বিশ্বের দীর্ঘতম ক্রমবর্ধমান ভূগর্ভস্থ গুহার নাম ম্যামথ কেভ। যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ সেন্ট্রাল কেন্টাকির ভৌগোলিক সীমানায় ৩৫০ মিলিয়ন বছর আগে যার সৃষ্টি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ভূতত্ত্ববিদদের ধারণা, ৩৫০ মিলিয়ন বছর আগে এই বিস্ময়কর গুহার জন্ম শুরু হলেও অত্যন্ত জটিল চেহারা নিয়ে ম্যামথ কেভ নিজস্ব আকৃতি লাভ করতে আরম্ভ করে দশ মিলিয়ন বছর আগে। অবশ্য ভূ-অভ্যন্তরে তার জন্ম শুরুর সমাপ্তি আজও ঘটেনি এবং সেই কারণেই ম্যামথ কেভ বিজ্ঞানের ইতিহাসে প্রকৃতির এক চির-বিস্ময়কর লীলাক্ষেত্র। প্রতি বছর অগ্রসর হতে হতে এই আশ্চর্য গুহা ক্রমান্বয়েই বাড়িয়ে চলেছে তার দৈর্ঘ্যরে বিস্তৃতি। আপাতত এর দৈর্ঘ্য চার শ’ মাইলেরও বেশি। জীবন্ত প্রাণীর মতো ক্রমবৃদ্ধির কারণেই বিশাল এই গুহাটির নামকরণ হয়েছে ‘ম্যামথ কেভ’। ম্যামথ মানে অতি বৃহৎ।
প্রাগৈতিহাসিককালে উত্তর আমেরিকার সুবিশাল অঞ্চল ‘ম্যামথ’ নামক হাতির মতো এক শ্রেণির বিশাল প্রাণীর বিচরণযোগ্য অভয়ারণ্য ছিল। ভৌগোলিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তিত ক্লাইমেট সিস্টেমে অতিকায় ডাইনোসরদের মতো একদিন এরা বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। ৩৫০ মিলিয়ন বছর আগে বরফ যুগ আরম্ভ হওয়ার আগে উত্তর আমেরিকা মহাদেশের অবস্থান ছিল পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধের উষ্ণ অঞ্চলজুড়ে। তখন অগভীর সাগরের উষ্ণ পানিতে নিমজ্জিত ছিল কেন্টাকি রাজ্যের এই সীমানা। কিন্তু ভূপৃষ্ঠের ও ভূগর্ভের বিভিন্ন প্রকার ভাঙা গড়ার কারণে উত্তর আমেরিকা মহাদেশ ক্রমশ সরে আসে উত্তর গোলার্ধ অভিমুখে। এরপরে বরফ যুগের আবির্ভাবে মহাসাগর পরিণত হয় শক্ত বরফের একটি পুঞ্জীভূত পাটাতনে। আর সেই পরিবর্তিত ইকোসিস্টেমে প্রচ- চাপে সাগরের পলিমাটির সঙ্গে সামুদ্রিক প্রাণীদের মৃতদেহ, অন্যান্য মৃত প্রাণী ও সাগরের উদ্ভিদসহ স্তরে স্তরে ভূগর্ভের ওপর জমে ওঠে ১২০০ থেকে ১৪০০ ফুট খাড়া হয়ে স্তরে স্তরে চুনাপাথরের অটল কঠিন আস্তরণ। আরও পরে তার ওপরে পঞ্চাশ ফুট ভারী আবরণের প্রলেপ পড়ে গঠিত হয় বেলে পাথরের গভীর স্তর। এই দুই কঠিন আবরণের অনিন্দ্যসুন্দর আকৃতিতেই ক্রমে ক্রমে সুগঠিত হয় অপরিমেয় সৃষ্টি বৈচিত্র্যে পৃথিবীর পার্থিব বিস্ময়, বিশ্বের দীর্ঘতম ক্রম বিস্তীর্ণ গুহা ম্যামথ কেভ।
