ছয়
‘কিরে কী হলো? আমাকে এভাবে টেনে আনলি কেন?’ হোটেল থেকে বের হয়ে আবুর থেকে হাত ছাড়িয়ে বলল সানিন।
‘মালোপাড়ার ঐ লোক মারা যায়নি। ওকে মারা হয়েছে।’ বিস্ময় ঝরে পড়ছে আবুর কণ্ঠে!
‘মানে খুন! আমারও কেমন জানি তাই মনে হচ্ছিল। সবাই বলল ওর তিন কুলে কেউ নেই। কেন ওকে কেউ কোনো কারণে মারবে? কিন্তু আবু তুই কি করে বুঝলি যে এটা খুন?’ জানতে চায় সানিন।
‘আমি নিশ্চিত এটা খুন। আর ঐ চেয়ারম্যান ব্যাটাই এই কাজ করেছে।’ বলল আবু।
সানিন সাথে সাথে ডান হাত দিয়ে আবুর মুখ চেপে ধরে। চারপাশে তাকিয়ে বলল, ‘আস্তে আস্তে। আশপাশে লোকজন আছে। প্রমাণ ছাড়া তুই কোনো মানুষকে এভাবে দোষারোপ করতে পারিস নে।’
আবু জোর করে মুখ থেকে সানিনের হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘ব্যাটা খুনি চেয়ারম্যান। আমিই প্রমাণ দেব ও খুনি।’ বলে সানিনের হাত ধরে টানতে টানতে বলল, ‘আয় আমার সাথে। চল মালোপাড়ায় ঐ লোকটার বাড়িতে। চেয়ারম্যান যে খুনি তার প্রমাণ ওখানে আছে।’
ঠিক সেই সময় ওদের পাশ দিয়ে একটা মোটরচালিত ভ্যান যেতেই আবু ওটা দাঁড় করিয়ে তাতে উঠে বসে বলল, ‘মালোপাড়ায় চলো।’
সানিন কোনো বাক্য ব্যয় করলো না। উঠে বসল ওতে।
পথে ওদের কোনো কথা হয়নি। ওরা যেয়ে থামে মৃত লোকটার বাড়ির সামনের রাস্তায়। সানিন ভাড়া মিটায়।
আবু পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় মৃত লোকটার ঘুপচি কুঁড়ের সামনে। চারপাশ নির্জন। কুঁড়ের ভিটের সাথে বেশ আগাছা জন্মেছে। আবু পা দিয়ে আগাছা মাড়িয়ে কিছু একটা খোঁজে। অবশেষে পেয়ে যায় ওটা। নিচু হয়ে তুলে আনে আগাছার ভেতর থেকে মেটে বেল্ট ওয়ালা একটা হাত ঘড়ি। তবে ওর একটা বেল্ট ছেঁড়া।
সানিন পায়ে পায়ে আবুর পিছে পিছেই এসেছিলো। আবুর হাত থেকে নিলো ওটা ও। দেখতে দেখতে এগুলো রাস্তার দিকে। যেখানে রাস্তার পাশে ফাঁকা জায়গায় এখনও গাড়ির চাকার দাগ আছে মাটিতে সেখানে। ফিরলো আবুর দিকে। বলল, ‘তুই কী বলতে চাচ্ছিস?’
‘আমি বলতে চাচ্ছি যে, এই ঘড়িটা চেয়ারম্যানের। হোটেলে ওর হাত ফাঁকা দেখেছি। আর উনি যে নিয়মিত ঘড়ি পরেন তার প্রমাণ তার হাত। তার হাতে ঘড়ি পরার দাগ রয়েছে। ঘড়িটা লোকটা মরার দিন দরজার পাশে বাইরে পড়ে ছিলো। ঐদিন আমিই পা দিয়ে গুঁতা মেরে আগাছার মধ্যে ফেলে দিই। ভেবেছিরাম হয়তো কেউ নষ্ট ঘড়ি ফেলে দিয়েছে। কিন্তু চেয়ারম্যানের হাতে ঘড়ির দাগ দেখে মনে হলো এটা তারই হবে।’
‘তারতো নাও হতে পারে।’ বলল সানিন।
‘এতো দামি ঘড়ি তারই হবে। হাতে ঘড়ি না থাকা, সেটা ছিঁড়ে মরা লোকটার ঘরের সামনে পড়ে থাকা আর তোর সেদিনকার কথা, চেয়ারম্যানের নতুন গাড়ি, চাকার দাগ, সব মিলিয়ে চেয়ারম্যানই লোকটাকে খুন করেছে।’ যেন পুরো বিষয়টা বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হলো আবু।
‘আবু চল।’ বলে রাস্তায় উঠে এলো সানিন।
আবুও ওর পাশে এসে বলল, ‘কোথায়?’
‘স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে। পুলিশের কাছে।’ বলল সানিন।
‘তারা কি আমাদের কথা বিশ্বাস করবে?’ আবুর জিজ্ঞাসা।
‘প্রমাণতো আমাদের হাতে।’ বলল সানিন।
‘তার পরেও কিন্তু, কিন্তু থেকেই যাচ্ছে।’ বলল আবু।
‘দেখ বিষয়টা জীবন-মৃত্যুর বিষয়। প্রশাসনকে জানানো সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত।’ বলল সানিন।
‘চল তাহলে যাওয়া যাক।’
আবুও যেতে রাজি হলো।
ওরা মাটির রাস্তা ধরে ওদের আপার বাড়ি পার হয়ে বেশ কিছুদূর পাকা রাস্তায় আসার পর একটা মোটরচালিত ভ্যান পেল। ওটায় করে ওরা স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে হাজির হয়।
ফাঁড়িতে প্রবেশ করে পাহারারত এক সিপাইয়ের কাছে জানতে চায় ডিউটি অফিসারের রুম কোন দিকে?
দেখিয়ে দিলে ওরা ডিউটি অফিসারের রুমের দরজার সামনে এসে দেখে টেবিলের ওপাশে অফিসার মনোযোগ দিয়ে তার কাজ করছেন। তার কাঁধের এবুলেট দেখে বোঝা গেল একজন এসআই।
‘আসতে পারি?’ জানতে চায় সানিন।
অফিসার কাজ থেকে মুখ তুলে ওদের দেখে বললেন, ‘হুম, এসো।’
ওরা দু’জন প্রবেশ করেই অফিসারের সামনে পাতা দু’টি চেয়ারে বসে।
অফিসার ওদের দিকে তাকিয়ে কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করেন। কেননা এভাবে কোন কিশোর তার চাকরির বয়সে পুলিশ ফাঁড়িতে এসে বিনাদ্বিধায় চেয়ারে বসেনি। সবচেয়ে বড় কথা আজ পর্যন্ত কোনো কিশোর তার ফাঁড়িতে প্রবেশ করেনি।
বিস্ময় প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘কী ব্যাপার?’
‘একটা খুনের ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।’ সানিনের কিছু বলার আগেই বলে ফেলল আবু।
‘খুন!’ অফিসার যেন আরো অবাক হন!
