নবী হজরত নূহ (আ)ই পৃথিবীর প্রথম নৌকা বানিয়েছিলেন। সেটি ছিল যেমন লম্বা তেমনি চওড়া, আর অনেক উঁচু। বিশাল সেই নৌকার কথা শুনে ছোট্ট জাইনু অবাক হয়ে গেল।
প্রশ্নের পর প্রশ্ন তার থামেই না-
– ‘তাহলে আগে কেমন নৌকা ছিল’?
-‘আগে তো মানুষ নৌকা কি তা জানতোই না’।
– ‘নূহ নবী কেমন করে নৌকা বানাল’?
– ‘আল্লাহই নূহ (আ)কে নৌকা তৈরি করা শেখালেন’।
– ‘কিভাবে’?
-‘তিনি নূহকে আদেশ দিলেন, এমন একটা নৌকা তৈরি কর যেখানে গাছ-পালা, পশু, পাখি মানুষের যা যা দরকার সব যেন তুলে নিতে পার।
কিন্তু নূহ তো আগে কখনো নৌকা বা জাহাজ দেখেননি। শুধু নূহ কেন পৃথিবীর কেউই তা দেখেনি কোনদিন। যা কখনো দেখেননি কিভাবে তা বানাবেন? তখন তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করে সাহায্য চাইলেন।
নূহের দোয়া চাওয়ায় আল্লাহ্ খুশি হলেন এবং তিনি ফেরেশতা জিবরাইলকে পাঠালেন নবী নূহের কাছে’।
-‘জিবরাইল কেমন ছিল দেখতে? সে কি আমাদের মত মানুষ’?
– ‘না। জিবরাইল (আ) হলো আল্লাহর একজন ফেরেশতা। আর ফেরেশতারা আলোর তৈরি। তাদেরকে একমাত্র নবী বা আল্লাহর প্রতিনিধি ছাড়া আর কেউ দেখতে পায় না।’
নৌকা, জাহাজ, গাড়ি এসব কিছুই ছিল না।’
-‘সবাই তাহলে চলত কী করে?’
-‘তখন মানুষ ছিল অল্প। পায়ে হেঁটেই তারা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেত।’
ফেরেশতা জিবরাইল মানুষের বেশে বন্ধুর মতো নূহের কাছে আসেন।
আল্লাহর নির্দেশ এবং ইচ্ছের কথা নূহকে জানান। তারপর পাশে বসে এঁকে বড় নৌকা বা জাহাজের ডিজাইন দেখিয়ে দেন।
একটু একটু করে সবকিছু বুঝিয়ে দেন, সাহস জোগান। কোথায় কি পাবেন, কিভাবে তৈরি করবেন, কোথা থেকে আনতে হবে সেসব কথাও বলে দেন।
এরপর, নূহ নবী খুব উৎসাহে কাজে লেগে যান। তিনি বন-জঙ্গল খুঁজে কাঠ কেটে আনেন।
তারপর বড় বড় টুকরো করে বসে বসে সাইজ করতে থাকেন। একটার সঙ্গে একটা জোড়া দেন। জিবরাইল (আ.) এর দেখানো নকশা মতো নৌকার আকার গড়তে থাকেন।
নূহ নবী তার দেশের লোকদেরকে আল্লাহর কথা বলতেন, ভালো কাজ করার জন্য উপদেশ দিতেন- এজন্য তারা তাঁকে পছন্দ করতো না। তারা নবীকে অনেক কষ্ট দিতো, মারধরও করতো।
এইভাবে প্রায় নয় শ’ বছর কেটে যায়। এর মধ্যে অল্প কিছু লোক নূহের কথা শোনে এবং এক আল্লাহর ইবাদত করতে থাকে।
সমাজের নেতারা অহঙ্কার, বিশৃঙ্খলা আর অত্যাচারের শেষ সীমায় পৌঁছে যায়। কিছুতেই তারা শান্তি শৃঙ্খলার কথা শোনে না।
তারা নিজেদের মধ্যে অশান্তি তো করেই। নবী নূহের ওপর চালায় অকথ্য নির্যাতন। দিনের পর দিন তাদের অত্যাচার বাড়তেই থাকে।
বহুকাল পর একসময় নূহ নবী অতিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় তাদের নির্যাতনের।
তিনি আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করে বলেন,
-হে আমার পালন কর্তা! আমাকে সাহায্য করো, ওরা আমাকে মিথ্যাবাদী সাজিয়েছে। অতএব তুমি আমার ও তাদের মধ্যে একটা চূড়ান্ত ফয়সালা করে দাও এবং আমাকে ও আমার সাথী মুমিনদেরকে ওদের হাত থেকে মুক্ত কর।’
আল্লাহ্ তার বান্দার ডাকে সাড়া দেন। তিনি নূহের কাছে আদেশ পাঠান, বিশাল এক নৌকা তৈরির জন্য।
সেই আদেশ পেয়েই নূহ (আ) আল্লাহর নির্দেশ মতো নৌকা তৈরির আয়োজন শুরু করলেন।
তিনি যখন নৌকা বানানোর কাজ করছিলেন, মানুষেরা তা দেখে অবাক হয়ে গেল।
লোকেরা পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় দেখল কী এক আজগুবি জিনিস নিয়ে সে মহাব্যস্ত! তারা বলাবলি করে-
-এ কি! এর মাথা নষ্ট হলো না কি, এ কী করছে!
