গ্রামের শেষে ছোট্ট নদীর পাশেই একটা সবুজ বন। বন জুড়ে সবুজ গাছপালা আর ফল, ফুলের গাছ। সে বনে অনেক পাখি। সারা দিন বনজুড়ে পাখির কিচিরমিচির। বনের মধ্যে একটা ছোট্ট পুকুর। পুকুর পাড়েই বাস করে এক জোড়া মোরগ-মুরগি। গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে এই বন-জঙ্গলে এসে এরা বাসা বুনেছে। এখানেই ওদের সুখের সংসার।
মুরগির রয়েছে দশটা তুলতুলে ছানা। দেখতে হলুদ ছানাগুলো কেমন ফুটফুটে। চোখগুলো পিট পিট করে। বাচ্চাগুলোকে দেখলেই মুরগির চোখ জুড়িয়ে যায়। ইচ্ছে করে বুকের কাছে নিয়ে আদর করে আর চুমু দেয়। মোরগ তো খুশিতে বাকুম বাকুম। সকাল হলেই বাচ্চারা চিউ চিউ করে মোরগকে আব্বু আব্বু বলে ডাকে। মুরগের তখন খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করে।

সকাল হলেই মোরগ কুক্কুরু কু, কুক্কুরু কু করে ডেকে উঠে। আর বাচ্চারা ছটফট করে ঘুম থেকে ওঠে। সে দিন এক বাচ্চা মোরগকে জিজ্ঞাসা করলো আচ্ছা আব্বু তুমি সকাল হলেই কুক্কুরু কু করো কেন? মোরগ তখন বলে খুশিতে কুক্কুরু কু করি। আমি কুক্কুরু কু করলেই তো তোমাদের ঘুম ভেঙে যায়, আর ঘুম থেকে উঠেই তোমরা চিউ চিউ করে আমাকে আব্বু ডাকো। সেই ডাক আমার খুব ভালো লাগে। মুরগের কথা শুনে বাচ্চাটা হি হি হি করে হাসতে লাগলো।

দিনে দিনে বাচ্চাগুলো বড় হচ্ছে। মা মুরগিটা সারাক্ষণ বাচ্চাদের চোখে চোখে রাখে। সে দিন দুপুরে মুরগি তার বাচ্চাদের পাঠালো বনটা ঘুরে ঘুরে দেখার জন্য। কারণ শুধু মায়ের কাছে কাছে থাকলেই তো হবে না। তাদেরকেও বড় হতে হবে। সাহসী হতে হবে। বিশ্বটাকে নিজের চোখ দিয়ে দেখতে হবে। তবে মা মুরগি বাচ্চাদের বলে দিয়েছে বেশি দূরে যেন না যায় আর কেউ কোন ক্ষতি করতে চাইলে যেন দ্রুত বাসায় ছুটে আসে।
বাচ্চারা প্রথমেই গেলো পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে। সেখানে গিয়ে দেখলো কি সুন্দর একটা কামিনী ফুলের গাছ। গাছের নিচে শুভ্র ফুলগুলো ঝরে পড়ে আছে। ফুলের সৌরভে চারপাশে কেমন সুঘ্রাণ। বাচ্চাগুলো নাক দিয়ে ফুলের সৌরভ ভিতরে নিলো আর বললো আহ্ কি শান্তি। তখন হঠাৎ তারা শুনতে পেলো একটি পাখি ডাকছে। খুব মিষ্টি কণ্ঠে। কুহু কুহু আওয়াজ করে। একটা মুরগির ছানা বললো এই তুমি কে? কী তোমার নাম? তুমি কুহ কুহ করছো কেন?