‘হ্যাঁ। গ্রামবাসী অনেকে এটাকে খুন বলে মনে করে।’ বলল সানিন।
আচ্ছা বিষয়টা ক্লিয়ার করে বলতো। সিরিয়াস হন এবার অফিসার।
‘মালোপাড়ায় যে লোকটা মারা গেছে ওটা স্বাভাবিক মৃত্যু নয়। খুন।’ বলল সানিন।
‘শুনেছি মালোপাড়ায় একটা লোক মারা গেছে। কিন্তু তোমরা ওটা কে খুন বলছো কেন?’ অফিসারের জিজ্ঞাসা।
‘ঐ লোকটার বাড়ির সামনে গাড়ির চাকার দাগ পাওয়া গেছে।’
আবুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে অফিসার বললেন, ‘এতেই কি প্রমাণ হয় লোকটা খুন হয়েছে?’
‘না।’ বলল সানিন। পকেট থেকে বেল্ট ছেঁড়া ঘড়িটা বের করে টেবিলের ওপর রেখে ও বলল, ‘এটাই প্রমাণ করে লোকটা মারা যায়নি, খুন হয়েছে।’
অফিসার ঘড়িটা হাতে নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখেন। বলেন, ‘এতেই কি প্রমাণিত ওটা খুন?’
‘অবশ্যই।’ বলল আবু। ‘এটা পাওয়া গেছে মৃত লোকটার দরজার পাশে বাইরে। ওই দিন সকাল বেলা। আর খুনিটা ঐ পাড়ার কেউ না। কেননা এতো দামি ঘড়ি মালোপাড়ার কেউ কিনবে না।’
‘আচ্ছা বিষয়টা ভালো করে বলোতো। তোমরা কী বলতে চাচ্ছো?’ অফিসার দু’হাত সামনে রেখে টেবিলের ওপর ঝুঁকে ওদের দিকে তাকিয়ে জানতে চান।
আবু সানিনের দিকে তাকায়। সানিন ওর দিকে তাকিয়ে দু’চোখ বন্ধ করে সম্মতিসূচক মাথা ঝাঁকিয়ে অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলা শুরু করলো।
লোকটার বাড়ির সামনে এবং মাটির রাস্তায় গাড়ির চাকার দাগ। এপথে সচরাচার গাড়ি চলে না। এলাকার চেয়ারম্যানের নতুন গাড়ি কেনা। মৃত লোকের দরজার সামনে ছেঁড়া ঘড়ি পড়ে থাকা সব বলেই চলল।
অফিসার কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। সানিন বড় মানুষের মতো ডান হাত উঁচু করে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলা অব্যাহত রাখে। ‘আজ দেখেছি চেয়ারম্যানের হাতে ঘড়ি পরার দাগ আছে অথচ হাতে ঘড়ি নেই। সব মিলিয়ে খুনটা চেয়ারম্যানই করেছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।’
অফিসার এবার চেয়ার থেকে ওঠেন। ওদের দু’জনের পেছনে পায়চারি শুরু করেন।
অবশেষে থেমে টেবিলের একপাশে দু’হাত ঠেস দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘তোমাদের বাড়ি কোথায়? পরিচয় কী?’
সানিন নির্ভয়ে নিঃসঙ্কচে বলে, ‘এটা আগেই বলা দরকার ছিলো। যাই হোক, আমি সানিন। আর ও আবু। মালোপাড়ার আগের গ্রামে আমাদের আপার বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। আমাদের বাড়ি শহরে। আপনাদের চেয়ারম্যানের সাথে আমাদের কোনো শত্রুতা নেই। আর মৃত লোকটাও আমাদের কিছু হয় না। মালোপাড়ার লোকজনই বলাবলি করছে লোকটার কিছু হয়নি। এমনি এমনি মারা যাবে? যদিও মৃত্যুর ফয়সালা ওপর থেকে আসে। তথাপি স্বাভাবিক আর অস্বাভাবিক বলে কথা। এখন বিশ্বাস-অবিশ্বাস আপনার ব্যাপার। আমরা আমাদের নাগরিক দায়িত্ব পালন করেছি।’
অফিসার সোজা হলেন। স্বাভাবিকভাবে যেয়ে বসলেন নিজের চেয়ারে। বললেন, ‘কিন্তু, চেয়ারম্যানকে তো ভালো লোক হিসেবে জানি। এদিকে তোমাদের কথাগুলো পুরোপুরি ফেলতে পারছিনে। হুম।’ একটা নিঃশ্বাস ছাড়েন জোর করে তিনি। তারপর বলেন, ‘ওকে, ঘড়িটা রেখে যাও। দেখি কী করা যায়।’
আবু আর সানিন বের হয়ে এলো ফাঁড়ি থেকে। সন্ধ্যার পূর্ব মুহূর্ত। ওরা আপার বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো।

 

সাত
‘হুম চমৎকার।’ বলল সানিন।
‘এর মাঝে এমন একটা জায়গা থাকবে, আমি ভাবতেই পারিনি।’ আবুও অবাক হয়ে বলে।
‘এই বিলের মাঝে এমন একটা জলাশয়! সত্যি সুন্দর।’ বলে প্রকৃতিপ্রেমী সানিন।
‘গভীরতা মনে হয় খুব বেশি হবে।’ বলল আবু।
‘সেটাই স্বাভাবিক।’ উদাস হয়ে উত্তর দিলো সানিন।
‘আমার কিন্তু এই সুন্দর পানিতে গোছল করতে ইচ্ছে করছে।’ যেন এখনই পানিতে ঝাঁপ দেবে এমনভাবে বলল আবু।
‘আরে থাম।’ আবুকে থামিয়ে বলে সানিন। ‘এই শীতের সাতসকালে উনি বিলের পানিতে গোছল করবে। উঁহ…। ওরে পানিতে নামলে তোরে যদি কেউ ঠ্যাং ধরে টেনে নিয়ে যায়, তাহলে কী হবে?’ যেন ভয় পাচ্ছে সানিন।
‘হেই। এই পানিতে আবার কী থাকবে?’ বলে আবু।
‘না! মানে শুনিসনে পুরাতন পুকুরের অনেক কিচ্ছা-কাহিনী। মানুষকে নাকি কিসে ঠেসে মেরে ফেলে।’ বলল সানিন।
‘এটাওতো শুনেছিস, পুকুরে সোনার থালা-বাটি পাওয়া যেত। আগে নাকি মানুষজন তাদের বাড়িতে দাওয়াতের অনুষ্ঠানে পানি থেকে উঠে আসা থালা-বাটি, হাঁড়ি-কুড়ি ব্যবহার করতো। কাজ শেষে ফিরিয়ে দিয়ে আসতো পানিতে। পরে কোন একজন লোভী মানুষ সেই জিনিসপত্রের একটা আত্মসাৎ করায় আর কোনোদিন সেই সব পাত্র পাওয়া যায়নি। সত্যি অনেক কথা-ই প্রচলিত আছে আমাদের সমাজে কিংবদন্তির মতো।’ যেন ওসব কাহিনী নিজের চোখে দেখেছে এমনভাবে বলে সানিন।
