বিড়ালকে নিয়ে তিশুমনির আদিখ্যেতা আর গেল না।
তিশু যখন আরো ছোট তখন থেকে তার বিড়ালের
প্রতি ঝোঁক। একবার ঘোর বর্ষাকালে স্কুল থেকে
ফেরার পথে একটা বিড়াল ছানাকে রাস্তার ধারে মিঁউ
মিঁউ মিঁউ করে ডাকতে দেখে তিশু। দেখে তিশুর
মনে খুব কষ্ট জাগে। আহারে! বিড়ালছানাটি বৃষ্টিতে
ভিজে ভিজে কাঁদছে। ওর আম্মুটা কোথায়! নিশ্চয়ই
কোন দুষ্টু ছেলের কাজ। বিড়াল ছানাটাকে এখানে
ফেলে গেছে। তিশু রিকশা থামায় তৎক্ষণাৎ। রিকশা
থেকে নেমে আধমরা সেই ছোট্ট বিড়ালছানাকে তুলে
নেয় স্কুল ব্যাগে। বাসায় নিয়ে আসে।
সেই প্রথম তিশুর বিড়াল-প্রীতির প্রকাশ। প্রথম
প্র ম তিশুকে সবাই বুঝিয়েছে চারতলায় বিড়াল
পোষা যায় না। আর কি কারণে তারা বিড়াল পুষতে
যাবে? চার তলায় ইঁদুরের তেমন উপদ্রব নেই।
কয়েক বছর আগে কিভাবে ঘরে ইঁদুরের প্রবেশ
ঘটেছিল। নেংটি ইঁদুর। সেটা ভাইয়া আঠাযুক্ত
অ্যালবাম কেইস এনে নিধন করে। এরপর ইঁদুরের
অস্তিত্ব আর এ বাসায় খুঁজে পাওয়া যায়নি।
তিশুর যে শুধু বিড়ালপ্রীতি, তা কিন্তু নয়। কুকুরের
প্রতিও তার দরদ ইদানীং দেখা যাচ্ছে। রাত্রিবেলা
সবার খাওয়া-দাওয়া শেষ হলে অবশিষ্ট খাবার এবং
কাঁটাঝুটা, হাড় ওসব পলিথিন ব্যাগে তুলে নেয়।
তারপর সবাই যখন যে যার ঘরে, তিশু ওই
ব্যাগভর্তি খাবার নিয়ে নিচে নামে। গেইট পার হয়ে
গলির মুখে লাইট পোস্টের পাশে উঁচুলো স্থানে
ঢেলে দেয় সেসব। রাস্তার নেড়ি কুকুরগুলো এসে
সে খাবারগুলো খেয়ে যায়। এভাবে রাস্তার নেড়ি
কুকুরের সঙ্গে তার নাকি ভাব জমে গেছে। স্কুলে
যাওয়া অন্যান্য বাচ্চা মেয়েরা যখন রাস্তার নেড়ি
কুকুরের ভয়ে অস্থির থাকে। ভয়ে মায়ের হাত
জোরে সাপটে ধরে, তিশুমণিকে সেখানে কুকুরগুলো
গার্ড অব অনার দেয়। খানিকটা পথ তিশুর পেছন
সামনে হেঁটে এগিয়ে দেয়। ‘গার্ড অব অনার’ ওই
বিষয়টা তিশুর আপু মিলিরই আবিষ্কার। স্কুলে দিয়ে
আসার দায়িত্বটা কলেজপড়–য়া মিলির ওপরই
পড়েছে। খুব সকালে তিশুমনির আম্মু যান স্কুলে।
আব্বুও সেভাবে অফিসে যান। ভাইয়া জিশানের
স্কুল অনেক দূর। বাস আসে নিতে। কিন্তু মিলির
কলেজ দুপুর বারোটায়। তাই সকাল সাড়ে সাতটার
আগে স্কুলে পৌঁছে দেয়ার ভার পড়ে মিলির ওপর।
মিলিই লক্ষ্য করেছে তিশুমনি স্কুলে যাবার পথে
রাস্তার নেড়ি কুকুরগুলো একটু দূরত্ব রেখে লেজ
নাড়ে। মাথা আকাশের দিকে তুলে মৃদু শব্দে ঘেউ…
ঘেউ… ডাকে। এ ডাকে একটা মিষ্টতা আছে।
ঝগড়া করার সময় কিংবা পথচারী মানুষকে ভয়
দিতে যেভাবে কুকুর ঘেউ ঘেউ করে সে রকম নয়।
ঠিক আছে কুকুরকে ফেলে দেয়া খাবার দাও বলে
পথে তুমি নিরাপত্তা পাওÑ এটা না হয় মানা গেল।
আর কুকুর তো ঘরে এসে উঠছে না। পথের পশু
পথেই পড়ে থাকে। কিন্তু বিড়াল কোন কাজে
আসবে? বাসায় ইঁদুরের কোন ঝামেলা নেই যে
একটা উপকার করবে বিড়াল। তাছাড়া বিড়ালতো
ফেলে দেয়া কাঁটাঝুটা বাসি খাবার খায় না। তার
