সে অনেক আগের কথা। শান্তিপুর নামের সবুজ ছায়াঢাকা এক গ্রাম। সে গ্রামে বাস করত মজিদ আর করিম নামের দুই বন্ধু। ওরা সবসময় একসঙ্গে থাকত। একসঙ্গে পাঠশালায় যেত, একসঙ্গে মাছ ধরতে যেত, শিকারে বের হতো।
একদিনের কথা। মজিদ বিকেলবেলায় একাকী শিকারের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলো। করিমকে ডাকেনি কী মনে করে। তীর ধনুক হাতে মজিদ ছুটে চলল শ্যামলা বনের দিকে। কিছু একটা শিকার করেই তবে বাড়ি ফিরবে- এমনটিই ইচ্ছে। বিকেল ঘনিয়ে সন্ধ্যা নামি নামি। তবু মজিদ কোনো শিকার ধরতে পারল না। একটা হরিণের পিছু বেশ কিছুক্ষণ দৌড়ানোর পরও সক্ষম হলো না ধরতে। মনটা বেজায় খারাপ হয়ে গেলো। আজ কি তবে খালি হাতেই বাড়ি ফিরতে হবে! কী আর করার! চেষ্টাও তো কম করেনি। ওদিকে সন্ধ্যাও নামতে শুরু করেছে। সব ভেবে ফিরে যাবে এমনটিই মনস্থির করল ও।

বিশাল বন। ঘন ঝোপঝাড়। হরেক পশুপাখির আনাগোনা এখানে। তবে বনের গভীরে ভয়ানক সব প্রাণীর বসবাস। ওদিকে খুব কম লোকই যায়। মজিদ একাকী কখনও শিকারে আসেনি বনে। এবারই প্রথম এলো। আগে যতবার এসেছে করিমের সঙ্গেই এসেছে। বাড়ির দিকে রওয়ানা দিচ্ছে এমন সময় হঠাৎ চোখে পড়ল, একটি গাছের নিচে কয়েকটা কাক কাপড়ের মতো কী যেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তুলছে। তা দেখে কৌতূহলী হয়ে উঠল মজিদ। তৎক্ষণাৎ ছুটে গেলো সেদিকে। ওকে দেখামাত্রই কাকগুলো উড়ে গেলো। তীর দিয়ে গুঁতিয়ে গুঁতিয়ে বেশ খানিকটা অংশ উপড়াল ও। ওদিকে চারপাশ অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে। মজিদ বুঝতে পারল, কোনো গুপ্তধন হবে হয়তো। বের করতেও যথেষ্ট সময় লাগবে। সব ভেবে ঠিক করল, কাল করিমকে নিয়ে ওটা নিতে আসবে ও। আজ না হয় বাড়ির পথ ধরা যাক।

বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে খানিকটা দেরিই হয়ে গেলো। তবুও আফসোস নেই। কারণ, ও গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছে। বাড়ি এসেই দেরি না করে প্রথমেই করিমের কাছে ছুটে গেল ও। কথা না বাড়িয়ে আসল খবরটা জানালো ওকে। সব শুনে করিমের চোখ যেন চড়কগাছ! কী বলে ও এইসব! ওরা দু’জন ঠিক করে, আগামীকাল দুপুরের দিকে চুপিচুপি সে গাছের ওখানে যাবে। তারপর গোপনে গোপনে নিয়ে আসবে গুপ্তধন। কিন্তু করিম ছিল কিছুটা লোভী স্বভাবের। ও মনে মনে ঠিক করে রাখল, কাল সকালে ঘুম থেকে জেগেই দেরি না করে ছুটে যাবে বনে। তারপর একা একা সবকিছু নিয়ে ফিরে আসবে চুপিচুপি। মজিদ টেরও পাবে না। মনে মনে এমনই দুষ্টু ফন্দি আঁটে করিম।
পরদিন খুব সকালেই ঘুম ভেঙে যায় করিমের। সারারাত ভালোমতো ঘুমও হয়নি উত্তেজনায়। ঘুম ভাঙতেই তড়িঘড়ি করে ছুটে গেলো বনের দিকে। অনেকক্ষণ চলার পর অবশেষে পৌঁছে গেলো বনে। মজিদের বর্ণনা অনুযায়ী গুপ্তধনের নির্দিষ্ট স্থান খুঁজতে লাগল ও। কিন্তু কোথাও তেমন কিছু দেখতে পেলো না। দীর্ঘক্ষণ পর্যন্ত খোঁজাখুঁজির পর যখন কোনো সন্ধানই পেলো না তখন ক্লান্ত দেহে একটা গাছের নিচে বসল ও, কিছু সময় জিরিয়ে নিতে। পুরো বন তখন একদম নীরব। কোথাও কোনো পশু প্রাণীর নড়াচড়া নেই। শুধুমাত্র গাছে গাছে পাখির কলকাকলি। বেশ কিছুক্ষণ জিরিয়ে নেওয়ার পর করিম গাছের নিচ থেকে উঠবে এমন সময় কোত্থেকে এলো এক বিষধর সাপ। সাপ দেখে ও দৌড় দেবে এমন সময় কিছু বোঝার আগেই ফণা তুলে সাপটা ওকে দিলো ছোপ। সাপের দংশনে তৎক্ষণাৎ মজিদ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেলো সেখানে।

