পর্ব ৬

ইজান তখনো দাদুর কোলে ও-ও-ও-ও করছে, আর মুখে আঙ্গুল পুরছে।
শাহান নানুর কাছ ঘেষে দাঁড়ায়। নানু ইজানের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছেন, আর বলছেন, কি খাবে দাদু ভাই, তোমার জন্য পায়েস করে রেখেছি। খুব মজা হয়েছে। শাহান নানুর আরেকটু কাছে এসে বলে না-নু। ওর কন্ঠে অভিমানের সুর। নানু বুঝতে পারেন ওকে আদর করা হয়নি। ও ভাবছে সব আদর ইজানকে দিয়ে ফেলেছেন নানু। নানু শাহানকে ডান হাতে কোলে টেনে নেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, নানা ভাই তুমি ফিন্নি খাবে?
শাহান মাথা নাড়ে বলে, ‘না এখন খাব না। আজ তুমি তো বল্লে বিরিয়ানী রাঁধবে, চিকেন বিরিয়ানী। ইজান দাদুর কোল থেকে গলিয়ে নিচে নেমে যায়, বলে, দাদু আমিও খাব কিচেন বিরিয়ানী।’
শাহান হেসে ফেলে বলে, ‘নানু ইজান কিচেন বিরিয়ানী খাবে। শুনেছ ও চিকেন বিরিয়ানীকে কি বল্লো?’ ইজান আবার বলে, ‘কিচেন বিরিয়ানী তাই না শাহান ভাইয়া! দাদু বলেন, ‘হ্যাঁ তাই ভাইয়া। কিচেনে রান্না হবে তো অসুবিধা নাই, তাই হবে।’
সুহা দরজার আড়ালেই ছিল, ও ছুটে এসে ইজানকে কোলে তুলে নেয়, হ্যাঁ ভাইয়া আজ আমরা কিচেন বিরিয়ানী খাব বলে একটা হাসি ঝেড়ে ফেলে। শাহান শুধরে দেয়, ‘সুহাপু তুমিও…’
সুহা বলে, ‘ও বড় হলে ঠিকই বলতে পারবে। আজ নানু রান্না করবে। বাবা কাল এক হালি মুরগি এনেছেন, দারুন হবে তাই না নানু?’
‘আজ রান্না করবে তোমার আম্মু! নানুর মুখে হাসি দেখে সুহা আপত্তি তোলে, তোমার হাতের মজার মজার রান্না…’
‘কেন আমার মেয়ের হাতের রান্না পছন্দ হয় না। এত দিনতো খেয়ে এসেছো!’
‘তাই বলেছি বুঝি? নানু আমরা আবার চলে গেলে তখন কাকে খাওয়াবে?’
‘আহ্হারে নাতিনের আবদার, বলে কথা।’ নানু সুহার চিবুক ঠেনে দেন।
সুহার আম্মু মুরগির মাংস টক দইয়ে ভিজিয়ে সুহাকে ডাকে, ‘এসো আজ তুমি আর আমি রান্না করবো।’
‘আমি!’ বলে সুহা চোখ ছানাবড়া করে বলে। ‘এটা কি জোলাভাতি মামনি?’
