চোখ নিয়ে হঠাৎ এক অদ্ভুত ভাবনা জাগে রায়হানের। ভাবনাটি হলো – দুটি চোখ যদি কপালের দুপাশে হতো কেমন হতো তবে !
যেই না ভাবনাটি জাগলো অমনি নিজের মনে হেসে দিলো নিজেই। মন থেকে হাসিটি ভেসে উঠলো ঠোঁটে। হাসতে হাসতে উঠে এলো আয়নার সামনে। আয়নার ঠিক মাঝখানে দাড়ালো। আয়নাটি বেডরুমের ওয়ালে। বেশ বড়। ড্রেসিং টেবিলের আয়না নয়। ওয়ালের সাথে সেট করে রাখা। আয়নার সামনে দাড়িয়ে চেহারাটি দেখে নিলো একবার। মুখের ওপর দুটি চোখের অবস্থান। তারপর দুচোখ সোজা উপরে কপালের দুপাশে দুহাত রাখলো। বুড়ো আঙুল চেপে হাতের কবজি খানিক উপরে তুলে দেখলো। বোঝার চেষ্টা করছে এখানে চোখ হলে কেমন দেখায়! দেখে হাসলো আরও একবার।

নাহ এভাবে হবে না। তাহলে? তখনই মনে হলো কপালে দুটি চোখ এঁকে নিলে কেমন হয়? দৃশ্যটি ভেবে হা হা করে হেসে উঠলো আপন মনে । রিডিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে নিয়ে এলো সাইন পেন।
আবার দাড়ালো আয়নার সামনে। আয়নার খুব কাছে নিয়ে গেলো মুখটি। দু পায়ে সমান ভর রেখে দাঁড়ালো। দরজার দিকে দেখে নিলো একবার- কেউ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে কি না! না কেউ নেই দরজায়।
মা এখন কিচেনে রান্নার কাজে ব্যস্ত। বড় ভাইটি কোচিং এ। বাসায় এখন শুধু ও আর ওর আম্চিমা।
সুতরাং কাজটিতে বাগড়া দেবার কেউ নেই। বড় ভাইটি থাকলে এতক্ষণ খবর ছিলো। হৈ চৈ ফেলে দিতো। দশবার ডাকতো মাকে। ডাকার ফাঁকে দুচারটি উত্তম মাধ্যম পড়ে যেতো গালে। ঘাড়ে। পিঠে।
এখন নিশ্চিন্ত ও।

বেশ দৃঢ়ভাবে দাঁড়ালো। আয়নায় ওর পুরো শরীর দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এদিকে খেয়াল নেই ওর। খেয়াল শুধু মুখ। মুখের ওপর চোখ। আর চোখের নতুন জায়গা কপাল।
খুব সিরিয়াস ভঙ্গি। মনে হচ্ছে বিরাট এক শিল্পী সে। এখন বিশাল এক গুরুত্বপূর্ণ ছবি আঁকবে। যে ছবিটি পাবে বিশ্ব খ্যাতি। এমন ভাব নিয়েই দাঁড়ালো আয়নার সামনে।
দু’চোখের ঠিক উপরে দুটি বিন্দু আঁকলো। বিন্দু দুটি কালো। এ বিন্দু দুটিই হবে দু’চোখের মণি।
আরও একটি লাইট জ্বালিয়ে নিলো ও। যাতে ফকফকা আলোর উজ্জ্বলতা থাকে। তাই হলো। আলোর খেলায় দুটি কালো বিন্দুকে মনে হচ্ছে দুটি কালো পিপড়ার চোখ। বেশ আনন্দ জমছে মনে। হাসিও পাচ্ছে খুব।
এবার এ দুটি বিন্দুকে মণি করে তুলতে হবে। আরও একটু নড়ে চড়ে নিজেকে দৃড় করে নিলো।
নিজের সিরিয়াস ভঙ্গি দেখে আরও একবার হাসলো ও। নিজের হাসি আয়নায় দেখে কেমন অচেনা লাগছে নিজেকে।

প্রথম ডান পাশের মণিটি আঁকবে। বাম হাত দিয়ে কপালটি ধরলো। ডান হাতে কালো সাইন পেন। খুব সাবধানে বিন্দুর ওপর রাখলো সাইন পেনের মুখ। তারপর বিন্দুর লাগোয়া চারপাশ ঘুরিয়ে নিলো পেনটি। বড় হয়ে উঠলো বিন্দুটি। আবার ঘুরিয়ে নিলো চারপাশ। আরও বড় হলো বিন্দু। আবারও ঘোরালো। আবার ঘোরালো। এবার খুব করে দেখে- বাহ বেশ তো। একটি গোলাকার মণি মতো দাঁড়ালো। কিন্তু একটি সমস্যা! মণির মাঝখানে একটি বিন্দু তো আছে। যা কালো ঠিক নয়। আবার খুব উজ্জ্বলও নয়। দেখে মনে হয় কালো কু-লী থেকে একটি আলোমাখা গভীর বিন্দু জেগে আছে। এই বিন্দুটি কীভাবে দেবে! এমন কোনো সাইন পেন তো নেই ওর সংগ্রহে। হাতে আছে কালো আকাশী আর লাল পেন। এর কোনোটাই মণির বিন্দুর সাথে যায় না। হঠাৎ মনে হলো- যা আছে তাই দিয়ে আঁকি না কেনো! এটি তো সত্যি চোখ নয়! এতো ভাবনা কিসের। আকাশী রঙের সাইন পেনটি তুলে নিলো হাতে। ঠিক আঁকা মণিটির মাঝখানে একটি বিন্দু চেপে দিলো। কালোর ওপর আকাশী ছাপে কিছুটা বদলে গেলো বিন্দুটির রঙ। একদম হুবহু না হলেও মণির মাঝখানে আলাদা একটি চিক্ বোঝা যাচ্ছে বেশ!

