নারকোলের ঐ লম্বা মাথায় হঠাৎ দেখি কাল
ডাবের মতো চাঁদ উঠেছে ঠাণ্ডা ও গোলগাল।
ছিটকিনিটা আস্তে খুলে পেরিয়ে গেলাম ঘর
ঝিমধরা এই মস্ত শহর কাঁপছিলো থরথর।
দরগাতলা পার হয়ে যেই মোড় ফিরেছি বাঁয়
কোত্থেকে এক উটকো পাহাড় ডাক দিলো আয় আয়।

পাহাড়টাকে হাত বুলিয়ে লালদিঘির ঐ পাড়
এগিয়ে দেখি জোনাকিদের বসেছে দরবার।
আমায় দেখে কলকলিয়ে দিঘির কালো জল
বললো, এসো, আমরা সবাই না-ঘুমানোর দল-
পকেট থেকে খোলো তোমার পদ্য লেখার ভাঁজ
রক্তজবার ঝোঁপের কাছে কাব্য হবে আজ।
দিঘির কথায় উঠলো হেসে ফুলপাখিরা সব
কাব্য হবে, কাব্য হবে- জুড়ল কলরব।
কী আর করি পকেট থেকে খুলে ছড়ার বই
পাখির কাছে, ফুলের কাছে মনের কথা কই।

বন্ধুরা, তোমরা কি বলতে পারো এত সুন্দর এই কবিতাটি কে লিখেছেন? হ্যাঁ, তা হলে বলছি শোন।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রাম। এই গ্রামের মোল্লাবাড়িতে ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই জন্ম হলো একটি শিশুর। শিশুটি দেখতে খুব সুন্দর। মা-বাবার খুশির সীমা নেই। এত সুন্দর চাঁদের মতো মুখ নাতি পেয়ে দাদীরও কোনো আনন্দের শেষ নেই। এ-বাড়ির ও-বাড়ির সবাই আসছে নতুন মেহমানকে দেখতে। পাড়ার মুরুব্বিদেরও যেন কী আনন্দ। মোল্লাবাড়ির দহলিজ ভরে গেলো লোকে লোকে। তাঁর পিতার নাম কি জানো? পিতার নাম মীর আবদুর রব। আর মাতার নাম রওশন আরা মীর। আদরে আদরে ভরে দিলো তাকে। মা-বাবা আর আত্মীয়দের আদর যতেœ দিন দিন বড় হতে লাগলেন তিনি।
ছেলেবেলায় গ্রামের অপর দশটি ছেলের সঙ্গে দুষ্টুমিতে মেতে থাকতেন তিনি। বটগাছের এ ডাল থেকে ও ডালে লাফালাফি করতেন। দিনভর খেলায় মেতে থাকতেন। প্রাণের আবেগে টগবগ করতো তার দুরন্তপনা। ফলে রাতের বেলায় খেতে হতো বকুনি। তখন মার বকা খেলেও দাদী আদর করে টেনে নিতেন কাছে। দাদী বেগম হাসিনা বানু হাতে তুলে দেন বর্ণশিক্ষা। সকাল হলে টেনে তুলে দেন ঘুম থেকে। টুপি মাথায় দিয়ে চলে যান মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে। এখানে তিনি ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করেন। একটু বড় হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এম ই স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হলো। এই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাঁকে জর্জ হাইস্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করা হয়।
ধীরে ধীরে শৈশব কেটে গিয়ে কৈশোর এলো। আস্তে আস্তে এই কিশোরটির স্বভাব থেকে দুরন্তপনা ও চপলতা হারিয়ে গেল, পরিণত মনের মানুষ হয়ে উঠতে লাগলেন তিনি।
লেখাপড়ার পাশাপাশি অবসর সময়ে অতল পানি আর আকাশের সীমাহীন নীলের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। দেখেন, সাদা বলাকার ঝাঁক আকাশে উড়ছে। দেখেন, বিলের পানিতে আলো করে ফুটে আছে লাল শাপলা। এসব দেখে তাঁর মনে কত ভাবনা আনাগোনা করতো। কত ভাবই না তাঁর মনে উঁকিঝুঁকি দিতো। ভাবতে ভাবতে এক সময় তিনি হারিয়ে যেতেন প্রকৃতির অতল গহ্বরে।
ঘরে এলে আম্মুর লেখা-পড়ার তাগিদ আসতো। বড় হয়েও তিনি ভুলতে পারেননি ওইসব দিনের কথা। তাঁর কবিতায় তিনি ছোটবেলার স্মৃতিগুলোকে কত সুন্দরভাবে সাজিয়ে তোমাদের জানার জন্য বলছেন-
আম্মু বলেন, পড়রে সোনা
আব্বু বলেন, মন দে
পাঠে আমার মন বসে না
কাঁঠাল চাপার গন্ধে।

আমার কেবল ইচ্ছে করে
নদীর ধারে থাকতে,
বকুল ডালে লুকিয়ে থেকে
পাখির মত ডাকতে।

সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে
কর্ণফুলীর কূলটায়,
দুধভরা ঐ চাঁদের বাটি
ফেরেশতারা উল্টায়।

তখন কেবল ভাবতে থাকি
কেমন করে উড়ব,
কেমন করে শহর ছেড়ে
সবুজ গাঁয়ে ঘুরব!