ওদিকে ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর থেকেই করিমকে খুঁজে পাচ্ছে না ওর বাবা মা। পুরো গ্রামে খোঁজ নিয়েও কোথাও পাওয়া গেলো না ওকে। এমনকি মজিদের কাছেও কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না। ওকে না পেয়ে পাগলপ্রায় হয়ে গেলো সকলে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো। কোত্থাও কোনো খোঁজ পাওয়া গেলো না ওর। হঠাৎ মজিদের মাথায় এলো, ও কি গুপ্তধনের সন্ধানেই গেলো তবে! না, এমনটি তো হওয়ার কথা না। ও তো এমন লোভী স্বভাবের না। তবু যেহেতু কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না মজিদ ভাবল, গুপ্তধনের সে জায়গাটি না হয় দেখে আসা যায় একবার। মজিদ করিমের বাবাকে সবকিছু খুলে বললে তৎক্ষণাৎ দু’জন বনের উদ্দেশে রওয়ানা হয়। অনেকক্ষণ যাবৎ চলার পর একপর্যায়ে তারা বনে পৌঁছায়। মজিদ গুপ্তধনের জায়গাটির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর ঠিক গুপ্তধনের পাশেই দেখতে পায় করিমের অজ্ঞান দেহ। এ অবস্থায় ওকে পড়ে থাকতে দেখে চিৎকার করে ওঠে করিমের বাবা। মজিদও একসঙ্গে হাউমাউ করে ওঠে। তারপর কোনো কিছু চিন্তা না করেই দু’জনে ধরাধরি করে ওকে নিয়ে রওয়ানা হয় বাড়ির দিকে।

বাড়িতে এসে কবিরাজকে ডেকে নিয়ে আসে করিমের বাবা। কবিরাজ সবকিছু পরীক্ষা করে বলে, ওকে বিষাক্ত সাপ দংশন করেছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, ও এখনও জীবিত আছে। অনেকক্ষণ যাবৎ ঝাড়ার পর অবশেষে ও চোখ মেলে। ওকে সুস্থ হতে দেখে আনন্দে ঝাপটে ধরে মজিদ। মজিদকে দেখেই করিম অনুতপ্ত সুরে বলে, ‘মজিদ! আমাকে মাফ করে দিস। বেশি লোভ করতে গিয়ে আজ আমার এমন দশা হলোরে।’ মজিদ বলে, ‘আরে না বন্ধু, এমন কথা বলিস না। তুই যে ফিরে এসেছিস সুস্থ হয়ে এটাই তো বড় বিষয়।’
গল্পটি বলা শেষ হলে দাদু বললেন,
‘তো দেখলে তো সিয়াম! লোভ মানুষের জীবনে কত বড়ো বিপদ ডেকে আনে! সুতরাং জীবনে কখনও কোনো জিনিসের প্রতি লোভ করবে না। কারণ, লোভে পাপ আর পাপে মৃত্যু। ঠিক আছে তো!’ সিয়াম দাদুর কথায় সায় দিয়ে বলে,
‘ঠিকই বলেছো দাদু। এই লোভ করার কারণেই তো কী বড়ো বিপদেই না পড়তে যাচ্ছিল করিম। কিন্তু শেষমেশ আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলেন। আসলেই লোভী মানুষ কখনও সফল হয় না।’

Share.

মন্তব্য করুন