(গত সংখ্যার পর)

দু’তিন দিন পর আবার সেই মাছওয়ালা হারানের সাথে একটা টাকপড়া লোক এলো। এবার মনে হয় আটঘাট বেঁধেই এসেছে। লোকমান চাচা বললো- শোন গরুটা আমি ছাব্বিশ হাজার টাকা হলে ছেড়ে দেব। হারু বললো- বুলেন কি চাচা? গরু আপনার একেবারে ঝিল্লি। দুদিন পর মরবে যে। এ কথা শুনে চাচা চেঁচিয়ে বললো- এই কে আছিস আমার বন্দুকটা নিয়ে আয় তো। এই কথা শুনে হারান আর লোকটার পা কাঁপতে লাগলো। হারান বললো- হুজুর ভুল হয়ে গেছে, ক্ষমা করেন। লোকমান চাচা একটু নরম হয়ে বললো- থাক আমি এ গরু বেচবো না, তোমরা যাও। হারান আর ওই লোকটা কোন মতেই যাচ্ছিলো না ঠেস ধরে বসে ছিলো। শেষ পর্যন্ত লোকমান চাচা বললো- যাও গরু নিয়ে যাও। পঁচিশ হাজার পাঁচশ টাকা গুনে গুনে দিলো হারান। লোকমান চাচার চোখে পানি এলো। আমার ধলি মার চোখ ভিজলো। আমি মার দিকে তাকাতে পারলাম না। হারান লোকটা ফোকলা দাঁতে হেসে আমার ধলি মাকে খুলে নিয়ে গেল। আমি তার যাবার পথে তাকিয়ে রইলাম। মা বুঝি পিছন ফিরে একবার তাকিয়ে ছিলো।
মা চলে যাবার দু’দিন পর উদয় হলো বজলু। তবে তার একটা পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা, হাতে বন্ধুক নেই। তার বদলে দুই বগলে দুটো ক্রাচ লাঠি। তার এমন অবস্থা কেন হলো বুঝলাম দুদিন পর। বাড়ির কৃষক কাশেম আর নজরের মুখে গল্প শুনে। নিমতলায় দাঁড়িয়ে নজর বলছিলো-বজলু কার কাছে যেন জোর করে চাঁদা বাজি করতে গেছিলো। সেখানে প্রতিপক্ষ ধরে তার ঠ্যাং ভেঙে দিয়েছে। তাতে লোকমান চাচার কোন প্রতিক্রিয়া নাই। বরং কাজটা যেন ভালো হয়েছে এমন ভাব। বাবার প্রশ্রয় না পেয়ে বজলু এখন নিমতলায় চেয়ারে চুপ চাপ বসে থাকে। সাজুও বড় হয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। সাজুর বড় ভাই রাজু চুপ চাপ পড়াশুনা করে। গৃহস্থের প্রতি তেমন কোন উৎসাহ নাই। সেই মডার্ন হতে চায়। শহরে গিয়ে পড়াশুনা করতে চায়। তাই গরুর গোয়ালের আশেপাশে তাকে দেখা যায় না। জিন্সের প্যান্ট শার্ট পরে। চশমা চোখে দিয়ে মাঝে মাঝে গোয়ালের দিকে আসে। কারণ গোয়ালের পাশ দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ। সেই পথে দু’একবার হেঁটে আসে। একদিন রাজুকে দেখে ভেলু হঠাৎ চিনতে না পেরে ঘেউ ঘেউ করে ধাওয়া করে ছিলো। সেই ধাওয়া খেয়ে গরুর গোয়ালে ঢুকে গোবর ভরিয়ে একাকার অবস্থা। সেই থেকে রাজুটার ভাব অনেকটা কমে গেছে।
কদিন বাদে হেমন্ত কাল চলে এলো। চারিদিকে ধান কাটা আর মাড়াইয়ের সাজ-সাজ রব। হাশেম, নজর আলী দিন রাত মাঠে মাঠে। গোয়ালের পাশে যে আঙ্গিনা সেটাকে বলে খোলান। সেই খোলান ধানে ধানে ভরে উঠলো। গরুদের আর স্বস্তি রইলো না। ধান মাড়াই শুরু হলো।
সারা দিন ছিটানো কাটা ধানের উপর আমাদের দলবেঁধে ঘুরানো শুরু হলো। আমরা ধানের উপর ঘুরছি। নজর আর কাশেম আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। বলদ আর ষাঁড়গুলোকে ঘুরাতে নজরের অবস্থা খারাপ। ষাঁড়গুলোকে দড়ির সাথে বেঁধে মাড়াইয়ের কাজ করা কম কষ্টের না। গোঁয়ারের মতো ঠেলা ঠেলি লাগিয়ে দিচ্ছে। আমি এখন বলদ তাতেই কাজ এসে কাঁধে চেপে বসেছে। ভবিষ্যতে কি পরিমাণ কাজ করতে হবে বোঝায় যাচ্ছে। খোলানের পাশে বিশাল বৈঠকখানায় পাড়ার যত কৃষান, ধান কাটার শ্রমিক লাইন ধরে আমাদের ধান মাড়াই দেখছে। সাথে আছে পাড়ার ছোট বাচ্চারা, যেন একটা উৎসব। ধান কাটা, মাড়াই কৃষকের জীবনের এক ধরনের বড় উৎসব। এসবের মধ্যে গরুদের আছে মস্ত অবদান। তারপর গোলা থেকে ধান বস্তায় ভরে, গাড়িতে করে হাটে বেচা কেনা, সব খানেই আমাদের কাজে লাগতে হয়। ধান মাপার সময় নজর আলী যখন মুখে বলতে থাকে- পাঁচের পাঁচ- ছয়ের ছয়- তখন তার মুখে ফেনা জমে যায়। কাশেম বস্তা ধরে বসে থাকে আর নজর ধান মেপে মেপে বস্তায় ভরে।