মনে মনে খুশি হয়ে উঠলো রায়হান। নিজেকে পাকা আঁকিয়ে মনে হচ্ছে তার। এবার দ্বিতীয় মণি আঁকার পালা। ঠিক আগের পদ্ধতিতে শুরু করলো আঁকা। আঁকলোও। কিন্তু ভেজাল হয়ে গেলো শেষ ঘোরনী দিতে গিয়ে। বাম দিকের উপরে একটু বাঁকা হয়ে উঁচু হয়ে গেলো কিছুটা। ইস্ শব্দে আফসোসের সুর বেজে উঠলো।
মুছতে হবে এখন। কিন্তু কি দিয়ে। এমন তো কিছু নেই যা দিয়ে মোছা যেতে পারে। বিজ্ঞান ক্লাসে একদিন টিচার বলেছিলো- এ ধরনের কালি ¯িপরিট দিয়ে মোছা যায়। কিন্তু কোথায় পাবে ¯িপরিট!
মনটি খারাপ হয়ে গেলো।

অকস্মাৎ মাথায় এলো- আচ্ছা মণিটি আরও একটু বড় করে দিলে তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়!
সাথে সাথে মনটি খুশি হয়ে উঠলো। ঠিক যে পরিমাণ উঁচু হলো সে টুকু চারপাশে বড় করে নিলো!
দেখে বেশ লাগছে এখন! ডান মণিটিও বাড়িয়ে নিলো ঠিক। দুটি মণি সমানে সমান। খুশিতে লাফিয়ে উঠলো সে। এবার মণির চারপাশ আঁকার পালা।
কিন্তু মণির চারপাশ তো সাদা। এখন তো বিপদ! সাদা কালি কোথায় পাবে! উঁ উঁ ভাবে! কি দিয়ে কি আঁকবে এখন! ভেবে সিদ্ধান্তে এলো- আকাশী রঙেই আঁকবে। আকাশী আঁকলে কি হয়!
কিচ্ছু হয় না! নিজেকে নিজে জবাব দেয়!

হাতে তুলে নিলো আকাশী রঙের সাইন পেনটি। খুব নিবিষ্ট মনে আঁকলো মণির চারপাশ। বামটিও।
এবার চোখের পাতা আঁকার পালা।
কালো রঙেই আঁকবে। আঁকলো বেশ সময় নিয়ে। দুটি চোখ এখন আঁকা হয়ে গেলো।
হঠাৎ চেহারার দিকে চোখ পড়লো ওর! নিজেকে দেখে ভয় পেয়ে গেলো খুব। কেমন ভূতুড়ে দেখাচ্ছে চেহারাটি। চোখের উপরে চোখ! চার চোখের চেহারা! ভূত নাকি দৈত্যের ছোট ভাই!
ফিক করে হেসে ফেললো! হাসতে হাসতে দেখছে নতুন চোখের রূপ!
এখন বড় সমস্যা দেখা দিলো ওর। কপালে চোখ হলে কেমন লাগে এটি দেখবে কি করে। আসল চোখ খোলা রেখে দেখলে তো হবে না। শুধু কপালে চোখ এটি দেখা না গেলে দৃশ্যটি বোঝা যাবে কি করে! কি করা যাবে এখন?
এক চোখ বন্ধ রেখে আরেক চোখে দেখলো ও। নাহ জমছে না। আসল দুচোখ বন্ধ রেখেই দেখতে হবে নকল চোখ।
মাথায় বুদ্ধি এলো হঠাৎ। চোখ বন্ধ করে সেলফি তুললে কেমন হয়! ভাবনার সাথে সাথেই মন
বললো- দারুণ আইডিয়া।

