আবারো চলে এলো গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্ম হলো বছরের উষ্ণতম কাল, যা পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে সাধারণত জুন, জুলাই এবং আগস্ট জুড়ে অবস্থান করে। পৃথিবীর সর্বত্রই গ্রীষ্ম হলো কর্মোদ্যমের সময়। বিশেষ করে শীতপ্রধান দেশগুলোতে গ্রীষ্ম খুবই আরাধ্য, কারণ সেসব দেশে শীতকালে কোনো ফসল উৎপাদিত হয় না, গ্রীষ্মকালেই সব ফসল উৎপাদন করে রাখতে হয়।
বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী প্রথম দুই মাস বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ জুড়ে গ্রীষ্মকাল। এই সময় সূর্যের প্রচন্ড তাপে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ভূমি, পানি শুকিয়ে যায়, অনেক নদীই নাব্যতা হারায়, জলশূন্য মাটিতে ধরে ফাটল। গ্রীষ্মকালের শেষার্ধ্বে সন্ধ্যা সমাগত সময়ে ধেয়ে আসে কালবৈশাখী ঝড়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এসময় গাছে গাছে বিভিন্ন মৌসুমি ফল দেখা যায়।
বৈশাখ হলো বাংলা সনের প্রথম মাস। বৈশাখ শব্দটি এসেছে বিশাখা নামক নক্ষত্রের নাম থেকে। এই মাসে বিশাখা নক্ষত্রটিকে সূর্যের কাছে দেখা যায়।
বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটি হলো বাংলা নববর্ষ। এই দিনটি বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ নামে পরিচিত। এই দিনটি বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও ধর্মীয় উৎসবের মধ্য দিয়ে পালিত হয়। এই দিনটিতে যাবতীয় ব্যবসায়িক কাজকর্ম শুরু হয়। ব্যবসায়ীরা এই দিন নতুন হালখাতা শুরু করেন। নতুন হালখাতা শুরু উপলক্ষে ব্যবসায়ীরা খদ্দেরদের মিষ্টি, উপহার ও বাংলা ক্যালেন্ডার বিতরণ করেন।
প্রথাগত দিক থেকে বৈশাখ মাস থেকে গ্রীষ্ম ঋতুর শুরু ধরা হয়। এই মাসে সন্ধ্যা বেলায় মাঝে মাঝে কালবৈশাখী ঝড় ওঠে। এই ঝড়ে মাঝে মাঝেই প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি ঘটে।
বৈশাখের পরেই আসে জ্যৈষ্ঠ মাস। জ্যৈষ্ঠকে মধুমাস বলে। এ সময় তাপমাত্রা সাধারণত ৩২-৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। বাংলাদেশের মাটি উর্বর। তাই অনেক ধরনের ফল এ দেশে জন্মে। তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাত অনুকূলে থাকলে সে বছর বিভিন্ন ঋতুতে প্রচুর ফল উৎপাদন হয়। এ দেশে বেশিরভাগ ফল উৎপাদিত হয় গ্রীষ্ম-বর্ষাকালের চার মাসে। ফালগুনে আমসহ অনেক ফলগাছে ফুল আসে, বৈশাখ থেকে বৃষ্টির বারিধারায় মাটি