এই ভাবে মানুষের যাতায়াত, কোলাহল, ধান মাড়াই চলেলো পুরো কার্তিক অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত। আমরা গরুরা পুরাই খাটনির মধ্যে কাটালাম। গরুদের কাজের কোন বিশ্রাম নাই। আবার নতুন করে নতুন ফসলের জন্য মাঠে চাষ দেওয়া। একদিন আমাকে নজর কি মনে করে বারান্দার খুঁটিতে বেঁধে রাখলো। আমি চুপ চাপ ধানের খড় চিবুচ্ছি। খেয়াল করে দেখলাম, বারান্দায় একটা বই হাতে বজলুর বড় ছেলে রাজু এসে দাঁড়ালো। তার পর বললো বজলু ভাই আমি যেটা বলবো সেটা তুমি দেখাবা, বলে গরুর রচনা পড়তে শুরু করলো। গরুর দুটি শিং আছে বলে বললো- এ গরুটার শিং খুব ছোট? নজর হেসে বললো- রাজু ভাই এ হলো ছোট গরু শিঙ এখনও ছোট। গরুর দুধের ছানা, দই, মিষ্টি, ঘি এসব হয়। এ পর্যন্ত পড়ে রাজু বললো- মাস্টার মশাইয়েরা ভুল লিখেছে। এ গরুটার তো দুধ হয় না, হবেও না। নজর হেসে বললো- জি ভাতিজা। সব গরু এক হয় না। ওইযে লাল গাভীটা আছে, ওকে নিয়ে আসলে তোমার পড়ার সাথে মিলে যাবে। শোন-শোন ঠিক আছে, কিন্তু বইয়ে এমন কথা তো লেখা নাই যে গরুর বিভিন্ন প্রকার হয়। গাই গরু, বকন গরু, এঁড়ে গরু, বলদ গরু, কই এসব তো লেখা নাই। হাশেম বললো- সে তোমার মাস্টার মশাইকে শুধালেই হয়।
রাজু খেপে গিয়ে বললো -নিয়ে যাও এ গরু দিয়ে রচনা হবে না। তুমি গাভীটা নিয়ে আসো। নজর তখন আমাকে কাঁঠাল গাছের সাথে বেঁধে। লাল গাভীটাকে নিয়ে গেল। আমি দেখে তো হেসেই মরি।
মাঠে রোজ চরতে যাই। আকাশ জোড়া ফসলের মাঠ। কোন জমিতে ধান, কোন জমিতে মশুর, বুট খেশারি, কোন জমিতে সবজি। রাখালরা সব সময় ব্যস্ত থাকে কোন গরু ছাগল যেন ফসল খেয়ে না ফেলে। তার পরও মজার খাবার পেলে খাওয়ার ইচ্ছে জাগবে। কেননা রোজ রোজ এক খাবার খেতে কত আর ভালো লাগে। আমারও ইচ্ছে জাগে মশুর অথবা বুট ক্ষেতে একটু নেমে পড়ি। তাই একদিন মজনুর চোখ ফাঁকি দিয়ে মশুরের জমিতে নেমে পড়লাম। বাহ্ কুচুর মুচুর শব্দ। আর খেতে কত মিঠা। মনের আনন্দে মশুরের গাছগুলো চিবিয়ে পাকস্থলীতে চালান দিচ্ছিলাম। এমন সময় চেঁচামেচি শুরু হলো। মজনুর ডাকটা একটু দূরে, কিন্তু জমিওয়ালা বোধ হয় খুব কাছেই ছিলো। সে এসে আমার গলার দড়িটা ধরলো।
আমি পড়িমরি করে ছুটে পালানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু জমিওয়ালার হাত থেকে ছুটতে পারলাম না। এরই মধ্যে মজনু এসে পড়েলো। সে আমাকে ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। ক্ষেতের মালিক খুব হুমকি ধমকি দিয়ে মজনুকে সরিয়ে দিলো। মজনু নিরুপায় হয়ে হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললো- আমি চাচার কাছে কি জবাব দিবো? ক্ষেতওয়ালা বললো- খোঁয়াড়ে দিয়ে দিবো। সেখান থেকে ছাড়ান লিয়ে আসিস। দ্যাখ কেমন রাখাল গিরি। আমি খোঁয়াড়ের কথা অনেক শুনেছি। কিন্তু জিনিসটা কী এবার তা দেখার ভাগ্যে জুটলো। ক্ষেতওয়ালা লোকটা বেশ জোয়ান আর কালো। গায়ে গতরে বেশ শক্তি। আমাকে সে টেনে হড় হড় করে নিয়ে চললো। আমিও চললাম খোঁয়াড় দেখতে। লোকটা আমাকে জমির মালিকের খোলানে নিয়ে বেঁধে ফেললো। তার পর আমার পেছনের কোমর বরাবর ছড়ি দিয়ে দুই তিনটা পটাপট মার দিলো। আমি তো লাফিয়ে উঠে ওমা গো- বাপগো বলে হাম্বা হাম্বা করে উঠলাম। জমির মালিক এসে ধমক না দিলে হয়তো। কপালে আরো মার ছিলো। যা হোক “এই কুতুব থাম” এই কথাটা খুব পছন্দ হলো। মানে শক্ত কালো লোকটার নাম ‘কুতুব’। জমির মালিক এসে জিজ্ঞেস করলো- কার গরুরে কুতুব? কুতুব জবাব দিলো- মজনু রাখাল, উত্তর পাড়ার লোকমান চাচার গরু চরাই।
-লোকমানের গরু?
