ও কি আর পাঁচজনের থেকে আলাদা? প্রশ্নটা আমাদের সবার।
ওর কথাই মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। ও আমাদের পরিবারে এসে যোগ দেয়ার পর থেকে ছোট ছোট ঘটনা এবং ওর ব্যবহার আমাদের বিস্মিত ও মুগ্ধ করলো। আমাদের বাড়তি আগ্রহ তৈরি হলো ওকে নিয়ে।
প্রথম দিনের পরিচয় থেকে শুরু করা যাক।
ও আমার দরোজার কাছে এসে দাঁড়ালো।
আমি লিখছি।
আড়চোখে তাকালাম ওর দিকে।
পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে আছে, ভেতরে ঢুকছে না।
ভয় পাচ্ছে হয়তো।
এমনিতেই আমি খুব গম্ভীর, বিশেষ করে লেখালেখির সময় নানা চিন্তা মাথার ভেতর কিলবিল করে, ফলে মুখে হাসিটাসি থাকে না।
ওর দিকে দ্বিতীয়বার চোখ পড়তেই চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেলো।
মেয়েটার দিকে এবার পূর্ণভাবে তাকালাম।
হাতের ইশারায় ডাকলাম কাছে।
ও এলো না।
এবার বললাম, ‘আয়।’
মেয়েটা এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিশ্চিত হতে চাইলো ওকেই ডাকছি কি না।
আমি আবার ডাকলাম, ‘কাছে আয়।’
পা ফেলে ফেলে ও আমার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালো।
‘নাম কি তোর?’
খুব স্পষ্টভাবে বললো ও, ‘রুশি।’
‘রুশি মানে কী?’
‘মানে জানি না।’
ও এবার আমাকেই প্রশ্ন করে বসলো, ‘তোমার নাম কী?’
আমি আমার নাম বলতেই ও জানতে চাইলো আমি আমার নামের অর্থ জানি কি না।
আমি বললাম, ‘আমার নামের অর্থ আমি জানি।’
‘তুমি বড়ো তাই নামের মানে জানো, আমি ছোট তাই নামের মানের জানি না। বড়ো হলে জেনে নেবো।’
রুশির বয়স কতো হবে? আন্দাজ করলাম পাঁচ অথবা ছয়।
‘স্কুলে পড়িস?’
‘না।’
‘কেন পড়িস না?’
‘মায়ে স্কুলে দেয় না।’
‘তোর মাকে বলিস নি তুই স্কুলে পড়বি?’
‘মাকে বলেছি, মা বলে মায়ের টাকা নাই। টাকা হলে আমাকে স্কুলে পাঠাবে।’
আমার টেবিলে লেখালেখির কাগজ ছড়িয়ে আছে। চা খাওয়া হয়েছে অনেক আগেই, কাপটা পড়ে আছে, কেউ নিয়ে যায়নি। আমি যে টেবিলটায় বসি তার সামনে একটা জানালা, পর্দা থাকলেও লেখার সময় আমি ওটা সরিয়ে দেই। খোলা আকাশ দেখা যায়। আমার লেখার চিন্তাগুলো ঐ আকাশে ওড়াউড়ি করে। আমার স্ত্রী এটা একসময় মোটেও পছন্দ করতো না। এখন করে।
আমার স্ত্রী আমার সব কাজ করে রাখে আমি খুব নামকরা লেখক বলে। আমার অনেক বই। বেরুলেই মুড়ি-মুড়কির মতো বিক্রি হয়। প্রকাশক আমার ওপর সবসময় খুশি এবং সন্তুষ্ট। একুশে বইমেলার আগে অন্তত দশটি উপন্যাস আমাকে রেডি করে রাখতে হয়। অগ্রিম টাকা-পয়সাও দিয়ে যায় কেউ কেউ। অনেকটা হুমায়ূন আহমেদের মতো।
রুশি আমাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কী লিখছো তুমি?’
‘উপন্যাস।’
‘উপন্যাস কী?’
‘এটা এক ধরনের ….’ কী বলবো মেয়েটাকে, আমি চিন্তা করতে থাকি।
‘এটা কি নাটক?’
মেয়েটির উচ্চারণ পরিষ্কার এবং শুদ্ধ ভাষায় কথা বলছে।
আমার অবাক হবারই কথা।
‘না, এটা নাটক নয়। তুই কি নাটক বুঝিস্?’
‘টিভি’তে কতো কতো নাটক দেখি। খুউব মজা লাগে।’
রুশির চোখে মুখে আলো ঝল্সে ওঠে।
‘আমি নাটক লিখতে পারি না।’
‘তাহলে কী লেখো?’
‘ঐ যে বললাম, উপন্যাস লিখি, গল্প লিখি।’
‘তুমি গল্প লেখো?’
‘হ্যাঁ।’
‘ভূতের গল্প?’
‘হ্যাঁ, ভূতের গল্পও লিখি।’
‘আমি ভূতের গল্প পছন্দ করি।’
‘তুই ভূত দেখে ভয় পাস না?’
‘আমি তো ভূত দেখিনি। মা বলেছে ভূত বলে কিছু নেই ।’
‘কিন্তু রাতে অন্ধকারে ভূত যে বের হয় সেটা তুই জানিস?’
‘মিথ্যা কথা।’
‘কেন?’
‘ঢাকা শহরে কারেন্টের তার আছে তো, ভূত উড়ে আসলে কারেন্টের তারে আটকে মরে- বাঁচে।’
আমার লেখা এসে থেমে গেছে তেতাল্লিশ পাতায়। কালকের মধ্যে লেখাটা শেষ করতে হবে। সন্ধ্যায় প্রকাশক আসবে। আমি রুশিকে বললাম,
‘তুই এখন যা। আমি লিখবো।’
রুশি যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই বেরিয়ে গেলো। যাবার আগে বলে গেলো,
‘তোমার এই বইটা খুব নাম করবে।’
আমি হতভম্ব, বলে কি মেয়ে!
স্থির হয়ে আমি আবার লেখায় মনঃসংযোগ করলাম।

২.
আমাদের কাজের মেয়ে রাবেয়ার চলে যাবার পর আমার স্ত্রী একটু সমস্যাতেই পড়ে যায়। হাতের কাছে কাজের মেয়ে একটা দরকার। রাবেয়া প্রায় দশ বছর আমাদের বাসায় ছিলো। পনেরো বছরের মেয়েটা দেখতে দেখতে পঁচিশে পা দিলো। রাবেয়ার বাবার সঙ্গে আমাদের কথা ছিলো, যতদিন খুশি আমাদের কাছে থাকবে, বড় হলে ওর বিয়ে-টিয়ের খরচপত্র আমরাই দেবো। ভালো একটা ছেলের খবর পেয়ে আমাদের কাছে যখন এলো রাবেয়ার বাবা, আমরা আর না করিনি। বিয়ের খরচাপাতি আমরাই দিয়েছি। রাবেয়া এখন ওর শ্বশুরবাড়িতে থাকে। কিশোরগঞ্জে। শুনেছি ভালোই আছে।
রাবেয়া থাকার সময় আমরা বেশ ভালোই ছিলাম।
পুরো বাসার কাজ ও একলাই সামলে রাখতো। ও চলে যাবার পর আমার স্ত্রী এবং আমি দু’জনেই বুঝলাম ওর অনুপস্থিতি আমাদের জন্য কত কষ্টকর হয়ে উঠেছে। ওকে আমরা আমাদের মেয়ের মতোই রেখেছিলাম। রাবেয়া আমাদের আব্বা-আম্মা বলে ডাকতো। আমরাও ওকে উজাড় করা স্নেহে আমাদের কাছে রেখেছিলাম। বুঝতেই দেই নি ও কাজের মেয়ে। আমাদের ছেলে রবিন এখন কলেজে পড়ছে। রাবেয়া যখন আমাদের বাসায় আসে তখন রবিনের বয়স সাত। আমরা রবিনকে শিখিয়েছিলাম রাবেয়া ওর বড়ো বোন। রাবেয়া ছোট ভাইয়ের মতোই আদর করতো রবিনকে। এতে হলোটা কি, রাবেয়াকে যখন ওর বাবা এসে নিয়ে চলে গেলো, তখন আমার কলেজ পড়–য়া ছেলেটা কেঁদেছিলো হাউমাউ করে।
ওর মা জিজ্ঞেস করেছিলো,
‘কাঁদছিস কেন?’
‘রাবেয়া আপু আর কোনোদিন আসবে না মা?’
রবিন আকুল হয়ে জানতে চেয়েছিলো।
কিন্তু সময় বলে কথা।
আস্তে আস্তে রবিন সামলে নিয়েছিলো নিজেকে। সমস্যায় পড়েছিলো আমার স্ত্রী।
পুরো বাড়ি ওর মাথায়। আমার যত্নপাত্তি করাটাও ওর কমে যাচ্ছিলো রান্নাঘরের কাজ দেখতে গিয়ে। সকালে উঠে নাশতা বানানো থেকে শুরু করে কাপড় ধোয়া, ঘর মোছা থেকে শুরু করে মেহমানদারি সবই ওকে এক হাতে করতে হতো।
আহা! বেচারার কি হাল।
আমি বাজার থেকে মাছ-মোরগ সবকিছু কেটেকুটে নিয়ে আসা শুরু করি। পাঁচ টাকা বেশি দিতে হতো, কিন্তু এতে স্ত্রীর সাহায্য হতো আরও বেশি।
চারিদিকে খবর পাঠানো হয়েছিলো কাজের মেয়ের জন্য। কিন্তু কোনোদিক থেকেই পজিটিভ খবর পাচ্ছিলাম না। মেয়েরা এখন বাসাবাড়ির কাজের চেয়ে গার্মেন্টের কাজ পছন্দ করে। বেতনও বেশি।
‘বেশি হলে কী হবে? সবতো যায় ঘরভাড়ায় আর খাওয়ায়।’
আমার স্ত্রীর এমন মন্তব্যে আমি যোগ করি-
‘সবকিছু যেতে পারে, কিন্তু একটা অতিরিক্ত জিনিস ওরা পায়।’
‘কী?’
‘স্বাধীনতা। নারীর স্বাধীনতা।’