‘কত যে গল্প আছে এই পুকুর-খাল-নদী নিয়ে তার কোনো ইয়ত্তা নেই।’ বলে আবু।
ওরা জলাশয়ের চারদিকটা ঘুরে ঘুরে দেখে। আজ সকালে ওরা কুয়াশা না থাকায় জলেশ্বরের বিলের মাঝে এসেছে। ঠিক বিলের মাঝে একটা জলাশয় সুন্দরভাবে তৈরি করা। পাড়টা মাটি কেটে বাঁধানো। বোঝা যায় এখানে শুকনোর সময় মাছ চাষ করা হয়। জলাশয়ের উত্তর পাশে একটা ঝুপড়ি মতো। হয়তো পাহারার জন্য বানানো। নয়তো এখানে এলে ক্লান্ত হলে ওখানে বসে বিশ্রাম নেয়ার জন্য। ঝুপড়ির চালা হোগলা দিয়ে তৈরি। আর ভিতরে বাঁশের চাটাই আছে বসা বা শোয়ার জন্য। চারপাশ অবশ্য ফাঁকা। পাশে তিনটা হোগলার বেড়া পড়ে আছে। যেন কেউ ইচ্ছে করলেই ঝুপড়ির তিন পাশে লাগিয়ে ছোট-খাটো একটা কুঁড়েঘর তৈরি করতে পারবে।
ওরা দু’জন চাটাইয়ে এসে বসে। দু’জন তাকায় দু’দিকে। দৃষ্টি যতদূর প্রসারিত করা যায়। দেখতে থাকে ওরা দূরের ঐ দৃশ্য। এ এক অন্য রকম দেখা। শূন্যতা। আর শূন্যতা। আর দূরে ছবির মতো গাছাপালা। আকাশে খ- খ- মেঘের ভেলা ভেসে যাওয়া। প্রকৃতিপ্রেমিক না হয়েও যে কেউ মুগ্ধ হবে এই দৃশ্য দেখে। ওরা দু’বন্ধু ভাবুক হয়ে যায়।
সূর্যের তেজটা যে বেড়েছে সেদিকে খেয়াল নেই ওদের।
মানুষের একটা ডাক শুনতে পায় সানিন। নিজেকে ফিরিয়ে আনে প্রকৃতিপ্রেমিক থেকে। তাকায় চারপাশে। আপাদের বাড়ির দিক থেকে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে চোখ যেয়ে থেমে যায় ওর। দু’জন লোক যেন চিৎকার করে হাতছানি দিয়ে ওদের ডাকতে ডাকতে এদিকে এগিয়ে আসছে।
সানিন আবুকে গুঁতা মারে।
আবু, ‘উহু’ বলে তাকায় সানিনের দিকে।
সানিন বলে, ‘দেখ, দু’জন লোক আমাদের ডাকতে ডাকতে এদিকেই আসছে।’
‘আমরা আবার কার কী করলাম।’ জিজ্ঞাসা আবুর।
‘বুঝতে হলে অপেক্ষা করতে হবে।’ সানিন ভাবছে।
ওরা একদৃষ্টিতে লোক দু’জনের দিকে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টিসীমার মধ্যে আসলে দেখা যায় একজন পুলিশের ড্রেস পরা। অন্যজন সিভিল।
আবুরা দু’জন চাটাই থেকে নেমে দাঁড়ায়।
ও দু’জন কাছে এলেই সিভিল ড্রেসওয়ালা বলে, ‘ আবু-সানিন কেমন আছো?’
‘আলহামদুলিল্লাহ।’ উত্তর দেয় সানিন। আবুও মুখ নাড়ে সানিনের সাথে।
কাছে এসেই লোকটা হাত বাড়ায় সানিনের দিকে হ্যান্ডশেকের জন্য। সানিন হাত মেলায়।
আবুর দিকে তাকিয়ে হাত বাড়িয়ে লোকটা বলে, ‘তুমিই আবু?’
আবু হাত এগিয়ে বলে, ‘হুউ।’
আবুর সাথে হ্যান্ডশেক করে লোকটা চাটাইয়ের ওপর বসে বলে, ‘তোমাদের কথা শুনেছি। তোমরা একটা খুনের কথা বলেছো। আমার কাছে মনে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটা একই সুতোয় গাঁথা।’
সানিন আর আবু হাঁ করে তাকিয়ে থাকে লোকটার মুখের দিকে। লোকটা আবারও মুখ খোলে। বলে, ‘তোমাদের সাথে আমার আগেও একবার দেখা হয়েছে পথে।’
সানিনের সাথে সাথে মনে পড়ে ঐদিনকার কথা। লোকটা ওদের পথের মাঝে থামিয়ে ওদের নাম পরিচয় জানতে চেয়েছিলো।
আবু সাথে সাথে বলে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। ঐ যে, আপনি আমাদের থামিয়ে আমাদের বাড়ি কোথায় জানতে চেয়েছিলেন।’
‘রাইট। ব্লিলিয়্যান্ট বয়েজ। শোন।’ যেন একটা দম নিলেন তিনি। তারপর কথা বলা শুরু করলেন, ‘তোমাদের কথাই পুলিশ অফিসারের কাছ থেকে আমি শুনেছি। এক রহস্যের সমাধান করতে এসে আর এক রহস্য তোমরা আমাকে দিলে। দেখি কতদূর কী করা যায়।’
আবু ফোঁস করে বলে বসে, ‘পুলিশের লোক দিয়ে আজ খুব বেশি বিশ্বাস করা যায় না।’
‘হুম। কিছু অসৎ পুলিশের জন্য আজ আমাদের এই দুর্নাম। যাক সে কথা। তোমরা কোনো কিছু জানতে পারলে আই মিন কোনো সন্দেহজনক কিছু দেখলে বা শুনলে অবশ্যই আমাকে জানাবে। আর যেহেতু তোমরা ছোট মানুষ, বড়দের এসব নিয়ে তোমাদের বেশি মাথা না ঘামানোই ভালো। যাই হোক। এই আবিদ।’ সাথে আসা পুলিশের ড্রেস পরা লোকটারে দিকে তাকিয়ে বলেন তিনি, ‘এই বিলটা সম্পর্কে কী জানো?’
সানিন ও আবু এবার আবিদ নামের পুলিশের দিকে তাকালো। দেখলো ফাঁড়িতে যেয়ে যাকে ওরা ডিউটি অফিসারের রুম কোন দিকে জানতে চেয়েছিলো সেই সিপাই এই পুলিশ।
আবিদ বলে, ‘স্যার, তেমন কিছু না। তবে এটা জানি এই বিলে প্রচুর ধান হয়। আর বর্ষার মৌসুমে মাছও ধরে লোকজন। তবে বিলের মালিক একক কেউ নয়। শুকনোর সময় সীমানা চিহ্নিত করে আর বর্ষার সময় ভেসে যায়।’
‘হুম। ওকে ছেলেরা। চলি।’ বলে ওরা দু’জন যেমন এসেছিলো তেমন চলে গেল।
আবু সানিন যেন এবার স্বাভাবিক হলো। সানিনই প্রথমে মুখ খুলল। বলল, ‘আবু লোকটা পুলিশের বড় কর্তা হবে হয়তো।’
‘তাতে আমাদের কী?’ আবুর প্রশ্ন।
‘আমাদের মনে হয় সূক্ষ্ম হুমকি দিয়ে গেল।’ সানিনকে থামিয়ে আবু বলে, ‘পুলিশের লোক হুমকি দেবে! মানে কী?’
