সূর্যোদয়ের সাথে সাথে তোপধ্বনি। তখনই বাসা থেকে বের হয় রিয়াদ। গেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। ওই তো শিহাব, আওলাদ, মঈন, রাসেল- একে একে সবাই এসে গেছে। একসাথে জড়ো হয়ে আওলাদ জিজ্ঞেস করে, তোপধ্বনি শুনছিস?
শিহাব সাথে সাথে বলে, নিশ্চয় আমরা কানে খাটো নই যে তোপধ্বনি শুনব না।
-এভাবে কথা বললি ক্যান?
রাসেল জানতে চায়। শিহাব নিজের মুখটা ভেংচিয়ে রাসেলকে বলে, এভাবে বলব না তো, আদর করে বলব? কাঁপিয়ে ওঠা এই তোপধ্বনি শুনছি কি না, বোকার মতো এসব জানতে চাইলে মেজাজ ঠিক থাকে?
অন্যরা হেসে দেয়। আওলাদ মুখটা ভার করে থাকে। রিয়াদ পরিবেশটা স্বাভাবিক করতে বলে, আমাদের বিজয় দিবসে, স্বাধীনতা দিবসে তোপধ্বনি দেয়া হয়; এটা তো সেই ছোট থেকেই আমরা শুনে আসছি। আজ বিজয়ের পঞ্চাশ বছর। তাই এখন এ তোপধ্বনি। বাদ দে ওসব। চল্ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যাই।
সবাই বলে- চল্।
রিয়াদের এ কথায় আওলাদ আবার প্রশ্ন করে, ওখানে যাবো কেন? প্রতিদিন তো হাঁটাহাঁটি করি। কোনোদিন তো যাইনি। আজ যাব কেন? তোপধ্বনি কি ওখান থেকে দেয়?
-এই তোর একটা স্বভাব। সব কিছুতেই প্রশ্ন।
একটু বিরক্তি নিয়ে শিহাব আবার বলে। অমনি রিয়াদ বলে, তোরা দু’জন একটুতেই রেগে যাস। প্রশ্ন করছে তো কী হয়েছে?
আবারও শিহাব খোঁচা মেরে বলে, তুই তো দুধ খাওয়া খোকা! তাই তোকে দেখাতে নিয়ে যাবো আমরা।
অন্যরা অট্টহাসি দিয়ে ওঠে। হাসতে হাসতেই রাসেল বলে, আরে ওখানটা তো আমাদের সাক্ষী।
-মানে!
খুবই চমকে আওলাদ জানতে চায়। এবার কেউ হাসেনি। স্বাভাবিক। রাসেল বলে- পঞ্চাশ বছর আগে ওখানে কী হয়েছিল জানিস না?
হ্যাঁ পঞ্চাশ বছর আগে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকেই স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন। অবশ্য সেসময় ওটাকে বলা হতো রেসকোর্স। সেই ডাকে যুদ্ধ করে লড়াকু বাঙালি বিজয় পেয়েছে ১৬ ডিসেম্বর এ মাঠকে সাক্ষী রেখেই। পাকিস্তান বাহিনী বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পরাজিত হয়ে সেদিন এই রেসকোর্সে লিখিতভাবে আত্মসমর্পণ করেছিল। তখন থেকেই স্বাধীন সত্তায় বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে জায়গা করে নেয়।
ওরা এসব শুনেছে বড়দের মুখে। আবার বই পড়েও। এখন রাসেলের কথায় আওলাদ বলে, ওহ্ হো ভুলেই তো গেছিলাম আমি। দুঃখিত।
অবশ্য সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনেক গিয়েছে ওরা। ঘুরতে গিয়েছে। বইমেলায় গিয়েছে। বিভিন্ন সময়েও গিয়েছে। কিন্তু আজকের এখনকার অনুভূতি নিয়ে যায়নি কখনো। আজ যাবে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নয়; স্বাধীনতার সূতিকাগার রেসকোর্সে। আমাদের স্বাধীনতার অস্তিত্বের এ শেকড়স্থান দেখতে যাবে ওরা।
ওরা যাচ্ছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে। এস এম হলের সামনে দিয়ে যাবার সময় রিয়াদ জিজ্ঞেস করে, স্বাধীনতার স্লোগানগুলো কি জানিস তোরা?
সবাই ভাবতে থাকে।
আওলাদ আমতা আমতা করে বলে, বাঁশ নিয়ে কী যেন একটা ছিল। মঈন আর রাসেল বলে, নদী নিয়েও একটা স্লোগান ছিল।
বিজ্ঞের ভাব নিয়ে রিয়াদ বলে, কিচ্ছু মনে রাখতে পারিস না। এসব আমাদের ইতিহাসের বিষয়।
আওলাদ রিয়াদকে আলতো ধাক্কা দিয়ে বলে, আপনি তো আমাদের স্যার। বলুন স্যার আজকের এই ওয়াকিং ক্লাসে কিছু।
সবাই হেসে দেয়। রিয়াদ হাসে না। সে আরো গম্ভীর হয়ে বলে- ফাজলামোর জায়গা না। আমাদের জানার বিষয় এসব। জানতেই হবে এসব। বিজয়ের এই পঞ্চাশ বছরেও এসে যদি স্বাধীনতার স্লোগান না জানি; তবে কেমন হলো? বল? আমার দেশ, আমার বিজয়, আমার স্বাধীনতা- সবকিছুই আমাকে জানতে হবে।
সবাই গম্ভীর হয়ে হাঁটতে থাকে। ওই যে বললি না বাঁশ আর নদীর কথা!
