শিশু-কিশোরদের সামনে এখন আনন্দের বিরাট জগৎ। তবে এর কোনটা তার জন্য ভালো আর কোনটা মন্দ সেটা কিন্তু তার পক্ষে নির্ণয় করা কঠিন। আগে আনন্দের মধ্যে ছিল চলচ্চিত্র দেখা। ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এবং মোবাইল ফোনের জগতে ঢুকে যাওয়ায় শিশু-কিশোরদের জন্য এই সঙ্কটটা আরো বেশি হয়ে দেখা দিচ্ছে। আর আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পে কিছু সমস্যা আগে থেকেই ভর করে আছে, ফলে এই শিল্পটি যেভাবে অগ্রসর হওয়ার কথা ছিল সেভাবে অগ্রসর হতে পারছে না। শিশুতোষ চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এই সঙ্কট আরো বেশি। ফলে শিশুতোষ চলচ্চিত্রের অঙ্গনে ভালো কোন কিছু আর দেখা যাচ্ছে না। ভালো ছবি ভালো কাহিনী না থাকায় মোবাইলে বা কম্পিউটারে এনিমেশন ছবি, যাকে বলি কার্টুন ও কিছু আজেবাজে কনটেন্ট দেখে তাদের সময় কেটে যাচ্ছে। ঠিক বিনোদন বলতে যা বোঝানো হয় সেটা হচ্ছে না। বাংলাদেশে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণ, সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা, সামনে ভালো দিন আসবে কিনা সেই আলোচনায় যাবার আগে শিশুতোষ চলচ্চিত্রের ওপর একটা ধারণা দেয়া যাক।

সাধারণভাবে শিশুতোষ চলচ্চিত্র বলতে বোঝায় শিশুদের উদ্দেশ্য করে, তাদের চারপাশের জগৎ ও কল্পনার জগৎকে কেন্দ্র করে যে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় সেগুলোকে। শিশুতোষ চলচ্চিত্র শুধুমাত্র শিশুদের অভিনীত চলচ্চিত্র নয়। শিশু অভিনেতা-অভিনেত্রী ছাড়াও শিশুদের উপযোগী চলচ্চিত্র হতে পারে। বড়দের চলচ্চিত্রও কাহিনী বিন্যাসের কারণে ও শিশু অভিনেতাদের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে শিশুতোষ চলচ্চিত্র হয়ে উঠতে পারে। লোক সাহিত্য গবেষক ও সুলেখক ড. আশরাফ সিদ্দিকীর একটি গল্পের কাহিনী নিয়ে গড়ে ওঠা চলচ্চিত্র সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘ডুমুরের ফুল’ এই ধরনের একটি চলচ্চিত্র। এটিকে শিশুদের উপযোগী চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রথম চেষ্টা বলা যায়। যদিও ১৯৭৮ সালে নির্মিত এ চলচ্চিত্রটি নির্মাণকালে নির্মাতা শিশুদের কথা ভেবে তৈরি করেননি। তৈরি করেছেন সামগ্রিক দর্শকের কথা মাথায় রেখেই। কিন্তু একটি শিশু চরিত্রের কারণে ছবিটির মোড় ঘুরে যায়, পায় অসম্ভব জনপ্রিয়তা। বলতে গেলে এই প্রথম কোন চলচ্চিত্র শিশু-কিশোরেরা নির্ভাবনায় হলে গিয়ে দেখে অবাক হয়, বিস্মিত হয়। তারা সেই চরিত্রটির মধ্য দিয়ে নিজেকে খুঁজে পায়। সে সময় আশরাফ সিদ্দিকীর ‘গলির ধারের ছেলেটি’ নামক একটি গল্প পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত থাকায় শিশু-কিশোরদের মধ্যে এর কাহিনীটি ছিল খুবই পরিচিত। কাহিনীটি প্রায় সকলের জানা ছিলো বলে অভিভাবকরাও নিশ্চিন্তে ছোটদের দেখানোর জন্য নিয়ে যেতেন। ভারতের কিছু বাংলা চলচ্চিত্রও এ রকমের। সত্যজিৎ রায়ের গুপি-বাঘা সিরিজের চলচ্চিত্রগুলোও একই ধারার বলা যায়। এ তো একদিক। আবার শিশু অভিনেতা-অভিনেত্রী থাকলেও শিশুতোষ চলচ্চিত্র নাও হতে পারে। হুমায়ূন আহমেদের ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ তার প্রমাণ। কারণ এতে শিশু-কিশোর চরিত্র আছে সত্য, কিন্তু বিষয়টা ছোটদের উপযোগী নয়। সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালি চলচ্চিত্রটির প্রধান দুই চরিত্র অপু আর দুর্গা দু’জনেই শিশু। কিন্তু চলচ্চিত্রটিকে কোন অর্থেই শিশুতোষ চলচ্চিত্র বলা যায় না। সুতরাং বলা যায়, শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্ভর করে চলচ্চিত্রটির বিষয়বস্তুর উপর। যেখানে শিশুরা অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে কাজ করতেও পারে আবার নাও করতে পারে।