৩.
ছেলেটা কলেজে। আমি দুপুরের খাবার খেয়ে নিত্যদিনের মতো বিছানায় ভাতঘুমে যাচ্ছিলাম, রুশি এসে হাজির।
‘তুমি ঘুমাচ্ছো?’
‘চেষ্টা করছি ঘুমাতে।’
‘দুপুরে ঘুমাও কেন?’
‘ভালো লাগে।’
‘সবাই কি ঘুমায়?’
‘তাতো জানি না।’
‘তুমি আমার চেয়ে অনেক বড়ো, জানো না কেন?’
আমি ওর দিকে পাশ ফিরি। ও আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে।
‘সবকিছু না জানলেও চলে।’
‘না জানলেও চলে কেন?’
রুশির কঠিন প্রশ্ন।
‘তুমি জানো না, যারা কিছু জানে না ওদের বোকা বলে?’
‘জানি।’
‘তাহলে তুমি বোকা কেন? তুমি কি ইচ্ছে করে বোকা?’
‘মানুষ কি ইচ্ছে করে বোকা হয়?’
‘আমি ইচ্ছে করে বোকা হয়েছি।’
রুশি হো-হো করে হেসে ওঠে। আমি বলি,
‘তুই এখন যা, আমি ঘুমাবো।’
‘তোমার বইটা লেখা শেষ হয়েছে? তাড়াতাড়ি শেষ করো, অনেক নাম হবে।’

৪.
রুশি মনোয়ারার মেয়ে। আমার এক প্রকাশকের বাসায় মনোয়ারা কাজ করতো। আমার দুরবস্থা দেখে একদিন প্রকাশক আমতা আমতা করে বললো,
‘যদি বলেন তো দিয়ে যাই আপনার বাসায়। সমস্যা একটাই, সঙ্গে ওর একটা মেয়ে আছে।’
আমার স্ত্রী জানতে চেয়েছিলো কতো বড়ো মেয়ে।
‘এইতো, ছোট, মানে বেশ ছোট।’
‘কান্নাকাটি করেনাতো?’
‘না ম্যাডাম, কী যে বলেন, খুব ছোট হলেও সব বোঝে। সমস্যা করে না।’
‘বাড়ি কোথায়?’
‘রংপুর।’
‘শুনেছি নর্থ বেঙ্গলের মেয়েরা কাজকর্মে ভালো হয়।’
আমার স্ত্রী যোগ করেছিলো তার মন্তব্য।
একদিন মনোয়ারা তার মেয়ে নিয়ে আমার বাসায় এসে ওঠে। আমি লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত, তাই কাজের মানুষ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠে আমার স্ত্রী। বাসার কোথায় কী আছে, কী কী কাজ করতে হবে, কোথায় ওরা ঘুমোবে ইত্যাদি বিষয়গুলো বুঝিয়ে দেয় মনোয়ারাকে। বাসার কাজ দু’দিনেই বুঝে নেয় মেয়েটা।
আমার স্ত্রী তার ধারণা থেকে আমাকে জানায়, মেয়েটা কাজকর্মে ভালো, তার সমস্যার আপাত সমাধান হয়েছে। আর মনোয়ারার বয়সও খুব বেশি নয়, ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে।
ওরা আমার বাসায় আসার তিন-চারদিনের মাথায় রুশির সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। আমার প্রকাশক মিথ্যে বলেনি, রুশি কোনো সমস্যা করে না।
সন্ধ্যার দিকে ফোন এলো প্রকাশকের।
‘স্যার, ভালো আছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘আমার উপন্যাসটা কদ্দুর?’
‘এইতো, কাল পেয়ে যাবেন।’
‘স্যার, মনোয়ারা কাজ-কর্ম পারছে তো?’
‘আপনার ম্যাডামতো ভালোই বলছে।’
‘আর রুশি?’
‘ভালোই। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলে। শিখলো কিভাবে?’
‘আমিই শিখিয়েছি স্যার। আমার বাসায় সবাই শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে।’
আমি একটু অবাকই হলাম। প্রকাশকদের ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বিষয় নিয়ে কখনো কথা বলি না, বলার দরকারও হয় না। আজ বলতে হলো আমারই প্রয়োজনে।
জিজ্ঞেস করলাম,
‘কেন? আজকাল টিভির নাটকেও তো কথ্য ভাষার ছড়াছড়ি। আপনি শুদ্ধতে মগ্ন হলেন কিভাবে?’
‘আমি তো স্যার প্রকাশক।’
প্রকাশক হলে শুদ্ধভাষা বলতে হবে এই প্রথম বুঝলাম।
কাপের তলানিতে কিছু চা জমে ছিলো, পেটের ভেতর চালান করে দিলাম।