ধরে নাও বড় পাতিলের আসল আসল জোলাভাতি। তোমারওতো তরকারি কাটাকুটি শিখতে হবে, রান্না-বান্না এসব। তোমরাইতো বলো রান্না-বান্না একটা আর্ট, একটা শিল্প।’ নানু এসব বলে হাসতে হাসতে পানের খিলি মুখে দেন। সুহা অবাক হয়ে বলে, না-নু! তুমিতো সবই জান দেখি। তোমার স্বামী মানে আমাদের নানাতো জ্ঞানের সাগর।
‘না না বলো, মহাসাগর। সারাজীবন মাস্টারি করেছেন, তবে হ্যাঁ অনেক কিছু জানার চেষ্টা করেন, এখনো দিনে দুই ঘণ্টা পড়া-শুনা না করলে ওনার চা নাকি হজম হয় না।’ নানু হেসে ফেলেন, পানমুখো লাল হাসি। সুহা এবার হি হি করে হেসে ফেলে, বলে তোমার লাল হাসিটা সত্যিই মজার। তুমি বল্লে, ডেইলি দুই ঘণ্টা পড়াশুনা না করলে নানার চা হজম হয় না। তাই না? তাহলে চা খাওয়া বন্ধ করে দাও-
‘হ্যাঁ দিয়েছিলাম একবার।’ পরদিন পেট ফুলিয়ে বলে, ‘চা না খেলে নাকি ভাত হজম হয় না।’
এবার নানিও হি হি করে হাসতে গিয়ে মুখের পান সুপারি অর্ধেক ছিটিয়ে পড়ে সুহার গায়ে। নানু খুব দ্রুত সুহার জামা থেকে পান সুপারি ঝেড়ে ফেলেন। এদিক ওদিক তাকিয়ে বলেন, জলদি জামাটা খুলে দাও কেঁচে দেই। তোমার আম্মু এমনিতেই আমার পান খাওয়া পছন্দ করে না।’ সুহা ইচ্ছে করেই মা-মা-আম্মু-আম্মু-ডাকতে থাকে। নানি ওর মুখে বাঁ হাতে চেপে ধরে বলেন, ‘চুপ। তোমার মা এখন কিচেন বিরিয়ানী রাঁধছে। ডাকাডাকি করলে মরিচ-লবণ বেশি পড়ে যাবে। তখন দোষটা পড়বে তোমার।’
এবার সুহা না হেসে পারে না। বলে ঠিক আছে মাফ করলাম, আমাকে চিকেনের রান দুইটা দিতে হবে।
ইজান আর শাহান দাদার কোল বেয়ে পাড়া মাতিয়ে আসে। নানা সুহাকে ডেকে বলেন, চলো আমরা সবাই পুকুর ঘাটে ভিটামিন ডি খাব। সুহা বলে, ‘ইয়েস নানা পুকুর পাড়ের সূর্যালো বড়ই মিষ্টি এবং দানাদার’ সুস্বাদু শাহান খিক্ খিক্ করে হেসে বলে ‘চল চল।’
নানা বল্লেন, ‘ওখানে আরেকটু মজা হবে আজ’। সুহা জানতে চায়, ‘নানা বলো না কি মজা হবে! ও বুঝেছি তুমিতো বলবে, গেলেই দেখতে পাবে।’
ওরা পুকুর ঘাটে, আসতেই দেখে বাড়ির ছোট-ছোট ছেলে-মেয়েরা কেউ কেউ লুঙ্গি, গামছা, হাফ প্যান্ট পরে লাফালাফি করছে, সুহা বুঝতে পারে ওরা গা গরম করছে পুকুরে সাঁতার কাটার জন্য।
নানা ওদের হাতে একটা একটা করে খেজুর দিয়ে বলেন, ‘বলতো আমরা দৈনিক কতবার শ্বাস গ্রহণ করি? ওরা সমস্বরে জবাব দেয় পঁচিশ হাজার বার।’
নানা আবার প্রশ্ন করেন ‘আমাদের কোন অঙ্গ বিরামহীন কাজ করে?’
ওরা সমস্বয়ে জবাব দেয়-হৃদপিণ্ড।
‘হৃদপিণ্ড বন্ধ মানে জীবন শেষ। রক্ত সঞ্চালন করে হৃদপিণ্ড। শ্বাসের মাধ্যমে আমরা অক্সিজেন ফুসফুসে ধারণ করি, ফুসফুস সে অক্সিজেন দিয়ে রক্ত শোধন করে সারা শরীরে প্রবাহিত করে হৃদপিণ্ডের সহায়তায়। তাই…
ব্যয়ামটা জরুরি। এবার বলতো সবচেয়ে ভালো ব্যয়াম কোনটি?’ নানার প্রশ্নের জবাব ওদের ঠোটস্থ।
ওরা সমম্বরে জবাব দেয় সাঁতার। এবার সুহার দিকে তাকিয়ে নানা বলেন, ‘শহরে যারা থাকে তারা এ সুযোগ পায় না তবে সাইকেল চালানোটাও ভালো ব্যয়াম। এবার বল আজ এখানে কি হবে? ওরা লাফাতে লাফাতে বলে, ‘সাঁতার প্রতিযোগিতা।’
‘কি পুরস্কার দেয়া হবে?’ বলেই সবাই হাসি ছড়িয়ে দেয় আকাশে-বাতাসে। এরিমধ্যে কালু একটা পাতিহাঁস কোলে নিয়ে পুকুর পাড়ে হাজির হয়। হাঁসটি কাত কাত কাত করে নিজের সরব উপস্থিত জানান দেয়। হাঁসটির গলায় কাগুজে ফুলের মালা পাখনা, পা, আলতা দিয়ে রাঙিয়ে এনেছে কালু।
শাহান বলে, ‘আমিও সাঁতার কাটবো।’
নানা বলেন, ‘সুহা রেডিতো?’
