বেড়াতে আমরা সবাই খুব পছন্দ করি- তাই না? কেউ বেড়াতে আসি, কেউ বেড়াতে যাই। আমরা সবাই কিন্তু এসেছি এই পৃথিবীতে বেড়াতে। কী হলো? ছোটরা এ কথায় আবার এর ওর দিকে কি তাকাতে শুরু করেছো? ভাবছো এ আবার কেমন কথা?
হ্যাঁ। এটাই চরম সত্য। পৃথিবীতে আমাদের এই বেড়িয়ে যাওয়ার নামই হলো জীবন।
তবে খুব মজার এবং সত্যিকারের বিষয়টি হলো আমরা কেউ এখানে ইচ্ছায় বেড়াতে আসি না। আবার স্বেচ্ছায় এখান থেকে চলেও যেতে পারি না। সবাই এখানে কিছুকালের জন্য অবস্থান করি মাত্র। একদিন বেড়ানোর পালা শেষ হয়। বেড়ানোর শেষে যার বা যাদের চলে যাবার- তারা নীরবে চলে যায়। যারা রয়ে যায় তাদের মন খারাপ করে।
আমাদের জন্ম নেয়াটা যেমন মহান স্রষ্টার ইচ্ছায় ঘটে- তেমনি আমাদের চলে যাওয়ার দিনক্ষণও স্রষ্টাই নির্বাচন করে দেন।
এই বেড়াতে আসার শুরুর দিনটাই হলো জন্মদিন। আমাদের প্রত্যেকের একটা জন্মদিন থাকে। শিশুদের কাছে তাদের জন্মদিন খুব বেশি প্রিয় হয়। কারণ বড়রা কখনো কখনো জন্মদিন উপলক্ষে শিশুদের উইশ করে, তাদের জন্য দোয়া করে। কখনো বা তাদেরকে খেতে বা বেড়াতে বাইরে নিয়ে যায়, গিফট দেয়।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মদিন ছিল সোমবার। সোমবার তিনি সবসময় রোজা রাখতেন। একবার হজরত ওমর (রা.) তাঁকে সোমবার কেন রোজা রাখেন জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেছিলেন, সোমবার তাঁর জন্মদিন। এই দিনে মহান আল্লাহ তা’আলা তাঁকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন- সে জন্য শুকরিয়া আদায় করে রোজা পালন করেন তিনি। সপ্তাহের আরেকটি দিনও তিনি রোজা রাখতেন। সে দিনটি হচ্ছে বৃহস্পতিবার। এই দিনটির গুরুত্ব হচ্ছে শুক্রবার অর্থাৎ জুমার দিনের আগের দিন বলে।
সৌভাগ্যক্রমে বৃহস্পতিবার আমার জন্মদিন। তবে যাদের জন্ম দিবস অন্যান্য দিনে তাদের মন খারাপ করার কিছু নেই। প্রতিটি দিনই আল্লাহর কাছে সুন্দর এবং গুরুত্বপূর্ণ।
জন্মদিনের মধ্য দিয়েই জীবনের শুরু। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এই দুনিয়ায় জীবনের অবসান। সদ্য জন্ম নেয়া শিশুটিকে আমরা ধীরে ধীরে আদরে যতেœ গড়ে তুলি। সে বড় হয়। ন’বছর পর্যন্ত জীবনের এই অংশকে আমরা বলি শিশুকাল বা শৈশব। শৈশবের পর আসে দুরন্ত কৈশোর কাল। তারপর বলা যায় ১৮-তে পৌঁছালে সেই মানুষটির শুরু হয় জীবনের স্বর্ণযুগ- যাকে আমরা বলি যৌবনকাল। বয়স যখন চল্লিশে, তখন মানুষ ধীরে ধীরে আবার যৌবন হারাতে শুরু করে। তারপর ক্রমে সে হয় প্রৌঢ়, তারপর বৃদ্ধ, অতিবৃদ্ধ… এরপর একদিন শেষ হয় এই সুন্দর পৃথিবীর জীবন। এটাই প্রকৃতির স্বাভাবিক রীতি। ব্যতিক্রমও আছে। কেউ শৈশবেই, কেউ কৈশোরে, কেউ যৌবনে, কেউবা বার্ধক্যে পৌঁছার আগেই জীবন থেকে বিদায় নেয়। মহান স্রষ্টার ইচ্ছায় পরকালে পাড়ি জমায়। এটাই মহান স্রষ্টার অমোঘ ও অলঙ্ঘনীয় বিধান।
সব মানুষেরই একটা শৈশব থাকে। এই যেমন এখন কেউ বা শিশু- আমরা এখন বড়। বড় শুধু বড়ই নয়- বড় অর্থাৎ একেবারে বুড়ো। আমাদের মতো বয়সের মানুষকে তোমরা এখন আর কাকা চাচাও (আঙ্কেল) ডাকবে না। ডাকবে দাদু ভাইয়া, নানুভাই ইত্যাদি বলে। অচেনা হলে তো ঠাট্টা করে বলেই বসবে- ‘ঐ বুড়ো লোকটা’।