চাই নিরেট মাছ দুধ। তিশুমনির ধারণা তাই-ই।
নিজের মাছটুকু দুধটুকু এখন বিড়ালের পেটেই যায়।
শুধু কি তাই, প্যাকেট প্যাকেট দুধ দারোয়ান
আংকেলকে দিয়ে কিনে বিড়ালকে খাওয়ায়। এটা
এখন ওপেন সিক্রেট। যতই লুকিয়ে-চুকিয়ে করুক
তিশু।
তিশুমনির বিড়ালপ্রীতি । সোলায়মান আহসানফ্রিজ থেকে মাছের পোঁটলা হাওয়া হওয়ার ঘটনা তদন্ত করে আম্মু রেহানা রেজাল্ট দিলেন একবারত- তাও বিড়ালের পেটেই গেছে। তিশুর  কাণ্ড থামাতে মিলি ওই মাছ চুরি করে।
হ্যাঁ, বিড়াল নিয়ে অনেক কাণ্ড তিশুর আছে। একবার তিশু ঠিক করল খাঁচার মধ্যে বিড়াল পালবে।
সেভাবে দুটো বিড়ালছানা তার বান্ধবী তমার কাছ থেকে নিয়ে এলো। প্র মে আম্মুর বাধা। তারপর আব্বুর নজরে আসে। তিনিও নাক সিটকান। ভাইয়া তো বিড়াল কুকুর এসব দেখতেই পারে না। বলে ওসব বজ্জাত পশু। তাই, সে পালে এক জোড়া শালিক। সাধারণ শালিক ওগুলো নয়। বিদেশী একেবারে ক্রিকেটের দেশ নিউজিল্যান্ড থেকে আনা। মামার বেস্ট উপহার। মহান মামা থাকেন ওই দেশে।
তাই বিড়াল পোষার ব্যাপারে আপু মিলিই একমাত্র
সাপোর্টার আর সবাই বিরোধী। মিলি সাপোর্ট
করলেও বিড়ালপ্রীতি নেই। ছোটবোন তিশুমনিকে
সবার ছুঁড়ে দেয়া তীর যাতে তাকে বিদ্ধ না করে
সেদিকে সে নজর রাখে। যখনই বিড়াল সংμান্ত
মামলা আব্বু-আম্মুর কোর্টে যায়। সাক্ষী মিলি, তার
মানে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে মামলাটি ডিসমিস।
সেই বাক্সে রেখে বিড়াল পোষার চেষ্টা শেষ পর্যন্ত
তিশুর সফল হয়নি। একটু বড় হয়ে উঠলে বিড়াল
ছানাদের দিনের কোন এক সময় বন্দিদশা থেকে
মুক্ত করা হতো। আর ওই সময়টুকু দুষ্টু বিড়ালছানা
ছুটে বেড়াতো এ-ঘর ও-ঘর। কখনো ভাইয়ার ঘরে
গিয়ে পড়ার টেবিলে উঠে মিঁউ। কখনো আব্বুর
বিছানায় উঠে মিঁউ। আবার কখনো আম্মু রানড়বা নিয়ে
ব্যস্ত তখন পায়ের কাছে এসে মিঁউ। তার মানে
তিশুর প্রতি যতো ঝাল উগড়ে দেয়া। নাহ আর
পারা গেল না। চারতলায় কেউ বিড়াল পোষে!
তিশুর ওপর চাপ প্রয়োগ বিড়ালগুলো বিদায় করার।
শেষ পর্যন্ত ফেইসবুকের মাধ্যমে বিড়াল বিদায় করা
হলো।
কিন্তু সেই ঘটনাই কি শেষ ঘটনা? এরপর আরো দু’
দু’বার তিশুমনি বিড়ালছানা ঘরে তুলে এনেছে।
কিন্তু পালতে পারেনি। দিয়ে দেয়া ছাড়া তেমন
কোনো উপায় ছিল না। তিশুমনির স্বভাবে
বিড়ালের সঙ্গে একটা অদ্ভুত মিল আছে। মাছ
যেখানে আজকাল বাচ্চারা খেতেই চায় না,
তিশু মাছের ভক্ত। ছোট মাছ ছাড়া বড় মাছ
একাই কাঁটা বেছে খেতে পারে। এমনকি কাঁটা
চুষে চুষে এমন পরিষ্কার করে খায়, আট
বছরের একটা মেয়ের তা পারার কথা নয়।
দুধও তার খুব প্রিয়। আজকাল দুধের
বাচ্চারাও দুধ খেতে চায় না। গুঁড়ো দুধের যুগে
গরুর দুধ বাচ্চাদের পেটে সহ্যই হয় না।
তিশুমনি এক্ষেত্রেও ব্যতিμমÑ গরুর দুধ তার
প্রিয়। এক মগ দিলে নিমিষে ঢক ঢক করে
গিলে ফেলবে। সবাই তাকে ক্ষ্যাপাবার জন্য
বলে বিড়ালের বংশ। বিড়ালের মত স্বভাব ও