‘তোমরা ছোট মানুষ। এসব নিয়ে মাথা না ঘামানোই ভালো। লোকটার কথা কী মনে পড়ে?’ জানতে চায় সানিন।
আবু যেয়ে চাটাইয়ের উপর বসলো। তারপর বলল, ‘বুঝেছি।’ সানিনও ওর পাশে যেয়ে বসলো। বলল, ‘এখন কী করবি?’
‘এর প্যাঁচ খুলে ছাড়বো।’ আবুর উত্তর।
‘মানে?’ জানতে চায় সানিন।
‘খুব সোজা।’ আবুর সংক্ষিপ্ত উত্তর।
‘কী?’ সানিন আগ্রহ ভরে জানতে চায়।
‘রহস্যের সমাধান।’ আবু যে রহস্যের মধ্যে ঢুকে গেছে।
‘আমারও তাই মত।’ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করে সানিন।

 

আট
‘আবু রহস্যের সমাধানতো করবি? কিন্তু কিভাবে?’ জানতে চায় সানিন।
বিকেলে শীতের মিষ্টি রোদে হাঁটতে বেরিয়েছে ওরা।
আবু দুই হাত পেছনে বেঁধে হাঁটতে হাঁটতে উত্তর দিলো, ‘জানি না!’
দু’জনেই ভাবতে ভাবতে হাঁটতে থাকে বাজারের দিকে।
হোটেলের সামনে আসতেই আবু দাঁড়িয়ে পড়ে।
সানিন ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, ‘চল। গজা খাওয়া যাক।’
‘তুই ও কি আমার মতো খাদক হয়ে গেলি নাকি?’ আবু কিছুটা অবাক হয়।
‘আরে না। কেন জানি আমারও গজা খেতে ইচ্ছে করছে।’ সানিন হোটেলের ভেতর ঢুকতে ঢুকতে বলে।
আবু ওর পিছে পিছে যায়। ওরা বসে ফাঁকা দেখে এক টেবিলে।
সেই ছেলেটি এগিয়ে আসতেই আবু বলে, ‘দেন আমাদের খাবার।’
ছেলেটা দুইটা পিরিচে গজা দিয়ে যায়। দু’জন নীরবে খেয়ে চলে। খাওয়া প্রায় শেষ। এমন সময় একটা মোটরসাইকেল এসে থামে হোটেলের সামনে। ওরা দু’জন একই সঙ্গে তাকায় মোটরসাইকেল ও এর আরোহীর দিকে। এটা সেই পালসার ওয়ালা। আজ কিছু না বলে মোটরসাইকেল রেখে ক্যাশে বসা ম্যানেজারের টেবিলে রাখা জিনিসটা ধরে একটা ঠোঙার ফাঁকা জায়গায় কিছু লিখে ঠোঙাটা ম্যানেজারের নিকট দিয়ে নিচু স্বরে কিছু বলে চলে গেল।
সানিন খাওয়া ফেলে সোজা ম্যানেজারের দিকে যায়। আবু দু’হাতে দুই পিরিচের সব গজা নিয়ে সানিনের পিছে পিছে হাঁটা ধরে।
সানিন পকেট থেকে টাকা বের করে ম্যানেজারের দিকে বাড়িয়ে ধরে। ভাগ্য ওদের প্রসন্ন হলো। ঠিক তখনি ম্যানেজারের মোবাইলটা বেজে উঠলো। লোকটা তখন ডান হাত দিয়ে লেখা ঠোঙাটা সরাচ্ছিল। একই সাথে মোবাইল বাজা এবং সানিনের টাকা দেয়ায় লোকটা একটা ছোট বাটখারা দিয়ে ঠোঙাটা চাপা দিয়ে সানিনের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ক্যাশে রেখে ক্যাশ থেকে মোবাইল বের করলো। এই সুযোগে সানিন পুরো লেখাটা পড়ে নিলো।
হোটেল থেকে বের হয়ে সানিন বলল, ‘চল আবু। আজ থেকে রহস্যের জাল ছিঁড়তে শুরু করি।’
‘মানে।’ জানতে চায় আবু।
‘মানে হলো মোটরসাইকেলওয়ালা লিখে গেছে এর রহস্য।’ বলল সানিন।
‘বুঝলাম না।’ গজা খাওয়ায় মত্ত আবু।
‘ওরে চান্দু। শোন, মোটরসাইকেল ওয়ালা দেখলি না কিছু একটা লিখে গেল। ওটা আমি পড়লাম কিন্তু কিছুই বুঝলাম না।’ ভাবে সানিন।
‘কী লেখা ছিলো ওতে?’ একটা গজা মুখে পুরে জানতে চায় আবু।
ঠিক তখনি ওদের পাশে এসে একটা মোটরসাইকেল থামে। আরোহী ফাঁড়ির সেই এসআই। স্টার্ট বন্ধ করে জানতে চাইলো, ‘কেমন আছো তোমরা?’
আবু কোৎ করে একটা ঢোক গিলে বলল, ‘ভালো। আপনি?’
‘আমিও আছি। তা তোমাদের কথাটা চেয়ারম্যান স্বীকার করেনি। আবার একেবারে অস্বীকারও করেনি।’ বলেন এসআই।
‘তাহলে তাকে ধরছেন না কেন?’ বলল সানিন।
‘দেখ তথ্য প্রমাণ ছাড়া মানে সন্দেহের বশে সাধারণ মানুষকে গ্রেফতার করা যত সহজ, একজন জনপ্রতিনিধিকে গ্রেফতার করা তত সহজ নয়।’
তাকে থামিয়ে দিয়ে আবু বলে, ‘আইন ক্ষমতার কাছে কি অসহায়?’
‘পুরোপুরি না। আচ্ছা থাক ওসব কথা। আমাদের এক স্যার মনে হয় তোমাদের সাথে দেখা করেছেন?’
‘হুম। তাহলে তিনি আপনাদের বড় স্যার।’ বলল আবু।
‘হ্যাঁ। উনি এক বিশেষ কাজে আমাদের এই অঞ্চলে এসেছেন। মালোপাড়ার বিষয়টা নিয়ে দেখলাম স্যারও বেশ চিন্তিত। তা ছাড়া আমরা একপ্রকার চাপের মধ্যে আছি।’
অফিসার থামলেই আবু ফস করে জানতে চায়, ‘কেন?’
‘হুম। বিষয়টা তোমাদের বলা যায়। নিশ্চয় শুনেছো বেনাপোল বন্দর দিয়ে অস্ত্র ও মাদকের এক বড় চালান দেশে ঢুকেছে। বেশ কিছুদিন পার হলো অথচ আমরা এখনও এর কোনো কূলকিনারা করতে পারলাম না।’ ওদেরকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে তিনি আবারও বললেন, ‘তোমরা কি নতুন কোনো কিছু জানতে পারলে?’
‘জানার চেষ্টা করছি।’ বলল সানিন।
‘জানলে অবশ্যই আমাকে জানাবে। ওকে। বাই।’ বলে তিনি মোটরসাইকের স্টার্ট দিয়ে চলে গেলেন।
আবু ওর গমনপথের দিকে হাঁ হয়ে তাকিয়ে রইলো। সানিন আবুর হাত থেকে একটা গজা নিয়ে আবুর মুখে পুরে দিলো।
ও নীরবে সেটা চিবিয়ে গলাধঃকরণ করলো।
‘এই যে আপনারা কি আবু আর সানিন ভাইয়া।’ বলল দশ-এগারো বছরের এক মেয়ে ওদের পাশে এসে দাঁড়িয়ে।
আবু তখন একটা গজা নিজে নিজে মুখে পুরতে যাবে। থেমে গেল ও।
সানিন বলল, ‘হ্যাঁ। কিন্তু কেন?”