৫.
রুশি সারা বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। বারান্দায় হাঁটে।
কিছু একটা খোঁজে ও।
স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কী খোঁজে ও?’
‘টেলিভিশন।’
আমার বাসায় দুটো টেলিভিশন। একটি ড্রইংরুমে, অন্যটি আমার ঘরে। আমি যখন যেখানে থাকি তখন সেটা চালানো হয়। সন্ধ্যার পর আমি লিখতে বসি, রাত দশটা অবধি লিখি। ফলে, এ সময়ে টেলিভিশন খোলা হয় না। রবিন ওর নিজের পড়াশোনা নিয়ে এমন ব্যস্ত থাকে যে ওর টেলিভিশন দেখারই সুযোগ নেই। সময় পেলে কম্পিউটার নিয়ে বসে। আমার স্ত্রীর টিভি দেখার ইচ্ছে-টিচ্ছে খুব একটা নেই।
আমি দেখলে দেখে, না হলে নয়।
টিভি চালিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া ওর অভ্যাস। ফলে, আমার বাসায় এই জাদুর বাক্সটি নিয়ে কৌতূহল নেই বললেই চলে।
রুশির জন্য এটাই হয়েছে সমস্যা।
দিনের সময়টা ওর যেভাবে যায় যাক, সন্ধ্যার পর টিভির সামনে বসা চাই।
স্ত্রীকে বললাম,
‘ড্রয়িংরুমের টিভিটা ওকে খুলে দাও।’
রুশির প্রয়োজনের তুলনায় মনোয়ারাকে সন্তুষ্ট করা এখন জরুরি।
ড্রয়িংরুমের টিভিটা অন করে দেয়া হলো। কার্পেটের একটা জায়গা বেছে নিলো রুশি। কোনো একটা চ্যানেল চলছিলো। ও বললো,
‘ম্যাডাম, চ্যানেলটা পাল্টে দেন।’
ম্যাডাম! আমি চমকে উঠলাম। রুশি আমার স্ত্রীকে ম্যাডাম ডাকছে?
‘কোন্ চ্যানেল দেখবি?’
‘স্টার প্লাস।’
গোল গোল হয়ে গেলো আমার স্ত্রীর চোখ দুটো।
বলে কি মেয়ে!
‘ও-তো হিন্দি চ্যানেল !’
‘ওটাই তো আমি দেখি।’
বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো রুশি।
‘হিন্দি বুঝিস?’
‘না। তবে ছবি বুঝি। নাটকে কী হয় বলতে পারি। খুব ভালো ভালো সিরিয়াল হয় স্টার প্লাসে। আপনি দেখেন না ম্যাডাম?’
আমার স্ত্রী রিমোট কন্ট্রোল টিপে টিপে স্টার প্লাস খোঁজে। আমাদের বাসায় সাধারণত বাংলাদেশের চ্যানেল দেখা হয়। ক্রিকেট খেলা দেখার জন্য মাঝে মাঝে বিদেশি চ্যানেল দেখতে হয়। নিউজের জন্য বিবিসি, সিএনএন আমি দেখি না। বিশ্বাসযোগ্য খবর ওরা দেয় না। ওরা চ্যানেল দিয়ে রাজনীতি করে। বাংলাদেশের কিছু টিভি চ্যানেলেরও এই সমস্যা আছে। আমার স্ত্রী খুঁজে খুঁজে হয়রান, স্টার প্লাস খুঁজে পায় না। শেষে আমার ডাক পড়ে।
আমি ড্রয়িংরুমে যেতেই রুশি দাঁড়িয়ে যায়। মেয়ের সৌজন্যবোধ দেখে আমি অবাক।
‘তোকে দাঁড়াতে হবে না। বস্। দেখি আমি তোর স্টার প্লাস খুঁজে পাই কি না।’
আজকালকার টিভির রিমোট কন্ট্রোলগুলো খুব জটিল। কোন্টা টিপ দিলে কী হয় কে জানে। বাট্নগুলো ভালোভাবে দেখে নিয়ে আমি টেপাটিপি শুরু করে দেই। অতঃপর উদয় হয় কাক্সিক্ষত চ্যানেলের।
রুশি হাততালি দিয়ে ওঠে।
‘ঐতো স্টার প্লাস। স্যার, রাখো রাখো।’
রুশি আমাকে স্যার ডাকছে।
আমি বললাম,
‘আমি তোর স্যার হলাম কিভাবে?’
রুশি একটু হকচকিয়ে গেলো, কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিয়ে বললো,
‘তুমি এ বাড়ির মালিক না? মালিককে তো স্যার ডাকতে হয়।’
‘স্যার মানে বুঝিস?’
‘আমার বোঝার দরকার নেই, তুমি মালিক তুমি স্যার।’
আমার স্ত্রী থমকে গেছে রুশির কথা শুনে।
আমি বললাম,
‘শোন্ রুশি, যারা স্কুল-কলেজে পড়ায় তারা স্যার। আমি তো তোকে পড়াই না।’
‘আমি নাটকে দেখেছি বড় বড় মানুষও স্যার ডাকে। উনারা তো স্কুল-কলেজে পড়ে না।’
রুশির যুক্তি অকাট্য। না মেনে উপায় নেই।
বললাম,
‘তুই বিটিভি দেখিস না?’
‘না স্যার। বিটিভি শুধু গান দেখায়, খবর দেখায়।’
‘বিটিভি নাটকও দেখায়।’
‘স্টার প্লাস সারাদিন সিরিয়াল দেখায়। ভীরা সিরিয়ালটা আমার খুউব ভালো লাগে।’
‘ঠিক আছে, তোর ভালো লাগে তুই দেখ্।’
আমি রিমোট কন্ট্রোল’টা সেন্টার টেবিলে রেখে নিজের ঘরে চলে আসি। রুশি মগ্ন হয়ে যায় স্টার প্লাসে।
লিখতে বসেও আমি লেখায় মনঃসংযোগ করতে পারি না। আমাদের টিভি চ্যানেলগুলো সম্পর্কে ঐ ছোট্ট মেয়েটার মতামত আমাকে ভাবায়। এই শিশু-কিশোরদের জন্য কতো কিছু করা যায়, নাটক-সিনেমা থেকে শুরু করে নানা রকমের প্রকাশনা, কিন্তু কোনো উদ্যোগই চোখে পড়ে না। আমাদের শিশুরা আনন্দ পায় বিদেশি টিভি চ্যানেল দেখে। কেউ কি এসব নিয়ে ভাববে না? আমি খুব বিমর্ষ হয়ে যাই।

৬.
একদিন রবিনের রুমেও উঁকিঝুঁকি দিয়েছিলো রুশি।
আমার ছেলেটা আবার একটু মুখচোরা। ওর সব কথা হয় ওর মায়ের সঙ্গে, রাবেয়া থাকার সময় হতো রাবেয়ার সঙ্গে।
রুশি ছোট, ওর সঙ্গে কী কথা বলবে রবিন?
রবিন কম্পিউটার নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। রুশি দরোজায় টোকা দেয়। কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে রবিনের দৃষ্টি চলে যায় দরোজার দিকে।
‘কে?’
‘আমি রুশি।’
‘ও তুমি? ভেতরে এসো।’
রুশি গিয়ে রবিনের পাশে দাঁড়ায়।
‘তুমি কম্পিউটারে গেম খেলছো?’
‘গেম খেলছি না। পড়ছি।’
‘মানুষ তো পড়ে বই, কম্পিউটার বই হয় কী করে?’
রবিন রুশির এইসব প্রশ্নে বেশ মজা পেয়েছিলো।
‘হ্যাঁ, এখন কম্পিউটারই তো বই।’
রুশি কী যেন ভেবে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো,
‘তোমার বুঝি বই নেই?’
‘বই আছে, কিন্তু এখন কম্পিউটার দিয়ে পড়া যায়। আরো বহু কিছু করা যায় কম্পিউটার দিয়ে।’
‘কী কী করা যায় ভাইয়া?’
‘পড়া ছাড়াও লেখা যায়, ছবি আঁকা যায়, বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলা যায়…. আরো কতো কি।’
‘তুমি কম্পিউটারে ছবি আঁকতে পারো?’
‘হ্যাঁ পারি।’
‘গরুর ছবি আঁকতে পারো?’
‘পারি।’
‘পাখির ছবি?’
‘পারি।’
‘পতাকা আঁকতে পারো? বাংলাদেশের পতাকা?’
রবিন ইলাসট্রেটর ওপেন করে সত্যি সত্যি বাংলাদেশের পতাকা এঁকে দেখিয়ে দিয়েছিলো রুশিকে।
‘যন্ত্রের ভেতর আঁকলে, তুমি আমাকে ওটা দেবে কিভাবে? আমি তোমাকে কাগজে এঁকে পতাকা দিতে পারি।’
‘আমিও তোমাকে কাগজে দিতে পারি।’ বলে রবিন প্রিন্টারটা অন করে পতাকার একটা প্রিন্টআউট বের করে দিয়েছিলো, রুশির সেকি আনন্দ।
ও ওটা নিয়ে ওদের ঘরের দেয়ালে আটকে রেখেছে।
‘ভাইয়া, তুমি আমাকে কম্পিউটার শেখাবে?’
রুশি খুব ভয়ে ভয়ে জানতে চেয়েছিলো রবিনের কাছে।
‘কিন্তু তুমি তো এ-বি-সি-ডি জানো না। শিখবে কিভাবে?’
‘আমি জানি।’
‘ভুল বলছো নিশ্চয়ই? লিখে দেখাও তো আমাকে?’
রুশি সত্যি সত্যি শাদা কাগজের ওপর কলম দিয়ে একটা আঁকাবাঁকা ‘এ’ লিখে ফেলে এবং তারপর ‘জেড’ পর্যন্ত।
রবিন তাজ্জব হয়ে যায়।
‘কিভাবে তুমি এসব শিখলে?’
‘দেখে দেখে শিখে ফেলেছি। আমি এ টু জেড লিখতে পারি।’
পাঁচ বছরের রুশি সব পারে!
রবিন অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো মেয়েটার দিকে।
পরে ওদের মধ্যে চুক্তি হয়েছে, রবিন প্রতিদিন পনেরো মিনিট করে কম্পিউটার চালানো শেখাবে রুশিকে। রবিন যে এমনভাবে রুশিকে আপন করে নেবে আমি ভাবতেই পারি নি।
রুশি যাবার সময় রবিনকে বলে গেলো,
‘তোমার সিলিং ফ্যানটা খুলে পড়বে। মিস্ত্রি ডেকে ঠিক করে নিও।’
সত্যি সত্যি এক দুপুরে ফ্যানটা খুলে পড়ে গেলো। ভাগ্যিস রবিন বাসায় ছিলো না।
রুশি এসব বোঝে কী করে? আমরা সবাই অবাক হয়ে যাই।

