আমাদের গাড়ি এসে থামলো থমথমে জঙ্গলে। ডুয়ার্সের বিশাল ভয়ার্ত অরণ্য। পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ির মাঝে এই জায়গাটির নাম আসলে লাটাগুড়ি। আমরা যাবো শিলিগুড়ি হয়ে দার্জিলিং। চারপাশের প্রায় প্রতিটি জায়গার নামের সাথে ‘গুড়ি’ শব্দটা যুক্ত হয়ে আছে। আকাশছোঁয়া শাল, সেগুন, গর্জনসহ নানা জাতের গাছ দাঁড়িয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানালো। জঙ্গলের পেটের মাঝে একটা রিসোর্টে লাগেজ নিয়ে উঠে পড়লাম আমরা- ট্যুরিস্ট দল। রুম বুঝে নিয়ে অরণ্যের দিকের দরজা খুলে বারান্দায় যেতেই আঁতকে উঠলাম ভয়ে। তখন সবে বিকেল গড়িয়ে সাঁঝ নেমেছে। কিন্তু সমস্ত বনে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। যা শুনে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে পরিবেশ সেটা হলো ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। অবিরত বিকট শব্দে ডাক দিয়ে যাচ্ছে অদৃশ্য পোকার দল। ভাবছিলাম শাল বাগানের ছায়ায় বসে জোছনা আর তারার আলোয় সুন্দর সময় কাটাবো সঙ্গীর সাথে। কিন্তু অজানা শঙ্কায় দ্রুত ফিরে এলাম ঘরে। ঘর মানে বারান্দা-সিঁড়িসহ শাল কাঠের দোতলা চারচালা- চমৎকার সাজানো গোছানো। দীর্ঘ ক্লান্তির পর রাতে ঘুম হলো বেশ গভীর। সকালে চনমনে মেজাজে চললাম গরুমারা অভয়ারণ্যে।

মাঝারি আকৃতির হলেও গরুমারা অরণ্য জীববৈচিত্র্যে ভরপুর। কত রকম অজানা প্রাণী এবং উদ্ভিদের দেখা মেলে। প্রায় ৫০ রকম প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ১৯০-এর বেশি প্রজাতির পাখি, ২০-এর বেশি প্রজাতির সরীসৃপ, ৭ ধরনের কচ্ছপ, ২৫ রকমেরও বেশি প্রজাতির মাছ এবং আরও নানা জন্তু-জানোয়ার। বড় বেড়াল জাতীয় প্রাণীদের মধ্যে রয়েছে কেবল লেপার্ড। তবে কখনও কখনও রয়েল বেঙ্গল টাইগার ঢুকে পড়ে গরুমারা অরণ্যে। গণ্ডার ছাড়া বাইসন, এশিয়ান হাতি, ভালুক, চিতল হরিণ, সম্বর হরিণের জন্যও গরুমারা বিখ্যাত। এছাড়া মায়া হরিণ, নাত্রিণী হরিণ, বুনো শুয়োরও আছে। দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের ভাম, বেজি, ছোটো বেড়ালের মতো মাংসাশী প্রাণী। সরীসৃপদের মধ্যে আছে পৃথিবীর সব থেকে বড় বিষধর ও বিষহীন সাপ এবং ভারতীয় অজগর এবং শঙ্খচূড়। তবে প্রধান আকর্ষণ হলো একশৃঙ্গী অদ্ভুত গণ্ডার।
আমরা যেহেতু যাবো সুদূর দার্জিলিং, সেহেতু সময় সংক্ষিপ্ত করার জন্য অরণ্যের পাশ দিয়ে রোমাঞ্চকর অনুভূতি নিয়ে চললাম গন্তব্যে। কেউ কেউ আফসোস করলো ভেতরে না যাওয়ার জন্য; তরুণ বন্ধুদের মাঝে কেউ বললো: নাহ, বনের গহিনে যাবোই, বাইসন দেখবো, হাতির পিঠে চড়ে জীবজন্তু না দেখে কোথাও যাবো না; বড়দের বুঝানোয় অবশেষে গাড়ি সমতল থেকে আকাশপানে চলতে শুরু করলো। দুই পাশে দীর্ঘ পাইনের সারি, মাঝখানে সড়কপথ।
নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গাড়ি ভাড়া করে মোটামুটি সাড়ে তিন ঘণ্টার পথ দার্জিলিং। গাড়িতে উঠে ঘণ্টাখানেক পর থেকেই জানালা দিয়ে বাইরের নিসর্গের চেহারা বারবার বদলে যেতে শুরু করল। জলপাইগুড়িতে একদিন থেকে ঘুরে ফিরে বেড়িয়ে চেনা শহরের রূপ ছাড়িয়ে আমাদের গাড়ি দু’পাশে পাইন গাছের বনকে পিছনে ফেলে অগ্রসর হচ্ছে পাহাড়ের পথে। তার কিছুক্ষণ পর থেকেই শুরু হলো চড়াই-উতরাই পাহাড়ের সড়ক। আমরা জানালা দিয়ে পাহাড়ের কোলে দেখতে থাকলাম মেঘের ঢেউ ঢেউ খেলা। মাথার উপর পাহাড়ের আকাশ তখন নীলিমায় নীল হয়ে আছে। পাহাড়ের রাস্তায় অগ্রসর হবার কিছুক্ষণ পর থেকেই হালকা শীত অনুভব করলাম। আমাদের গাড়ি পাহাড়ের অপরূপ সৌন্দর্য চোখের সামনে উন্মোচিত হতে হতে দার্জিলিং-এর পথে ছুটে চলল। অবশেষে যাত্রা শুরুর ঘণ্টা তিনেক পর আমরা কাক্সিক্ষত গন্তব্য দার্জিলিং এসে পৌঁছলাম।