‘এটা আপনাদের।’ বলে মেয়েটা একটি চার ভাঁজ করা কাগজ সানিনের হাতে দিয়ে সোজা পূর্বদিকে হাঁটা ধরলো।
সানিন ওটা হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলে দেখে একটা চিঠি। আবুকে সম্বোধন করে লেখা। ওটা ও না পড়ে আবুর দিকে বাড়িয়ে ধরলো। দেখে আবু এখনও হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছে হাতে গজা ধরে।
আবু চিঠিটা ওর হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, ‘নে তোর চিঠি। গজা খা আর পড়।’
আবু ডান হাতে একটা গজা মুখে পুরে দিয়ে চিঠিটা নিয়ে পড়তে আরম্ভ করলো।
চিঠিতে লেখা:
আবু,
¯েœহ নিস। আমি খুব জরুরি এক কাজে হঠাৎ করে উপজেলায় যাচ্ছি। আজ নাও ফিরতে পারি। জানি তোদের কষ্ট হবে। আজ রাতে কোথাও একটু থাকার ব্যবস্থা করিস। আমার সোনা ভাই রাগ করিস না।
ইতি
তোর বড় আপা
‘এটা কোন ধরনের কথা। কওয়া নেই বলা নেই আপা আমাদের ছেড়ে বাড়ি থেকে চলে গেল! বলল আজ রাতে অন্য কোথাও থাকতে। না..না..না এটা হতে পারে না।’ আবু যেন মানতেই চাচ্ছে না।
‘দেখ আবু। আপা মনে হয় ইমার্জেন্সি গেছে। কি আর করা! আপা যখন বলেছে। চল বাড়ি চলে যাই।’ বলল সানিন।
‘আরে জামা কাপড়ের ব্যাগতো আপার বাসায়।’ বলল আবু।
‘পরে এসে নিয়ে যাবো।’ উত্তর সানিনের।
মন খারাপ করে হাঁটতে হাঁটতে বাজারের ইজিবাইক স্ট্যান্ডে এলো ওরা। খাজুরাগামী এক বাইকে উঠে বসলো।
খাজুরা থেকে বাসে নিউমার্কেট পর্যন্ত তারপর আবার ইজিবাইকে যে যার বাড়ি ফিরলো ওরা।

 

নয়
বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যায়।
আবু বাড়ি যেয়ে সোজা ওর রুমে প্রবেশ করেই শুয়ে পড়ে।
মা এগিয়ে এসে বলেন, ‘কিরে বেড়ানো শেষ?’
‘হুউ’ সংক্ষিপ্ত উত্তর আবুর।
‘ওরা কই’ জানতে চান মা।
‘আছে।’ ঘুরে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে ও।
মা আর ওকে ঘাঁটান না। রাতে খাওয়ার সময় ওকে খেতে ডাকেন শুধু। আবু ক্ষিধে নেই বলে শুয়েই থাকে। এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে ও।
ভোর ৪টায় ঘুম ভেঙে যায় আবুর। পেটে যেন ক্ষুধার রাক্ষস নেচে বেড়াচ্ছে। গতকাল কোন দুপুরে আপার বাড়ি ভাত খেয়েছিলো আর আজ ভোর। এর মধ্যে শুধু কাল বিকালে গজা খেয়েছিলো।
সুতরাং ক্ষুধায় কাতর হয়ে কম্বল মুড়ি দিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায় ও। ফ্রিজ খুলে খাওয়ার কিছু খুঁজতে থাকে। পেয়েও যায়। একটা বক্সে ভরা মায়ের হাতে রান্না সেমাই পায়। যেটা ওর প্রিয় খাবারের একটি।
বক্সটা হাতে নিয়ে নিজের ঘরে যাওয়ার সময় ছোট বোন নাজিরার ঘরের সামনে দিয়ে যেতেই ওর ঘরের দরজা খোলা দেখতে পায় ও। যেটা কখনই থাকে না। থমকে দাঁড়িয়ে ঘরে উঁকি মারে। এই সাতসকালে কী করে ছোটবোন দরজা খুলে।
আবছা আলো আঁধারিতে দেখে নাজিরার বেডও ফাঁকা। সুন্দর পরিপাটি করে গোছানো বিছানা। ঘরে প্রবেশ করে ও। ডান হাতে সেমাইয়ের বাক্স নিয়ে বাম হাতে আলো জ্বালে। ঘর ফাঁকা নাজিরা নেই।
ওর টেবিলের ওপর একটা খাতা পড়ে থাকতে দেখে আবু। ওটা উল্টে-পাল্টে দেখে চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় ওর।
ঠিক তখনি মা নাজিরার ঘরের দরজার সামনে এসে দাঁড়ান। মা নামাজ পড়তে উঠে নাজিরার ঘরের বাতি জ্বালা দেখে এগিয়ে আসেন এখানে। বলেন, ‘কিরে কী করছিস? তুই এলি নাজিরা এলো না?’
‘মা তোমার মেয়ে আমাকে ভত্তা বানিয়েছে। ও আমাকে … ও আমাকে..।’ কথা বের হয় না আবুর মুখ থেকে।
‘আচ্ছা বাবা। আস্তে আস্তে।’ মায়ের চোখ যায় আবুর ডান হাতের দিকে। বলেন, ‘তোমার হাতে ওটা কেন?’
‘আমার প্রচ- ক্ষিধে পেয়েছে। তাই ফ্রিজ থেকে এনেছি।’ বলে আবু।
‘রাতেতো বললে ক্ষিধে নেই।’ উত্তর মায়ের।
‘মিথ্যা বলেছিলাম। এখন তার জ্বালা বুঝছি।’
‘বুঝেছো তো মিথ্যার ফল।’ মায়ের প্রশ্ন।
‘তোমাকে আর বলতে হবে না। সত্যি মিথ্যা খুব খারাপ জিনিস। কিন্তু আম্মু তোমার মেয়ে যে আমাকে গিনিপিগ বানালো। তার কী হবে?’ বলল আবু।
‘ও কী করেছে সেটাই তো বললি নে।’ জানতে চান তিনি।
‘তার আগে বল ও বাড়ি থেকে বেরিয়েছে কবে এবং কোথায় গেছে।’ বক্স খুলে হাত-মুখ না ধুয়ে হাত দিয়েই খাওয়া শুরু করে।
‘আগেতো হাত-মুখ ধো।’
‘পরে ধুয়ে নেবো। নাজিরার কথা বল।’ জানতে চায় আবু।
‘ওতো বলে গেলো ওর বান্ধবীর মামা বাড়ি তোদের বড় আপাদের পাশের গ্রামে ওখানে যাবে। তারপর তোদের আপার বাড়ি হয়ে তোদের সাথে একসাথে বাড়ি আসবে। তুই এখনও বললি না ও কই।’ মায়ের জিজ্ঞাসা।
‘ওর সাথে আমার সামনা-সামনি দেখা হয়নি। ও এখনও হয়তো ওর বান্ধবীর মামা বাড়িতে আছে। কিন্তু চিঠি লিখে ও আমাকে ইঁদুর বানিয়েছে।’ রাগটা যেন পড়ছে সেমাইয়ের ওপর। মায়ের সাথে কথা বলছে আর গোগ্রাসে সেমাই গিলছে।
মা বলেন, ‘আস্তে আস্তে খা। নয়তো গলায় বেঁধে যাবে।’
‘বাঁধবে না। তোমার মেয়েকে আজ কান ধরে বাড়ি আনবো।’ বক্স খালি করে মায়ের হাতে দিয়ে হাত চাটতে চাটতে বেসিনের দিকে যায় আবু।
মা বক্সটা নিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলেন, ‘বুঝিনে বাপু তোদের কী হয়?’