৭.
রুশি এ বাসার একজন সদস্য হয়ে গেছে। অত্তোটুকুন মেয়ের এমন চটপটে কথায় সবাই মুগ্ধ। বুদ্ধিও কম নেই, চটজলদি যে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেয়ায় ওর জুড়ি নেই। কিন্তু আমাদের এ সামাজিক ব্যবস্থায় রুশিদের পৃথিবীটা খুব ছোট, ওদের সামর্থ্যরে পরিধি আরো ছোট। আমি লেখক হয়ে এ কদিনেই বুঝে গেছি রুশিরা সুযোগ পেলে অবশ্যই মানুষ হতো। যাদের পেছনে আমরা অঢেল টাকা খরচ করছি, ফার্মের মুরগির মতো পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকছি সারাক্ষণ, তারা কতোটুকু মানুষ হবে বা হচ্ছে তা আমরা একবারও ভাবি না। এই রুশিরা ফ্যান্টাসি কিংডম বা শিশুপার্ক দেখে নি, পেট ভরে খেতে পায় না, শীত নিবারণের জন্য এরা পায় না গরম কাপড়, এদের সিংহভাগের ঘরবাড়ি নেই, পথে ঘুমোয়। এই সমাজের সমাজসেবীরা এদের নিয়ে কতোটুকু ভাবি? আর যেটুকু করি, সেটাও কি টিভি-ক্যামেরার আকাক্সক্ষায় করি না?
একবার একটি সামাজিক সংগঠন আমাকে নিয়ে গিয়েছিলো রংপুরে। শীতবস্ত্র বিতরণের প্রধান অতিথি আমি। বিশেষ অতিথি কবি সাকলায়েন জাফর। রংপুরে গিয়ে যখন পৌঁছি তখন বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই করছে। আমাদের দু’জনকে রাখা হয়েছিলো সার্কিট হাউজে। উত্তরবঙ্গের হাড়কাঁপানো শীত কাকে বলে! সোয়েটার, কোট, মাঙ্কি ক্যাপ, হাতমোজা, মাফলার ভেদ করে ঠাণ্ডা বাতাস শরীর কাঁপিয়ে দেয়।
আমার কবিবন্ধু সাকলায়েন জাফর গরম পানিতে হাতমুখ ধুয়ে কম্বলের নিচে ঢুকে যায়। কিন্তু নামকরা লেখক বলে কথা। আমি তো তা করতে পারি না। রংপুরের সববয়সী সাহিত্যিকদের লাইন পড়ে যায় আমাদের রুমে। আমি ওদের সাথে লেখালেখি নিয়ে কথা বলি। কম্বলের তলা থেকে মুখ বের করে ওদের সঙ্গে কথা বলে কবিবন্ধু। বেশিটা সময় আমি চুপচাপই থাকি। ‘আপনারা রংপুরে এসে আমাদের গর্বিত করেছেন’ জাতীয় কথাবার্তায় আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে যায়।
রাত ন’টায় খাবার খেলাম রুমে বসেই।
‘শীতবস্ত্র বিতরণ কখন হবে?
আমি জানতে চাইলে আয়োজকদের একজন বলে,
‘স্যার, আমরা রাত ১১টায় বেরিয়ে যাবো। চারটে মাইক্রোবাস যাবে আমাদের সঙ্গে। আপনাদের জন্য একটা কারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।’
‘ফিরবো কখন?’
‘রাত ১২টার মধ্যেই আশা করি আপনারা ফিরে আসতে পারবেন।’
আর একজন জানায়,
‘স্যার, আপনাদের কষ্ট দেবো না। আপনারা প্রধান অতিথি-বিশেষ অতিথি, শুধু শুরুটা করে দিয়ে বলে আসবেন সার্কিট হাউজে। বাকিটা আমরা করে নেবো।
আমি অতো অমানুষ নই যে দরিদ্রদের শীতবস্ত্র বিতরণ শেষ না করে ফিরে আসবো। ততক্ষণে ঠাণ্ডাটা শরীরের সঙ্গে একটা সমন্বয় করে নিয়েছে। খুব একটা কষ্ট হচ্ছিলো না। রাত ১১টায় আমরা বেরিয়ে যাই। কিছু স্পট আগেই ঠিক করে রেখেছিলো আয়োজকরা। আমাদের দেরি হয় না। আমরা পৌঁছে যাই খুব দ্রুতই। গাড়ি থেকে নামতেই দেখি কয়েকজন একটা বিরাট ব্যানার ধরে দাঁড়িয়ে গেলো।
আমি বললাম,
‘ব্যানার কেন?’
‘স্যার, আমরা যে শীতবস্ত্র বিতরণ করছি তা বোঝানোর দরকার আছে না?’
একজন মাথা চুলকাতে চুলকাতে বললো।
আমি রসিকতা করার চেষ্টা করলাম।
‘এই রাত ১২টায় আপনার ব্যানার দেখবে কে?’
আমার কথায় ওদের কোনো ভাবান্তর হলো না।
আমরা রেডি, শীতার্ত মানুষগুলো হাত বাড়িয়ে বসে আছে রাস্তার পাশে। ওরা বেশ কিছু বাতির ব্যবস্থা করেছিলো, তাতে স্পষ্টই সব দেখা যাচ্ছিলো।
আমরা হাতে কম্বল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি।
বিতরণ করতে যাবো এমন সময় আয়োজকদের একজন এসে বারণ করলো।
‘স্যার, একটু অপেক্ষা করুন।’
‘ও আচ্ছা’ বলে আমি থেমে গেলাম।
থেমে গেলাম তো গেলাম, বিতরণ আর শুরু হয় না। পাঁচ মিনিট-দশ মিনিট করে প্রায় আধ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলো।
আমি অধৈর্য হয়ে যাচ্ছি।
‘কী ব্যাপার, দেরি কেন? আর কেউ আসবেন নাকি?’
একজন এগিয়ে এসে বললো,
‘স্যার, আমরা কয়েকটা টিভি চ্যানেলকে বলেছি এটা কভার করার জন্য। ওরা এখনও আসে নি।’
তারপর ঘড়ির দিকে তাকালো ছেলেটা।
‘এইতো এসে যাবে স্যার, আর পাঁচ মিনিট।’
সমাজসেবার নমুনা বুঝতে আমার কোনো অসুবিধা হলো না।
এ ধরনের অভিজ্ঞতা আমার জীবনে অনেক আছে।

৮.
রুশির জন্য জামাকাপড়ের প্রয়োজন।
আমার স্ত্রী বাজার থেকে ওর জন্য দুটো ফ্রক, সালোয়ার এবং স্যান্ডেল কিনে আনলো। সোয়েটারও নিয়ে এলো একটা, যদি দরকার পড়ে।
রুশিকে কাছে ডেকে নিয়ে আমার স্ত্রী বললো,
‘এই নে, এগুলো তোর জন্য।’
‘এতো জামা আমার জন্য?’
অবাক হলো রুশি।
‘হ্যাঁ, তোর জন্য।’
‘ম্যাডাম, আমার তো দুটো জামা আছে। এখনও ছেঁড়ে নি।’
‘না ছিঁড়লে কি হয়েছে? আমি দিলাম, তুই পরবি।’
রুশি আমার স্ত্রীর দিকে এমনভাবে তাকায় যেন সে সত্যি সত্যি অবাক হয়েছে এতো জামাকাপড় পেয়ে। আমি বাইরে যাবো, রুশি এসে বললো,
‘একটা মানুষের কয়টা জামা লাগে?’
আমি পাঞ্জাবিটা গায়ে চড়াতে চড়াতে বললাম,
‘একটা তো লাগেই, চারটা-পাঁচটা ….’ একটু থেমে ভেবে নিয়ে বললাম,
‘দশটাও লাগতে পারে।’
‘আমার কয়টা লাগবে?’
‘তোর তো একশ’টা লাগবে।’
‘একশ’টা কেন?’
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো রুশি।
‘নিরানব্বইটা জামা যদি কোনো কারণে ভিজে যায় তবে তো একশ’টা লাগবেই।’
‘ভিজবে কেন?’
‘বাথরুমে বারবার পড়ে গিয়ে ভিজতে পারে। পানি খেতে গিয়েও ভিজতে পারে।’
‘তুমি কি দেখেছো পানি খেতে গিয়ে আমি জামা ভেজাই?’
‘দেখি নি মানে এই নয় যে দেখবো না। কিন্তু আমার জানতে ইচ্ছে করছে, জামা নিয়ে প্রশ্ন উঠলো কেন?’
‘ম্যাডাম আমাকে আরো দুটো জামা দিয়েছে। আমার তো দুটো আছেই, আমি বলেছি আর লাগবে না, তারপরও দিয়েছে।’
মাথা নিচু করে একনাগাড়ে বলে গেলো রুশি।
‘ঠিক আছে, তোর নতুন জামা দুটো আমাকে দিয়ে দিস, আমি পরবো।’
হো- হো করে রুশি হেসে উঠলো।
‘আমার জামা তুমি পরবে কিভাবে? ওগুলো তো ছোট।’
আমি ভাবতে ভাবতে বললাম,
‘তাইতো তাইতো। … আচ্ছা ঠিক আছে, তুই আমাকে দিস, আমি নিচের দিকে কাপড় জোড়া দিয়ে লম্বা করে নেবো।’
রুশি ওর কামিজ উল্টে কোমরে রাখা নতুন ফ্রক দুটো বের করে বিছানায় রেখে দিলো। তারপর যেতে যেতে বললো,
‘মাপ ঠিকমতো দিয়ো কিন্তু। বেশি লম্বা জামা তোমাকে মানাবে না।’
আমি ফ্রক দুটো আলমারিতে তুলে রাখলাম।
রাতে মনোয়ারাকে ডেকে ওগুলো দিয়ে দেবো।