সুহা মন খারাপ করে বলে, ‘আমিতো মাত্র শিখছি। শুধু ঘাট পার হতে পারি, শাহানও তাই।’
নানা বলেন, ‘অংশগ্রহণটা জরুরি। প্রতিযোগিতায় তোমরাও অংশ নিবে। কালু আর ফরহাদ তোমাদের সাথে থাকবে।’
নানার হাততালির সাথে সাঁতার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। ন’জন ক্ষুদে সাঁতারু লাফিয়ে পড়ে পানিতে। মাহমুদ আর ফরিদ পুকুরের দক্ষিণ পাড়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করে। শেষমেশ তুমুল প্রতিযোগিতার মধ্যে প্রথম সাঁতারুকে কাঁধে করে নিয়ে আসে ফরিদ।
সুহা আর শাহান তিনবার সিঁড়ি সাঁতারে আবার ফিরে আসে। ইজান দাদার কোলে বসে হাততালি দিতে থাকে। প্রথম বিজয়ী মাওয়ার হাতে নানা তুলে দেন হাঁসটি। হাঁসটি কাত কাত করে মাওয়ার হাত থেকে ছুটে পানিতে সাঁতরাতে থাকে। বাড়ির ছেলে-মেয়েরা আবার হৈ হৈ করে পানিতে নেমে পড়ে হাঁসটিকে ধরার জন্য।
সুহা আর শাহান ঘরে ফিরে আসে ভেজা কাপড়ে। ঠক্ ঠক্ কাঁপতে কাঁপতে সুহা বলে, ‘নানু নানু ডবল ডবল চিকেন বিরিয়ানী দিতে হবে আজ।’ শাহানও যোগ দেয় তার সাথে, ‘আমারও ডবল।’ ইজান দাদার কোল থেকে বলে, ‘দাদু-দাদু আমারও কিচেন বিরিয়ানী দাও।’

৬.
সকালে ঘুম থেকে জেগে ঘরের বাইরে এসে সুহা দেখে একি আয়োজন! ফরিদ উঠানে শীতল পাটি বিছিয়ে একোণ ওকোণ টেনে সমান করছে। নানাও হাত লাগিয়ে বলছেন, ‘ফরিদ জোড়া মিলে নাই, টেনে দে আরেকটু। ওখানে রোদ লাগবে। শেষ পৌষের মজার শীত-রোদের সাথে শীত পিঠার আয়োজনে ব্যস্ত সুহার নানি। ক’দিন আগে সুহা আর শাহান নানা বাড়ি এসেছে মা-বাবার সাথে।
নানা মসজিদে ফজর নামাজ সেরে হাঁটাহাঁটি করে ফিরেছেন একটু আগে। সুহাকে এগিয়ে আসতে দেখে বল্লেন, ‘শাহান কি ওঠেনি? আজ সকালের নাশ্তা আমরা সূর্যালোকের ভিটামিন ডি’র মিষ্টান্ন মাখিয়ে খাব। শাহান দরজার আড়াল থেকে কি মজা, কি মজা বলে বেরিয়ে আসে।’ সুহাও ফিক্ ফিক্ করে হেসে ওঠে। ওর ভেতরও আনন্দ পুলকিত হচ্ছে আয়োজন দেখে।
শাহানকে আদর করে নানা বলেন, ‘আজ আমরা মজার মজার পাটিসাপ্টা পিঠা শীতল পাটিতে বসে খাব।’ নানার কথা বলার অঙ্গভঙ্গি দেখে শাহান লাফাতে থাকে- ‘মজা মজা’ বলে।