কিছুক্ষণ পরে আবু হাঁক ছাড়ে, ‘মা, আমি চললাম।’
মা তেড়ে আসেন। বলেন, ‘এই দাঁড়া। এই দাঁড়া।’
আবু সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।
মা বলেন, ‘কোথায় যাচ্ছিস এই শীতের ভোরে?’
‘তোমার মেয়েকে কিলাতে আপার বাড়িতে।’
‘বুঝলাম না।’
‘তোমার মেয়ে চিঠি দিয়ে আপা সেজে আমাদেরকে আপার বাড়িতে যেতে বলেছিলো। আর কাল বিকেলে আবার আপা সেজে চিঠি দিয়ে এক রাতের জন্য বাইরে থাকতে বলে। তোমার মেয়ে আপা সেজে চিঠি দিয়ে আমাদেরকে বোকা বানিয়েছে।’ আবু আর দাঁড়ায় না। যাত্রা শুরু করে।
মা বলেন, ‘সাবধানে যাস। আর ভাই-বোন ঝগড়া করিস না যেন।’
শীতের এই কুয়াশা ঘেরা ভোরে আবু সানিনকে যেয়ে ডেকে তোলে। সব চিঠি যে নাজিরা লিখেছে তা ওকে জানায়। ওর খাতা দেখে ও নিশ্চিত হয়েছে যে ওগুলো নাজিরার হাতের লেখা।
ছোট্ট একটা মেয়ের কাছে বোকা বনে সানিন হো হো করে হাসতে থাকে।
আবু ওকে ধমক দিয়ে বলে, ‘হাসি থামা। প্রথম থেকেই চিঠির লেখা আমার পরিচিত বলে মনে হয়েছিলো। কিন্তু ঠিক ধরতে পারিনি। এখন মনে পড়েছে ঐদিন রায়পুর স্কুল মাঠে খেলা দেখতে দেখতে ওকে ভ্যানে করে যেতে দেখেছিলাম। কিন্তু আমি ভাবতে পারিনি ও আসবে। এখন তাড়াতাড়ি রেডি হ। দেয়ারা যাব।’
‘এই সাতসকালে।’
‘হুম।’
‘বাসতো এখনও চলা শুরু করেনি।’
‘সেজন্যই তো সাইকেল নিয়ে এসেছি। রেড়ি হ। সাইকেল নিয়ে চল। লোকাল রাস্তায় যাব মাত্র পনের কিলোমিটার।’
‘এই শীতের সকালে সাইকেল চালাতেতো কষ্ট হবে। মানে শীত লাগবে।’
‘কিচ্ছু হবে না। একটু চালালেই গরম লাগবে। নাজিরাকে আজ একটা শিক্ষা দিতে হবে। নে নে তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আয়।’ বলল আবু।

দশ
‘তোরা বলছিস আমার হয়ে নাজিরা তোদের চিঠি দিয়ে আমার বাড়িতে বেড়াতে এনেছে। কাল আবার চিঠি দিয়ে তোদেরকে চলে যেতে বলেছে? বিষয়টা আমার কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না।’ বলেন আপা। সাতসকালে দু’জন হাজির। অনেকটা অবাক হন তিনি।
‘শুধু বলছি নে। প্রমাণও দিচ্ছি।’ বলে আবু পকেট থেকে দুইটা চিঠি বের করে আপার হাতে দেই।
আপা ও দুটো পড়া শেষ করে হাসেন। বলেন, ‘প্রথম চিঠি লিখে ও ঠিক করেছে তোদেরকে আমার বাড়িতে এনে। আসিসই নাতো। কতদিন পরে এলি। জানিস কী মজা হচ্ছে আমার। তোরা যা খেতে চাচ্ছিস আমি তা বানাতে কত্ত আনন্দ পাচ্ছি তা বলতে পারবো না।’ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন আপা। একটু দম নেন। তারপর বলেন, ‘কিন্তু পরের চিঠিটা এমন করলো কেন? মনে হচ্ছে তোদের সাথে ঠাট্টা করেছে।’
‘কিন্তু ও কই?’ আবুর জিজ্ঞাসা।
‘ও আর ওর বান্ধবী কাল তোরা যখন বিকেলে বের হস তারপর এসেছিলো। সন্ধ্যার একটু আগে আমাকে বলল, তোরা নাকি আসবি না কী এক কাজে বাড়ি যাবি। আসবি আজ বিকেলে। খানিক পরে এসে বলল, ‘ওরা একটু বেড়াতে বের হচ্ছে। সন্ধ্যার পর একটা ফোন এলো। নাজিরা ফোনে বলল, রাতে আর আসবে না। ওর বন্ধবীর মামার বাড়িতে থাকবে। সকালে আসবে। এর ভেতর কুয়াশা ভেদ করে তোরা এলি।’ বলে থামেন আপা।
‘আপা ওকে যদি আমি পাই না, ওর কান দুটো টেনে আমি ছিঁড়ে দেব। ও আমাকে বোকা বানিয়েছে।’ রাগে ফুঁসতে থাকে আবু।
‘সে পরে দেখা যাবে। আগে হাত-মুখ ধো। কিছু খাবি।’ আপা রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলেন।
ওরা হালকা নাস্তা করে হাঁটতে বের হয়। শীতের সকালে কুয়াশা ভেদ করে হাঁটতে হাঁটতে মালোপাড়া পার হয়ে আসে।
সূর্যটা উঁকি দিচ্ছে পুব আকাশে। কুয়াশা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। মিষ্টি রোদে ভালোই লাগছে হাঁটতে।
রাস্তার দু’পাশে ঝোপঝাড়। ভাটিগাছগুলোতে ফুল ফুটে আছে। অপরূপ সুন্দর লাগছে দেখতে। শিশিরবিন্দু ফুলের পাপড়ির ওপর চিক চিক করছে। আর পাতাগুলো ভিজিয়ে দিয়েছে। রাস্তার ধারের খেজুর গাছগুলোর কিছু গাছে রসের ভাঁড় বাঁধা আছে। আর কিছু আছে ফাঁকা।
কিছুদূর এগুতেই দেখা হলো একজন গাছি খেজুর গাছ থেকে রসের ভাঁড় পাড়ছে।
ওরা দু’জন লক্ষ করে দেখে গাছি গাছ থেকে ভাঁড় বদল করছে নিপুণ হাতে। খালি ভাঁড় পেতে রস ওয়ালা ভাঁড় পেড়ে নিয়ে আসছে। গাছে ওঠার সময় খালি ভাঁড় গাছির কোমরে একটা আঙটার সাথে ঝুলানো ছিলো। গাছি একবার ওদের দিকে তাকিয়ে পরক্ষণে তার নিজের কাজে মন দেয়।
ওরা হাঁটতে হাঁটতে আরো কিছুদূর গেল। সূর্যের তেজটা এখন বেড়ে গেছে।
আবু বলল, ‘চল ফেরা যাক।’
সানিন বলল, ‘হু, চল।’
ওরা বাড়ির পথে হাঁটা ধরলো। পথে ওদের কোনো কথা হয় না। আপার বাড়ি এসে খাটে দু’জন শরীর এলিয়ে দিলো।
একটা মাইক্রোবাস থামার শব্দ পেল ওরা রাস্তায়।
সানিনের ঘুম ঘুম ভাব আসায় দু’চোখ বন্ধ করে। আবু এখনও রেগে আছে ছোট বোনের ওপর। ওকে পেলে কী করবে তাই মনে মনে ভাবে।
নিজের অজান্তেই শুয়ে শুয়ে চালের দিকে তাকিয়ে মুখ দিয়ে থুথুর ছোট ছোট বাবল ছাড়ে জিহ্বা দিয়ে। ওগুলো জানালা দিয়ে উড়ে বাইরে যায়। ত্রিশ সেকেন্ডের মতো হলো ও থুথুর বাবল বের করতে থাকে।