৯.
রবিনের ঘরে এখন রুশির যাতায়াত বেড়েছে।
কম্পিউটার শিখছে রুশি।
রবিন ওর মাস্টার।
কম্পিউটার অন করা আর শাট ডাউন করা শিখে গেছে মেয়েটা। এখন কি-বোর্ডের অক্ষর শিখছে। কি-বোর্ডের অক্ষরের সঙ্গে বইয়ের অক্ষর মেলায়। ইংরেজি অক্ষর লিখতে লিখতে রুশি রবিনকে জিজ্ঞেস করে,
‘ইংরেজি অক্ষরটা খুব সহজ।’
রবিন বলে,
‘বাংলাও সহজ।’
‘আর হিন্দি?’
‘হিন্দিটা একটু কঠিন।’
‘আচ্ছা রবিন ভাইয়া, আমরা বাংলায় কথা বলি কেন?’
রুশি কি-বোর্ড থেকে মুখ তুলে জানতে চায় রবিনের কাছে।
‘আমরা বাঙালি তাই বাংলায় কথা বলি।’
‘আমরা হিন্দিতে কথা বললে খুব ভালো হতো।’
‘কেন?’ রবিন জিজ্ঞেস করে।
‘স্টার প্লাসের সব কথা বুঝতে পারতাম।’
ওর মাথায় স্টার প্লাসের ভূত, রবিন নামায় কিভাবে?
কিন্তু রুশির প্রশ্ন বন্ধ হয় না।
‘আমরা হিন্দিও জানি না, ইংরেজিও জানি না। শুধু বাংলা জেনে আমাদের কোনো লাভ আছে?
‘অনেক লাভ।’
‘বোঝাও আমাকে, কী লাভ আমাদের?’
রবিন এরপর রুশিকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের গল্প শোনায়। সালাম-রফিক-বরকতের গল্প বলে। রুশি অবাক হয়ে শোনে স্বাধীনতাযুদ্ধের কথা, একাত্তরের গণহত্যার কথা, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের কথা। রুশি কি সব কথা বোঝে রবিনের?
মনে হয় মেয়েটা পাথর, নইলে কেন সে বলে,
‘আমি বাংলা এবং হিন্দি ভাষা শিখবো কম্পিউটারে। তুমি হিন্দি এবং বাংলা কি-বোর্ড নিয়ে এসো আমার জন্য।’
মেয়েটার এসব কথায় অবাক হয়ে যায় রবিন।
বাংলাদেশে হিন্দি কি-বোর্ড পাওয়া যায় না। তাছাড়া, রবিন নিজে হিন্দি জানে না। হিন্দি ভারতের রাষ্ট্রভাষা। আমাদের দেশে কেউ হিন্দি বলে না।
হিন্দি কি-বোর্ড ও কোথায় পাবে?
রবিনের মাথাটা খারাপ হবার জোগাড়, সব ঐ স্টার প্লাসের করুণাধারা।
পরদিন সে বাংলা কি-বোর্ড এনে কম্পিউটারে লাগায়।
‘তোমার জন্য বাংলা কি-বোর্ড লাগিয়ে দিলাম।’
‘খুব ভালো করেছো। কিন্তু হিন্দি কি-বোর্ড আনো নি?’
‘না, আমি হিন্দি বুঝি না, কি-বোর্ডও পাওয়া যায় না।’
রুশি অবাক হয়।
‘তাহলে হিন্দি শিখবে কিভাবে? আমার তো ভালো হিন্দি শিখতে হবে।’
‘আগে ভালো করে বাংলা শেখো, তারপর হিন্দি।’
বাংলা অক্ষর শেখা অতো সহজ নয়। তবুও চেষ্টার কমতি নেই রবিন আর রুশির। ‘ক’ এর মোচড় দিতে গিয়ে ঠিকমতো হয় না। বারবার লিখতে লিখতে খাতা শেষ। নতুন খাতা আসে রুশির জন্য।
লিখতে লিখতে রুশি ক্লান্ত হয়ে যায়।
‘আচ্ছা ভাইয়া, বাংলা ভাষা এতো কঠিন কেন?’
‘অন্য ভাষাগুলো সহজ তাই বাংলা কঠিন।’ রবিন মজা করার জন্য বলে।
‘অন্য ভাষাগুলো সহজ কেন?’
এ প্রশ্নের উত্তর রবিন কী দেবে? তাই উল্টো করে বলে,
‘বাংলা কঠিন বলে অন্য ভাষা সহজ।’
‘ধুর, একই কথা তুমি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলছো।’
রুশি কথার প্যাঁচ বোঝে।
‘আমি কিন্তু হিন্দি বলতে পারি। খুব সহজ।’
‘তাতো পারবেই। মাথায় হিন্দির ফ্যাক্টরি আছে তো।’
রবিন রাগ করেছে বুঝতে পারে। তবুও বলে,
‘মেরি বাতো মে হিন্দি কুছ কুছ আতা হ্যায়।’
বেশ স্পষ্টভাবে হিন্দি বলে যায় রুশি। রবিন এটুকুন মেয়ের হিন্দি শুনে অবাক হয়ে যায়। রবিনের বেশ কয়েকজন সহপাঠী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে পাস করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। ওরা এমনভাবে ইংরেজি বলে যে মনেই হয় না ওরা বাঙালি। মাঝে মাঝে ওরা হিন্দিও বলে রুশির মতো। আমি রবিনকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়াইনি। বাংলায় পড়িয়েছি। আমরা বাংলা ভাষা শুদ্ধ করে পড়তে বা বলতে না পারলে মাতৃভাষার প্রতি অবমাননা হবে, এটা আমার বিশ্বাস। আমার স্ত্রী চেয়েছিলো রবিন ইংলিশ মিডিয়ামে পড়–ক। চাকরি খুঁজতে গেলে আজকাল শর্ত জুড়ে দেয় ইংরেজিতে পারদর্শিতা থাকতে হবে, হয়তো তাই। আমি তবুও অনড় থেকেছি।
রবিন এসএসসি’তে এ-প্লাস পেয়ে পাস করেছে। ঢাকার একটি ভালো কলেজে পড়ছে। আমার নামের কোনো সুবিধা সে নেয়নি, প্রয়োজনও হয়নি।
কিন্তু রুশিদের হিন্দিপ্রীতি আমাকে ভাবায়। এই শিশুদের আমরা কিভাবে মাতৃভাষার প্রতি আগ্রহী করে তুলবো?
রবিন আমাকে বলে,
‘ওতো বাংলায় কম্পোজ শিখছে। বাংলা অক্ষর শেখাচ্ছি, বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বলেছি।’
‘বেশ করেছো।’
‘কিন্তু ওতো হিন্দিও শিখতে চায়।’
‘শিখতে চায় তো শেখাও।’
বিরক্তি নিয়ে আমি লেখায় মন দেই।
মনে মনে ভেবে রাখি, সামনে বছর রুশিকে স্কুলে ভর্তি করে দিতে হবে।

১০.
আমার নতুন উপন্যাসটি বেরিয়েছে। সন্ধ্যায় প্রকাশক দশ কপি নতুন বই, দশ কেজি নানাপদের মিষ্টি এবং বিশাল এক রুই মাছ নিয়ে হাজির। এ প্রকাশক নতুন। প্রায় পাঁচ বছর পিছে লেগে থেকে উপন্যাসটা নিয়েছে। ছয় ফর্মার উপন্যাস। আজকাল এর চেয়ে বেশি লেখা যায় না। বছরে অন্তত কুড়িটা উপন্যাস লিখতে হয়। তাছাড়া, কলাম জাতীয় লেখাও কখনো কখনো লিখতে হয় চাপে পড়ে। বিভিন্ন দিবসকে কেন্দ্র করে সাহিত্য সম্পাদকরা এমনভাবে ধরে যে না লিখে উপায় থাকে না।
এবারের উপন্যাসটির নাম দিয়েছি ‘আকাশ ভাঙার ইতিকথা’।
নামটা খুব জমজমাট হয়নি, কিন্তু কাহিনিটা জমজমাট।
পাঠকরা পড়ে খুব মজা পাবে।
আমার স্ত্রী বইয়ের নাম নিয়ে বরাবর খুঁতখুঁত করে। কোনো নামই ওর পছন্দ হয় না।
‘রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন দিয়ে বইয়ের নাম রাখতে পারো না?’
‘এখন থেকে বইয়ের নাম তুমিই রেখো।’
আমি হাসতে হাসতে বলি।
‘হুমায়ূন আহমেদের বইয়ের নামগুলো দেখতে? দারুণ রোমান্টিক- ‘তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে’
অথবা ‘আগুনের পরশমণি’ ইত্যাদি।’
‘আকাশ ভাঙার ইতিকথা খুব কি খারাপ হয়েছে?’
‘খু-উ-ব ভালো হয়েছে।’ ভেংচি কাটে আমার স্ত্রী।
আমার নতুন বই রুশি দেখতে আসে।
আমি এক কপি ওর হাতে তুলে দিতেই ও নেড়েচেড়ে দেখে। প্রচ্ছদ উল্টে আমার ছবি দেখে।
‘তোমার ছবিটা খুব সুন্দর হয়েছে।’
‘আমি সুন্দর বলেই তো ছবি সুন্দর।’
আমি হাসতে থাকি।
রুশি জিজ্ঞেস করে,
‘তোমার বইয়ের নাম কী?’
‘আকাশ ভাঙার ইতিকথা।’
‘ইতিকথা মানে কী?’
‘ইতিকথা মানে…. শেষ কথা।’
‘তুমি আকাশ ভাঙার শেষ কথা বই লিখেছো?’
‘হ্যাঁ!’
‘আকাশ ভাঙে কিভাবে? তুমি ভাঙতে দেখেছো?’
‘হ্যাঁ দেখেছি। যখন ভাঙে তখন হুড়মুড় করে ভাঙে।’
‘র্কা মাথায় ভেঙে পড়েছে?’
আমি এই প্রশ্নে বিব্রত হয়ে যাই।
‘না, মানে আমার মাথায় পড়েনি। তবে কারো না কারো মাথায় তো পড়েছে।’
‘ও কি মরে গেছে?’
‘মরবে কেন?’
‘এতো বড়ো আকাশ ভেঙে পড়লে মরবে না? ছাদ-টাদ ভেঙে পড়লেই কতো মানুষ মরে যায়।’
আমি রুশির সঙ্গে কথায় পারি না।
‘তোমার আকাশ ভাঙার গল্পটা আমাকে বলবে?’
গল্প-উপন্যাস লিখতে পারি, কিন্তু তাই বলে গল্পের মতো বলা, তাও আবার এই পিচ্চি মেয়েটাকে!
আমি আমতা আমতা করে বলি,
‘এটা তো বড়দের গল্প, তোর মতো ছোটদের জন্য নয়।’
‘গল্প গল্পই, তা আবার বড়দের-ছোটদের হবে কেন?’
‘বড়দের গল্প একটু আলাদা হয়।’
‘কেন আলাদা হয়?’
‘না, মানে, ওখানে অনেক কিছু থাকে ….।’
‘কী থাকে?’
আমার কথা যেন থেমে যায়।
এসব প্রশ্নের কী জবাব দেবো?
আমি চুপ করে থাকি। আমাকে চুপ থাকতে দেখে রুশি বলে,
‘তুমি ছোটদের জন্য গল্প লেখো না কেন?’
‘লিখবো।’ ওকে আশ্বস্ত করি।
‘কবে লিখবে?’
‘এইতো কাল-পরশুই শুরু করে দেবো।’

