আবিদার মা আবিদাকে তাড়াতাড়ি টেনে তুলে বলল, তাড়াতাড়ি ওঠ। হাতে সময় নেই। এখনই বের হতে হবে।
মায়ের ডাক শুনে বিছানা থেকে ওঠে বসলো। মনে হলো কাঁচা ঘুমে ডেকে তোলা হলো তাকে।
চোখ মুছতে মুছতে মাকে বললো, কী হয়েছে মা।
এখন কথা বলার সময় নেই। কিছুক্ষণ পর লকডাউন দেবে সরকার। কেউ বাহিরে যেতে পারবে না। তার আগেই শহর ছাড়তে হবে।
আবিদা মায়ের কথার কিছু বুঝলো না। তাড়াতাড়ি আবিদাকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। মনে হলো আগে থেকে সব কিছু গুছিয়ে গাড়িতে রাখা হয়েছে। আবিদা গাড়িতে আসতেই গাড়ি ছেড়ে দেয়া হলো।
বাবা ড্রাইভারের পাশের ছিটে বসে ঝিমাছে, মনে হলো বাবাকে আমার মতো ডেকে তুলে নিয়ে এসেছে।
আবিদা কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে কিছু বুঝার চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। কী হচ্ছে চারিদিকে। কিছুদিন আগে হঠাৎ করে স্কুল বন্ধ হয়ে গেলো। যে সকল স্কুলের বন্ধু ছিলো তারাও এখন কাছে আসে না, কথাও বলে না। কেমন যেনো সব কিছু উল্টাপাল্টা হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী।
এখন সবাই মুখ ডেকে রাখে। মানুষ এর নাম দিয়েছে মাস্ক। এখন সারাদিন মাস্ক পরে থাকতে হয়। আগের মতো কেউ কারো কাছে আসে না। কি সব অদ্ভুত নিয়ম কানুনের ভিতর দিয়ে আমাদের সময় পার করতে হচ্ছে।
এখন শহর থেকে অনেক দূরে ফাঁকা রাস্তা তেমন মানুষ নেই। মাঝে মাঝে ছোট বাজার দেখা যাচ্ছে কিন্তু সব দোকানগুলো বন্ধ কিছু কিছু বাতি জ্বলছে।
মনে হচ্ছে ভূতের দেশ হয়ে গেছে। এক সময় মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, মা দেশে কি অনেক বড় ভূত এসেছে?
মেয়ের কথা শুনে মা অবাক হয়ে বলে কেনো?
আমাদের বাসা ফেলে জীবন বাঁচানোর ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছি।
আবিদার মা সুলতানা অনেক বড় একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক বলেছিস আমাদের দেশে অনেক বড় একটা ভূত এসেছে।
কী নাম ভূতের?
মেয়ের এমন কথা শুনে বুকের ভিতর চেপে ধরে বলল, কী বলবো মা, আমার জীবনে এমন ভূতের নাম শুনি নাই আর তোকে কী বলবো।
আবিদা মায়ের বুক থেকে মুখ তুলে বললো, আমাদের দেশটা কেমন অচেনা হয়েছে। চারিদিকে ফাঁকা কেউ কারো কাছে আসে না। মানুষ মানুষকে দেখলেই সরে থাকে। কেমন অদ্ভুত লাগে। আগে তো এমন ছিলো না।
আবিদা কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না।
অনেক রাতে আসার কারণে পথে কোনো বাধার মুখে পড়তে হলো না পুলিশের। দিনের বেলায় হলে পুলিশ বাধা দিতো।
ভালোয় ভালোয় হাজির হলো গ্রামের বাড়িতে। গাড়ির শব্দ শুনে দাদু ঘর থেকে বাহিরে এসে আবিদাকে দেখে তাড়াতাড়ি কোলে তুলে নিতে গেলে আবিদার মা বললো, আমরা তো শহর থেকে এসেছি। এখন আবিদাকে নিলে আপনার বিপদ হতে পারে।
ধুর পাগল আমার নাতিকে নিলে কিছুই হবে না একটু থেমে বলল, তুমি দেখে নিও বৌমা।
আবিদার মা আরও কিছু বলতে গেলেই আবিদার বাবা আবিদার মাকে থামিয়ে বললো, এখন আর কথা না বাড়িয়ে ঘরে চলো।
ঠিক বলেছিস।
আবিদার বাবা আবিদার দাদুর দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা গরম পানি হবে না।
হবে তো। কেনো বাবা?
আমরা একটু গরম পানি দিয়ে গোসল করতে চাই।
ঠিক আছে আমি দেখছি বলেই ঘরে ভিতর চলে গেলো সাথে সাথে আবিদার বাবা ও মা।
আবিদা রুমটা দেখে ভীষণ খুশি। দারুণ করে রুমটা সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
আম্মু দারুণ লাগছে আমার কাছে।
তাই বলে একটু হেসে দিলো।
আবিদার দাদু এসে বললো বৌমা গরম পানি হয়ে গেছে তুমি আসতে পারো আমার নাতিকে নিয়ে।
বৌমা নাতিকে নিয়ে গোসল করতে চলে গেলো। এক সময় গোসল করে আবিদাকে নিয়ে ফিরে এলো।
বাবা তুমি কথা বলো তোমার নাতির সাথে আমি গোসল করে আসি।
তুমি যাও গোসল করতে আমি বৌমা আর নাতিকে নিয়ে খাবার রুমে গেলাম, তুমি গোসল করে খাবার রুমে চলে আসো।
টেবিলে অনেক ধরনের খাবার রাখা হয়েছে। দাদু তুমি আমাদের জন্য এতো আয়োজন করেছো।
কত বছর পর আমার দাদুভাই এসেছে তার জন্য আয়োজন না করলে হয়?
আবিদা একটু হাসলো।