‘ওয়াক থু..থু..থু।’ শব্দ আসে জানালা দিয়ে।
ঘুম ছুটে যায় সানিনের। ও তড়াক করে উঠে বসে। ধাক্কা মারে আবুকে।
আবু ভড়কে উঠে বসে বলে, ‘কিরে কী হয়েছে।’
সানিন ইশারায় জানালার বাইরে নির্দেশ করে। তখন আবারও শব্দ আসে, ‘উঁহু..উ..উ।’
আবু আর দেরি করে না এক ঝাটকায় বসা থেকে লাফ মেরে খাট থেকে নেমে বাইরে দৌড় মারে। সানিনও ওর পিছে যায়।
আবু যেয়ে নাজিরার একটা কান টেনে ধরে। নাজিরা বলে, ‘উঁহু। ছাড় আমার ব্যথা লাগছে। আমার কান ছাড়। একটা নোংরা পিশাচ কোথাকার। তোর ঐ গন্ধ ওয়ালা মুখের থুথু আজও আমার নাকে লেগেছে।’ ও এক হাতে নাক ডলতে থাকে আর এক হাতে কান ছাড়াতে থাকে।
ওদের হট্টগোলে আপাও চলে এসেছেন। তিনি আবুর দিকে চোখ পাকিয়ে তাকান। আবু তাড়াতাড়ি কান ছেড়ে দিয়ে নাজিরার মুখোমুখি দাঁড়ালো। বলল, ‘বল, আমাদের এভাবে বোকা বানিয়ে বাড়ি পাঠালি কেন?’
নাজিরাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে এলো ওর বান্ধবী আফরিন। ও নাজিরার পাশে এসে বলল, ‘ভাইয়া শোনো, ওর কোনো দোষ নেই। কাল ওকে ওটা করতে বাধ্য করা হয়েছে।’
সানিন সামনে এগিয়ে এসে বলল, ‘কেন কেন?’
‘সে ছোটখাটো এক ইতিহাস। পুরোটা না বললে বুঝবে না।’ বলল নাজিরা।
‘তো বল।’ বলল আবু।
‘ঘরে চল বলছি।’ হাঁটা ধরলো ঘরের দিকে ও। পিছে সবাই। আপা গেল রান্নাঘরের দিকে। বলে গেল, ‘তোরা যা আমি পিঠা বানিয়ে আনি।’
নাজিরা আর আফরিন খাটে পা ঝুলিয়ে বসেছে। আবু আর সানিন দু’টি চেয়ারে বসেছে।
নাজিরা বলা শুরু করলো, ‘ শোন, তোদের চিঠি দেয়ার পরে তোরা চলে আসার পর আমরা যেদিন এখানে আসি ঐদিন বাসে বসে তোদের চিঠি দিয়ে বোকা বানানোর গল্প আফরিনকে বলছিলাম। কথাগুলো আমাদের অপজিটে বসা সুন্দর ভদ্রলোক শুনে ফেলেন। বলেন, দারুণ বুদ্ধিতো তোমার। ভাইকে বোকা বানিয়ে বোনের বাড়ি পাঠিয়ে দিলে? এরপর লোকটার সাথে পুরো পথ আমরা বিভিন্ন গল্প করতে করতে আসি। উনি নাকি এই গ্রামে কী এক কাজে আসছেন।’
‘আচ্ছা, সকালে তাহলে লোকটা বলল কেন যে চেয়ারম্যান তার বন্ধু?’ পাশ থেকে বলল আফরিন।
‘মানে?’ আবু অবাক হয়।
নাজিরা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, ‘হুম। তাইতো। কাল বিকেলে আমরা আপার এখানে এসে জানলাম তোরা বাজারের দিকে হাঁটতে গেছিস। আমরাও পায়ে পায়ে গেলাম। ওদিকে বাজারের মধ্যে রাস্তায় লোকটার সাথে দেখা হলো। আমাদের সাথে কুশল বিনিময় হলো। সাথে তোদের খবরও জানতে চাইলো। বললাম তোদের সাথে এখনও দেখা হয়নি। ঠিক তখন তোরা হোটেল থেকে বের হলি। আফরিন তোদের দেখিয়ে বলল, ঐযে ভাইয়ারা। চল দেখা করি। কিন্তু লোকটা আমাদের পথ আগলে দাঁড়ালো। আসতে দিলো না। বলল, ভাইয়াদের সাথে আর একটু মজা করো। আমি বললাম, না আর করবো না। তখন লোকটা পকেট থেকে বের করে ছোট্ট একটা পিস্তল দেখালো আমাদের। বলল, এটা এদেশে আসা সর্ব লেটেস্ট। যা বলি তাই শোন। এতে তোমাদেরও লাভ আমারও লাভ।’ এ পর্যন্ত বলতেই নাজিরার চোখে পানি চলে এলো।
আফরিন ওকে বাম হাতে ধরে বলল, ‘তারপর ভাইয়া, রাস্তা দিয়ে একটা মেয়ে মনে হয় কোচিং শেষে বাড়ি ফিরছিল তাকে থামিয়ে ওর কাছে থেকে খাতা কলম নিয়ে নাজিরাকে দিয়ে ওই চিঠি লিখিয়ে ওই মেয়েটাকে দিয়ে তোমাদের কাছে পাঠায়। লোকটা আগেই জেনেছিলো যে আমরা আমার মামাবাড়িতে উঠেছি। তাই বলল, কাল যেন আপার বাড়ি না আসি। সোজা মামার বাড়ি যেতে। পেছনে তাকাতে বারণ করেছিলো। ভয়ে আমরা মামাবাড়ি চলে যাই। ও হ্যাঁ, আপাকে ফোনে তোমরা বাড়ি যাবে এবং আমরা আসবো না তা ঐ লোকটার মোবাইল থেকে আপাকে বলি।’
‘আচ্ছা লোকটা দেখতে কেমন?’ জানতে চায় আবু।
আফরিন বলল, ‘ভাইয়া কাহিনী এখানেই শেষ না। আজ সকালে যখন মামাবাড়ি থেকে আপার বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হলাম তখন কোন যানবাহন পাচ্ছিলাম না। হেঁটে কিছুদূর আসার পর পেছন থেকে একটা মইক্রোবাস এসে থামলো আমাদের পাশে। দরজা খুলে নামলো সেই লোক। জানতে চাইলো কোথায় যাচ্ছি। ভয়ে ভয়ে বলে দিলে আমাদের গাড়িতে উঠতে বলল। আমরা উঠতে রাজি না হওয়ায় অনেকটা জোর করে আমাদের গাড়িতে তোলে। গাড়ি চলতে শুরু করলে তোমাদের কথা জানতে চাই। আমি বলি তোমাদের সাথে আমাদের কোনো কথা হয়নি। লোকটা পকেট থেকে আগের দিনের থেকে ছোট একটা পিস্তল বের করে অন্য হাতে একটা সিগারেট বের করে তা পিস্তল থেকে আগুন জ্বেলে ধরায়। বলে এটা দেখে কি তোমরা ভয় পেয়েছিলে। আমরা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ি।’
সাথে সাথে নাজিরা বলে, ‘মোটেও আগের দিনের সেই পিস্তল ওটা নয়। ওটা আরো বড় ছিলো। লোকটা বলে ও নাকি চেয়ারম্যানের বন্ধু। চেয়ারম্যানের নিকট এক কাজে সে এসেছে। আর ওর গাড়িতে করে একটু ঘুরতে বেরিয়েছে। আজ আমাদের সাথে কোনো খারাপ ব্যবহার করেনি। বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে গেছে।’
সানিন চেয়ার থেকে উঠে বলল, ‘লোকটার চেহারা কেমন?’