১১.
রুশিকে কথা দিয়েছিলাম, ছোটদের জন্য লিখবো। কিন্তু কাল-পরশু চলে যায়, ছোটদের জন্য লেখা শুরু করা হয় না। চার মাস পর ঈদ। এখনই ঈদসংখ্যার জন্য উপন্যাস লেখা শুরু করতে হবে। অন্তত দশটি উপন্যাস। মাঝখানে দশ দিনের জন্য একটি সাহিত্য সম্মেলনে যোগ দিতে কলকাতায় যেতে হবে। সরকারি নমিনেশন। সরকারি ডেলিগেট হয়ে গেলে একটা আলাদা সম্মান পাওয়া যায় বিদেশে। তাছাড়া, ভালো টাকা-পয়সাও মেলে। আমার কবিবন্ধু সাকলায়েন জাফরের সঙ্গে সরকারের উপরমহলে ভালো যোগাযোগ আছে। এসব সুযোগ সে হাতছাড়া করে না। আমি মাঝে মাঝে ওকে ‘তদবির মাস্টার’ বলে ডাকি, ও মাইন্ড করে না।
কলকাতার এই সাহিত্য সম্মেলনে আমার নামটা ও-ই ঢুকিয়েছে। নিজের নাম সবার আগে ঢোকায়।
সকালবেলা লিখতে বসেছি, তদবির মাস্টারের ফোন।
‘রাইটার, রেডি হয়ে যাও।’
‘কিসের রেডি?’
‘কলকাতার জন্য।’
‘ওপারের বন্ধুরা তো চা ছাড়া আর কিছু খাওয়ায় না, পকেটের ডলার ভেঙে খেতে হয়।’
‘চা যে খাওয়ায় ওটাই তো বেশি।’
‘বেশি কেন? ওরা এলে আমরা তো সোনারগাঁও’য়ে খাওয়াই, বাসাবাড়িতে দাওয়াত দিয়ে ভুঁড়িভোজে আপ্যায়িত করি।’ আমি বলি।
‘এটাও আমরা বেশি করি।’
আমি বিরক্ত হই কবির ওপর, ফোনটা রেখে দেই।
রুশি আসে।
‘কোথায় যাচ্ছো তুমি?’
ও মনে হয় আড়াল থেকে আমাদের কথা শুনেছে।
আমি জিজ্ঞেস করি,
‘কেন?’
‘না মানে, তুমি মনে হয় কোথাও যাচ্ছো?’
‘হ্যাঁ, কলকাতা। লেখকদের আড্ডায়।’
‘কেন যাচ্ছো?’
‘সরকার পাঠাচ্ছে তাই যাচ্ছি।’
‘সরকার কি সবাইকে পাঠায়?’
রুশির আজগুবি প্রশ্নে বিরক্ত না হয়ে পারি না।
‘সবাইকে নয়, কাউকে কাউকে পাঠায়।’
‘সরকার বুঝি তোমাকে খুব পছন্দ করে?’
‘তুই সরকারকে চিনিস?’
‘হ্যাঁ-, চিনি।
‘কে, বল্তো?’
‘শেখ হাসিনা।’
‘কে বলেছে তোকে?’
‘আমি জানি।’
রুশি খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর বলে,
‘তুমি শেখ হাসিনাকে বলে দাও তুমি এবার যাবে না।’
‘যাবো না কেন?’
‘না, তুমি এবার যাবে না।’
বলে কি মেয়ে! আমি অবাক হয়ে যাই।
রুশি বলে,
‘তোমার হাতটা দেখাও তো।’
আমি হাত মেলে ধরি রুশির সামনে।
রুশি খুব মনোযোগ দিয়ে আমার হাত দেখে, তারপর চোখের দিকে তাকায়। তারপর বেশ দৃঢ়স্বরে বলে,
‘তুমি এবার যাবে না।’
রুশি সোজা বেরিয়ে যায় আমার ঘর থেকে।
১২.
দুপুর বেলা খাবার টেবিলে আমি কথাটা ওঠাই।
রবিন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকায়।
আমার স্ত্রীর চোখ কপালে ওঠে।
‘ও মেয়ে তোমাকে যেতে নিষেধ করেছে?’
‘হ্যাঁ, হাত দেখলো, চোখ দেখলো, তারপর নিষেধ করে দিলো।’
আমি ইলিশ মাছের টুকরোটা প্লেটে তুলতে তুলতে বলি।
মনোয়ারাকে ডাকলো আমার স্ত্রী।
‘কী ব্যাপার মনোয়ারা? রুশি কি মুখে মুখে কথা বলে?’
আমি বাধা দেই-
‘আরে মুখে মুখে কথা তো বলে নি…।’
‘ঐ হলো। মুখে মুখে কথা বলা আর নিষেধ করা একই কথা।’
অপ্রস্তুত মনোয়ারা।
‘স্যার, …।’
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো মনোয়ারা, আমার স্ত্রী থামিয়ে দিলো।
‘মেয়েকে সামলাও। বড়দের ব্যাপারে নাক গলাতে নিষেধ করবে।’
‘ম্যাডাম, ম্যাডাম শোনেন…।’
ব্যাকুল মনোয়ারা আবারও কিছু বলতে যাচ্ছিলো, কিন্তু আমার স্ত্রী যুক্ত করলো,
‘ম্যাডাম-ম্যাডাম করো না, এ বাসায় আসা তোমাদের কম দিন তো হলো না। সবকিছু বুঝে চলবে, বুঝে বলবে।’
আমার স্ত্রী হন্হন্ করে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো।
মনোয়ারা এবার আমার দিকে তাকালো।
আমি বললাম,
‘শোনো মনোয়ারা, আমি একটা সরকারি ডেলিগেটের সদস্য হয়ে কলকাতা যাচ্ছি, এটা তে তো খুশি হবারই কথা, তাই না? হ্যাঁ রুশি ছোট মেয়ে, ওর কথাকে আমি হিসেবের মধ্যে না আনলেও পারি। কিন্তু মেয়েটা এমনভাবে বললো!’
মনোয়ারা মাথা নিচু করলো। আমি দেখলাম ও পায়ের নখ দিয়ে মেঝে ঘষছে।
‘কিছু বলবে?’
আমি জিজ্ঞেস করতেই মুখ তুললো মনোয়ারা।
‘স্যার, আপনার যেতে ইচ্ছে করলে যাবেন, বাধা দেবার জন্য আমরা কে? কিন্তু-।’
‘কী কিন্তু?’
ঢোক গিললো মনোয়ারা।
‘রুশি যখন বলেছে তখন না গেলেও পারেন।’
‘কেন? রুশি বললে যাবো না কেন?’
রবিন এতোক্ষণ চুপ ছিলো। এবার সেও বললো,
‘বলো বুয়া, বাবা যাবে না কেন?’
‘সেটা তো আমি জানি না স্যার।’
মনোয়ারা ধীর পায়ে চলে গেলো একটা অদ্ভুত প্রশ্ন আমার সামনে ঝুলিয়ে দিয়ে।

