কিছুদিন আগে, সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি নিউজ পড়ে চমকে উঠেছিলাম। একটি কিশোর তার হাতে ছুরি দিয়ে কেটে কেটে প্রেমিকার নাম লিখেছে। এ এক নতুন খেলা। আর এই নতুন খেলার শুরু গেইমিং অ্যাপ থেকে। শিশু-কিশোরদের জন্য গেম অ্যাপ তৈরি করে তাদের আনন্দ দেয়াই ছিলো আসল উদ্দেশ্য। গেমস অ্যাপ তৈরির প্রথম ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো শিশুদের মনোরঞ্জন। কিন্তু আস্তে আস্তে তার পরিধি বেড়ে গেছে। আর সেই সুযোগে বেড়েছে শিশু-কিশোরদের জন্য নানান রকম উপকরণে সাজানো গেমস অ্যাপ। আগে, গল্পভিত্তিক গেমস অ্যাপ শিশুদের জন্য নির্মিত হতো। এখনো হয়। তবে সেসব গল্পের ধরন-ধারণ পাল্টে গেছে অনেকটাই। সেসব গল্পের সাথে জুড়ে দেয়া হয়েছে শিশুর মনে শক্তি আর ক্ষমতা বাড়ানোর এমন সব খেলা, যা তাদের নতুন চেতনায় দাগ কেটে বসে যায়।
আগে দেখেছি, বই থেকে ছবি দেখিয়ে শিশুদের ভোলানো হচ্ছে এবং তাদের খাওয়ানো হচ্ছে। (আমার ছেলেরাও এক সময় রেসিং খেলতো ডেকসটপে। সেটা ছিলো কোন গাড়িটা রেসে আগে পৌঁছে যায়, এমন ধরনের। কিন্তু গাড়িটি কি-বোর্ডের নির্দিষ্ট বাটন টিপেই খেলা যায়। তারপর দেখলাম তারা রেস্টলিং খেলায় মজলো। এমনকি ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়ও তারা ওই রেস্টিং মুভি দেখতো। এখন তারা সেসব খেলায় মগ্ন হয়ে আছে কি না জানি না।) এখন সেই শিশুদের খাবার খাওয়ানো হয় সেল ফোনে গেমস অ্যাপ খুলে দিয়ে। শিশু দেখতে থাকে আর সেই দেখার আনন্দের সাথে সাথে সে খাবারও খায়। মূলত, শিশু আসক্ত হয় গেমসে এভাবেই। বাবা-মায়েরাই শিশুর মগজে অ্যাপ-ভিত্তিক গেমস ঢুকিয়ে সহজে শিশুদের খাওয়ানোর কাজটা শুরু করেন। পরে ওই শিশুই বায়না ধরে মোবাইলে খেলার উপকরণ কিনে দিতে। এবং বাবা-মা নির্দ্বিধায় সেটা করেন। কারণ তাদের ধারণা, এই যান্ত্রিক উপকরণ তার শিশুকে সমকালীন জীবনের সাথে আপডেট করছে। অর্থাৎ যুগের সাথে তাল মিলিয়েই সেই শিশু বড় হচ্ছে। ফলে সে পিছিয়ে থাকবে না, বা পিছিয়ে পড়বে না। বাবা-মায়েদের এই মন-মানসিকতাই শিশুদের ভবিষ্যৎকে টেনে নিয়ে গেছে আজকের ভয়াবহ পরিণতির দিকে। এবং তার জন্য কিছু ভুল জড়িয়ে আছে, যা তারা ধরতে পারছেন না এবং সে ব্যাপারে তাদের সজাগও করা হয়নি।

‘টিকটক’ অ্যাপটি চীনা কোনো এক অ্যাপ নির্মাতা কোম্পানির। বাংলাদেশের কিশোরদের কাছে সেই অ্যাপ খুবই জনপ্রিয়। এই অ্যাপটি কোনো গেমিং অ্যাপ নয়, কিশোরদের অডিও-ভিডিও করতে শেখায় ও উৎসাহিত করে। এই শিশুদের বয়স ১৩ থেকে ১৯ পর্যন্ত। এই বয়সী কিশোররা কতটা স্বপ্নবাজ হয়, তা জানেন সাইকোলজিস্টরা। এই বয়সেই কিশোররা পারিবারিক শিক্ষা ও মানবিক পরিচর্যা থেকে বেরিয়ে সামাজিক পরিবেশে পড়ে। আর ওই বড়সড় সামাজিক পরিবেশে তারা পায় আরো নতুন নতুন কিশোর, যারা ক্রমে তাদের বন্ধু হিসেবে গড়ে ওঠে। টিনএজরা এভাবেই বেড়ে ওঠে। এই বয়ঃসন্ধিকালটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নতুন বন্ধু আর নতুন নতুন সব বন্ধুদের সাথে তাদের যেসব ভাবনারাজি আদান-প্রদান হয়, যা পরবর্তীকালে কিশোর মনোবৃত্তিকে নতুন জীবনের স্রোতে ফেলে দেয়। তখনই মূলত কিশোরদের জন্য ভয়ঙ্কর কাল। আজ যারা টিকটক নিয়ে মজা করছে, ভিডিও বানাচ্ছে, ফেসবুকে বা অন্য কোনো সামাজিক মাধ্যমে আপ করছে, তারাই মূলত শিকার হচ্ছে অধঃপতনের দূরগামী কলে। এই ফাঁদ এতটাই আসক্তিময় যে এর নেশা হেরোইন নেশার মতোই ধ্বংসাত্মক।