প্রশ্ন শুনে পাখিটা হাসতে হাসতে বললো আমি হলাম কোকিল। আমি কুহু কুহু স্বরেই ডাকি। তোমরা যেমন কক কক কক আর কুক্কুরু কু করে ডাকো। তখন মুরগির অন্য একটা ছানা বললো- আমরা তো শুধু চিউ চিউ করি। কুক্কুরু কু আর ককক কক ডাকি না। তখন কোকিল আবারো হাসি দিলো আর বললো তোমরা তো ছোট তাই চিউ চিউ করো। একটু বড় হলেই কক কক কক আর কুক্কুরু কু করবে। তখন একটা মুরগির ছানা বললো- হ্যাঁ হ্যাঁ আমার আব্বু তো সকাল হলেই কুক্কুরু কু করে। কোকিল বললো আর তোমার আম্মু করে কক কক কক। কোকিলের সাথে কথা শেষ করেই দৌড়ে বাচ্চাগুলো মায়ের কাছে গেলো। মাকে বললো আম্মু আম্মু তুমি নাকি কক কক কক বলে ডাকো? কে বলেছে তোমাদের এই কথা? মুরগিটা খুশি খুশি মুখ নিয়ে জানতে চাইলো। কোকিল বলেছে আম্মু। এবার লক্ষ্মী মেয়ের মতো বলো- তুমি কি সত্যি কক কক কক করে ডাকো? একটা ছোট্ট তুলতুলে ছানা বললো। মুরগি একটু লাজুক লাজুক মুখ নিয়ে বললো- শোন, তোদের যখন জন্ম হয়নি তখন আমি কক কক কক করে ডাকতাম। একটা একটা ডিম পাড়তাম আর গলা উচু করে সারা পৃথিবীকে জানিয়ে বলতাম কক কক কক। মানে এই যে আমি ডিম পেড়েছি। দেখো কত সাদা ফক ফকা। এই সাদা ফক ফকা ডিম থেকেই তো তোদের জন্ম। বাচ্চাগুলো অবাক হয়ে মায়ের কথা শুনলো। একটা বাচ্চা কক কক কক বলার চেষ্টা করলো। তার শব্দ শোনে সবাই হি হি হি করে হেসে উঠলো।

তার পর দিন বাচ্চারা গেলো বনের একটু ভিতরে খুশি মনে তারা ছোটাছুটি করছে। এমনি তাদের পথ আগলে দাঁড়ালো একটা শেয়াল। কী ভয়ানক তার চোখ। সে উচ্চ স্বরে বললো আমি তোদের খাব। শেয়ালের কথা শুনেই বাচ্চারা ভয়ে দৌড়াতে লাগলো। মুরগির বাচ্চারা দৌড়ায় তার পিছু পিছু দৌড়ায় দুষ্টু শিয়াল। বাচ্চারা কোন মতে প্রাণ নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে মায়ের কাছে এলো। মা তার বাচ্চাদের বুকের মধ্যে জড়ায়ে ধরলো আর বললো ভয় পাবে না। মা আছে তো তোমাদের পাশে।

সন্ধ্যা হলেই বাসায় মিটিং বসলো। মোরগ খুব চিন্তিত হলো। যেভাবেই হোক শিয়ালের হাত থেকে বাচ্চাদের বাঁচাতে হবে। মুরগি হঠাৎ বললো- বাচ্চাদের রক্ষা করার একটা উপায় আছে। মোরগ বললো কি উপায়? শিয়াল কুকুরকে খুব ভয় পায়। আমাদের বনের দক্ষিণে একটা কুকুর আছে। তাকে বলতে হবে শিয়ালকে যেন ভয় দেখায়। মুরগিটা আস্তে আস্তে বললো। কেন ভয় দেখাবে কুকুর শেয়ালকে? কোন কারণ তো থাকতে হবে? মোরগ বললো। তখন মুরগি বললো তুমি কুকুরকে গিয়ে একটা মিথ্যা কথা বলবে। কুকুরকে বলবে শিয়াল বলেছে এই বনের কুকুরটা নাকি অনেক লোভী, ভীতু আর দেখতে কুচকুচে কালো। দেখবে এ কথা বললেই কুকুরটা রেগে শিয়ালের ঘাড় মটকাবে। কিন্তু মিথ্যা বলা তো পাপ! মোরগ বললো। পাপ তো জানি কিন্তু বাচ্চাদের জীবনও তো বাঁচাতে হবে। ভেবে দেখো। কাতর কণ্ঠে মুরগি বললো।

পরদিন মোরগ কুকুরকে সব কথা বললো। কুকুর তো রেগেমেগে আগুন। বললো দেখি আজকেই ওকে আমি শায়েস্তা করব। সে তাই মুরগের বাসার কাছে এসে লুকিয়ে রইলো। যেই না দুষ্টু শিয়াল মুরগের বাড়ি আসলো অমনি কুকুরটা দিলো শেয়ালকে এক দৌড়ানি। ভয়ে তো শিয়ালের পড়িমরি অবস্থা। কোন রকমে প্রাণ নিয়ে দুষ্টু শিয়াল বন থেকে পালালো। তারপর তাকে আর কখনো বনে দেখা যায়নি। মোরগ আর মুরগি তাদের তুলতুলে বাচ্চাদের নিয়ে সুখে শান্তিতে বনে বাস করতে লাগলো।

Share.

মন্তব্য করুন