১৩.
হৈ হৈ করতে করতে সন্ধ্যায় বাসায় এলো ‘তদবির মাস্টার’ কবি সাকলায়েন জাফর। খুব আমুদে এই কবি যে অসম্ভব প্রকৃতিপ্রেম বুকে পুষে রেখেছে তা ওর কবিতা না পড়লে বোঝা যায় না। শুরুর দিকে আল মাহমুদের কবিতার কিছুটা গ্রামীণ-লোকজ ভাব ওর মধ্যে থাকলেও অচিরেই সে ওটা থেকে বেরিয়ে আসে। এখন বয়স হয়েছে, কিন্তু কবিতা তৈরিতে প্রতিদিন ও তরুণ হয়ে জন্ম নেয়।
‘পরশু ফ্লাইট।’
‘পরশু?’
ড্রয়িংরুমে আমরা আড্ডায় বসি। আজ আমার আর লেখালেখি হবে না। কখন উঠবে ঐ-ই জানে। স্ত্রীকে একটু ভালোমন্দ রান্না করতে বলে দেই।
অনেক রাত অবধি গল্প করে বিদায় নেয় সাকলায়েন জাফর। ইন্ডিয়ার ভিসা লাগানো পাসপোর্টটা ব্যাগ থেকে বের করে দেয়। সঙ্গে হাত খরচের দুই হাজার ডলার। বিদায় নেয়ার আগে রুশির কথাটা আমি ওকে বলি। ও তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে বলে,
‘বাচ্চা মেয়েটাকে তুই মনে হয় খুব মায়া করিস। তুই দশ দিনের জন্য থাকবি না, তাই ও না করছে যেতে। ওসব মায়া-আদর তুলে রাখ, রেডি হয়ে নে।’
সাকলায়েন জাফর চলে যায়। আমি ওকে ওর গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি। কথা হয়, ও পরশু সকালে এসে ওর গাড়িতে আমাকে তুলে নিয়ে এয়ারপোর্টে যাবে।

১৪.
রুশি দুপুরে ভাত খায়নি। রাতেও না।
খবরটা আমার স্ত্রী আমাকে দিলো।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
‘কেন খায় নি?’
‘তা আমি কি জানি?’
আমার স্ত্রী প্রায় খেঁকিয়ে উঠলো। এরকম বহিঃপ্রকাশ আমি অনেকদিন পর দেখলাম।
‘তুমি বাড়ির ম্যাডাম, তুমি জানবে না?’
আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বললাম।
‘অত্তোটুকুন পুঁচকে মেয়ে, জেদ কম নয়।’ আমার স্ত্রী গজ্গজ্ করতে থাকলো।
আমি রবিনকে ডাকলাম।
‘যা তো বাবা, রুশি নাকি ভাত খায় নি, ওকে খাইয়ে দে’।
‘আমার কথা কি শুনবে?’
রবিন অসহায়ের মতো আমাকে বললো।
‘চেষ্টা র্ক, তোর ছাত্রী যখন, তখন শুনতেও পারে।’
অনেক রাত হয়েছে, এখন এসব নিয়ে বেশি কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।
রবিন চলে গেলো এবং দুই মিনিটের মাথায় আবার ফিরেও এলো।
‘না বাবা, খাবে না।’
‘কারণ জিজ্ঞেস করেছিলি?’
‘করেছিলাম। বললো, স্যার জানে।’
‘আমি জানি!’
আমার অবাক হবার পালা। আমি কিভাবে জানবো ওর ভাত না খাবার কারণ?
এবার মনোয়ারাকে ডাকি।
ও দরোজার বাইরে দাঁড়ায়।
‘আমাকে ডেকেছেন স্যার?’
‘হ্যাঁ, শুনলাম রুশি নাকি দুপুরে ভাত খায়নি। এখনও না খেয়ে শুয়ে পড়েছে?’
‘জি স্যার।’
‘তুমি খাওয়াতে চেষ্টা করো নি?’
‘অনেক করেছি। কিন্তু আমি জানি, ও খাবে না।’
‘তুমি জানো?’
‘জি জানি। কিন্তু আপনি জিজ্ঞেস করলে আমি বলতে পারবো না।’
আবার সেই রহস্যময় কথা!
আমি বিরক্ত হয়ে নিজেই রুশির বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়াই।
‘রুশি?’
‘জি স্যার।’
খুব অস্ফুটস্বরে জবাব দেয় ও। নিশ্চয়ই ক্ষুধায় নেতিয়ে পড়েছে।
‘ভাত খাবি না?’
রুশি কোনো জবাব দেয় না।
‘আমি জিজ্ঞেস করছি, ভাত খাবি না?’
এবার একটু রুঢ় কণ্ঠস্বর আমার ।
‘না স্যার।’
‘কেন?’
‘আপনি কলিকাতা যাওয়া বাদ দিলে আমি ভাত খাবো।’
‘কী সব আবোল-তাবোল বলছিস? আমার কলকাতা যাবার সঙ্গে তোর ভাত খাওয়া না-খাওয়ার সম্পর্ক কি?’
আমার পেছনে আমার স্ত্রী, তার পেছনে মনোয়ারা।
রবিন ওর ঘরে চলে গেছে।
আমি পেছন ফিরে আমার স্ত্রীর দিকে তাকাই।
‘আচ্ছা ওটা কালকে ঠিক করবো, এখন তুই ভাত খেয়ে নে।’
রুশি নড়ে না, আমার কথায় ওর কোনো ভাবান্তর হয় না।
‘তোর জন্য কালকে একটা গল্প লিখবো। তুই পড়ে খুব মজা পাবি। ওঠ্ এখন, ভাত খেয়ে নে।’
আমি পরিবেশটাকে হালকা করার চেষ্টা করি।
‘তুই বললে কাল বিকেলে তোকে শিশুপার্কে নিয়ে যাবো।’
মনোয়ারা মিন্মিনে গলায় কিছু একটা বলতে চেয়েছিলো, আমার স্ত্রী ওকে থামিয়ে দেয়।
‘থামো মনোয়ারা, ছোট বাচ্চাদের অতো লাই দিতে নেই।’
‘আহা-হা, কী সব কথা বলছো?’
আমার স্ত্রীর কথায় আমি বিরক্ত হই।
‘ওরা বাচ্চা মানুষ, অনেক কিছু বোঝে না। ওদের বোঝাতে হয়, গাল-মন্দ করলে ওরা আরো …. না থাক্। ওঠ্ রুশি, ভাত খেয়ে নে।’
মধ্যরাতের এতো কথাবার্তার পরও রুশি নাছোড়বান্দা। ভাত খেলোই না মেয়েটা।

