আমাদের প্রিয় কবি ফররুখ আহমদ আমাদের জন্য অনেক ধরনের মজার মজার ছড়া লিখে গেছেন। প্রথম ছড়ার বই “পাখির বাসা”য় তিনি আমাদের নিয়ে বলেছেন
নতুন মানুষ এলে যারা
খোদার দুনিয়াতে
ছোট্ট আমার পাখির বাসা
দিলাম তাদের হাতে।
একদিন সকালে ঘুম ভেঙেছে পাখিদের কোলাহলে। ভোরে পাখিরা খুব ডাকে। সেই ডাকেই ভোর হয়। কিন্তু সকালে এভাবে ডাকছে কেন? দেখিতো, বলেই জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি অনেকগুলি টুনটুনি পাখি নিজেদের মাঝে কি নিয়ে যেন লাফালাফি করছে আর লেজ উঁচিয়ে একজন আরেকজনের সাথে কথা বলছে টুইট, টুইট করে। তাদের পাশেই ডুমুর গাছের নিচে একটা পাখির বাসা ছিঁড়ে খুড়ে পড়ে আছে। ঐ ডুমুর গাছটায় এই বাসাতেই টুনটুনি পাখিরা থাকতো। কাল রাতের ঝড়বৃষ্টিতে তাদের বাসাটা ভেঙে পড়েছে। বুঝলাম ভেঙে পড়া এই বাসাটা নিয়েই সকাল থেকে ওদের এত চিৎকার চেঁচামেচি। ওদের জন্য আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ওরা এখন থাকবে কোথায়?
ভেঙে গেছে পাখির বাসা
বইছে তুমুল ঝড়
ছোট্ট ছানা ভিজছে কেমন
আসে যদি জ্বর।
বোকা পাখি তোমরা কেন
বাসা বানাও গাছে!
ঝড়ে ভিজে রোদে শুকায়
শান্তি কিছু আছে!
চলনা বুবু ওদের এনে
ঘুম পাড়িয়ে রাখি
দেখনা ওরা ভয় পেয়েছে
করছে ডাকাডাকি।
এবার বাবা আসুক দেশে
বলবো শোন বাবা
মিস্ত্রিকে ডেকে এনে
বানাও পাখির বাসা।
প্রতিদিন কত পাখি পাখামেলে উড়ে বেড়ায়, ঘুরে বেড়ায়। এ ডাল থেকে সে ডালে লাফালাফি, ডাকাডাকি। কাক, কোকিল দোয়েল, চড়ুই, ময়না, টিয়া, শালিক, মাছরাঙা, কত পাখি বনে বাদাড়ে, মাঠে ঘাটে, হাওর বিলে, ঝাঁকবেঁধে ছুটে চলে। আমরা যারা মন খারাপ করা একলা একা বসে আছি। তাদের জন্য কবি ফররুখ আহমদ আমাদের সাথে নিয়ে পাখির বাসা খুঁজে বেড়াতে চান।
আয়গো তোরা ঝিমিয়ে পড়া
দিনটাতে
পাখির বাসা খুঁজতে যাবো একসাথে
কোন বাসাটা ঝিঙে মাচায়
ফিঙ্গে থাকে কোন বাসাটায়
কোন বাসাতে দোয়েল ফেরে
সাঁঝরাতে
ঝিলের ধারে ঝোপের মাঝে
কোন বাসাটা লুকিয়ে আছে
কোন বাসাটায় বাবুই পাখির
মনমাতে।
আবার আমাদেরকে বর্ণমালা চেনানোর জন্য এবং বর্ণমালা দিয়ে শব্দ, বাক্য গঠন করা শিখানোর জন্য কী সুন্দর ছড়া তৈরি করে রেখেছেন। একের পর এক বর্ণমালা সাজিয়ে বলে গেছেন-
ক’ এর কাছে কলমীলতা
কলমীলতা কয় না কথা
কোকিল ফিঙ্গে দূর থেকে
কলমী ফুলের রঙ দেখে।
খ’ কে নিয়ে খেকশিয়ালী
যায় পালিয়ে কুমারখালী
পাখ পাখালী খবর পেয়ে
খরগোশকে দেয় জানিয়ে।
এভাবেই তিনি আমাদের বর্ণমালা চিনিয়ে দেয়ার ফাঁকে ফাঁকে মজা করে করে জীবজগতের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। আবার প্রিয় দাদুকে নিয়ে লিখেছেন-
অবাক হলাম দাদুর হাতে
দেখে চুষি কাঠি
ঘোরেন তিনি মারবেল আর নিয়ে দুধের বাটি
সবাই বলে শেষ বয়সে
আবদারটা চড়া
দাদু বলে আধাবুড়োরা কেন পড়ে ছড়া!