সুহা ঢাকার বনশ্রী আইডলে ক্লাস ফাইবে পড়ে, শাহান আগামী বছর স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বাবা অফিসে গেলে ভাই-বোনের মা’র মোবাইল নিয়ে কাড়াকাড়ি। কেউ গেমস্ খেলে কেউ নানান লাইক নিয়ে ব্যস্ত হয়। এদের কাড়াকাড়িতে মা’র তিনটে মোবাইল এরি মধ্যে ভেঙে গিয়েছে। এবারের স্কুল ছুটিতে মা’র ইচ্ছেতেই বাবা রাজি হয়ে যায় গ্রামে বোড়াতে যাবে।
রান্না ঘরে সুহার নানু পাটিসাপ্টা পিঠা বানাচ্ছেন। পিঠার মৌ মৌ গন্ধে ঘরে-বাইরে বাতাস ভরপুর। সুহার আব্বু দ্রুত এসে শীতল পাটিতে জায়গা করে নেন। পকেট থেকে লুকিয়ে মোবাইলটা বের করে সময় দেখে ভাবেন বেশ আগেই আজ নাশ্তা হবে। মোবাইলটা দ্রুত পকেটে গুঁজে লক্ষ্য করেন শাহানের চোখ পড়লো কিনা!
না, শাহান আজ ব্যস্ত। মা’র হাতের প্লেটটা টেনে নিজেই বসে পড়ে বাবার পাশে।
মা বড় থালায় অনেকগুলো পার্টিসাপ্টা পিঠা এনে পাটির মাঝখানে রাখেন। নানা বলেন, ‘বাহ্ বাহ্। নাকটেনে লম্বা দম নিয়ে হাসতে হাসতে বলেন, ‘আজ মনে হয় সবগুলোই আমি খাব।’
সুহা নাক টেনে বলে, ‘আর আমরা হাওয়া খাব। ‘নানা বলেন, ‘সুহা সূর্যের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বস্ তোমরা খাবে ভিটামিন ডি। থাকতো শহরে দালানের ভেতর দালান। সূর্যের আলো দেখতেও পাওনা খেতেও পাওনা। এবার জোরে হাঁক মেরে বলেন, ‘কই তোমরা সবাই আস। আজ এক সাথে সবাই মিলে খাব।’
শাহান প্রশ্ন করে, ‘এক সাথে কেন?’
‘এক সাথে, হ্যাঁ এক সাথে বসলে, খেলে নিজেদের মধ্যে দূরত্ব কমে যায়। আল্লাহর রহমত হয়, খাবারে বরকত হয়।
‘নানা নানা, আল্লাহর রহমত কি!’
‘আল্লাহর করুণা, আল্লাহর দয়া। আল্লাহর রহমত ছাড়া আমরা কোনো ভালো কাজ করতে পারি না- তাই না?’ সুহার আব্বু এরি মধ্যে গরম গরম পাটিসাপ্টা পিঠা ধুঁয়া উড়িয়ে মুখে হু হা করে খাচ্ছেন। দেখাদেখি সুহাও খেতে থাকে মজা করে।
নানা উচ্চস্বরে ডাকেন, ‘কহিনুর তোমার মাকে নিয়ে এসো।’
শাহান দেখে উঠানের দক্ষিণ কোনে দু’টি শালিক হাঁটাহাঁটি করছে। ওদের হেলে-দুলে হাঁটার মধ্যে কেমন রাজকীয় ভাব। ও খুব মনোযোগ দিয়ে ওদের হাঁটাহাঁটি লক্ষ্য করছে। শীত সকালের রোদের মিষ্টি তেজ ওরা খুব উপভোগ করে। নানুকে প্রায় জোর করে এনে সুহার আম্মু শীতল পাটিতে বসিয়ে দেয়। মেয়েজামাইর সামনে বসতে কেমন যেন অস্বস্তি বোধ করেন তিনি। নানা হাসতে হাসতে বলেন, ‘তুমিতো নেপথ্যের নায়িকা আজ সামনেই বসে পড়; আমরা আমরাই তো।’ মেয়েজামাইর পাত খালি দেখে সুহার নানু বলেন, ‘তোমার প্লেট খালি কেন?’