পত্রিকায় পড়েছি, এমন অনেক কিছু ঘটে চলেছে বাংলাদেশের সমাজজীবনে যা আমাদের কিশোর বা যুবা আমলে আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। একবার ফেসবুকে দেখেছিলাম, এক কিশোর অন্য এক কিশোরকে মারছে এবং সিনেমার ডায়ালগ দেবার মতো করে ডায়ালগ বলছে। তার সাথে আরো কয়েক কিশোর। তারাও ভিকটিমকে ঘিরে আছে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম এটি কোনো নাটকের খণ্ডাংশ। কিন্তু পরে দেখলাম, সেই উদ্যত কিশোর ভিলেনিক স্টাইলে মারছে, আর ভিকটিম তাকে বলছে, দোস, মারিস না, আমি ওই কাজ করিনি। ওই কাজ মানে, ওই উদ্যত কিশোরের কথিত প্রেমিকাকে সে কিছু বলেছে। আবার সেই বালিকা তার বয়ফ্রেন্ড এই মাস্তান-কিশোরকে তা বলে দিয়েছে। তারই অ্যাকশন চলছে। এরা সবাই পরস্পরের বন্ধু। শুধু একটি কিশোরীর কারণে তাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। এবং উদ্যত মাস্তান কিশোর নিজের নাম ধরে ডায়ালগ দেয় ও ভিকটিম কিশোরকে মারে। ভিকটিম কিশোর এর মধ্যেই রক্তাক্ত হয়েছে। বোঝা গেলো উদ্যত ছেলেটি উঠতি মাস্তান এবং সে যে ডি-রেইল্ড, এতে কোনো ভুল নেই। সেদিন আমার খুব খারাপ লাগছিলো মার-খাওয়া কিশোরটির জন্য। ওই ছেলেটি তো আমারও হতে পারতো। ওই ভিডিও দেখতে দেখতে বেশ কিছু লোক ওই পথে যাচ্ছিলো, কিন্তু তাদের কেউই ভিকটিম ছেলের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়নি। তার মানে সামাজিক মানুষ এই সব অপরাধ দেখেও নিরাসক্ত? কেন? তারা কি মানবিক নয়? নাকি তারা ভীত ওই মাস্তান-মার্কা কিশোরদের আচরণে? তারা কি কোনো রাজনৈতিক দলের ছায়াতলের বেড়ে ওঠা উঠতি মাস্তান? কে জানে?

কোনো এক মফস্বল শহরের এই ঘটনা কতটা ভাইরাল হয়েছিলো আমি খোঁজ রাখিনি। ওই দিনগুলোতে এই ধরনের অকারেন্সের অনেক ভিডিও আমরা দেখতে পেতাম। আজকাল কেবল বয়স্ক ও খারাপ লোকেদের অন্যায়-অবিচার ও নিজ হাতে আইন তুলে নেয়া ঘটনার গোপনে ধারণ করা ভিডিও আপ হতে দেখি।
কি করে ওই কিশোররা এমন অপরাধের মধ্যে নিপতিত হলো। সমাজবিজ্ঞানীরা এর ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। গবেষণা করে বের করতে হবে কেন কিশোর বয়সীরা পড়াশোনা না করে এমন নৃশংস পথে পা বাড়াচ্ছে। এর জন্য দায়ী কারা?