দার্জিলিং পৌঁছানোর পরই পাহাড়ের যে সৌন্দর্য চোখের সামনে ধরা দিলো তা এককথায় অপূর্ব। চোখের সামনে দেখতে পেলাম নিচে পাহাড়ের গায়ে চলছে অপরূপ মেঘের খেলা। সেখানে পৌঁছে দুপুরের আহার সেরে একটু বিশ্রাম নিয়ে আমরা যখন বাইরে বেরোলাম তখন সূর্য প্রায় পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়েছে। রক্তমেঘের আকাশ তখন আবির রঙে রাঙা হয়ে বিপুল রঙ ছড়িয়ে যাচ্ছে।
আমাদের নির্ধারিত হোটেলে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে একটি ব্রিটিশ আমলের চা বাগান দেখতে গেলাম। কি সুনিপুণ দক্ষতার সঙ্গে পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে এখানকার অধিবাসীরা চা চাষ করে থাকেন তা আমাদের সকলকে অবাক করে দিলো। আর চোখে পড়ল চা বাগানের মাঝে মাঝে ছোট ছোট চা গাছগুলোকে ছায়াদানের উদ্দেশ্যে লাগানো কিছু কিছু বড় পাতাযুক্ত ঝাঁকড়া লম্বা গাছ। দার্জিলিংয়ের এই চা তার অতুলনীয় স্বাদ ও গন্ধের কারণে ভারতবর্ষে তো বটেই, ভারতের বাইরেও বিশেষ আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেছে। আমরা সেই চা বাগান থেকে কিছু খাঁটি চা কিনলাম।

দার্জিলিং ভ্রমণে অন্যতম আকর্ষণ হলো টাইগার হিল থেকে ভোরের সূর্যোদয়ের দৃশ্য উপভোগ করা। সেই কারণে টাইগার হিল না গেলে দার্জিলিং যাওয়া অসম্পূর্ণ থেকে যায়। ভোর চারটায় উঠে আগে থেকে ঠিক করে রাখা গাড়ি করে বহু কষ্টে ঘুমঘুম চোখে আমরা পৌঁছালাম টাইগার হিল। আকাশে তখন সবে হালকা আলো ফুটছে। টাইগার হিল পৌঁছে অবাক বিস্ময়ে সূর্যোদয়ের সাক্ষী হওয়ার রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম- হিমালয়ের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘায় প্রতাপশালী সূর্য বিপুল আলো নিয়ে বিশ^ময় ছড়িয়ে পড়ছে। কী এক ভালো লাগা অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। সোনার আলোয় কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন এক জান্নাত।

দার্জিলিং শহরে সমৃদ্ধ একটি চিড়িয়াখানা রয়েছে। উঁচু নিচু পাহাড়ি পথ হওয়াতে হাঁটতে ভালোই কষ্ট হলো। তবে সেই চিড়িয়াখানা দেখে অবাক। গোটা দেশ থেকে কত রকমের নাম না জানা পাখি এনে রাখা হয়েছে এখানকার চিড়িয়াখানাটিতে। আর রয়েছে বেশ কিছু বাঘ, ভল্লুক, চমরি গাই। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভাবে রয়েছে পাহাড়ি লাল পাণ্ডার দল। এই চিড়িয়াখানাটির অন্যতম আকর্ষণ হলো স্নেক গার্ডেন। স্নেক গার্ডেন বিভিন্ন প্রকারের সাপ দেখতে পাওয়া যায়। তার মধ্যে দেশী-বিদেশী সব ধরনেরই আছে। পাশেই একটি মিউজিয়াম ও ইনস্টিটিউট আছে, হিমালয় ও হিমালয়ে অভিযানকেন্দ্রিক।