-জি জমির চাচা।
-সেতো ভালো মানুষ- কিন্তু কি করা যায়?
-কিন্তু না আপনার ফসল নষ্ট করেছে এরে খোঁয়াড়ে দেব।
-ঠিক আছে খোঁয়াড়ে দে, না হলে রাখালের শাস্তি হবে না।
জমির মালিক জমির চাচা চলে গেল। আমি বাঁধা থাকলাম খোলানে। আমাকে দেখতে এলো আশপাশে থাকা মেয়ে-পুরুষ, ছোট বাচ্চাদের দল। যেন মজার ঘটনা ঘটেছে। অনেকে অনেক রকম কথা বললো, কেউ বললো- এডাতো ছোট একটা বাছুর। কেউ বললো-পাকা বলদ, কেউ বললো-ক্ষেত খাও, খোঁয়াড়ে যাও। এসব বলে হাসা হাসি করতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর কুতুব ঢেকুর তুলতে তুলতে বাড়ির বাইরে এলো। তারপর দড়ি খুলে নিয়ে চললো খোঁয়াড়ের উদ্দেশ্যে। সাথে উঠতি কটা ছোকরা কিছু দূর এগিয়ে এসে ফিরে গেল। খোঁয়াড় কোথায় জানি না। একটা কাঁচা সড়ক হয়ে হেঁটে চললাম। দুই পাশে ধান, কাওনের জমি। বিরান জমি। আকাশে অনেক মেঘ। এসব দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম খোঁয়াড়ে। বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘেরা খোঁয়াড়। তার মধ্যে একটা চালতোলা মাচা। সেখানে হাসি হাসি মুখ করে বসে আছে দুজন লোক। খোঁয়াড়ে আমার মতো ক্ষেত খাওয়া অনেক গরু-ছাগল পাওয়া গেল। আমাকে ঢুকিয়ে রাখা হলো গরুদের মধ্যে। খোঁয়াড়ওয়ালা গরু পেয়ে খুব খুশি। কুতুবও খোঁয়াড়ে দিয়ে খুশি। কেননা খোঁয়াড়ি তাকে গুনে পঞ্চাশ টাকা দিলো এবং লিখে রাখলো কার গরু, নাম ঠিকানা। খোঁয়াড়ের এক দিকে একটা গাভী, ষাঁড় আর একটা বলদ ছিলো। অন্য দিকে ছাগল, ভেড়া, হাঁস। আমাকে দেখে ষাঁড়টা বললো- তুই কি খেলিরে ছোকরা? আমি বললাম-মশুর আপনি কি খেলেন? ষাঁড়টা শুনে বললো- ছোকরার আদব আছে। আমাকে আপনি বলে ডাকলো শুনলিরে বলদ। বলদ শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছিলো, তাই ষাঁড়টা কি বললো বুঝতে পারেনি। প্রশ্ন করলো- কি বললে শুনতে পাইনি। একথা শুনে ষাঁড়ের প্রেসটিজে লেগে গেল, তাই এলো তেড়ে- আমি একটা ষাঁড়, কথা কানে যায় না? ফোঁস করে শিং ঘোরালো। বলদটা ভয় পেয়ে ধড়-ফড় করে উঠে দাঁড়ালো। আশপাশে দুটো ছাগল চ্যাঁচালো ব্যাঁ ম্যাঁ করে। খোঁয়াড়ি ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে লাঠি নিয়ে ঢুকলো খোঁয়াড়ে, তারপর ষাঁড় টাকে কষে কয়েকটা ঘা বসিয়ে দিলো। তাতেই ষাঁড়টার প্রেস্টিজ ঠিক। খোঁয়াড়ে সবাইকে আলাদা বাঁধা থাকলেও এ ওর সাথে ফুঁসফাঁস করে। ঠেলা-ঠেলি করার চেষ্টা করে। খোঁয়াড়িকে কুতুব পরেশ দাদা বলে ডাকছে। বোঝা গেল আগে থেকেই গলায় গলায় ভাব। দু’জন মিলে বিড়ি ধরিয়ে খি-খি, হিহি করে কি হাসি। আমার তো রাগে- গা শির শির করছিলো। কিন্তু আমি কেবল ছোট বলদ বলে কিছু বলছি না। সুযোগ পেলে কুতুবকে ঢুশিয়ে দিতাম। এসব ভাবনার সাথে দুঃখও লাগে। ষাঁড়কে যখন বলদ করা হয়, তখন দিন দিন রাগও কমে যায়। গাভীটার জন্য একটা বিধবা মেয়ে এসে কান্না-কাটি করছিলো, সেদিকে খেয়াল হলো। তার গরুটায় একমাত্র সম্বল। সেটার দুধ বেচে সংসার চালায়। কেঁদে কেঁদে তাই বলছিলো। কিন্তু গরু ছাড়ান নিতে একশ টাকা লাগবে, সে টাকা তার কাছে নাই। পরেশ দাদা বললো- আমি তো লস দিতে পারবো না। যে গরু খোঁয়াড়ে দিয়ে গেছে তাকে তো পঞ্চাশ দিতে হয়েছে। তোমাকে তো ফ্রি ছেড়ে