মায়ের মোবাইলটি হাতে নিলো কায়দা করে। কয়েকবার অনুশীলন করে নিলো। এবার ফাইনালি তোলার ক্ষণ। মোবাইল ঠিকঠাক ধরে বন্ধ করলো চোখ। হাত না নেড়ে খুব সাবধানে ক্লিক করে নিলো। পরপর তিনবার।
খুব আগ্রহ নিয়ে দেখলো তোলা ছবি। দেখে পেট ফেটে হাসি বেরিয়ে আসছে। হাসতে হাসতে ভাঁজ হয়ে যাচ্ছিলো। ঠিক তখন দরজা থেকে মায়ের কণ্ঠ- কি হলো রায়হান! একা একা এমন করে হাসচ্ছিস! কিহলো!
আকস্মিক মায়ের কণ্ঠে চমকে উঠলো রায়হান। মুহূর্তে ঢোক গিলে ফিরলো মায়ের দিকে। আ উ উ করে চিৎকার করে উঠলো মা। খানিকটা ভয়ই পেয়ে গেলেন তিনি।

মায়ের ভীতু চেহারা দেখে আবার হেসে দিলো রায়হান। বললো – দেখো তো মা কপালের চোখ দুটি কেমন হয়েছে? আমি ভালো আঁকি না মা?
এতক্ষণে রায়হানের মা বুঝলেন এটি ছেলের চিত্র কর্ম! কিন্তু চোখ আঁকার খাতা কাগজ ছিলো না!
ধমকের শুর মায়ের কণ্ঠে।
রায়হান বললো- খাতা কাগজে আঁকলে তো আসল বিষয় ধরা পড়বে না!
এখানে আবার কি বিষয়! কি আসল! কি নকল!
রায়হান বললো- বলছি মা। তার আগে আমার একটি ছবি তুলে দাও। আমি চোখ বন্ধ করে দাড়ালাম। এই নাও বলে হাত বাড়িয়ে মোবাইল তুলে দিলো মায়ের হাতে। বুকে দু’হাত বেঁধে চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে গেলো রায়হান। কেমন যে লাগছে দেখতে! হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাচ্ছে রায়হানের মায়ের।
মোবাইলে ক্যামেরা সেট করে টাচ করলো একাধিক। বেশ কটি ছবি হয়ে গেলো। মা ছেলে দুজনেই দেখলো ছবিগুলো।

কি যে অদ্ভুত দেখাচ্ছে ছবিতে! হেসে ঢলে পড়ছে দুজনই।
এবার বলো কেনো এ কা-? কি আসল নকল বলছিলে?
মায়ের প্রশ্ন শুনে আরও একবার হাসলো রায়হান। বললো- আম্মু শোনো তবে কাহিনী! হঠাৎ মনে হলো বিষয়টি- মানুষের চোখ যদি কপালে থাকতো তো কেমন দেখাতো!
অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছেন ছেলেকে! ভাবছেন- কি বলে ছেলে !
মুখে বললেন – তারপর?
হেসে বললো রায়হান – তারপর চোখ আঁকলাম কপালে। দেখছোই তো!
আরেকবার হাসলেন মা ছেলে। দুজন মোবাইলের স্কিনে ভেসে থাকা কপালে চোখওয়ালা রায়হানের ছবির দিকে। দুজনই বিস্ময়ে দেখলো কপালে চোখ কেমন বিশ্রী! কি অসুন্দর! কি অশৈল্পীক!
বললো রায়হান- দেখো কেমন ভূতের মতো দেখাচ্ছে! মহান সৃষ্টিকর্তা আমাদের কি চমৎকার রূপে প্রতিটি অংগ সেট করে দিয়েছেন।

ছেলেকে বুকে জড়িয়ে রায়হানের আম্মু বললেন- ওরে আমার সোনা রে তুই এতোকিছু বুঝিস কি করে! আমি খুব আনন্দিত আমার ছেলে নিয়ে! জানিস এ ভাবনাটি ভেবেছিলাম আমিও। সেই ছোট বেলায়। অবশ্য আমার ভাবনাটি তোর থেকে একটু আলাদা। জিজ্ঞেস করেছিলাম তোর নানাকে- মানুষের নাকটি যদি কপালে থাকতো?
শুনে হাসতে হাসতে তোর নানা বলেছিলো- তবে মানুষকেও কোনো বন্য প্রাণী মনে হতো!
আমিও হাসছিলাম তোর নানার সাথে। আজ তোর চোখ কা- দেখে মনে পড়লো।
কি সুন্দর করে মানুষ বানিয়েছেন আল্লাহ। যে অংগ যেখানে দরকার ঠিক সেখানেই সেটি সেট করা। এর আগে পরে অথবা উপরে হলে কেমন দেখাতো ভাবো।
দেখো আবার তোমার কপালে আঁকা চোখের ছবি।
মোবাইলের স্কিনে দুজন ছবিটি দেখতে থাকে। সেই সাথে হাসতে থাকে খুব! হাসতে হাসতে বললো রায়হান- আচ্ছা আম্মু দেখো তো দাঁতের উপর যদি ঠোঁট না থাকতো তবে সারা জীবন ভেটকি মাছের মতো থাকতো মানুষ! দুজন একসাথে হেসে ওঠে আবারও!

Share.

মন্তব্য করুন