১৫.
প্রতিদিনের মতো সকালে উঠে নাশতা খেয়ে লেখার টেবিলে বসেছি। একটা গল্প কয়েকদিন ধরে মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। ওটা শুরু করবো, কলকাতায় সময় পেলে লিখে শেষ করে ফেলবো। যদিও ওখানে সময় বের করা কষ্টকর হবে। তবুও শুরুটা ঢাকায় করতে চাই। আমার স্ত্রী চা রেখে গেছে টেবিলে, লেখায় মগ্ন ছিলাম তাই কথাবার্তা বলেনি। চায়ে চুমুক দিলাম। বেশ সুস্বাদু চা। এই চা-পাতা আমার এক লেখক-সাগরেদ দার্জিলিং থেকে এনে আমাকে উপহার দিয়েছিলো। দুটো উপহার নিতে আমি কার্পণ্য করি না। এক হলো কলম, দুই চা-পাতা। এ দুটো জিনিসের প্রতি আমার আজন্ম লোভ। পত্র-পত্রিকার ইন্টারভিউর সুবাদে এটা সবাই জানে। ফলে কেউ আমাকে গিফ্ট দিলে ও দুটো জিনিসই নিয়ে আসে। রান্নাঘরের দিকে আমি সাধারণত যাই না, আমার স্ত্রী বলে, বিদেশি চা-পাতায় একটা ক্যাবিনেট সম্পূর্ণ ভরে গেছে। দ্বিতীয়বার চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে খেয়াল হলো, টেবিলে আমার পাসপোর্টটা নেই। তার ভেতর দু’হাজার ডলারও ছিলো। তদবির মাস্টার রাতে ওটা দিয়ে যাবার পর আমি টেবিলেই রেখেছিলাম, আমার স্পষ্ট মনে আছে। বইপত্র সরালাম, কাগজ সরালাম, টেবিলের ওপাশে পড়ে গেছে কিনা তাও খুঁজে দেখলাম। টেবিলের দুটো ড্রয়ার টেনে তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। না, কোথাও নেই।
আমি কি তাহলে ওটা আলমারিতে তুলে রেখেছিলাম? আলমারি খুলে দেখলাম। আলমারিতে নেই। আমার বারবার মনে হলো, না, ওগুলো আমি টেবিলেই রেখেছিলাম। আমার স্ত্রী কি তাহলে ওসব সরিয়ে অন্য কোথাও যত্ন করে রেখেছে? ওর কথাই ভাবছিলাম, ও এসে ঘরে ঢুকলো।
‘কী খুঁজছো?’
‘পাসপোর্ট আর ডলারগুলো।’
‘টেবিলেই তো রাখলে রাতে।’
‘তুমি কি সরিয়ে রেখেছো?’
‘তোমার ওসব আমি ধরতে যাবো কোন্ দুঃখে?’
আমার স্ত্রীর কপট অভিমান আমার চোখ এড়ালো না।
‘দুঃখে ধরবে কেন, খুশিতে ধরবে।’ আমি মুখে হাসি টেনে আনার চেষ্টা করলাম।
‘না মানে, খুঁজে পাচ্ছি না তো, তাই মনে করলাম তুমি হয়তো সরিয়ে রেখেছো।’
‘না, আমি ধরি নি।’
‘রুশি কি এ ঘরে এসেছিলো?
‘না। ওতো বিছানাতেই পড়ে আছে।’
‘এখনও ওঠে নি?’
আমি একটু বিস্মিতই হলাম।
‘না। মনোয়ারা কয়েকবার ডাকাডাকি করেছে। উঠছে না।’
এই অবস্থায় আমার লেখালেখি গোল্লায় গেলো। আমার ঘর, ড্রয়িং রুম, রবিনের ঘর, ফ্যামিলি রুম, এমনকি বাথরুমেও তন্ন তন্ন করে খোঁজা হলো। কোথাও নেই আমার পাসপোর্ট।
আমার স্ত্রী শেষতক রুশিকে গিয়েও একবার জিজ্ঞেস করে এলো আমার পাসপোর্ট ও দেখেছে কিনা। রুশি কোনো জবাব দেয় নি।
আমার যাওয়াটা কি তাহলে অসম্ভব হয়ে গেলো?
সাকলায়েন জাফরকে ফোন করলাম।
‘কবি, তুমি কি যাবার সময় পাসপোর্ট এবং ডলার আমার হাতে দিয়েছিলে?’
‘হ্যাঁ, দিয়েই তো এলাম। কেন, কী হয়েছে?’
‘খুঁজে পাচ্ছি না। রাতে, মনে আছে, আমার টেবিলেই রেখেছিলাম, সকালে উঠে দেখছি উধাও।’
‘রাইটার, তোমার পাসপোর্টের ডানা গজিয়েছে বোধ হয়। উড়ে গেছে।’
‘না-না, তুমি বিশ্বাস করো, সারা বাড়ি তছনছ করেছি, কিন্তু ওটার হদিস নেই, ডলারগুলোও নেই।’
‘তাজ্জব ব্যাপার! কাজের মানুষকে ইন্টারোগেট করো।’
কবি যা বললো তা সব বাসাতেই করে। কোনো কিছু হারানো গেলে প্রথম সন্দেহটা গিয়ে পড়ে কাজের মানুষদের ওপর। কিন্তু মনোয়ারাকে গত কয়েক মাসে আমরা যেভাবে দেখছি তাতে ওকে সন্দেহ করা রীতিমতো অপরাধ হয়ে যাবে। আমি জিজ্ঞেসই করতে পারবো না।
‘না কবি, তা হয়নি। আমার কাজের মানুষটা অমন না।’
আমি বেশ দৃঢ়স্বরেই বললাম।
‘তাহলে তো তোমার যাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়লো রাইটার।’
কবি সাকলায়েন জাফর বেশ দুঃখ দুঃখ গলায় বললো।
‘দেখি কী করা যায়’ বলে আমি ফোন রেখে দিলাম।
এখন থানায় জিডি করে নতুন পাসপোর্ট করা এবং ভিসা নেয়া দুঃসাধ্য কাজ। আমি কলকাতা সফর মাথা থেকে নামিয়ে রাখলাম। এই মানসিক অবস্থায় লেখালেখিও করা যায় না। টেবিলে বসলে কলম এগুবে না। আমি মাথাটাকে একটু হালকা করার জন্য জামাকাপড় পরে বাসা থেকে বেরিয়ে যাই।

১৬.
সন্ধ্যার পর বাসায় ফিরে আসি।
লেখার টেবিলে বসতেই আমার স্ত্রী জানতে চায়,
‘ব্যবস্থা কিছু হলো?’
‘কিসের?’
‘কলকাতা যাবার?’
‘না, আমি তো ও কাজে বের হইনি। যাওয়া বাতিল। কাল সকালে থানায় জিডি করবো পাসপোর্টের ব্যাপারে।’
রুশিকে নিয়ে কোনো কথা হয় না আমাদের। আমি জানতেও চাই না কিছু।
আমার স্ত্রী বোধ হয় জানায় রুশিকে যে আমি যাওয়া বাতিল করেছি। রুশি মনে হয় খুশিই হয়। রাতে ও ভাত খায়, মনোয়ারা সেটা জানিয়ে দেয় আমার স্ত্রীকে।
অনেক রাত তখন। আমি গতকালের শুরু করা উপন্যাসটা লিখতে বসেছি আবার। সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে।
আমার দরোজায় টুক্টুক্ করে টোকা পড়লো।
এতো রাতে দরোজায় কে? তাও আবার টোকা দিচ্ছে?
আমার বাসায় সাধারণত কেউ টোকা দিয়ে ঘরে ঢোকে না, প্রয়োজনও পড়ে না।
আমি বললাম,
‘কে?’
‘আমি রুশি।’
পর্দার ফাঁক দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিলো ও।
বললাম,
‘ভেতরে আয়।’
মেয়েটা গুটিগুটি পায়ে ভেতরে এলো। আমি কলম-কাগজ একপাশে সরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,
‘কিরে, এতো রাতে আমার কাছে?’
রুশি খুব নিচুস্বরে বললো,
‘তুমি কলিকাতা যাচ্ছো না তাই আমি অনেক খুশি।’
আমি ব্যাখ্যা করে বললাম,
‘যাচ্ছি না নয়, যেতে পারছি না।’
‘ও, আচ্ছা।’
আমাকে আর কিছু না বলে আবার বেরিয়ে গেলো ও। আমি মেয়েটার এমন আচরণে সত্যি অবাক হয়ে গেলাম।

১৭.
অনেক রাত করে ঘুমিয়েছিলাম, তাই বেলা হয়ে যাবার পরও ঘুমটা ভাঙেনি। ঘুম ভাঙলো মোবাইল ফোনের মধুর রিং টোনে। বিছানায় শুয়েই হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিয়ে কানের কাছে ধরলাম।
‘হ্যালো, কে?’
‘স্যার, আমি ইমরান আহমেদ।’
ইমরান আহমেদ কবি। বয়সে আমাদের চেয়ে অনেক ছোট, কিন্তু খুব ভালো কবিতা লেখে। কলকাতা সফরের সেও একজন ডেলিগেট।
‘কী ব্যাপার ইমরান? আপনারা এয়ারপোর্টে? আমি তো ভাই যেতে পারছি না।’
‘না স্যার, বিষয় সেটা নয়।’
খুবই উদ্বেগভরা কণ্ঠ ইমরানের।
আমি ততক্ষণে বিছানায় উঠে বসেছি।
‘কী হয়েছে?’
‘স্যার, কবি সাকলায়েন ভাই এয়ারপোর্টে আসার পথে অ্যাক্সিডেন্ট করেছেন। ড্রাইভার ডেড। সাকলায়েন ভাই সিরিয়াসলি ইনজির্উড। তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। বিষয়টা আপনাকে জানালাম। আমরা এখন হাসপাতালে।’
ফোনটা কেটে দিলো ইমরান।
আমি হতভম্বের মতো বসে থাকলাম।
ঐ গাড়িতে তো আমারও যাবার কথা ছিলো এয়ারপোর্টে!
সারাদিন হাসপাতালে কাটানোর পর সন্ধ্যায় ফিরে এলাম বাসায়। বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত আমি। সাকলায়েন জাফর মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে। আমার স্ত্রী আমার দিকে তাকিয়ে বিপদ আঁচ করতে পেরে কিছু বললো না। আমি হাত-মুখ ধুয়ে বিছানায় বসলাম। মনোয়ারা এক কাপ চা রেখে গেলো টেবিলে। ক্লান্তি আর অবসাদে শরীর ভেঙে পড়ছিলো আমার। চা-টা খেলে হয়তো ভালো লাগবে। কাপটা ঠোঁটের কাছে তুলতেই রুশি এসে ঢুকলো আমার রুমে। তারপর জামার নিচ থেকে আমার পাসপোর্ট আর ডলারগুলো বের করে আমার সামনে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললো,
‘এই নাও তোমার পাসপোর্ট।’
আমি তো অবাক।
‘কোথায় ছিলো?’
‘আমি পরশু রাতে চুপ করে নিয়ে গিয়ে রেখে দিয়েছিলাম। আমি জানি, এটা না হলে বিদেশ যাওয়া যায় না।’
রুশি খুব উজ্জ্বল মুখে চোখ তুলে আমার দিকে তাকালো।
আমি শুধু মনে মনে বললাম- আল্লাহ আমাকে এভাবেই রক্ষা করলেন! হ

Share.

মন্তব্য করুন