দিতে পারি না। বিধবার কাছে শুধু পঞ্চাশ টাকা ছিলো। সেই টাকাটা নিয়ে বসে বসে কাঁদছিলো। আমিও হতাশ হচ্ছি। আমার কোন জামিনদার আসে না। না মজনু, না লোকমান চাচা। পাশের খোঁয়াড় ঘরে ছাগল, ভেড়া সবগুলো ঝগড়া লাগিয়েছে- তোর জন্য আমি খোঁয়াড়ির জমিতে গেলাম, অন্যজন বললো- দুজনই খেসারি খেয়েছি, দোষ দুজনেরই, এই নিয়ে তর্ক করার কিছু নাই। একটা ভেড়া একটা খাসি ছাগলকে ঢুশিয়ে দিয়েছে, তাই নিয়ে ঢিশাঢিশি শুরু হলো- সেগুলো দেখছিলাম, চার পাঁচটা হাঁস ধান খেয়ে আটকা পড়ে আছে। সেগুলো প্যাঁক প্যাঁক করে বেড়ার দিকে সরে গেল। এর মধ্যে মোটরসাইকেলের শব্দ শুনলাম। দেখলাম বজলুর বাইকে চড়ে আসছে মজনু। তার মধ্যে কান্না কান্না ভাব। বজলুর ঠ্যাংটা তাহলে সেরে উঠেছে। মজনু এসে খোঁয়াড়ি দাদার সাথে কথা বললো। দেখলাম একশ টাকার নোট দিয়ে ছাড়ের কাগজ নিতে। কিন্তু বিধবা মহিলার জন্য খারাপ লাগছে। তার টাকা কে দিবে? মনে হলো আমিতো গরু অত কিছু ভাবার দরকার কী? শুনলাম বজলু জিজ্ঞেস করছে- এই মেয়েটা কাঁদে কেন? দাদা বললো-গাই গরু, একশ টাকা লাগবে আছে পঞ্চাশ। বজলু বললো -ছেড়ে দাও এই বিশ টাকা রাখো। শুনে খুব ভালো লাগলো। বজলু একটা বদ ছেলে। বদ ছেলেরাও মাঝে মাঝে ভালো কাজ করে। মেয়েটার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো- দাদাও আমতা আমতা করে শেষ পর্যন্ত সত্তর টাকায় গায় গরুটা ছেড়ে দিলো। বজলু মোটরবাইক চালিয়ে উধাও হলো। মজনু বিরস মুখে আমাকে নিয়ে সেই কাঁচা সড়কে উঠে এলো। আমার মনে খুব আনন্দ। কেননা আমি বন্দিদশা ছেড়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছি। মজনুও দড়ি ছেড়ে দিলো। আমি হেঁটে হেঁটে একাই ফিরতে লাগলাম। মজনু পিছনে পিছনে একটা দড়ি হাতে করে হেঁটে হেঁটে আসতে লাগলো। জানি না আমার আর শাস্তি বাকি থাকলো কিনা।
হাঁটতে হাঁটতে যখন বুঝে ফেললাম আমার বাড়ির রাস্তা আমি চিনে ফেলেছি, তখন দৌড়ে দৌড়ে ফিরতে লাগলাম। পিছনে মজনু চিৎকার করতে করতে আমার পিছু পিছু দৌড়ে আসছে। তার শঙ্কা আমি যদি আবার হারিয়ে যাই। আকাশে অনেক মেঘ করে- ছিলো। সেখান থেকে ফুট ফাট বৃষ্টি শুরু হলো। আমিও ছুটছিলাম জোরে, পেছনে মজনু। এবার বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য- আরো জোরে ছুটে চললাম। এক সময় তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। দুজনই ভিজে সারা হয়ে বাড়ি ফিরলাম। তখন মনে পড়লো ধলি মাকে। আবার ছোটবেলার কথা মনে হলো। দৌড়ে গোয়ালের মধ্যে ঢুকে পড়লাম। তারপর কদম গাছটার দিকে তাকিয়ে মার কথা মনে হলো। এতদিন হয়তো মা পৃথিবী ছেড়ে কোন সুদূরে হারিয়ে গেছে।
আমি দিনে দিনে বলদ হয়ে উঠেছি। আমাকে দিয়ে গাড়ি বহানোর চিন্তা চলছে। গোয়ালের ষাঁড় দুটোর দুদিন থেকে কথা-বার্তা শুনে বোঝা গেল, গোয়ালে শোকের ছায়া। তাদের কোরবানির হাটে তোলা হবে। আর আমাকে লাঙ্গল জোয়ালে। ষাঁড় দুটো রোজ গল্প করছে, আর চোখের পানি ফেলছে। এসব দেখে আমাকে বলদ করার যে দুঃখটা হয়েছিল, সেটা কমে গেল। কেননা বেশির ভাগ ষাঁড় দাঁত উঠলেই হাটে তোলা হয়। তার পর মানুষের খাদ্য হয়ে যায়। বেশি ভাগ গাই গরু আর বলদ গরুদের পৃথিবীতে একটু বেশি থাকা হয়।