ম্যামথ কেভের বিপুল বিস্ময় আর রহস্যময়তার মায়াজাল, হাজার হাজার বছর আগেই আকর্ষণ করেছিল জিজ্ঞাসু মানুষের কৌতূহলী অন্তর। চার হাজার বছর আগে নেটিভ আমেরিকানরা প্রথম এই গুহা দেশ আবিষ্কার করেছিলেন বলে আধুনিক নৃতত্ত্ববিদদের বিশ্বাস। কেভের অভ্যন্তরে প্রাচীন যুগের যেসব পোশাক পরিচ্ছদ ও মৃতদেহের সন্ধান মিলেছে, তাঁদের বিশ্বাস সেই তথ্যের ওপর নির্ভর করেই ভিত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবীর দীর্ঘতম গুহার অজানা দিকের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে আঠারো শতকের গোড়ায় প্রথম শুরু হয় বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে তার জন্মরহস্য উদ্ধারের চেষ্টা। সেই থেকে আজ পর্যন্ত নানান বিষয়গুলো বিরামহীনভাবে আবিষ্কারের চেষ্টা চলছে বিভিন্নভাবে। তবে ম্যামথের অজস্র স্থান দুর্গমতার কারণে এখনো পড়ে রয়েছে অনাবিষ্কৃত হয়ে। যে কারণে এই গুহা দেশের অনেকখানি আজও রয়ে গেছে অজানার রহস্যেই নিমজ্জিত। ম্যামথ কেভের নিয়মিত দেহ বৃদ্ধির এই চলন্ত প্রক্রিয়া কোনো দিন থেমে যাবে কি না সে বিষয়েও কারও জানা নেই। বিশ্বের সর্ববৃহৎ, জটিল এবং অনন্যসাধারণ গঠন বৈচিত্র্যে পৃথিবীর তাবৎ পর্যটকদের কাছে এই গুহা তাই অ্যাডভেঞ্চার উপভোগের এক অফুরন্ত আকর্ষণ। সাধারণভাবে পর্যটকদের জন্য ভূগর্ভস্থ দর্শনীয় স্থানগুলো হলোÑ গ্র্যান্ড অ্যাভিনিউ, ফ্রোজেন নায়াগারা, ইকো রিভার ও ফ্যাট ম্যানস মিজারি। কেভের বিভিন্ন স্থানের নামকরণ হয়েছে তাদের গঠন বৈশিষ্ট্যের বিশেষত্বের ওপর নির্ভর করে। প্রতিকূল পরিবেশের কারণে নব্বই দশকের প্রথম থেকে ইকো রিভারে অর্থাৎ যেখানে নিকষ কালো অন্ধকারে মশালের আলো ফেলে নৌকা ভ্রমণ করতে হয়, সেই ট্যুরটি বন্ধ করে দিয়েছে ম্যামথ কেভ ন্যাশনাল পার্ক কর্তৃপক্ষ। সেই অন্ধকার পানিতে প্রাণিজগতের এমন দুই প্রজাতির অনুসন্ধান মিলেছে যারা নিরন্তর আলোর অভাবে জন্ম থেকেই চক্ষুহীন। অন্ধত্বের বিষয় নয়, এই অর্গান দুটি প্রাণীদের দেহে কখনো তৈরিই হয় না পরিবেশের কারণে। এরা হলো- কেভ শ্রিম্প ও কেভ ক্রে ফিশ নামের দু’টি মৎস্য প্রজাতি।
