বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। তারান্নুম জানালার পাশে বসে আছে। আজ তার খুব মন খারাপ। আজ তার বান্ধবী জাকিয়া সাদিয়া ও আনিকার ছোটো চাচ্চু ঢাকা থেকে এসেছে। তাদের জন্য কত্তো কিছু এনেছে। তারান্নুম জানে তার ছোটো চাচ্চু আসবে না। অবশ্য এজন্য তার চাচ্চুর ওপর কোনো অভিমান নেই। তবে আজ তার ছোটো চাচ্চুর কথা খুব মনে পড়ছে। টেবিল থেকে অ্যালবামটা হাতে নেয়। চাচ্চু আর তার ছবি দেখতে দেখতে সে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায়।
তারান্নুমের ছোটো চাচ্চুর নাম হাসান মোরশেদ। তার সবচেয়ে প্রিয় একজন মানুষ। তারান্নুম যখন ছোটো ছিলো তখন তার হাজার রকমের বায়না মেটাতো তার চাচ্চু। চাচ্চু ঢাকা থেকে এলে তার আর খুশির সীমা থাকতো না। চাচ্চু এলে সে সারাদিন চাচ্চুর সাথে কাটাতো। চাচ্চুর কাছে কতো রকমের যে গল্প শুনতো। চাচ্চু এলে তাকে আর আম্মুর কাছে বকা খেতে হতো না। মাকে ফাঁকি দিয়ে কতো যে লুকিয়ে লুকিয়ে আইসক্রিম খেতে নিয়ে গেছে তার চাচ্চু। চাচ্চু এলে তার কোনো রকম দুষ্টুমি করতে বাধা থাকতো না। আম্মু তখন চাচ্চুকে বলতো, ‘তোমার আশকারা পেয়ে ও দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে।’ তখন চাচ্চু বলতো, ‘ভাবী ছোটো বাচ্চারা এখন দুষ্টুমি করবে না তো কখন করবে? তোমার মতো বয়সে?’ বলে প্রিয় ভাতিজিকে কোলে নিয়ে দু’জন মিলে হাসতো। তখন তার আম্মু বলতো, ‘তোমরা দুই চাচা ভাতিজি যা ভালো বোঝো তাই কর।’ যদিও তার আম্মু চোখ রাঙিয়ে কথাটা বলতো তবে মনে মনে যে হাসতো তা সে উপলব্ধি করতে পারতো। তার চাচ্চু একদিনের জন্য হলেও প্রতি মাসে আসতো। তবে সে বারে তিন মাস হয়ে যাওয়ার পরও চাচ্চু একবারও আসেনি। মনে মনে সে খুব কষ্ট পায়। তার আব্বু-আম্মুকে চাচ্চুর কথা বললে তারা চুপ করে থাকতো। তার আম্মু বলতো তার চাচ্চু কি কাজে ব্যস্ত আছে তাই আসতে পারছে না। বলেই তার আম্মু মুখ লুকিয়ে কান্না করতো।
যতো দিন যায় চাচ্চুর ওপর তারান্নুমের অভিমান বাড়তে থাকে। ভাবে এবারে চাচ্চু এলে আর চাচ্চুর সাথে কথা বলবে না। কতো গল্প যে জমিয়ে রেখেছে একটাও চাচ্চুকে শোনাবে না। এভাবে বেশ কিছু দিন কাটার পরে তারান্নুমের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। সে কান্নাকাটি শুরু করে। কান্না করতে করতে তার আব্বুকে বলে, ‘আব্বু, চাচ্চু কবে আসবে?’ বাবা মেয়েকে জড়িয়ে ধরে নিজেও কেঁদে ফেলেন। হাসান তার একমাত্র ছোটো ভাই। মা-বাবা মারা যাওয়ার পরে নিজের সন্তানের মতো করে বড়ো করেছেন তিনি। মেয়েকে কী উত্তর দেবে ভেবে পায় না। এক সময় বলে, ‘খুব তাড়াতাড়ি তোমার চাচ্চুকে নিয়ে আসবো মা।’ তারান্নুম খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দেয়। এক সময় সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তার অবস্থা দেখে বাবা-মা চিন্তায় পড়ে যায়। আম্মু তার আব্বুকে বলে, ‘একবার না হয় তারান্নুমকে দেখা করিয়ে নিয়ে এসো।’ তার আব্বু কিছু বলে না মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। পরের দিন সকাল বেলা আব্বু বলে, ‘কাল তোমাকে তোমার চাচ্চুর সাথে দেখা করতে নিয়ে যাবো।’
শুনে তার আর খুশির সীমা থাকে না। সে কী করবে আর কী করবে না ভেবে পায় না। সময় যেন তার কাটতে চায় না। রাতেও তার ঘুম আসতে চায় না। ভোর বেলা উঠে সে রেডি হয়ে যায়। তারপর আব্বুর সাথে রওনা দেয়। কয়েক ঘন্টা পরে তারা ঢাকা পৌঁছায়। তারা যেখানে গিয়েছিলো সেখানে অনেক পুলিশ আর গাড়ি ছিলো। তারান্নুম তো অবাক হয়ে গিয়েছিলো। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরে তাদের ভেতরে যেতে বলা হলো। তারা বড়ো একটা রুমে গেলো। কিছুক্ষণ পরে দু’জন তার চাচ্চুকে নিয়ে এলো। তারান্নুম দৌড়ে গিয়ে তার চাচ্চুর কোলে উঠলো। চাচ্চুর সাথে তার কতো যে গল্প। যেন শেষ হয় না। এক সময় একজন এসে বললো যে, ‘সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে।’ আব্বু বললো, এবার চলো মা।’ কিন্তু তারান্নুম তার চাচ্চুর কোল থেকে কিছুতেই আসবে না। তার চাচ্চুকে সাথে নিয়ে আসবে। সে জোরে জোরে কান্না করতে লাগলো। তার কান্না দেখে চাচ্চু আবার তাকে কোলে নিলো। তাকে বলেছিলো, ‘তুমি না আমার মা? মা কান্না করলে ছেলে কি ভালো থাকতে পারবে? আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি মামুণি আমি খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি যাবো, ইনশাআল্লাহ। আর তুমি কান্না করবে না। শুধু দোয়া করবে। আমার মা তো আমার কথা শুনবে আমি জানি।’ এরপর তারান্নুম তার আব্বুর সাথে চলে আসে। চাচ্চু খুব তাড়াতাড়ি চলে আসবে এই আশায় সে দিন গুনতে থাকে।
এর এক মাস পরে তারান্নুম স্কুল থেকে এলে তার আম্মু তাকে বলে যে, ‘তার চাচ্চু আজ আসবে।’ এ কথা শুনে সে তো আনন্দে লাফালাফি শুরু করে দেয়। কিন্তু তার আম্মু কেন কান্না করছিলো সে তা বুঝতে পারেনি সেদিন। বেলা বাড়ার সাথে সাথে তাদের বাসায় সব আত্মীয়-স্বজনরা আসতে শুরু করে। এতো আনন্দের দিনেও সবাই কেন কান্না করছিলো সে বুঝতে পারছিলো না। বেলা দুইটায় তাদের বাসায় কয়েকটি গাড়ি আসে। সাথে একটা অ্যাম্বুলেন্স ছিলো। গাড়ির শব্দ পেয়ে তারান্নুম দৌড়ে বাহিরে গিয়েছিলো। সে দেখছিলো যে তার চাচ্চু ঘুমিয়ে আছে। আর তার চাচ্চুকে একটি বিছানায় শুইয়ে নামিয়ে আনা হচ্ছে। তার খুব অভিমান হয়। এতোদিন পরে চাচ্চু বাসায় এলো তবুও ঘুমিয়ে আছে। সে চাচ্চুর কাছে গিয়ে চাচ্চুর মাথায় হাত দিয়ে ডাকতে থাকে। বলে, ‘চাচ্চু ওঠো। তুমি এখন কেন ঘুমিয়ে আছো? তোমার সাথে আমার কত্তো গল্প আছে তুমি জানো?’ সে তার চাচ্চুর মুখে কিছু আঘাতের চিহ্ন দেখতে পায়। তারান্নুম আবার বলে, ‘তোমাকে কে মেরেছে? আমাকে একবার বলো, আমি তাকে খুব করে বকে দেবো।’ এবারেও চাচ্চু কোনো কথা বলে না। তার কথা শুনে সবাই কান্না করছিলো। তার আব্বু বলে, ‘মা, তোমার চাচ্চু খুব ক্লান্ত। তাই ঘুমিয়েছে। তোমার চাচ্চু উঠলে আমরা তোমাকে ডেকে দেবো। এখন তুমি ভেতরে যাও।’ সে যেতে চায় না। কিন্তু আম্মু তাকে জোর করে ভেতরে নিয়ে যায়।
সারাদিন বাড়ি ভর্তি মানুষ ছিল। কেমন যেন একটা থমথমে পরিবেশ ছিলো। বিকেলের দিকে সবার সাথে সে চাচ্চুর কাছে গিয়ে দেখলো তার চাচ্চুকে সাদা কাপড় পরিয়ে রাখা হয়েছে। এসব কিছু দেখে তারান্নুম কিছুই বুঝতে পারে না। সে একদম চুপ করে থাকে। সে ভাবতে থাকে চাচ্চু কখন উঠবে। পরে সে লক্ষ্য করে সবাই তার চাচ্চুকে কোথায় যেন নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। দেখতে দেখতে সবাই মিলে তার চাচ্চুকে কাঁধে তুলে নেয়। এবার সে কেঁদে ওঠে। বলতে থাকে, ‘কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আমার চাচ্চুকে? আমিও যাবো আমার চাচ্চুর সাথে। চাচ্চুর সাথে আমার অনেক কথা আছে।’
সেদিন কেউ তার কথা শোনেনি। আর সে কিছু বুঝতেও পারেনি সেদিন। আজ সে জানে যে, আল্লাহ তার চাচ্চুকে না ফেরার দেশে নিয়ে গেছেন। যেখানে তার চাচ্চুকে দুনিয়ার কোনো কষ্ট ছুঁতেও পারবে না। ভাবতে ভাবতে তারান্নুমের দু’চোখ দিয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরতে থাকে। মাগরিবের আজানের ধ্বনিতে তারান্নুম কল্পনার জগৎ থেকে ফিরে আসে। চোখের পানি মুছে সে অ্যালবামটা যত্ন করে তুলে রাখে। নামাজ পড়ে সে তার চাচ্চুর জন্য দোয়া করে, যেনো তার চাচ্চু আসল মর্যাদা পায়। তার সাথে আরও দোয়া করে যে, যারা তার চাচ্চুকে কষ্ট দিয়েছে আল্লাহ পাক যেন তাদের যোগ্য শাস্তি দেন। আর এভাবে যেন কোনো তারান্নুমকে তাদের ছোটো চাচ্চুকে হারাতে না হয়। যাকে সে আদর করে ডাকতো ‘ছোটাচ্চু’।
Share.