দুদিন পর চারিদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। কোরবানির ঈদ, গরু-ছাগল বেচাকেনার হাট। ষাঁড় দুটোকে বেচতে নিয়ে যাবে। সাথে যাবে পাশের গোয়ালের দুটো খাসি আর ভেড়া। দুদিন থেকেই শোকের মাতন জুড়ে দিয়ে ভ্যা ভ্যা-ম্যা ম্যা, ব্যাব্য করে চেঁচামেচি করছে। সেদিন মজনু আমাদের মাঠে নিয়ে গেল না। ষাঁড় দুটোকে গোসল করানো হলো। শিঙে তেল মাখানো হলো। জীবনে এত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা গরুদের ভাগ্যে জোটে না। বেশি দাম পাবার জন্য এমন পরিষ্কার করা। নজর আলী বললো- দুটোর দাম এক লাখের কমে হবে না। কাশেমও তার কথায় সাই দিলো। দুজন হাসা-হাসি করলো, ষাঁড় দুটোর চোখে পানি। লোকমান চাচার বাড়ির স্মৃতি ছেড়ে যাওয়া, তারপর পৃথিবী ছাড়া। যা সকল প্রাণীর জন্য চির সত্য। ষাঁড় দুজনের শিঙে লাল ফিতের ফুল বাঁধা হলো। তাতে সৌর্ন্দয গেল বেড়ে। সেই সাথে তাদের বিনিময় মূল্য বাড়লো। দুজনের কথার মাঝে কোথা থেকে বন্দুক হাতে বজলু এসে বললো- কাশেম, নজর নতুন বলদ ডারে হাটে তুললে হয় না। ওর তো দুটো দাঁত হয়েছে। নজর বললো- না ভাই, চাচা অরে দিয়ে লাঙল দিবে- চারটা বলদতো আছে সেগুলা দিয়ে হবে না? নজর বললো- একটা বলদের বয়স বেশি। সেটা এবার কোরবানি করা হবে।
বজলু বিরক্ত হয়ে বললো- বাপজান যে কি? আমার একটা কথাও শুনে না। বোঝা গেল বজলু কদিন মার খেয়ে চুপ ছিল। ভাঙ্গা পাটা সেরে যাবার পর আবার বন্দুক হাতে নিয়েছে। তার কথা শুনে আমার বুক ধড়ফড় করে উঠলো। আমার দিকে তার নজর পড়েছে।
আমার দিকে বজলু তাকিয়ে কি যেন ভাবলো, তারপর হেসে মাঠের রাস্তা ধরে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে কাশেম আর নজর আলী ষাঁড় দুটোকে নিয়ে, হাটের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। আমি তাকিয়ে দেখতে লাগলাম তাদের শেষ বিদায় বেলা। এখন শুধু আমি, বকনা, আর লাল গাইটা গোয়ালে থাকলো। বলদ চারটে কাঁঠাল গাছের সাথে বাঁধা। লোকমান চাচা মজুনকে ডেকে নিয়ে বললো- ষাঁড় দুটো হাটে পাঠানু, বাকি গরু দেখার কথা ভুলে যাস না। বজলু খুব খারাপ। বলদগুলো বেচার ফন্দি আঁটছে। সবসময় পাহারায় থাকবি। মজনু মাথা নাড়িয়ে কথা শুনলো। চাচা চলে বাবার পর মজনু নাদে খোল ভুসি মিশিয়ে দিলো, আমরা খেলাম। কিন্তু দুপুর গড়ানোর আগেই হাজির হলো বজলু, সাথে গামছা আক্কাস মুখঢাকা। বুঝতে পারলাম কপালে আবারো দুঃখ আছে। আক্কাস তড়িঘড়ি করে আমার দড়ি খুলে টানতে লাগলো। আমিও অনড় আমি কোন মতেই যাবো না। তাই গোঁ ধরে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বকনা আর লালগাই ফোঁস ফাঁস করে প্রতিবাদ জানালো। আক্কাস আমাকে দড়ি ধরে টেনে সামনে নিতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত বজলু একটা ছড়ি দিয়ে আমার পেছন দিকে পটাপট, পিটুনি দিতে লাগলো, তখন আর সামনে না যেয়ে উপায় থাকলো না। সামনে আক্কাস। ছড়ি হাতে বজলু পেছনে। মূল রাস্তায় না যেয়ে ধানি জমির আল দিয়ে আমাকে নিয়ে চললো। আমিও মনে মনে ভাবলাম শুধু একবার পালানোর সুযোগ পেলে আমাকে আর ধরতে হবে না। এক সময় ধানি জমি পেরিয়ে ধুলো বালির সড়কে উঠলাম। উঠে অবাক হলাম। আমার মতো অনেক ষাঁড় গরু, বলদ চলেছে পূর্বদিকে। আমাকেও সেই সব গরুর সাথে হাঁটিয়ে নিয়ে চললো। লোকজন