ম্যামথের সৃষ্টিপ্রক্রিয়ার বৈচিত্র্য, বিজ্ঞানরাজ্যে মেলে ধরেছে অপার রহস্যের ব্যাপক ভা-ার। আর্কিওলজিস্ট, জিওলজিস্ট, ক্লাইমেটোলজিস্টদের কাছে ম্যামথ তাই এক জীবন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া। এর দেহ প্রাচীনতম আর বিস্তৃততম হওয়ার কারণে সবচাইতে পরিচ্ছন্ন ও পরিপূর্ণভাবে রেকর্ড করতে পেরেছে ভূরহস্যের অগণিত অজানা তথ্যগুলো। ম্যামথ কেভের অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যসম্ভারও অতুলনীয় মহিমায় ভাস্বর। চুনাপাথরের কঠিন আস্তরণ কোথাও কোথাও হাজার ফুট খাড়া হয়ে সহসা মাথা তুলে থমকে দাঁড়িয়েছে অতি উচ্চ, উদ্ধত গম্বুজের মতো। কোথাও মহাসাগরের অজস্র ঢেউয়ের খেলায় ছুটোছুটি করতে করতে বিভিন্ন মাপের উচ্চতায় পৌঁছুতে না পৌঁছুতে হঠাৎই মুখ তুলেছে পাহাড়ি উপত্যকার ঢেউ হয়ে। তার ওপরে বিশাল ছাতার বিস্তীর্ণ আবরণ হয়ে যেন এই অপরূপ সৃষ্টিরহস্য রক্ষা করতেই পঞ্চাশ ফুট ঘনত্বের বেলে পাথরের কঠিন স্তর গুহা অভ্যন্তর আবৃত করেছে উদার হৃদয় আশ্রয়দাতার মতো। তাদের প্রত্যেকের শরীর জুড়ে মূল্যবান মিনারেলের গভীর প্রলেপ, কোথাও ফুটে উঠেছে গুচ্ছ গুচ্ছ পাপড়িসমেত প্রস্ফুটিত ফুল হয়ে। কোথাও তা ঝুলে পড়েছে কাশবনের ঝালর হয়ে ঝলমলে লাবণ্যের ধারায়। কোথাও গুহার মেঝে হাজার ফুটের অধিক নিচে শায়িত অবস্থায় হারিয়ে গেছে নিকষ কালো অন্ধকারে। আবার সেই অন্ধকার ছেদন করেই চুনাপাথরের কঠিন স্তর ভারী পর্দার আড়াল হয়ে শক্তশেলের মতো সহসা ঠেলে উঠে তৈরি করেছে মৌচাকের মতো অগণিত কুঠুরির সারি। যেন বিরাটকায় রাজপ্রাসাদের সংখ্যাহীন চেম্বারের মতো একেকটি স্থাপত্যশিল্প তারা। তাদেরও রয়েছে বিভিন্ন আকৃতির কারুকার্যখচিত সহস্র পিলার। দৃষ্টিনন্দন বিছানার চাদরের মতো ঈষৎ প্রসারিত ঝুলন্ত মেঝে। সব মিলিয়ে ভূ-অভ্যন্তরের বিস্ময়কর গোলকধাঁধা কেবল পর্যটকদের জন্যই বিরাট অ্যাডভেঞ্চার হয়ে নেই। বিজ্ঞানের ব্যাখ্যাতেও এই অসাধারণ দৃশ্যমানতা রহস্যময়ী প্রকৃতির অভূতপূর্ব সৃষ্টির প্রদর্শনীরূপে বিরাজিত! যেখানে সঞ্চিত আছে অনাদিকালের বিজ্ঞানরহস্যের অফুরন্ত সৃষ্টিসম্ভার! অন্তহীন ¯্রষ্টার অলৌকিক সৃষ্টিকল্পের অপার্থিব অস্তিত্বের পরশ! কিন্তু তার সঙ্গেই ঝুলে রয়েছে উত্তরহীন সেই প্রশ্নটিও, ম্যামথ যদি চলতেই থাকে সময়হীন কাল ধরে, কী হবে সেই চলায়মানতার ভবিষ্যৎ ঘিরে? নতুন ভাঙা গড়ার বিপজ্জনক পরিণতি নয়তো? যাতে একটি মহাদেশই বিলীন হয়ে যেতে পারে?