চারদিকে প্রতিদিন কত ফুল ফোটে। লাল সাদা হলুদ কমলা রঙের কত বিচিত্র ফুল। ডালে ডালে সেই ফুল দোল খায় বাতাসে। দেখতে কি ভীষণ ভালো লাগে। বনের ভেতর জবা ফুলের দুলুনি দেখে কবির মন আনন্দে ভরে ওঠে।
ঝুমকো জবা বনের দুল
উঠলো ফুটে বনের ফুল
সবুজ পাতা ঘোমটা খোলে
ঝুমকো জবা হাওয়ায় দোলে,
সেই দুলুনির তালে তালে
মন উড়ে যায় ডালে ডালে।
বৃষ্টি দেখতে কার না ভালো লাগে। বৃষ্টি পড়ছে গাছের পাতায়। বৃষ্টি পড়ছে মাঠে ঘাটে। বৃষ্টি পড়ছে শহরে গ্রামে, রাস্তায় কাদায়। বৃষ্টিতে ভিজছে গাছপালা পশু পাখি। বৃষ্টির ফোঁটায় নেচে ওঠে পুকুর খাল বিল নদী নালা। সেই পানিতে কেউ লাফালাফি দাপদাপি। তাই নিয়ে কবি লিখেছেন-
বৃষ্টি এলো কাশবনে
জাগলো সাড়া ঘাসবনে
বকের সারি কোথা রে
লুকিয়ে গেলো বাশবনে।
নদীতে নাই খেয়া যে
ডাকলো দূরে দেয়া যে
কোন সে বনের আড়ালে
ফুটলো আবার কেয়া যে।
আমাদের জন্য কবি ফররুখ আহমদ কত কিছু নিয়েই না লিখেছেন। প্রাণিজগৎ নিয়ে ‘চিড়িয়াখানা’ কার না ভালো লাগে। চিড়িয়াখানায় দেখা সেই প্রাণিজগৎকে দেখতে কবি আমাদেরকে আহবান করেছেন এইভাবে-
দেখতে যাব কাজের ফাঁকে
প্রাণীর বাসা জগৎটাকে
খোদার গড়া এই দুনিয়ায়
কেউ পানিতে কেউ বা ডাঙ্গায়,
কেউ বা ঘোরে শূন্য হাওয়ায়
দেখি আজব চিড়িয়াখানায়।
‘চিড়িয়াখানা’ বইটির ঈগল কবিতায় কবি আমাদের মত শিশু-কিশোরদের ঈগলের মত হতে বলেন, কবি নিজেও ঈগল পাখিকে খুব পছন্দ করেন। কারণ ইগল পাখি সাহসী। সে হালাল খাবার খায়। ঈগলের যেমন শক্তি তেমনি সাহস। সে ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ায় ঊর্ধ্বাকাশে। ঈগল আশাবাদী পাখি দুঃখ কষ্ট তার চলার পথকে থামাতে পারে না। তঁর লক্ষ্য সুদূরপ্রসারী, তাই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এই ঈগল পাখি নিয়ে তিনি বলেন-
উঁচু আশা ঈগল পাখির সাহস ভরা বুক
মুক্ত স্বাধীন জীবনে তার নাই জানা দুখ
পাল্লা দিয়ে ওড়ে ঈগল সবার উপরে
পাহাড় চূড়ায় বাঁধে বাসা মেঘের শহরে॥
আবার মন খারাপের দিনে ঘুরতে যাওয়া নিয়ে তিনি মজা করে লিখেছেন। ঘুরতে গিয়েও কত রকমের ফ্যাঁকড়ায় পড়তে হয়।
‘বাপরে সে কি ধুম ধাড়াক্কা
