বনের প্রান্তে বসে বিশ্রাম নিচ্ছিল একটা সিংহ। মনমেজাজ তার ফুরফুরেই ছিলো কারণ ভালো আহার জুটেছে, আস্ত একটা খরগোশ একাই খেয়ে সাবার করেছে সে। কী করা যায় এখন, সে বসে বসে ভাবছিল। সে মাটিতে পিঠ এলিয়ে দিয়ে কয়েকবার গড়াগড়ি খেলো। তারপর লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। এদিক ওদিক ফালুক ফুলুক করে তাকালো। তারপর বসে পড়লো আবার। বসে চোখ বুজে বড় করে হাঁ-করে হাই তুললো একটা। হঠাৎ চোখ খুলে সামনে তাকিয়ে দ্যাখে, একটা বানর হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে মুখ কাচুমাচু করে।
সে হুঙ্কার ছেড়ে বললো, এই বাঁদর, তুই কী করছিস এখানে?
হুজুর একখান কথা ছিলো আপনার সাথে।
কী কথা, বলে ফেল।
হুজুর, ভয়ে বলবো, না নির্ভয়ে বলবো?
নির্ভয়েই বল।
বানর তবু বিনয়ের সাথে তার মুখখানি আরো বেশি কাচুমাচু করতে লাগলো। তা দেখে সিংহ হেসে উঠে বললো, অত ভণিতা করতে হবে না। কী বলবি বলে ফেল সরাসরি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
না, হুজুর, এই বলছিলাম কী-
কী বলছিলি?
বলছিলাম, আপনার মাথায় যে পরিমাণ চুল-
তাই?
নিশ্চয়ই ওখানে প্রচুর উকুনের বসবাস-
তাই?
সে-উকুন নিশ্চয়ই আপনাকে আরামে ঘুমাতে দেয় না-
দেয় না তো। তাতে তোর কী?
তো, হুজুর, বলছিলাম কী-
কী বলছিলি?
বলছিলাম, আমি তো ভালো উকুন বাছতে পারি-
উকুন বাছতে পারিস তো আমি কী করবো-
যদি আপনি অনুমতি দিতেন-
কিসের অনুমতি?
আপনার মাথার উকুন বাছার-
বানরের কথা শুনে সিংহ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। সে বললো, কী, তুই আমার মাথার উকুন বাছতে চাস?
জি, হুজুর। আমার বহুদিনের শখ-
তোর অন্য কোনো ধান্দা নেই তো?
না, হুজুর। শুধু আপনার খেদমত করতে চাই। আমি এমনভাবে আপনার মাথার উকুন ছাফ করে দেবো, আপনি আরাম পাবেন, উকুনের কোনো অস্তিত্বই থাকবে না মাথায়, নাক ডাকিয়ে ঘুমোতে পারবেন রাতে।
ঠিক বলছিস তো?
হুজুর, আপনার সাথে মিথ্যে বলার স্পর্ধা আমি কোথায় পাবো বলুন।
সিংহ বললো, বেশ, তাহলে আমার মাথার উকুনগুলো তুই বেছে দে।
বানর বললো, এজন্য আমাকে আপনার ঘাড়ের উপর বসতে দিন। ওখানে না বসলে আমি সুন্দর করে উকুন বাছতে পারবো না।
ঘাড়ের উপর না বসলে হয় না?