শুধু টিকটক নয়, গেমিংয়ের শত শত অ্যাপ আছে যা সুনির্দিষ্ট করা আছে। ৩ থেকে ৭ বছর পর্যন্ত, তারপরের স্তরের শিশুদের জন্য কিছু অ্যাপ। সেগুলোও সাধারণ গেমভিত্তিক। টিনেজারদের জন্যও কিছু অদূষণীয় গেম অ্যাপ আছে। এই বয়সী কিশোরদের জন্য তাদের প্যারেন্টদের উদ্দেশ্যে কিছু নীতিমালা দেয়া আছে। অ্যাপ ব্যবহারকারীদের জন্য কিছু পলিসি দেয়া আছে। যা বাবা-মাকে ফলো করতে হবে। অর্থাৎ বাবা-মায়ের খবরদারির মধ্যে তাদের রাখতে এই ব্যবস্থা। একেবারে শিশু, তাদের জন্য কোনো রকম বন্দুকের খেলার অ্যাপ নেই। তাদের অ্যাপ দূষণীয় বা হিংসা তৈরি করে না। কিন্তু টিনএজারদের জন্য কিছু গেম অ্যাপ আছে যা সশস্ত্র যুদ্ধের। সেই সব অ্যাপ কারা ব্যবহার করতে পারবে, তারা এই সব অ্যাপ ডাউনলোড করতে পারবে তা বলা আছে। হিংস্র ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের, খুনোখুনির, মনের ভেতরে ক্ষোভ ও কষ্ট সৃষ্টি করে এবং কিশোর-কিশোরীদের সংক্ষুব্ধ করে তুলতে পারে, এমন সব গেম অ্যাপ কিশোররা নিজেরা ডাউনলোড করতে পারে না। প্যারেন্টস প্রোটেকশন দেয়া আছে। তারা যদি মনে করেন যে, এটি তার কিশোর-কিশোরীকে ডাউনলোড করে দেবেন, তাহলে দিতে পারেন। বাবা-মায়ের প্রোটেকশনে থাকলে কোনো কিশোর ভয়ঙ্কর গেম ডাউনলোড করতে পারবে না। কিন্তু আমাদের দেশের বাবা-মায়েরা অতটা সজাগ-সচেতন নন যে তারা প্রোটেকশন দেবেন। তারা নিজেদের কষ্ট লাঘব করতে গেম অ্যাপ অ্যাকাউন্টটি তাদের কিশোর-কিশোরীর হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকে। এবং তাদের জিজ্ঞেস করলে বলবে- আমার বাচ্চা কোনো বাজে অ্যাপ নামাবে না। সে তো আমার ফ্যামিলির বাচ্চা।

এমন কনফিডেন্স নিয়ে কথা বলবে যে প্রশ্নকর্তাই বরং বেকুব ও থ’ মেরে যাবে। আমার ধারণা বাবা-মায়ের এরকম মনোভাবই তাদের বাচ্চাদের ডিরেইল্ড হতে সুযোগ দেয়। আমরা জানি কিছু কিশোর-উত্তীর্ণ যুবকের ডি-রেইল্ড হয়ে যাওয়ার নারকীয় ঘটনা। তারা গুলশানে একটি রেস্তোরাঁয় হামলা চালিয়ে বহু স্বদেশি-বিদেশিকে হত্যা করেছিলো। সেই হামলাকারীদের মধ্যে ঢাকার ধনাঢ্য পরিবারের যুবাও ছিলো। ওরা যে অ্যাডভাঞ্চারিজমের মধ্যে পড়েছিলো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নিউ ইয়র্কে, এক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে ফুসলিয়ে ছিলো এফবিআই-এর এক এজেন্ট। ওই শিক্ষার্থী কেন ওই এজেন্ট লোকটিকে বিশ্বাস করেছিলো? কারণ কি সে কিশোরকালে এমন সব গেমস অ্যাপের ভেতর দিয়েই তার শিক্ষাজীবনের সূচনাকাল পার করেছে, যা ছিলো অ্যাডভেঞ্চারিজমে ভরপুর। না হলে, যে যুবাটি পড়তে গেছে নিউ ইয়র্কে, সে কেন একজন আমেরিকান হোয়াইটের কথা বিশ্বাস করে নিজেকে বিন লাদেনের অনুসারী বলে পরিচয় দেবে?

এখনো ব্যাপক আকারে কিশোর-যুবাদের ওই রকম নৃশংস কাজের মধ্যে পড়ার কথা জানা যায়নি যদিও, তবে এটা যে ছোঁয়াচে রোগের মতোই এক সামাজিক রোগ, সেটা মনে রাখতে হবে। বিশেষ করে যে সব ধনীরা মনে করেন যে, শিশু-কিশোরকে অবাধে অ্যাপ ডাউনলোড করার সুযোগ দেবেন, তাদের ছেলে-মেয়েরা এক অমানবিক মানুষ হয়ে জন্মাবে। তার খেসারত দিতে হবে এই সমাজকে, যে সমাজ এখনো ডিজিটাল জিনিসটা কি তাই-ই ভালোভাবে জানে না। একমাত্র বাবা-মারাই ওই নষ্ট পথ থেকে তাদের আত্মজ-আত্মজাদের বাঁচাতে পারে, ফেরাতে পারে সঠিক পথে।

Share.

মন্তব্য করুন