এবার দেখবো আমাদের শিশুতোষ চলচ্চিত্রের ধারাটি। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৬ সালে ‘মুখ ও মুখোশ’ ছবির মাধ্যমে ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণের যাত্রা শুরু হলেও ছোটদের জন্য চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রচেষ্টা তেমন একটা দেখা যায়নি। একমাত্র ব্যতিক্রম ১৯৬৬ সালে ফজলুল হক পরিচালিত ‘সান অব পাকিস্তান’। সান অব পাকিস্তান ছিল একটি অ্যাডভেঞ্চার কাহিনীর চলচ্চিত্ররূপ। যদিও এ চলচ্চিত্রটিও ব্যবসায়িকভাবে সাফল্য বয়ে আনতে পারেনি। তবে বাংলাদেশে শিশু চলচ্চিত্র নির্মাণের একটি ভিত তৈরি করে এ চলচ্চিত্রটি নিঃসন্দেহে। ১৯৭০ সালে ‘বাবলু’ নামে একটি ছবি মুক্তি পায়। বাবলু নামের এক শিশু চরিত্রের কাহিনী নিয়ে গড়ে ওঠা ছবিটি বেশ দর্শকপ্রিয়তা পায়। স্বাধীন বাংলাদেশে সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘ডুমুরের ফুল’-কে শিশুদের উপযোগী চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রথম চেষ্টা বলা যায়। এর কথা আগেই বলেছি। ১৯৭৮ সালে নির্মিত এ চলচ্চিত্রটি নির্মাণকালে নির্মাতা শিশুদের কথা ভেবে তৈরি করেননি। তৈরি করেছেন সামগ্রিক দর্শকের কথা মাথায় রেখেই। বাংলাদেশে ১৯৮০ সালে প্রথম সর্বাঙ্গীণ শিশু চলচ্চিত্র হিসেবে নির্মিত হয় ‘এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী’। বাদল রহমান পরিচালিত এই চলচ্চিত্রটি সরকারি অনুদানে নির্মিত হয়েছিল। এরিখ কাস্টনারের কাহিনি নিয়ে নির্মিত এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী চলচ্চিত্রটি শুধু জনপ্রিয়ই হয়নি; সে বছর শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র, সম্পাদনা, শিশুশিল্পী, রঙিন চিত্রগ্রহণ এবং পার্শ্ব-অভিনেতা ক্যাটাগরিতে পাঁচটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। ডানপিটে ছেলে খান আতাউর রহমান পরিচালিত ১৯৮০ সালের শিশুতোষ চলচ্চিত্র। ছবিটি ডানপিটে এক কিশোরের দুষ্টুমি ও নানা অঘটন নিয়ে আবর্তিত হয়। এতে ডানপিটে সেই ছেলের চরিত্রে অভিনয় করে মাস্টার শাকিল।

আজিজুর রহমানেরই আরেকটি ছবি ‘ছুটির ঘণ্টা’ (১৯৮০)। এটি একটি স্কুলে আটকে পড়ে ভাগ্য বিড়ম্বনার শিকার এক বালকের কাহিনী। এই ছবিটিও জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এছাড়া শেখ নজরুল ইসলামের এতিম (১৯৮০) এবং মাসুম (১৯৮১), শহীদুল আমিনের রামের সুমতি (১৯৮৫) ইত্যাদি চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্র বা অন্যতম প্রধান চরিত্র ছিল শিশুরা। আশির দশকে মাস্টার সুমন কিংবা মাস্টার শাকিল তারকাখ্যাতি পেয়েছিলেন, কারণ তারকা হয়ে ওঠার মতো যথেষ্ট পরিসরজুড়ে শিশু-কিশোর চরিত্রের উপস্থিতি থাকতো। বাবলু ছবিতে বেবী হেলেন নামে একটি মেয়ে বাবলুর চরিত্রে অভিনয় করে। পরে তিনিই নায়িকা হন সুচরিতা নামে।