-হ্যাঁ, এমন কী একটা স্লোগানের কথাও শুনেছিলাম আমি। কিন্তু মনে করতে পারছি না।
মঈনের এ কথায় রিয়াদ বলে, দুটো স্লোগান ছিল। একটা হলো- ‘বাঁশের লাঠি তৈরি করো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। আরেকটা ছিল- ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’।
সবাই শান্তকণ্ঠে বলে, আসলেই এসব স্লোগান আমাদের ইতিহাস।
কথা বলছে আর হাঁটছে ওরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর দিয়েই যাচ্ছে। ভিসির বাসভবন পেরিয়ে একটু এগোতেই রিয়াদ বামের বিল্ডিংটা দেখিয়ে বলে, এটা কোন বিল্ডিং জানিস?
ওরা সবাই একসাথে বলে ওঠে- কলাভবন।
-এ জায়গাটাও আমাদের স্বাধীনতা ও বিজয়ের জন্য একটি ঐতিহাসিক স্থান, বুঝলি?
সবাই রিয়াদের দিকে তাকায়। আওলাদ বলে, এখানে আবার কী হয়েছিল?
– এই কলাভবনের ছাদেই একাত্তরের মার্চের দুই তারিখে আমাদের এই জাতীয় পতাকা প্রথম উড়ানো হয়েছিল।
– তাই কি!
– হ্যাঁ। সেদিনের ছাত্ররা এমন অসীম সাহস দেখিয়েছিল। সাধারণ মানুষও সাহস দেখিয়েছিল। এমন সাহসেই আজ আমরা স্বাধীন। বড়রা আমাদের জন্য এ স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন।
আওলাদ খুশির ভাব নিয়ে বলে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সেই টেবিলটা কিন্তু জাদুঘরে আছে।
ওর কথা শেষ না হতেই রাসেল, শিহাব একসাথে বলে, আমি বহুবার দেখেছি জাদুঘরে ওই টেবিল। ছোট একটা টেবিল।
সেই টেবিলটা …!
একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে রিয়াদ।
১৯৭১-এর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে স্বাক্ষরের জন্য টেবিল চেয়ার দরকার। সেখানে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধার সাথে ছিল বজলুল মাহমুদ বাবলু। স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিকতার শিহরণ তার দেহমনে। কিন্তু টেবিল চেয়ার পাবে কই? তখনই হঠাৎ দৌড়ে যায় ঢাকা ক্লাবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের উত্তর পাশে রাস্তা। রাস্তার উত্তর পাড়ে এই ঢাকা ক্লাব। নিয়ে আসে টেবিল চেয়ার সেখান থেকে।
আবেগ থামিয়ে একটু শান্ত হয়ে রিয়াদ বলে, সেই টেবিলটা কে এনেছিল জানিস?
কেউ কিছু বলে না।
রিয়াদ আবার বলে, বজলুল মাহমুদ বাবলু নামে একজন বীরমুক্তিযোদ্ধা। তিনি বীরপ্রতীক খেতাবও পেয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের জন্য গৌরবের ব্যাপার হলো- তিনি আমাদের স্কুলেরই ছাত্র ছিলেন। ফেসবুকে এমন একটা স্ট্যাটাস পড়েছি আমি। তারপর মেসেঞ্জারে কল করে উনার সাথে কথা বলে আমি নিজে তার মুখে শুনেছি। এই তো সপ্তাহ দু’য়েক আগের ঘটনা।
– কী!
সবাই থমকে হাঁটা থামিয়ে দেয়। রিয়াদের মুখের দিকে চেয়ে থাকে সবাই।
বজলুল মাহমুদ বাবলু আজিমপুরের ওয়েস্ট অ্যান্ড হাই স্কুলেরই ছাত্র। ১৯৬৯তে ম্যাট্রিক পাস করেছেন। একাত্তরে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন আরো অনেক স্কুলবন্ধুর সাথে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে তিনি বিজয়ের সে-ই শুভক্ষণে রেসকোর্স ময়দানে ছিলেন।
আচমকাই আনন্দে সবাই একসাথে বলে ওঠে- দারুণ! আমাদের স্কুলও বিজয়ের সাক্ষীর অংশীদার! আমরাও সে গৌরবের সরাসরি অংশীদার!

Share.

মন্তব্য করুন