দিচ্ছে ধাক্কা খাচ্ছে ধাক্কা
গুঁতোর চোটে হয় প্রাণান্ত
হাঁপিয়ে ওঠে ক্যাবলা কান্ত
লাগলো যখন বিষম তেষ্টা
ক্যাবলা করে ডাবের চেষ্টা
তাকিয়ে দেখে পকেট সাফ
ভিড়ের ভেতর দেয় সে লাফ।
মজার ব্যাপার হল মজা করা নিয়েও তিনি মজার একটা লেখা লিখেছেন। সেখানে তিনি মজাকে খুঁজছেন এই ভাবে-
মজার ব্যাপার! মজার ব্যাপার!
কোথায় পাবো মজার ব্যাপার?
চলছে সব-ই সোজাসুজি
তাইতো মিছে খোঁজাখুঁজি
ভেবে ভেবে হদ্দ সবাই
মজার ব্যাপার পাই কোথায় ভাই?
ফুল পাখি প্রাণিজগৎসহ মজার বিষয়ের পাশাপাশি আমাদের ঋতু বৈচিত্র্যও তাঁর লেখায় উঠে এসেছে। ঋতু বৈচিত্র্য নিয়ে লিখতে গিয়ে পৌষ মাস নিয়ে তিনি ‘পৌষের কথা’ কবিতায় পৌষ মাসের অনুভূতির কথা বর্ণনা করেছেন এভাবে-
হিমেল হাওয়ায় শিরশিরিয়ে
এলো অচিন সড়ক দিয়ে
মাঠ ঘাট বন ঝিমিয়ে গেলো
পউষ এলো পউষ এলো!
মাঠের ফসল আসলো ঘরে
ধান দেখে ভাই পরান ভরে
কিষান চাষীর মন ভরে যায়
গল্প গানে মিঠাই পিঠায়
গুড় পাটালির সোয়াদ্দ পেলো
পউষ এল! পউষ এলো!
আমাদের মতো ছোটদের জন্য এরকম মজার মজার লেখা ছড়া ও কবিতার বই লিখেছেন তিনি ২১টি। এর মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে মাত্র ৮টি। কবি ফররুখ আহমদের জন্ম ১৯১৮ সালের ১০ই জুন মাগুরা জেলায়, মৃত্যুবরণ করেন ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর ঢাকায়। শিশুদের তিনি প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। তাদের নিয়ে খুব ভাবতেন। শিশুদের কথা তিনি মন দিয়ে শুনতেন। বাংলাদেশের বাংলা একাডেমি, একুশে পদক, স্বাধীনতা পদক, আদমজীসহ বড় বড় সব পুরস্কারের পাশাপাশি প্রেসিডেন্ট পদক ‘প্রাইড অব পারফরম্যান্স’ ও ইউনেস্কো পুরস্কারে ভূষিত হন।
আজকে আমরা যারা ছোট কাল তারা বড় হব। বড় হতে হলে আমাদেরকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। অপরের কাছে হাত পাতা যাবে না। অপরের কাছে মাথা নত করা যাবে না। তাই কবি আমাদের শিখিয়ে দিচ্ছেন-
তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে
খোদার মদদ ছাড়া
তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে
নিজের পায়ে দাঁড়া।

Share.

মন্তব্য করুন