না, হুজুর। আপনার ঘাড়ের উপর বসতে না পারলে উকুনগুলোকে আমি পুরোপুরি খতম করতে পারবো না।
সিংহ গোঁফের তলে হেসে বললো, এতই যখন বলছিস, তখন নে ওঠ। কিন্তু খবরদার, কাউকে যেন একথা বলিসনে কখনো। তাহলে কিন্তু বনে আমার কোনো মানসম্মান থাকবে না।
হুজুর, সে কথা বলতে- হবে না।
একথা বলে বানর সিংহের ঘাড়ের উপর বসে তাকে বললো, হুজুর, এবার আপনি উঠে দাঁড়ান।
সিংহ বানরকে ঘাড়ের উপর নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। উঠে দাঁড়ানোর সাথে সাথেই বানরটি দুই হাত দিয়ে শক্ত করে তার দুই কান এঁটে ধরলো। এঁটে ধরে কান মুচড়াতে লাগলো। সিংহ প্রথমে ভেবেছিল, বানর বোধ হয় রসিকতা করছে। কিন্তু অচিরেই সে টের পেলো, বানর তার কান টেনে ছিঁড়ে ফেলানোর কসরত করছে। ব্যথায় সে ছটফট করতে লাগলো। সে গর্জন করে উঠলো, ঘাড় থেকে নাম বলছি, কান ছেড়ে দে বলছি, ভালো হবে না কিন্তু। কিন্তু কিছুতেই কোনো কাজ হলো না। বানর কোনো কথাই বলছে না, চুপচাপ তার কান দুটো সর্বশক্তি দিয়ে টেনে চলেছে তো চলেছেই।
সিংহ রাগে গড়গড় করতে লাগলো। সামনের পা দিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করলো, পারলো না। পিছনের পা তো ঘাড়ের কাছে গেলই না। বানরটি আসলে এমন এক স্থানে বসে পড়েছে, যেখানে না পৌঁছোলো সিংহের সামনের পা, না পিছনের পা। মহাবিপদ কাকে বলে! এদিকে বানরটি আরো জোরে তার কান টেনে চলেছে, কান দুটো প্রায় ছিঁড়ে যাবার উপক্রম। ব্যথায় ও রাগে সিংহটি লাফাতে লাগলো ও গর্জন করতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত সে আর সহ্য করতে না পেরে বানরকে ঘাড়ের উপর নিয়ে দৌড়াতে লাগলো। বনের মধ্যে ঢুকে সে তার এক স্বজাতি-সিংহের দেখা পেলো। সে তাকে দেখে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করে উঠলো। কিন্তু সে অবাক হয়ে দেখলো, অন্য সিংহটিও তাকে দেখে বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছে কারণ তার ঘাড়ের উপরও আরেকটা বানর কান ধরে বসে আছে। সিংহ দুটো অসহায়ের মতো পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো, তারপর দু’জনেই যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বনের আরো গভীরে ঢুকে গেল। তাদের সঙ্গে আরো সিংহের দেখা হলো। সব সিংহেরই একই অবস্থা; প্রত্যেকের ঘাড়ের উপর কান ধরে বসে আছে একটা করে বানর। অসহায় সিংহদের আর্তনাদে বনের বাতাস ভারী হয়ে উঠলো।
বনের পণ্ডিত শিয়াল এ সময় তার গুহার মধ্যে শুয়েছিল। বাইরে চিৎকার- চেঁচামেচি শুনে সে গুহা থেকে বের হয়ে আসলো। এসে দ্যাখে আজব কাণ্ড। বানরের বাঁদরামি দেখে সে ভীষণ মর্মাহত হলো। একটা সিংহ শিয়ালকে দেখে চিৎকার করে বললো, এই যে পণ্ডিতমশাই, দয়া করে বুদ্ধি দিন। বাঁচার উপায় বলুন।
শিয়াল বললো, আপনারা বানরগুলো ধরে আছাড় মারছেন না কেন?
কী করে আছাড় মারবো, ধরতেই তো পারছি না।
কেন পারছেন না?
ধূর্ত বানর এমন এক জায়গায় বসে পড়েছে, তার পর্যন্ত আমাদের হাত-পা যাচ্ছে না।
কেন যাবে না? আমি যা বলি, তাই করুন।
সমস্ত সিংহ মনোযোগ দিয়ে শিয়ালের কথা শুনতে লাগলো। শিয়াল বললো, আপনারা নিজেদের বানর ধরতে পারছেন না, এই সমস্যা তো? তাহলে একে অপরের বানর ধরুন। একজন আরেকজনের সামনে এসে ঘাড়ের উপর বসে থাকা বানরগুলো ধরে আছাড় মারুন।
সিংহের এই ভয়ঙ্কর কথা শুনে বানরেরা লাফ মারার প্রস্তুতি নিচ্ছিল বটে, কিন্তু তার আগেই সিংহগুলো ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদেরকে ধরে ফেললো। দুষ্টু বানরদের আর কিছুই করার থাকলো না।
নৈতিক শিক্ষা: এখানে বানর হলো দুনিয়া, সিংহ হলো মানুষ। মানুষের উপর জেঁকে বসা দুনিয়াকে দূর করতে হলে পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করতে হবে, একাকী এটা সম্ভব হবে না। রূপকের মাধ্যমে এ গল্পে এ শিক্ষাই দেওয়া হয়েছে।

Share.

মন্তব্য করুন