তারা নূহকে নিয়ে মজা করতে লাগল। কেউ কেউ হাসাহাসি, বিদ্রƒপ ছুড়ে দিল-
-দেখ দেখ! পাগল কী করছে, আস্ত একটা উজবুক!
আবার কেউ কৌতূহলে অবাক চোখে তাকায়।
নূহ কোনদিকে না দেখে একমনে নিজের কাজ করতে থাকেন। মাঝে মাঝে তাদের কথার জবাব দিয়ে বলেন-
-‘আজ তোমরা আমাকে নিয়ে হাসছে। তোমরা আল্লাহর কথা না শুনে নিজেদের মধ্যে হানাহনি করছ। খুব শিগগিরই জানতে পারবে, কে উপহাসের পাত্র! নাফরমানির জন্য আল্লাহ তোমাদেরকে শাস্তি দিবেন।’
-‘হু! তুমি সব জেনে বসে আছ কি না!’
-‘হ্যাঁ! আমিই জানি। আল্লাহ আমাকে যে জ্ঞান দিয়েছেন, তোমরা তা জান না।’ এ কথা শুনে তারা আরো রাগে ফেটে পড়ে! দল বেঁধে মারতে যায়।
অনেক পরিশ্রমের পর বিশাল আকারের একটি জাহাজ বানানো শেষ হলো। তা দেখে সেই কওমের লোকদের বিস্ময়ে চোখ কপালে উঠল-
-‘হায়! এতো এক দৈত্য!’
তারা ঘুরে ফিরে দেখে আর নানা রকম সমালোচনা করতে থাকে।
আল্লাহর হুকুমে প্রথমে নূহ নবীর রান্নাঘরের চুলো দিয়ে পানি উঠতে লাগলো।
ধীরে ধীরে পানি বাড়ে। ঘরবাড়ি-উঠোন-রাস্তা-মাঠ-ঘাট সব পানিতে ভেসে যেতে থাকে। শুরু হয় প্রচণ্ড ঝড়-তুফান।
আল্লাহর নির্দেশে নূহ নবী সব গাছ-পালা পশু-পাখি, প্রাণী থেকে শুরু করে সবকিছুর নমুনা সংগ্রহ করে রেখেছিলেন।
সেসব এক এক করে নৌকায় তোলা হলো।
এ সময় তাঁর এক ছেলে কিনান তাঁর সাথে নৌকায় উঠতে চাইলো না।
অন্য তিন ছেলে বাবার সাথে নৌকায় উঠেছে। কিন্তু কিনান কিছুতেই উঠবে না।
সবাই তাকে বোঝালো। কোন কাজ হলো না।
সে আগে থেকেই বাবার কথা কানে তোলে না। এদিকে বড় বড় ঢেউ বিশাল তরঙ্গের মতো ফুলে উঠছে। নবী নূহ অনেক অনুরোধ করে বললেন-
-‘তুমি যদি নৌকোয় না ওঠো তবে অবশ্যই তুমি তলিয়ে যাবে, আজ আর কেউ তোমাকে সাহায্য করতে পারবে না।’ কিনান তা না শুনে বলল-
-‘আমি ঐ পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বসবো। ওখানে বন্যার পানি আমাকে ছুঁতে পারবে না।’
সে ছিল অন্যান্য লোকদের মতোই। তার কথা শেষ না হতেই পাহাড়ের মতো প্রবল এক ঢেউ তাকে নিচে ফেলে ভাসিয়ে নিলো।’
নবী নূহ (আ) আল্লাহর কাছ থেকে অহির মাধ্যমে জেনেছিলেন যে, এই নৌকাটি ছাড়া পৃথিবীর আর সব ডুবিয়ে দেয়া হবে। জায়ান প্রশ্ন করল-
-‘তাহলে আমরা কেন ডুবলাম না?’
-আমরা তো তখন ছিলাম না। আমরা সবাই তো অনেক পরে জন্মেছি। আমরা নূহ নবীরই বংশধর, উনার পরের মানুষ। নূহ নবীর কাছ থেকেই মানুষ নৌকা বানানো শিখলো।

Share.

মন্তব্য করুন