শান্তশিষ্ট। লেখাপড়ায় ভালো। এবার ক্লাস
থ্রিতে ফার্স্ট হয়ে তার উনড়বতির ধারা বজায়
রেখেছে। পড়ার ব্যাপারে কিচ্ছুটি বলতে হয়
না। এ জন্য তার বিড়াল বিষয়ক ঝামেলা
সবাই মেনে নেয়।
বেশ অনেক দিন তিশুমনি বিড়াল থেকে দূরে
ছিল। একবার একটি বিড়াল ছাদ থেকে মারা
গেলে তিশু ভীষণ কষ্ট পায় মনে। ছাদের
খোলামেলা পরিবেশে রেখে এসেছিল নিজের
বাসায়। কিছু সময় পর গিয়ে দেখে দুটোর
একটি নেই। কোথায় গেল! খোঁজ খোঁজ
খোঁজ। পাওয়া গেল উত্তর দিকের বদর
সাহেবের বাগানে মৃত অবস্থায়।
এরপর তিশু বিড়াল থেকে
দূরে থাকে অনেক দিন।
কিন্তু কথায় বলেÑ
কয়লা ধুলেও ময়লা
ছাড়ে না। স্বভাব
বদলায় না। চাঁদে
গেলেও মানুষের
আদি স্বভাব যায়
না। আর সেটা
আবার প্রমাণ করল
তিশু।
সেদিন তিশুর আব্বু
যাচ্ছিলেন বাইরে। নিচে
নেমে দেখেন একটা লাল
কালো সাদা লোমের হৃষ্টপুষ্ট
বিড়াল। মিনহাজকে দেখে বিড়াল না
সরে বসে ডাক দেয় মিঁউ। আশ্চর্য হলেন
মিনহাজ সাহেব। বুঝে নিতে কষ্ট হলো না
কেউ না কেউ এই বিড়ালের পৃষ্ঠপোষক
রয়েছে। বেশ অধিকার নিয়েই ডাকাডাকি
করছে। সে সময় নিচতলা ভাড়াটের ছোট বাবু
দেড় কি দু’ বছর বয়স ঘর থেকে বের হয়ে
বিড়ালকে একটা আস্ত বনরুটি ছুঁড়ে দিলো। কিন্তু
বিড়াল সেটা না খেয়ে পা দিয়ে খেলতে শুরু
করল। এবার বুঝতে পারল বিড়ালের পৃষ্ঠপোষক
বা আশ্রয়দাতা এই খুদে বিড়ালবন্ধু। বাবুটির মা
বের হয়ে এলো। মিনহাজ হেসে বললেন, তাহলে
এ বিড়ালটির মনিব বাবু?
না, ভাই শুধুই বাবু না, বাবুর আব্বুও। রাত্রে
অফিস থেকে ফিরেই বিড়ালের খোঁজ নিবেন।
বলবেন, খাবার টাবার দিয়েছো? নিজেই খাবার
নিয়ে বারান্দায় অপেক্ষা করবেন। বিড়ালটাও
কিভাবে টের পেয়ে যায়। এসে হাজির। খেয়ে
দেয়ে বাবুর সঙ্গে খেলা করে চম্পট।
মিনহাজ ভেবেছিল তিশুমনির কথা বলবে। তার
বলার আগে বাবুর মা বললেনÑ ভাই, আপনার
বিড়ালবন্ধু মেয়ে তিশুমনিও ওকে খাবার দেয়তো।
হি হি হি, হাসেন মহিলা।
মনে মনে মিনহাজও হাসে এই ভেবেÑ তা না
হলে বিড়ালটা এমন অধিকার ফলাবে কোন
সাহসে। খোদ বাড়ির মালিকের ছোট মেয়ের
ভালোবাসা যখন আদায় করে ফেলেছে!
এরপর বিড়ালটি একটু একটু করে তার অধিকার
প্রতিষ্ঠা করছে। আগে থাকত নিচতলা গ্যারেজে।
কিছুদিন পর দোতলা সিঁড়ির বড় স্টেপে। আরো
কিছুদিন পর তিনতলার বড় স্টেপের
এক কোণে। সেখানে একটা
টিনের কৌটায় পানি এবং
একটা প্লাস্টিকের পাত্রে
খাবার দেয়া। জানতে
পারলেন এসব
তিশুমনির
বদৌলতেই
বিড়ালটা পাচ্ছে।
এখন মিনহাজ
আবার আশঙ্কা
করছে হয়তো খুব
শিগগিরই ওই বিড়াল
তার বাসায় ঢুকে
পড়ার সাহসও পেয়ে
যাবে। সেদিন সে রকমটাই
দেখল বিড়ালের মতিগতি।
মুখে হাই-হুই জুতো দিয়ে ঠাস-ঠাস
শব্দ করেও এক চুল নাড়ানো গেল বিড়ালটাকে।
ভালোভাবে লক্ষ্য করল, ওটা গর্ভিনীও বটে। তার
মানে, মৌরসি পত্তনে বাস করার অধিকার ছিনিয়ে
নেয়ার ষড়যন্ত্র না তো?

Share.

মন্তব্য করুন