এখানকার পাহাড়ের মাঝে মাঝে বসতি। নিচ থেকে যেমন পাহাড়ের উপরের বাড়িগুলো খুব ছোট দেখায়। আবার উপর থেকেও নিচের বসত বাড়িগুলো খুব ক্ষুদ্র দেখায়। অনেক সময় মেঘের আবরণে ঢাকা, ঝাপসা দেখায়। অন্যদিকে পাহাড়ি রাস্তাগুলোর মোড় কেমন ভয়ঙ্কর। মাঝে মাঝে ১৮০ ডিগ্রি টার্ন। পাশে তাকালেই পাহাড়ের পাদদেশ। কোনভাবে পিছলে পড়লেই গভীর খাদে মৃত্যু।
বাতাসিয়া লুপ থেকে সমগ্র দার্জিলিং দেখা যায়। দুরবিন দিয়ে শহর যেমন দেখা যায়; অন্যদিকে হিমালয়ের উঁচু উঁচু শিঙ্গগুলো, সেইসাথে নেপালের রাজার বাড়িও চোখে পড়ে। একটা স্মরণীয় মনুমেন্ট ঘিরে ফুলগাছ সুন্দর করে সাজানো আছে। গোর্খা সৈন্যদের স্মরণে সেই মনুমেন্ট। চারপাশে ট্রয়ট্রেনের লাইন। সেই ট্রয়ট্রেনে চড়ে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো ও জানালা দিয়ে মেঘপাহাড়ের রাজ্যে কল্পলোকে ভেসে বেড়ানোর মতো আনন্দ জগতে কি থাকতে পারে জানা নেই! এখান থেকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য হলো- দিগন্তে চোখ রাখলেই পাহাড়ের ওপারে পাহাড়, তার ওপারে পাহাড়ের সারি, পাহাড়ের সারি ঘিরে রহস্যময় মেঘের তিমিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে- আকাশ ও দিগন্ত মিলেমিশে একাকার। বাতাসিয়া লুপের পাশেই রোমাঞ্চকর রোফওয়ে। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ঝুলে ঝুলে পার হওয়া ঝুলন্ত বক্সে চড়ে। অনেক উপর থেকে মেঘপাহাড়ের শহর ও সৌন্দর্য উপভোগ করা। বহু ভিড় দেখে ও সময় না থাকায় ফিরে এলাম দূর থেকে দেখেই।

মনে অ্যাডভেঞ্চার, শরীরে ক্লান্তি আর হাঁটুতে ব্যথা নিয়ে বিখ্যাত ঝরনা- রকগার্ডেনের দিকে রওনা হলাম। রক গার্ডেন দার্জিলিং শহর থেকে অনেক নিচে, তিন হাজার ফিট তো হবেই। যাওয়ার পথে সবাই দোয়া-দরুদ পড়তে থাকলো ভয়ে। দুরুদুরু বুকে আল্লাহর প্রতি ভরসা রেখে সাপের মতো আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে নামতে থাকলাম যেখানে ঝরনার পানি সুদূর থেকে আছড়ে পড়ছে। আবহাওয়াটা বেশি ভালো থাকায় সবকিছু অনেক উপভোগ্য ছিলো। চারপাশ দেখতে দেখতে রক গার্ডেন পৌঁছালাম। এখানে এসে মনে হলো জান্নাতে যে বাগান ও তার তলদেশে প্রবাহিত ঝরনার কথা বলা হয়েছে সেটা মনে হয় এই প্রশান্তিময় অপরূপ জায়গা। ঝরনার চারপাশ বেশ সুন্দর। ঝরনার উপরের দিকে উঠার জন্য সিঁড়ি করে দেয়া। পাহাড়, মেঘ আর আকাশের নীল মিলে দারুণ এক অনুভূতি। ঝরনার পানি অত্যন্ত শীতল ও স্বচ্ছ। আমরা সেই ঠাণ্ডা পানিতে পা ডুবিয়ে মন শান্ত করে যারপরনাই আনন্দ যাপন করতে থাকলাম। একগ্লাস শীতল পানিও পান করলাম তৃপ্তি নিয়ে। ঝরনা দেখে আবার দার্জিলিং শহরে ফিরলাম।
আগামী কাল রওনা হবো মেঘের দেশ পাহাড়ের দেশ কালিম্পং- সে আর এক রহস্যময় রাজ্য। সেই রাজ্য থেকে নেপালের সীমান্ত ধরে মিরিক শহরে যাবো- সেই গল্প অন্য এক দিন করা যাবে। আজ দার্জিলিং শহরেই স্বপ্নতরী থামালাম।

Share.

মন্তব্য করুন