সরকারিভাবে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণের বেশ প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যায় স্বাধীন বাংলাদেশে। ১৯৭৮ সালে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণকে উৎসাহিত করতে সরকারি অনুদান প্রদানের ঘোষণা দেন। এর আওতায় প্রতি বছর তিনটি চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়, যার মধ্যে একটি অবশ্যই শিশু চলচ্চিত্র হবে বলে শর্ত আরোপ করা হয়। এরই আওতায় বাদল রহমানের এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছিল। তবে এই অনুদানপ্রথা নিয়মিত থাকেনি আর ভালো কাহিনী নিয়ে ভালো ভালো পরিচালক এগিয়ে না আসাই এর কারণ। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিশু চলচ্চিত্র নির্মাণের ওপর বিশেষ জোর দিয়েছেন। তিনি প্রতি বছর দুইটি করে শিশুতোষ চলচ্চিত্রে অনুদানের ঘোষণা দেন। তার ফলস্বরূপ সরকারি অনুদানে সজল খালেদ নির্মাণ করেন ‘কাজলের দিন রাত’ চলচ্চিত্রটি। এটিও মুহম্মদ জাফর ইকবালের কাহিনী অবলম্বনে নির্মিত। কিন্তু ছাড়পত্র পাওয়ার পরও কোন হলে এটি মুক্তি না দেয়ায় চলচ্চিত্রটি অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়।
বাংলাদেশ শিশু একাডেমি ১৯৮০ সাল থেকে শিশুদের উপযোগী চলচ্চিত্র নির্মাণ করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে খান আতাউর রহমানের ডানপিটে ছেলে (১৯৮০), সি বি জামানের ‘পুরস্কার’ (১৯৮৫), শেখ নেয়ামত আলীর ‘রানীখালের সাঁকো’ (১৯৯০) শিশুদের মধ্যে বেশ সাড়া ফেলেছিল। বাদল রহমানের ‘ছানা ও মুক্তিযুদ্ধ’ (১৯৯৯) চলচ্চিত্রটিও খানিক আলোচিত হয়েছিল। হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ (১৯৯৪) সিনেমার শিশু চরিত্র দুটি দর্শকদের নজর কাড়ে, দুটি চরিত্রের শিশুশিল্পী শীলা আহমেদ ও পুতুল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। একে একে নির্মিত হয় ‘লিলিপুটরা বড় হবে’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘দূরবীন’ ও ‘পাতার বাঁশি’সহ বেশকিছু শিশুতোষ চলচ্চিত্র। বাণিজ্যিক ধারায়ও শিশু চরিত্রের প্রভাব পড়তে থাকে, এর মধ্যে ‘চাচ্চু’ উল্লেখযোগ্য। ২০১৫ সালে নির্মিত আশরাফ শিশিরের ‘গাড়িওয়ালা’ ছবিটি বেশ আলোচিত হয়।

সম্প্রতি শেষ হলো এ বছরের উৎসব। ৫ মার্চ আন্ততর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয়, শেষ হয় ১১ মার্চ। এই চলচ্চিত্র উৎসবে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ৩৮টি দেশের ১১৭টি নানা স্বাদের চলচ্চিত্র দেখার সুযোগ পায়। উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো, বাংলাদেশি শিশুদের নির্মিত চলচ্চিত্র প্রতিযোগিতা বিভাগটি। পুরস্কারের জন্য গঠিত তিন সদস্যের জুরি বোর্ডের সবাই ছিল শিশু-কিশোর। এই বিভাগে ২৫টি চলচ্চিত্র জমা পড়েছিল। যার মধ্যে নির্বাচিত ৯টি চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়। এই ৯টি চলচ্চিত্রের মধ্যে ৩টি চলচ্চিত্রকে পুরস্কার দেয়া হয়। এছাড়াও বাংলাদেশ চিলড্রেন টেলিভিশন ফাউন্ডেশন ইউনিসেফের সহায়তায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশুদের শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহিত করে তুলছে। শিশুরা এক মিনিট ব্যাপ্তির চলচ্চিত্র নির্মাণ করছে যা তাদের ভবিষ্যতে শিশুতোষ চলচ্চিত্র নির্মাতা হবার স্বপ্ন দেখায়।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে শিশু কিশোরদের পছন্দের ও সেই সাথে শিক্ষণীয় চলচ্চিত্র কি আবার ফিরে আসবে? ভালো ভালো লেখকের কাহিনী নিয়ে ভালো চলচ্চিত্র নির্মিত হবে? কিছু কিছু চেষ্টা আমাদের আশাবাদী করে তোলে, সেই চেষ্টা আগামীতে জোরদার হোক সেটাই আমাদের চাওয়া। শিশুদের বিনোদনের জন্য এ মুহূর্তে কিংবা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের হলগুলোর পর্দায় কিছুটা জায়গা ছেড়ে দেওয়া হবে কি না, কিংবা বাণিজ্যের ঘুরপাক থেকে কিছুক্ষণের জন্য বের হয়ে নির্মাতারা শিশুদের জন্য কোনো শিশুতোষ চলচ্চিত্র তৈরি করতে ইচ্ছুক হবেন কি না, সেটি চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে। বর্তমানে বাংলা চলচ্চিত্রে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে। এর ঁেছায়া এসে লাগুক শিশুতোষ চলচ্চিত্রেও। তৈরি হোক ভালো মানের শিশুতোষ চলচ্চিত্র। শিশুতোষ চলচ্চিত্রকে কেবল বাণিজ্যিক অনুষঙ্গ হিসেবে না দেখে শিল্পের তাগিদ হিসেবে বিবেচনা করা হোক। আমাদের দেশের নতুন প্রজন্মের কাছে চলচ্চিত্র হয়ে উঠুক সুস্থ বিনোদন ও জীবন গঠনের হাতিয়ার।

Share.

মন্তব্য করুন