‘না মা, আজ অনেক খেয়েছি। দারুণ হয়েছে। শুকর আলহামদুল্লিলাহ্।’
নানা মেয়ে জামাইয়ে উঠার লক্ষণ বুঝে বলেন, ‘বসো আজ চা এখানেই খাব। শীতের রোদের সাথে ধোঁয়া ওড়ানো চা দারুণ মজাদার।’
শাহান এতোক্ষণ ধরে শালিক দুটোর হাঁটাহাঁটি দেখছিল। এবার নানাকে প্রশ্ন করে, ‘নানা ওরা কি পিঠা খায়?’
‘না না, ওরা খায় পোকা-মাকড়।’ উঠানের কোণে আমড়া গাছে দু’টি দোয়েল উড়ে এসে বসে। নানা আমড়া গাছের ডালের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘দেখেছ জাতীয় পাখি দোয়েলও এসেছে তোমাদের দেখতে। কয়েকটি চুড়–ই পাখি শাহানের মাথার ওপর আম গাছের ডালে বসে কিচির মিচির শুরু করে দিয়েছে। শাহান সে দিকে তাকিয়ে বলে নানা ওরাও? ’
‘হ্যাঁ, তোমাদের নতুন দেখেছে কিনা? জান, নানা ভাই, পাখ-পাখালি আমাদের প্রকৃতির অলংকার। এ ছাড়াও ওরা যদি পোকা-মাকড় না খেত আমরা সুস্বাদু ফলফলাদি, ধান অনেকটাই পেতাম না। পোকা-মাকড় ওসব খেয়ে নষ্ট করে দিত।’ শাহানের নজর শালিক দু’টোর হেলেদুলে হাঁটার দিকে। ও খাবার ছেড়ে ওদের মতো হেলেদুলে হাঁটতে গেলে ওরা উড়ে চলে যায়।
নানু চামচ দিয়ে পিঠা খেতে গেলে পিঠার টুকরাটা নিচে পড়ে যায়। শাহান হো হো করে হেসে উঠতেই নানা বলেন, ‘তোমার নানুর ইয়া বড় একটা চামচ দরকার, ঐ যে রান্না ঘরের বড় বড় চামচ’। এবার শাহান সুহা দু’জনেই হেসে উঠে। নানী মুখে আঁচল চেপে কৃত্তিম রাগ দেখিয়ে বলেন, হ্যা, হয়েছে।’
সুহা ছড়া বানায়
‘পাটিতে বসে পাটিসাপটা
নানুর মুখে আঁচল ঝাপ্টা।’
নানু বলেন, দারুণ হয়েছে তোমার ছড়া। বড় হলে তুমি কবি হবে। কবিদের আমার খুব পছন্দ-
‘কেন নানু?’
‘কবিরা এতটুকুন ঘটনাকে রাঙিয়ে বড় করে ফাটিয়ে দেয়।’ নানার দিকে তাকিয়েই নানু কথাটা ঝেড়ে উঠে দাঁড়ান।
এবার সবাই মিলে একতালে হেসে ওঠে। বাড়ির দু’টো কুকুর অনেকক্ষণ যাবত উঠানের শেষ কোণে শুয়েছিল। ওদের হাসিতে কুকুর দু’টো ঘেউ ঘেউ করে তাদের অবস্থান জানিয়ে দেয়। নানা একটা পাটিসাপটা পিঠা দু’ভাগ করে ওদের দিকে ছুড়ে দেয় ওরা লাফিয়ে উঠে খপ করে পিঠার টুকরা মুখে পুরে নেয়। মজা পেয়ে শাহানও ওদের দিকে দু’টুকরা পিঠা ছুড়ে দেয়।
নানা এবার উঠে গায়ের চাদর ঝাড়া দিয়ে ফরিদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘ফরিদ তাড়াতাড়ি খেয়েনে। পশ্চিমের পুকুরে জেলেরা আজ জাল ফেলবে জানিস্ তো।’
ফরিদ পিঠায় শেষ কামড় বসিয়ে বলে, ‘এতোক্ষণে নিশ্চয় জেলেরা এসে গেছে দাদু। আমি যাই…’ সুহার নানা বলেন, ‘সে কিরে! আমরাও যাব। সুহা-শাহান তৈরিতো-’
