একঘেয়েমি জীবনের কিছু মুহূর্ত আনন্দে কাটাতে সৈকতরা এখন সীতাকুণ্ডের বড় দারোগার হাটে অবস্থান করছে। সৈকতের সাথে এখানে এসেছে ওর আরও পাঁচ বন্ধু। সবাই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। দুর্গাপুজোর ছুটি পেয়েই ওরা এখানে বেড়াতে এসেছে। এখানে এসে ওরা একটি আবাসিক হোটেলে উঠেছে। সারাদিন জার্নি করে এসেছে। তাই ক্লান্ত শরীরে আর সেদিনের মতো হোটেল থেকে বের হয়নি। সারারাত প্রোপার বিশ্রামের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দিলো।
পরদিন ফজরের নামাজ আদায় করে খুব ভোরে কাঙ্ক্ষিত জায়গা খুঁজতে বের হলো। আঁকাবাঁকা সরুপথ পেরিয়ে ওরা চলে আসে একেবারে গহিন অরণ্যে। সুবিশাল রূপসী ঝর্ণার ধারে পৌঁছে ওরা আনন্দে উল্লাস করতে থাকে। সৈকত, নীরব ও হাবিব এক দৌড়ে একেবারে ঝর্ণার ধারে চলে আসে। পাহাড়ের গা বেয়ে ঝরে পড়া স্বচ্ছ জলে একে অন্যকে ভিজিয়ে আনন্দে ভাসছে। ওদের এমন উচ্ছ্বাস দেখে হীরা, দীপঙ্কর ও শান্তনুও সামনে এগিয়ে আসে। মনোরম ঝর্ণার ধারে উঁচু-নিচু পাথরে আসন পেতে বসে জল ছিটাছিটি খেলে ওরা। কিছু সময়ের জন্য ওরা কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায়। জগতের সকল কালিমা মন থেকে মুছে স্বপিড়বল স্বর্গরাজ্যের একমাত্র বাসিন্দা হয়ে যায়। এমনই আনন্দঘন মুহূর্তে এই নির্জন বনে কারো কান্নার আওয়াজ অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। সৈকতরা উদ্বিগ্ন হয়ে ঝর্ণার পাদদেশ থেকে দৌড়ে পাশের সরু রাস্তায় উঠে আসে। ওদের সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ে একটি মেয়ে। বয়স আনুমানিক পঁচিশ কী ছাব্বিশ হবে। কপালে লাল টিপ। পরনে তার টুকটুকে লাল শাড়ি। টানাটানা দুটো চোখ হতে অপ্রত্যাশিত অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। সৈকতরা একে অন্যের দিকে চিন্তিত চোখে তাকায়। সৈকত মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে শঙ্কামনে জিজ্ঞেস করলো,
– আপনার কী হয়েছে? এভাবে কাঁদছেন কেন?
মেয়েটি কান্নার জন্য কথা বলতে পারছে না। তার সুন্দর মুখখানা যেনো মুহূর্তে লাল সূর্যের আকার ধারণ করেছে। পাশ থেকে নীরব বলে উঠলো, – আপনি শান্ত হোন, প্লিজ। এভাবে কাঁদলে তো কোন সমাধান আসবে না। আপনার সাথে কী ঘটেছে আগে আমাদেরকে সব খুলে বলুন। আমরা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কথা দিচ্ছি আমরা আপনাকে সাহায্য করবো। মেয়েটি কান্না থামিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছে নিয়ে স্বাভাবিক হতে একটু সময় নিলো। সৈকতরা উদ্বিগ্ন হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলো।
এরপর মেয়েটি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে লাগল, – আপনারা এখান থেকে চলে যান। ওরা আপনাদেরকেও মেরে ফেলবে। ওরা আমার স্বামীকে মেরে ফেলবে। এই কথা বলে মেয়েটি আবার হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। শান্তনু উত্তেজিতভাবে বলল,
– ওরা কারা? আর কেনই বা আপনার স্বামীকে মেরে ফেলবে?
– ওরা কারা তা আমিও জানি না। আমরা এখানে বেড়াতে এসেছিলাম। এই পথটির একেবারে শেষে পাহাড়ের গায়ে একটি মন্দির আছে। আমরা ঘুরতে ঘুরতে সেই মন্দিরে প্রবেশ করি। যাবার সময় কোন মানুষজন ছিল না। কিন্তু প্রার্থনা শেষে মন্দির থেকে বের হতে না হতেই দুইজন লোক আমাদের ঘিরে ফেলে। তাদের কাছে অস্ত্র ছিল। আমরা খুব ভয় পেয়ে যাই। তারা শুরুতেই আমাদের কাছ থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। এরপর আমাদের কাছে পাঁচ লক্ষ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। এ নিয়ে ওদের সাথে আমার স্বামীর কথা কাটকাটি হয়। একপর্যায়ে ওদের একজন আমার স্বামীর পায়ে গুলি করে দেয়। আমার স্বামী যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে। আমি মুহূর্তে অজ্ঞান হয়ে পড়ি। দীপঙ্কর আগ্রহভরা কণ্ঠে বলল,
– থামলেন কেন! তারপর কী হয়েছে?