সিক্ত হয়, তাপদাহ শেষে পানির পরশে ফলের পরিপুষ্টি ঘটে। জ্যৈষ্ঠে তাপবৃদ্ধিতে পুষ্ট ফলের ভেতরে টক অম্ল মধুর রসে পরিণত হয়। ফলের খোসার রঙ বদলে যায় ও ফলে মিষ্টতা আসে। যেসব কারণে গ্রীষ্মঋতুতে জন্মানো প্রায় সব ফলই হয় মিষ্ট, সুঘ্রাণযুক্ত ও সুদর্শন। হয়তো ফলরসিকরা এ জন্য গ্রীষ্ম ঋতু বিশেষ জ্যৈষ্ঠ মাসকে ‘মধুমাস’ নামে অভিহিত করে থাকেন।
গ্রীষ্ম বলা হলেও আসলে এ মৌসুমে উৎপাদিত অনেক ফলের বিস্তৃতি থাকে বর্ষাকাল পর্যন্ত। নাবি জাতের আম বর্ষাঋতু এমনকি ভাদ্র মাস পর্যন্ত পাওয়া যায়। অথচ আম গ্রীষ্মকালের প্রধান ফল। এ দেশে উৎপাদিত ফলের প্রায় ৬০ শতাংশ উৎপাদন হয় বৈশাখ থেকে শ্রাবণের মধ্যে অর্থাৎ চার মাসে। বাকি ৪০ শতাংশ ফল উৎপাদিত হয় বাকি আট মাসে। এ জন্য গ্রীষ্ম মৌসুমকে বলা হয় ফলের মাস। গ্রীষ্মকালে এ দেশে পেয়ারা, পেঁপে, কলা, নারকিলে, সফেদা, তালশাঁস, লেবু, আম, কামরাঙা, ড্রাগন ফল, ডেউয়া, জাম, কাঁঠাল, তৈকর, প্যাশন ফল, কাজুবাদাম, গোলাপজাম, বাঙ্গি, চুকুর, লিচু, আঁশফল, তরমুজ, ফলসা, করমচা, গাব, হামজাম, বৈঁচি, লুকলুকি, জামরুল, গাব, বেতফল, মুড়মুড়ি, খেজুর, ননিফল, আতা, শরিফা ইত্যাদি ফল পাওয়া যায়। ফলের মাসে এ পল্লীবাংলার ঘরে ঘরে বসে নানা রকম ফলাহারের আয়োজন। জ্যৈষ্ঠ মাসে হয় জামাইষষ্ঠী অনুষ্ঠান, যে অনুষ্ঠানের প্রধান উপকরণ নানারকমের প্রচুর ফল।
বাড়িতে বাড়িতে এ ঋতুতে তৈরি করা হয় ফল থেকে নানারকম খাদ্যসামগ্রী। চাঁপাইনবাবগঞ্জে পাকা আমের গোলা দিয়ে যবের ছাতু খাওয়া, গাজীপুরে পাকা কাঁঠালের গোলা দিয়ে চিতোই পিঠা খাওয়া, আমসত্ত্ব বানানো, আমের পলিশ শুকানো ইত্যাদি এ দেশের অন্য এক ফল সংস্কৃতির স্বাক্ষর বহন করে।
শুধু ফলই নয় গ্রীষ্মে নানারকম ফুলও ফোটে। গ্রীষ্মে ফোটা ফুল হচ্ছে অরেজুনইপলি ইপলি, কনকচূড়া, করঞ্জা, কামিনী, ক্যাজুপুট, গাব, জারুল, জ্যাকারান্ডা, তেলসুর, দেবদারু, নাগকেশর, নাগেশ্বর, নিম, পরশপিপুল, পলকজুঁই, পাদাউক, পারুল, পালাম, বনআসরা, বরুণ, বাওবাব, বেরিয়া, মাকড়িশাল, মিনজির, মুচকুন্দ, মেহগনি, রক্তন, সোনালু, স্বর্ণচাঁপা ইত্যাদি।
যদিও গ্রীষ্মের দাবদাহতা আমাদের জন্য কষ্টদায়ক তবে গ্রীষ্ম শুধু ধ্বংস, খরতাপ কিংবা নতুনের আহ্বান নিয়েই আসে না। আসে মওসুমি ফলের সম্ভার নিয়ে। তাইতো পল্লীকবি জসীম উদদীন তারই প্রতিচ্ছবি এঁকেছেন ‘মামার বাড়ী’ কবিতায়-
‘ঝড়ের দিনে মামার দেশে আম কুড়াতে সুখ
পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ।
Share.