তারপর থেকে আবিদা এই বাড়িতে। চারিদিকে সারি সারি গাছ। আম, কাঁঠাল, পেয়ারা কোনো কিছুর কমতি নেই।
বাবা এতো সুন্দর গ্রাম ছেড়ে শহরে থাকো কেনো?
মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দিয়ে বলল, আমার যে ব্যবসা আছে শহরে।
গ্রাম কত সুন্দর। এই গ্রামে থেকে ব্যবসা করা যায় না?
শহরের ব্যবসা শহরে করতে হয়। এই ব্যবসা গ্রামে হয় না মা।
পাগল বাবা আমি বড় হয়ে গ্রামে ব্যবসা করবো গ্রামের মানুষদের কাজ দেবো তখন আর গ্রামের মানুষ শহরে যাবে না।
পাগল মেয়ে আমার। তুমি বড় হয়ে যখন ব্যবসা করবে আমি তখন তোমাকে সহযোগিতা করবো।
এইভাবে ভালোই কাটছে দিন বোঝার কোনো উপায় নেই দেশে করোনা নামে একটি মহামারী দেশে আছে। গ্রামের মানুষ দিনভরে কাজ করে রাতে এক সাথে বসে গল্প করে। তারা বুঝে না করোনা কী এবং কেমন।
এই সব করোনা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। ঘরে চাল আছে পুকুরের মাছ। সব কিছু তাদের হাতের কাছে। ক্ষেতে সবজি। লবণ আর তেল ছাড়া কিছুই কিনতে হয় না তেমন।
মনে হয় এরাই মহা সুখে আছে। গ্রামের সবাই আবিদাকে ভালোবাসে। বলা চলে নয়নের মণি। সবার আদরে আছে এই গ্রামে শহরে তাকে এমন করে ভালোবাসে না কেউ। সবাই টাকার পিছনে ছুটে, শহরে ভালোবাসা নেই গ্রামের মানুষের মতো। গ্রামের সরল সোজা মানুষগুলো ভালোবাসার বিনিময়ে কিছু চায় না। সময় পেলেই আবিদার কাছে ছুটে আসে, এটা সেটা দিয়ে থাকে। এই গ্রাম এমনকি এই গ্রামের মানুষগুলো তার আপন হয়ে গেছে। দাদু বিকাল হলেই আবিদাকে নিয়ে গ্রামের রাস্তায় ঘুরতে যায়। কি সুন্দর নদী-নালা, খাল-বিল দেখলেই মন ভরে যায়। আবিদা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আর শহরে নয় এই গ্রামে দাদুর কাছেই থেকে যাবে।
এক সময় করোনা কমে গেলো স্কুল, কলেজ, অফিস খুলে দিয়েছে। সবাই এখন শহর মুখে ছুটছে। আবিদার বাবা মা সব কিছু গুছিয়ে ঢাকার মুখে যাত্রা করবে কিন্তু সব কিছু উল্টা পাল্টা হয়ে গেলো আবিদার একটি কথা- সে শহরে যাবে না।
চলো মা গাড়ি এসে গেছে।
আমি যাবো না বাবা।
কেনো মা?
তোমাদের ওই শহর আমার ভালো লাগে না। আমি এই গ্রামে থেকে যাবো।
কোনো ভাবেই বুঝিয়ে নিতে পারলো না আবিদাকে।
শেষে আবিদা গ্রামেই থেকে গেলো। আবিদার বাবা বাধ্য হয়ে একাই শহরে চলে গেলো।

Share.

মন্তব্য করুন