‘দু’জনেই সমস্বরে চিৎকার করে বলে ইয়েস নানা।’ ‘সুহার আম্মুর মোবাইল ফোন বেজে ওঠে। ফোনের শব্দ আড়াল করে দ্রুত ছুটে যায় ঘরের ভেতর। পাছে মোবাইলে শব্দ পেয়ে ওরা যদি আবার মোবাইলের জন্য ছুটে আসে। একটু পরেই উঠানে মায়ের মুখোমুখি হয়। মা বলেন, কিরে তোরা নাকি কাল চলে যাবি ঢাকায়? ’
‘তোমার জামাইতো তাই বল্লো।’
মা বল্লেন, ‘আরো ক’দিন থেকে যা, ওদের স্কুল খুলতে তো দেরি আছে-’
পুকুর পাড়ের দিকে ছুটতে ছুটতে নানার গলার আওয়াজ শোনা যায়। ফরিদ তুই তাড়াতাড়ি যা, আজ পুকুরে বড় কাতল মাছটা বলবি আমার নাতিন-নাতির জন্য।’
সুহা ছুটতে ছুটতে বলে, ‘নানা আগে বলনি কেন? আমরা আরো আগে পুকুর পাড়ে যেতাম। টানা জালে মাছের লাফালাফি দেখতে দারুণ। শাহানও যোগ করে হ্যাঁ দারুণ।’
সুহার আব্বু পায়জামা পাঞ্চাবি পরে ঘরের বাইরে এসে দাঁড়ায়। পাঞ্চাবির শেষ বোতামটা লাগাতে লাগাতে বলে ‘ভাবছিলাম বাজারে যাব-’
সুহার আম্মু কথা কেড়ে নিয়ে বলেন, ‘আর যেতে হবে না। পশ্চিম পুকুরে জাল ফেলেছে। বাবা বড় মাছের মুড়োটাই আজ জামাই বাবাজিকে খাওয়াবেন।’ সুহার নানি আঁচলে মুখ ঢেকে হাসেন।
সুহার আব্বু বলেন, ‘তা হলে আমিও সে দিকে যাচ্ছি।’
সুহার নানি মন খারাপ করে বলেন, ‘আমি বলি কি জামাই বাবাজিকে বল ছুটি এক সপ্তাহ বাড়িয়ে নিতে। আর কবে আসবি না আসবি। তোর বাবাকে দেখেছিস্ নাতিন-নাতি নিয়ে সারাক্ষণ কিভাবে মেতে আছে। ওদের গাছ-গাছালি দেখায় পাখ-পাখালি চিনায়। কলার ছড়ি কেটে আনে ওদের নিয়ে। এ বাড়ি ও বাড়ি যায় ওদের পরিচয় করিয়ে দেয় গর্ব করে। ওরাও তো খুব খুশি।’
সুহার আম্মু মায়ের ঘাড়ে মাথা রেখে বলেন, ‘মা, মাগো আমি যে এ ক’টাদিন কত শান্তিতে আছি তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না।’
‘কিরে মা কি হয়েছে?’
সুহার আম্মুর চোখে পানি ছলছল করছে। ‘গত ক’দিনে ওরা কেউ একবারও আমার বা তার বাবার মোবাইল চায়নি; কাড়াকাড়ি করেনি। ওদের মারপিঠ করেও মোবাইল ছাড়া করতে পারি না। রাত-দিন ভাই-বোনের ঝগড়া। সুহা এখন খালি চোখে কিছুই পড়তে পারে না, ওর রেজাল্টও খারাপ হচ্ছে। শাহানও মোবাইল না পেলে এটা ওটা ভাঙচুর করে।’ অথচ, এ ক’দিন বাবার সাথে, তোমার সাথে কতই না আনন্দে মেতে আছে। আমার যে কতই না ভালো লাগছে।’ সুহার আম্মু আঁচলে চোখ মুছে নেয়।
সুহার নানু বলেন, ‘ওদের পৃথিবীটা তোমরা বড় করে দাও, ওদের শৈশব ফিরিয়ে দাও। সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে।’
[সমাপ্ত]

Share.

মন্তব্য করুন