করা। নজর আলী বললো- দুটোর দাম এক লাখের কমে হবে না।
কাশেমও তার কথায় সাই দিলো। দুজন হাসা-হাসি করলো, ষাঁড় দুটোর চোখে পানি। লোকমান চাচার বাড়ির স্মৃতি ছেড়ে যাওয়া, তারপর পৃথিবী ছাড়া। যা সকল প্রাণীর জন্য চির সত্য। ষাঁড় দুজনের শিঙে লাল ফিতের ফুল বাঁধা হলো। তাতে সৌর্ন্দয গেল বেড়ে। সেই সাথে তাদের বিনিময় মূল্য বাড়লো। দুজনের কথার মাঝে কোথা থেকে বন্দুক হাতে বজলু এসে বললো- কাশেম, নজর নতুন বলদ ডারে হাটে তুললে হয় না। ওর তো দুটো দাঁত হয়েছে। নজর বললো- না ভাই, চাচা অরে দিয়ে লাঙল দিবে- চারটা বলদতো আছে সেগুলা দিয়ে হবে না? নজর বললো- একটা বলদের বয়স বেশি। সেটা এবার কোরবানি করা হবে।
বজলু বিরক্ত হয়ে বললো- বাপজান যে কি? আমার একটা কথাও শুনে না। বোঝা গেল বজলু কদিন মার খেয়ে চুপ ছিল। ভাঙ্গা পাটা সেরে যাবার পর আবার বন্দুক হাতে নিয়েছে। তার কথা শুনে আমার বুক ধড়ফড় করে উঠলো। আমার দিকে তার নজর পড়েছে।(চলবে)

Share.

মন্তব্য করুন