জিজ্ঞাস করতে শুরু করলো-কত দাম হলো, হাটে যাচ্ছেন? কত দামে বেচবা? এসব মানুষের বেশির ভাগ প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যাচ্ছে বজলু আর আক্কাস। আমিও বেশি জোরে জোরে হাঁটছি। কিন্তু ছোটবেলায় যে রাস্তা দিয়ে আমাকে হাটে নেয়া হয়েছিল সেই রাস্তা এটা না। মনে হলো অনেক দূরে যাচ্ছি? রাস্তা যেন ফুরাতে চায় না। পেছনে একবার দেখলাম, কেউ নাই বজলু উধাও। পাশে দিয়ে অনেক ভ্যানগাড়ি, নসিমন, করিমন যাচ্ছে। মনে হয় এমন কোন গাড়িতে সে উঠে গেছে। আক্কাস এখন একা, কিন্তু এখন পালানোটা হবে বোকামি। রাস্তায় অনেক লোক জন। তাই সহজভাবে হেঁটে হাজির হলাম এক মাঠে। সেটা একটা হাট। গরু-ছাগল, ভেড়া, মোষ হাজার হাজার। তবে মানুষরা তার চেয়ে দশগুণ। কালো চুল, লাল গামছা- মানুষের মাথার সঙ্গে ছাতা।
মাঠের একদিকে যেখানে বলদরা দাঁড়িয়ে আছে সেই লাইনে একটা বাঁশের সাথে আমাকে বেঁধে ফেলা হলো। হাটের মধ্যে এতই হট্টগোল যে কান পাতা দায়। মানুষের কথাবার্তায় বোঝা যাচ্ছে। মানুষরা অকারণে বেশি কথা বলে। গরুর হাম্বা, ছাগলের ম্যা ম্যা, ভেড়ার ব্যা ব্যা, ভ্যা ভ্যা, সব মিলিয়ে একটা আজব কলরব তৈরি হয়েছে। সেই কলরবের মধ্যে বুঝলাম আমার ক্ষিদে পেয়েছে। আমি নিচের দিকে মুখ করে খড় খুঁজতে লাগলাম। খানের শুকনো খড় পড়েছিলো সেগুলো চিবুতে বেশ মজা। এর মধ্যে বজলুর কণ্ঠ শুনে কান খাড়া হলো- দেখলাম বজলুও এসে গেছে। অনেকেই এসে পেছনের পিঠে ধপাস, ধপাস, করে থাপ্পড় দিয়ে দামদর করছে। ভাই গরুটার কত মাংস হতে পারে। এসব কথাবার্তা শুনে রাগে গা-শির শির করতে লাগলো। কিন্তু বলদের রাগ এই পর্যন্ত, তবে সিদ্ধান্ত নিলাম এবার একটা ঢিশ দেব। পাশের বয়স্ক বলদটা হাম্বা করে বললো-হ্যারে ছোট বলদ, তোকে এখনই হাটে আনলো। আমি বললাম- ভাগ্য খারাপ, গেরস্তের ছেলে চুরি করে বেচতে এসেছে। -তাই নাকিরে! বলে বুড়ো বলদটা হা হা করে হাসতে লাগলো। -যাক বেঁচে গেলি। সারা জীবন লাঙ্গল বহানোর কাজটা করতে হলো না। তার আগেই কোরবানি। বলদটার কথা শুনে রাগ হলো কিন্তু কিছু বললাম না। ছোটবেলায় যে হাটে আমাকে বেচতে এসেছিলো, তার চাইতে আরো দূরের হাট এটা। আমার দাম ত্রিশ হাজার পর্যন্ত উঠলো। এঁড়ে হলে চল্লিশ হাজারে এমনি বিক্রি হয়ে যেত। কোরবানির হাটে বলদের চাহিদা কম। সবাই এঁড়ে কিনতে চায়।
মানুষ প্রচুর কিন্তু কেনার মানুষ মনে হলো কম। হাটের একদিকে হইচই বেধে গেল। একটা এঁড়ে গরু ছুটে গেছে, সেই গরু ধরতে বহু ঠেলাঠেলি। চারদিকে গরুর গোবর ছড়িয়ে ছিটিয়ে, তারই উপর মানুষের পা। ছ্যা ছ্যা অবস্থা। গরুদের কাছে এসব ব্যাপারই না। তবে এর মধ্যে পণ্ডিত মশাইদের বলা ‘মানুষ গরু’ও অনেক আছে। বজলুকে আমার মানুষ গরু বলে মনে হয়। যা হোক হাটে শুধু এঁড়ে গরুই ছুটে পালায় না। বলদ গরুও ছুটে পালায় সেটা আজ দেখাবো। রাগে আমার মধ্যে ছুটে পালানোর নেশা ধরলো। কিন্তু এই হাটটা অনেক দূরে, পালালে বাড়ি চেনা মুশকিল হবে। খুব ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। বজলুর চেনা একটা লোক এসে খোশ গল্প করছে অনেকক্ষণ। লোকটাকে দেখে আক্কাসের মতো চোর-চোর চেহারার মনে হলো, পেছনের ঘাঁড়ে ছাতা ঝুলানো, মুখে পান খেয়ে দাঁত লাল। লোকটা দেখে মনে হলো, সেই কথাটা যে কথাটা