‘হ্যান্ডসাম চেহারা। বয়স চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ হবে।’ বলল আফরিন।
‘বাম ভ্রুর উপরে কি একটা তিল আছে?’ জানতে চায় আবু।
‘হ্যাঁ হ্যাঁ।’ বলল নাজিরা।
‘আবু আর নয়। এক্ষুনি চল। রহস্যের সমাধান হয়ে গেছে।’ দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল সানিন।
আবু বলল, ‘আমার মাথায় কিন্তু এখনও পুরোপুরি ঢোকেনি।’
ঐ সময় আপা একটা পাত্র হাতে গরম গরম পাটিসাপটা পিঠা নিয়ে হাজির হন। ওরা দু’জন দুইটা পিঠা হাতে তুলে নেয়।
আবু আপাকে বলল, ‘আপা আমরা না আসা পর্যন্ত এদেরকে বের হতে দিবে না। সিরিয়াস কিন্তু। আমাদের পেছনে শত্রু লেগে গেছে।’
আপাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় ওরা দু’জন।

 

এগারো
আজ দু’দিন হলো বেনাপোল বন্দর দিয়ে যে অস্ত্র আর মাদক এসেছিলো তার উদ্ধারের।
ওরা চারজন আপার বাড়ির উঠানে বসে আছে সকালের মিষ্টি রোদে। ওদের ভাগ্নিটা সবার মাঝে খেলা করে বেড়াচ্ছে।
নাজিরা প্রথমে কথা বলল, ‘ভাইয়া বলতো তোরা কিভাবে বুঝলি এই জলেশ্বরের বিলেই সব কিছু আছে?’
আবু মুখ খুলল। বলল, ‘তোদের কাছ থেকে ওসব শোনার পর সানিনের মনে হলো সব এখানেই আছে। আমরা যেদিন তোদের চিঠি পেয়ে বাড়ি যাই সেদিন হোটেলে পালসার ওয়ালা একটা চিরকুট লিখে যায়। সানিন ওটা দেখে। ওতে লেখা ছিলো, সানিন তুই বল।’
সানিন বলা শুরু করে, ‘ওতে লেখা ছিলো, ‘জলে থাল ডুবলে মাছ তুলতে হবে। আসবে সাদা। তাতে যেতে হবে।’
‘মানে কী?’ জানতে চায় আফরিন।
‘মানে বুঝতে হলে আর একটু পিছে যেতে হবে। পালসার ওয়ালা যে বলেছিলো ‘জলে থালা ডুববে আজ।’ এই দু’টির মানে বের করলে সব পরিষ্কার হবে। সেদিন আমরা জলেশ্বরের বিলের মাঝে যেয়ে এর অর্থ আমার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। জলে মানে জলেশ্বর বিলের মাঝের পানিতে। আর থালা মানে চাঁদ। মাছ মানে অস্ত্র আর মাদক। সাদা মানে চেয়ারম্যানের সাদা গাড়ি। ব্যাস সব পরিষ্কার।’
‘চেয়ারম্যানকে কোথায় পাওয়া গেল?’ বলল নাজিরা।
‘তোদের দিয়ে চিঠি লিখিয়ে আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয় ঐ রাতে চেয়ারম্যান আর একবার বেঁকে বসেন। মানে তিনি এতে জড়াতে চান না। তাই চেয়ারম্যানকে মেরে আটকে রাখা হয়। ওদের ইচ্ছে ছিলো ঐরাতেই সব নিয়ে যাওয়া। কিন্তু চেয়ারম্যান রাজি না হওয়ায় পরের রাতে ওরা সব সরাতে চেয়েছিলো। তার আগেইতো আমরা কাজ সেরে দিই। ওরা যে চেয়ারম্যানকে গাড়িটা উপহার দিয়েছিলো যাতে ওটা ব্যবহার করলে কেউ সন্দেহ করবে না। অর্থাৎ চেয়ারম্যানের ঘাড়ে বন্দুক রেখে ওরা কাজটা করতে চেয়েছিলো।’ বলল সানিন।
‘সেই পুলিশ অফিসারের কী হলো?’ বলল আফরিন।
‘ও ক্রিমিনালদের সাথে হাত মিলিয়েছিলো টাকার লোভে পড়ে। ফাঁড়ির এসআই এসপির সাথে কথা বলে তাৎক্ষণাৎ তাকে শহরে ডেকে পাঠায় যাতে ও কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে না পারে। ওকে বিভাগীয় শাস্তি দিয়েছে।’ আবু থামে।
‘আর মালোপাড়ার খুন?’ নাজিরা জানতে চায়।
‘হ্যাঁ, ওটা খুনই ছিলো। চেয়ারম্যান বাধা দেয়ায় ধস্তাধস্তির সময় তার হাতের ঘড়ি ছিঁড়ে পড়ে। আর মৃত লোকটার অপরাধ সে এই বিলে অস্ত্র আর মাদক রাখা হচ্ছে তা দেখে ফেলা।’ থামলো সানিন।
‘হুম। এবার তোরা থাম। তোদের ‘অপারেশন জলেশ্বর বিল’ থামা। এই যে তোদের যার যা প্রিয় পিঠা সব তৈরি করে নিয়ে এসেছি। খাওয়া শুরু কর।’ আপা তিন চার রকমের পিঠা দিয়ে যান ওদের সামনে।
ওরা যার যা পছন্দ সে পিটা নিয়ে তাতে কামড় বসায়।
শেষ

Share.

মন্তব্য করুন