– এরপর আমার জ্ঞান ফিরে এলে আমি মন্দিরসহ আশপাশের পুরো এলাকায় আমার স্বামী ও লোকদের খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও তাদের পেলাম না। এই কথা বলে মেয়েটি আবার কাঁদতে লাগলো। এতক্ষণ ধরে সব কথা শোনার পর হাবীব বলে উঠলো, – আপনি কোন চিন্তা করবেন না। আমরা আপনার স্বামীকে ওদের কাছ থেকে উদ্ধার করবো। পাশ থেকে হীরা দাঁতে নখ কাটতে কাটতে বলল,
– কিন্তু তা কী করে সম্ভব! ওদের কাছে তো অস্ত্র আছে।
নীরব বলল, – তাতে কী হয়েছে? ওরা অন্যায় করেছে। মনের দিক থেকে ওরা সবসময় দুর্বল থাকবে। আমরা কৌশল করে ওদের ধরে ফেলবো। সৈকত বলল, – কিন্তু কিভাবে?
– আমার মাথায় একটা বুদ্ধি এসেছে। উনি বললেন ওরা সংখ্যায় মাত্র দুইজন। তার মানে একজনকে সবসময় উনার স্বামীর পেছনে লেগে থাকতে হবে। মুক্তিপণের টাকার জন্য অন্যজন এসে উনাকে খোঁজ করবে। আমরা উনাকে মন্দিরের সামনে রেখে পাশেই লুকিয়ে থাকবো। লোকটা উনাকে ধরতে যেতে না যেতেই আমরা ওকে পেছন থেকে ধরে ফেলবো। ওর কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে ওকে জিম্মি করবো। এরপর ওকে ব্যবহার করে উনার স্বামীকে উদ্ধার করবো।
– গুড আইডিয়া!
এরপর সবাই হাতে হাত রেখে শপথ নিলো। পরিকল্পনা মতো মেয়েটিকে মন্দিরের প্রধান দরজার সামনে দাঁড় করিয়ে নীরব দরজার আড়ালে লুকিয়ে রইলো। অন্যরা মন্দিরের পাশেই লুকিয়ে রইলো। প্রায় আধা ঘন্টা সময় কেটে গেলো। এরই মধ্যে দূর থেকে মন্দিরের দিকে একজন লোক এগিয়ে আসতে দেখে মেয়েটি সৈকতদের দিকে চোখের ইশারা করলো। সৈকতরা যার যার সতর্ক অবস্থান নিলো।
লোকটি মেয়েটিকে ধরতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে নীরব শক্তি ব্যবহার করে তার কাছ থেকে পিস্তলটি কেড়ে নিয়ে তার দিকে তাক করে রাখলো। এই সুযোগে অন্যরা দৌড়ে এসে তাকে ধরে ফেললো। লোকটি ভয়ে কাঁদতে লাগলো। দীপঙ্কর তাকে ভালোভাবে দড়ি দিয়ে বাঁধলো। পরিকল্পনা মতো প্রথম অপারেশন সফল হওয়ায় সবার আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেলো। মেয়েটিও তার প্রাণপ্রিয় স্বামীকে ফিরে পাওয়ার আশায় বুক বাঁধলো। সবাই মিলে লোকটিকে যথেষ্ট উত্তম-মধ্যম দিলো। এরপর তার কাছ থেকে অপর অস্ত্রধারীর অবস্থান জানলো।
এমন সময় সৈকত বলল, – আমার মাথায় আরেকটি বুদ্ধি এসেছে। এই লোকটিকে আমরা হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মন্দিরের ভেতরে রেখে প্রথমে ওকে দিয়ে ওর সঙ্গীকে কল করাবো। সে মোবাইলে বলবে, দোস্ত মেয়েটিকে মন্দিরের ভেতর পেয়েছি। কিন্তু মেয়েটি এখনও অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। আমি একা আনতে পারছি না। তুই লোকটাকে ভালোভাবে বড় কোনো গাছের সাথে বেঁধে মন্দিরের ভেতরে চলে আয়। নীরব পূর্বের মতো মন্দিরের প্রধান দরজার পাশে সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। এরপর ও যখনই মন্দিরে ঢুকবে অমনি নীরব ওকে পেছন থেকে ধরে ফেলবে। এরপর আমরা সবাই মিলে দু’জনকে আটক করে উনার স্বামীকে উদ্বার করবো। তোরা কি বলিস?
সবাই সমস্বরে বললো,
– ওয়াও! গুড আইডিয়া।
সৈকতের কথামতো লোকটিকে দিয়ে অপর লোককে কল করা হলো। এরপর তাকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় মন্দিরের ভেতরে রেখে যে যার অবস্থান গ্রহণ করলো। অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে অপর লোকটি খুশিমনে মন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করলো। অমনি পেছন থেকে তার হাত দুটো শক্ত করে ধরে নীরব সজোরে চিৎকার দিলো। সৈকতরা দৌড়ে এসে লোকটার হাতের অস্ত্র কেড়ে নিয়ে ভালোভাবে বেঁধে ফেললো। প্রথমে আগের লোকটির মতো করে তাকেও বেশ উত্তম-মধ্যম দেয়া হলো। এরপর তাদের দেয়া তথ্যমতে সবাই গিয়ে মেয়েটির স্বামীকে উদ্ধার করলো।
মেয়েটি ও তার স্বামী তাদের কাছে কৃতজ্ঞতা জানালো। সৈকত তার মোবাইল থেকে ৯৯৯ নম্বরে কল করে খবর পৌঁছালে অল্প সময়ের মধ্যে পার্শ্ববর্তী থানা থেকে পুলিশের দল সেখানে উপস্থিত হলো। সবকিছু শোনার পর পুলিশের দল সৈকতদের ধন্যবাদ জানিয়ে অপরাধীদের নিয়ে চলে গেলো।
নীরব আর শান্তনু মেয়েটির স্বামীকে কাঁধে নিয়ে সবার সাথে হাঁটতে লাগলো। সবাই বিজয়ের আনন্দে গন্তব্যের পানে ছুটে চললো।
Share.