মানুষেদেরই বলতে শুনেছি “বাঙ্গালি দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা জানে না।” এই লোকের দাঁত দেখে তাই মনে হলো। এই লোক যে গরুর দালাল সেটা বোঝা গেল আক্কাসের কথায়। আক্কাস বললো- মকসেদ ভাই তুমি দালালি করো ভালো কথা। তুমি তিরিশ হাজার নগদ দাও, গরুডা নিয়ে যাও। দালাল মকসেদ আটাশ হাজার দিতে চায়। এবং সে যে বজলুর খুব কাছের মানুষ সেটাও বোঝা গেল। বজলু রাজি না হওয়াতে মকসেদ চলে গেল। কিন্তু বলদ কেনার খরিদ্দার আর আসতে না দেখে বজলু অধৈর্য হয়ে উঠলো, বললো- হ্যারে আক্কাস, গরুডা মকসেদকেই দিয়ে দে অরে বাড়িতে নিয়ে যাবো না। মকসেদ হাটেই অন্য কারো কাছে বেচে দিবে। আক্কাস বললো- তাও ঠিক বুল্যাছো। মকসেদের জন্য আক্কাস আর বজলু অপেক্ষা করতে লাগলো। অনেকক্ষণ বাদে ঘুরে ঘুরে দালাল মকসেদ আবার-ফিরলো। সেই মকসেদকে চুপে চুপে বজলু কিছু কথা বললো। মনে হলো- এসব ঘটনা তার বাপ লোকমান যেন জানতে না পারে। গরু যেন হাটেই অন্য কারো কাছে বেচে দেয়। এসব শুনে মকসেদ খিখি, হিহি করে দাঁত বের করে হাসলো। আমি একটা গরু, তবু তার হলুদ আর লাল দাঁত দেখে ওয়াক করে উঠতে হলো। গরুদের দাঁত মাজতে হয় না, কিন্তু এক পাটি দাঁত ঘাস খেয়েই সাদা। সেই হলুদ দেতো মকসেদ আমাকে কিনে নিলো। কিন্তু টাকা দিলো না। দালালদের এই এক ব্যবসা। বিনা টাকায় ব্যবসা।
আমাকে মকসেদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল বজলু আর আক্কাস। নিজেকে আরো একা মনে হতে লাগলো। লাল দাঁতওয়ালা আমাকে হেঁকে হেঁকে বেচার জন্য চেঁচাতে লাগলো। আমি কি তাহলে এই বয়সে কোরবানি হয়ে যাব! মনের মধ্যে ভয় শংকা দানা বেঁধে উঠছে। আবার লোকমান চাচার কথা মনে হলে, আশার আলো দেখছি। শেষ পর্যন্ত দেখা যাক আমার ভাগ্য কোন দিকে যায়। মকসেদের পরিচিত একজন হেসে কাছে এসে বললো- হ্যারে মকা এঁড়েটার দাম কত নিবি? মকসেদ খিখি হেসে বললো- মধু চাচা, এডি এঁড়ে না বলদ। মধু চাচা ভালো করে দেখে বললো তাই-তোরে। তা জবর একটা বলদ। দেখতে এঁড়েদের মতো। একথা শুনে আমার বুক ফুলে গেল। আমাকে লোকটা পছন্দ করলো। দামদর করলো। তার পর বললো- দাঁড়া হাটটা একটু ঘুরে আসি- এঁড়েতো কিনতে এসেছি, না হলে তোর বলদটায় নিয়ে যাবো। চাচা এঁড়ের খোঁজে চলে গেল। আমি আশপাশের গরুদের অবস্থা দেখছি। বলদের বিক্রি নাই বললেই চলে। পাশের বলদ গুলো সেই গল্পই করছে। বেচা নাহলে ফিরে যেতে হবে। লাঙ্গল জোয়াল কাঁধে নিতে হবে, তাছাড়া আরকি? আমারও সময় এসেছে লাঙ্গল জোয়াল কাঁধে নেয়ার। আর ভাগ্যে থাকলে কোরবানি। কিছুক্ষণ পর সেই মধু চাচা এসে বললো- মকসেদ গরুডা আমার বাড়িতে নিয়ে যা দাম বাড়িতে গিয়ে দিবো। মকসেদ এতেই মহাখুশি। এসব কথা শুনে আমার বুকের মধ্যে, ধড়-ফড়ানি বেড়ে গেল। তাহলে কি মধু চাচা আমাকে কোরবানি করে ফেলবে। মনের মধ্যে দুঃশ্চিন্তা চেপে বসলো, আর জেদও চাপলো। আজ একটা দফারফা করা দরকার। দালাল মকসেদ। হাটের বাইরে এসে দম নিলো। তারপর হাট পেরিয়ে কাঁচা সড়কে উঠে গেল। যে সড়ক দিয়ে এসেছিলাম এটা তার উল্টো দিকের সড়ক। এই সড়কেও গরু ছাগলের আসা যাওয়া। লোকজন দামদর জিজ্ঞেস করে, গরুর দাম কত হলো? বেচবা না কিনলা? এমনি আমাকে অনেক দূরের হাটে আনা হয়েছে। এখন আবার হাট ছেড়ে আরো দূরে যেতে