তোমরা যখন শিখছ পড়া
মানুষ হওয়ার জন্য,
আমি নাহয় পাখিই হব
পাখির মত বন্য।

তা হলে তোমরা বুঝতেই পারছো কেমন ছিল তাঁর কৈশোরকালটি। এক সময় তিনি সীতাকুণ্ড হাইস্কুল ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিয়াজ মোহাম্মদ হাইস্কুলে লেখাপড়া করেন। পাঠ্যবই ও খেলাধুলার চেয়ে গল্প-উপন্যাস বা সাহিত্য বিষয়ক বইয়ের প্রতি তাঁর আগ্রহ বেশি ছিল। তাঁর স্মৃতির সাথে জড়িয়ে আছে একটি পাঠাগার। তা হলো লাল মোহন স্মৃতি পাঠাগার। এই পাঠাগার থেকে তিনি বই এনে পড়তেন। তিনি ভাবতেন সমাজের কথা, দেখতেন সমাজটাকে পাল্টিয়ে দেয়ার রঙিন স্বপ্ন।
এর মধ্যে চলে এলো ১৯৫২ সাল। ১৯৫২ সালের কথা তোমরা হয়তো সবাই জানো। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন কত ভাই। ভাষা আন্দোলনে তাঁর অবদানও কম নয়, তিনি তখন নিয়াজ মোহাম্মদ হাইস্কুলের ছাত্র। সে সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়া সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে একটা লিফলেট বের হলো। এ লিফলেটে তাঁর চার লাইনের একটা কবিতা ছাপা হলো। ফলে পুলিশ এসে হানা দিলো তাঁদের বাড়িতে। পুলিশ থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তিনি এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে পালিয়ে বেড়ান। এক পর্যায়ে বিদ্যালয়ের সাথে তাঁর সম্পর্কের চির ইতি ঘটে।
এরই মধ্যে তাঁর নতুন জীবন শুরু হলো। পিতার একান্ত ইচ্ছা ছেলেকে বিয়ে করাবে। সে দিনটি ছিল ১৯৫৫ সাল। সৈয়দা নাদিরা বানুর সাথে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন।
১৯৫৪ সালে তিনি চলে এলেন ঢাকায়। তাঁর শখ তিনি একজন বড় লেখক হবেন। এরই মধ্যে কলকাতা ও ঢাকার কয়েকটি পত্রিকায় তাঁর কয়েকটি লেখা ছাপা হলো। ঢাকায় এসে তিনি বিভিন্ন পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ পদে চাকরি করেন। সাথে সাথে সাহিত্য চর্চাও চালিয়ে যান। ইতোমধ্যে প্রকাশিত হলো তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘সোনালী কাবিন’।
একে একে চলে গেলো অনেকগুলো বছর। দেশের শুরু হলো স্বাধীনতাযুদ্ধ।
তিনি অংশগ্রহণ করেন দেশ মুক্তির সংগ্রামে। ১৯৭১ এ মুজিবনগর সরকারের স্টাফ অফিসার হিসেবে যোগ দিলেন। বীরত্বের সাথে তিনি সে দায়িত্ব পালন করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে তিনি ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ‘গণকণ্ঠ’-এর সম্পাদক হলেন। এই পত্রিকাটি তখন একমাত্র সরকার বিরোধী পত্রিকা। পত্রিকাটি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে থাকে। পত্রিকাটি সম্পাদনার অপরাধে ১৯৭৪ সালের মার্চ মাসে তিনি কারারুদ্ধ হন। এক বছর জেল খেটে ছাড়া পেয়ে তিনি শিল্পকলা একাডেমিতে চাকরি নেন। ১৯৯৩ সালে শিল্পকলা একাডেমির গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালকের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন।
তিনি অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেন। তোমাদের জন্য লিখেন কত মজার মজার ছড়া-কবিতা। গ্রহণ করেন দেশী-বিদেশী সর্বোচ্চ পুরস্কার।
তোমাদের মনে এতক্ষণ হয়তো কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে, কে সে কবি। এত সুন্দর পরিচ্ছন্ন কবিটির নামই বা কী?
হ্যাঁ, তিনি আর কেউ নয়। তিনি হলেন তোমাদের আমাদের সবার প্রিয় ফুলপাখিদের কবি আল মাহমুদ।
কবি আল মাহমুদ এখন আর আমাদের মাঝে নেই। ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার তাঁকে বিদায় দিয়েছি চিরদিনের জন্য। মৃত্যুর আগে তাঁর লেখা কবিতায়ই তো তিনি বলে গেছেন-
‘আমার যাওয়ার কালে
খোলা থাক জানালা দুয়ার
যদি হয় ভোর বেলা
স্বপ্নাচ্ছন্ন শুভ শুক্রবার।’

Share.

মন্তব্য করুন