হচ্ছে। আমার হঠাৎ ইচ্ছে হলো আর যাবো না। হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলাম গোঁ ধরে। মকসেদ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো! তারপর তাড়া দিতে থাকলো, তাতেও আমি অনড়। শেষে মকসেদ হাতের লাঠি দিয়ে আমাকে পিটাতে লাগলো। আমি মার খেয়ে আরো খেপে গেলাম। ফোঁস করে উঠে মকসেদকে দিলাম একটা ঢিশ। বেচারা আশা-করেনি যে আমি ঢিশাবো। তাই চিৎপটাং হয়ে- বাবারে-মারে বলে চেঁচাতে লাগলো। আমি কাঁচা সড়ক ছেড়ে মাঠের মধ্যে নেমে পড়লাম।
শরীরের মধ্যে একটা চনমনে ভাব এলো। মনে হলো আমি আজ স্বাধীন। দিগন্ত জোড়া মাঠ, চারদিকে নানা ফসল দেখেই মনটা নেচে উঠলো। দৌড় দিলাম সেই সবুজ মাঠে। পেছনে মকসেদ চিৎকার করে উঠলো। তার চিৎকারে একটা হতাশার ভাব। আমি ছুটলাম। যত দৌড়াচ্ছি তত যেন শরীর বলছে- আরো জোরে দৌড়া। ছুটতে ছুটতে পেরিয়ে গেলাম নাড়ার জমি। সমস্যা হচ্ছে গলার সাথে বাঁধা দড়িটা, সেটা মাঝে মাঝে পায়ে বাঁধছে। কখনো বাঁধছে কোন শক্ত গাছে। পেছনে জোরে দৌড়ে মকসেদ আমাকে ধরতে চায়। মকসেদের সাথে আরেকজন যোগ দিয়েছে। আমি কিন্তু ধরা দেব না। যেদিকে ইচ্ছে সেদিকে আমি হারিয়ে যাবো, তবু কারোর হাতে ধরা পড়া যাবে না। আমি দৌড়ে একটা পাট ক্ষেতে ঢুকে পড়লাম। তারপর হাঁটতে, হাঁটতে পাট সরিয়ে, সরিয়ে অনেক গভীরে গিয়ে দুটো পাটের পাতা খেলাম, কচি পাতা কি সুস্বাদু। এই ভাবে একপা, একপা করে পাট ক্ষেত পেরিয়ে গেলাম। সামনে একটা নালা। ধানের জমিতে পানি দেওয়া ছোট নালা। মুখ ডুবিয়ে পানি খেলাম। আহ্ তৃপ্তি। পেছনে মকসেদ আর সাথের লোকটা নেই। পাট ক্ষেতে ঢুকে যাবার পর তারা দিক হারিয়ে আমাকে খুঁজছে। আমি আবার হালকা চালে দৌড়ে চললাম। আমার শরীরে কোন ঝিমুনি নেই বরং তেজ আরো বেড়ে গেছে।
ছুটতে ছুটতে মাঠের শেষে একটু উঁচুতে একটা আম বাগান। সেই বাগানে উঠতেই একটা প্রশান্তি নেমে এলো। ভাটফুল, জংলি ফুলে বাগানটা মৌ মৌ করছে। একটা আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম। খেয়াল করলাম, বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে। এতক্ষণে ভয় ভয় মনে হলো। জীবনে প্রথম কোন সন্ধ্যা এমন নির্জনে কাটাচ্ছি। যা হোক সন্ধ্যা যত গভীর হতে লাগলো চাঁদের আলোটা তত উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তাই ভয় ভয় ভাবটা দূর হয়ে গেল। পেছনে ধাওয়া করে আসা মকসেদ আর লোকটাকে দেখা যায়নি। তবে বাগান থেকে মাঠের মধ্যে টর্চের দু’একবার আলো দেখতে পেলাম। তারপর সব চুপ চাপ।
এই নির্জন বাগানে একা আমি। আলো আঁধারির মধ্যে বসে বসে জাবর কাটতে লাগলাম। মনে ক্লান্তি নেমেছিল। তাই কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই। অনেক রাতে কিসের একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি দুটো শেয়াল আমার পাশে ঘুর ঘুর করছে। মনে করেছে মরা গরু। আমি ভয় পেয়ে ফোঁস করে উঠে মাথা ঝাঁকালাম। ওরা সরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রাতে তাদের চোখ ধক ধক করে জ¦লছে। বুঝলাম এদের একটু ঢিশিয়ে দিতে হবে, না হলে পালাবে না। তাই একটার দিকে শিং উঠিয়ে মাথা ঘুরিয়ে তেড়ে গেলাম। সেটা পালালো। আরেকটাও দাঁড়িয়ে ছিলো।
(চলবে)

Share.

মন্তব্য করুন