একজন শিশু একটি ভোরের মতো।
যেন সুন্দর একটি সকাল দিয়ে একটি দিনের সূচনা। ইংরেজিতে একটি কথা আছে- ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’। প্রতিটি শিশু ধীরে ধীরে দিনের পরিণতির মত বড় হতে থাকে। শিশু দৌড়ায়- কিশোর লাফায়- যুবক শক্তিমত্তা-সাহস ও কর্ম দিয়ে সামলায়। আর বৃদ্ধ ধীরপায়ে এগিয়ে যায় শান্ত পরিণতির দিকে।
তোমরা কি একথা জানো যে বাংলাদেশী মানুষের বয়স যখন ৬০ থেকে ৬৫ বছরের মধ্যে তখন তাঁদের কর্মজীবন মোটামুটিভাবে শেষ হয়ে যায়? অর্থাৎ চাকরিরত মানুষের তাঁদের চাকরিতে ইস্তফা বা অবসর দেয়া হয়। আর যারা বৃদ্ধ কৃষক, শ্রমিক বা স্বাধীন পেশার মানুষ তারাও ধীরে ধীরে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেন। তখন তাদের সন্তানেরাই ক্রমে তাঁদের স্থলে সংসারের দায়িত্বভার গ্রহণ করে।
তোমরাও একদিন শিক্ষা-দীক্ষা, প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে কর্মজীবনের জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত হবে। ধীরে ধীরে তোমাদের পিতা-মাতার দায়িত্বভার গ্রহণ করবে। এটাই জগৎ সংসারের নিয়ম।
এই যেমন ধরো আমরা এখন ধীরে ধীরে ৬০ বছর পেরিয়ে বার্ধক্যের গাড়িতে চড়েছি।
কি বললে? মন খারাপ করছে? ভাবছো আমরা তো সবে শিশু। জীবনের এতো কিছুর আমরা কী জানি! এখনই আমাদের বুড়ো হবার কথা কেন বলছেন!?
ওহ হো! স্যরি স্যরি, ঠিক বলেছো। এমন কঠিন কথা-রা থাক। এসো আমরা অন্য কথা বলি।
আচ্ছা তোমরা কি গ্রাম চেনো? তোমরা হয়তো চট করে বলবে, এ আবার কেমন প্রশ্ন? যেখানে অনেক গাছগাছালি, ধানক্ষেত নদী, মেঠোপথ, চৌচালা টিনের বাড়ি আর ছোট ছোট কুঁড়েঘর… সেটাইতো গ্রাম। তোমাদের জন্ম কি গ্রামে নাকি শহরে? তা যেখানেই হোক- গ্রামের বাড়িতে অর্থাৎ দাদুর বাড়িতে বা নানুর বাড়িতে বেড়াতে তো যেতেই হয়- নাকি বলো? গ্রামেই বেশির ভাগ শিশুর জন্ম হলেও অভিভাবকরা চান শহরে যেন তারা বেড়ে ওঠে। কেননা তারা চান তাদের সন্তানরা এগিয়ে যাক। শিক্ষা দীক্ষায় চলনে-বলনে, পোশাক-আশাকে মন মানসিকতায় তারা হোক আলোকিত। তবে কি গ্রামের ছেলেরা আলোকিত হয় না? হয়। তথাপি কিছুটা পিছনেই থেকে যেতে হয় তাদের। শহুরে চৌকস ছেলেদের সাথে তারা কেন যেন ঠিক পেরে ওঠে না। এই প্রতিযোগিতায় অতি যোগ্যরা হয়তো উতরে যায় বটে!
আমিও কিন্তু গ্রামের ছেলে। নোয়াখালী জেলার কবিরহাট থানায় নবাবপুর গ্রামে আমার জন্ম। সাত-আট বছর বয়স পর্যন্ত বড় হয়েছি গ্রামের পরিবেশে। গ্রামের জল জংলায় ঘুরে ঘুরে, কতো না জানা-অজানা গাছের ফল-মূল খেয়েছি, সকালে চুপি চুপি ঘরের দোর খুলে আম-জাম বরই কুড়িয়েছি। তারপর, আরবি শিখতে ভোরের মক্তবে যাওয়া, দল বেঁধে স্কুলে আসা যাওয়া, ছাগল পালন করা। বড়দের অবাধ্য হয়ে পুকুরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাঁতার কেটেছি। গাছের মগডালে উঠে পেয়ারা খেয়েছি। ঘুড়ি উড়িয়েছি অবারিত বিলে। ধানক্ষেতের খাড়ি সিচে সারা গায়ে কাদা মেখে মাছ ধরে বাড়ি ফিরেছি। হাতে কলাপাতায় মোড়ানো দুই চারখান মাছ! টাকি, বাইন, পুঁটি, শিঙ, ম্যেনি, টেংরা… তখন বড়দের সেকি বকুনি! চুপচাপ মুখ নিচু করে আড়ালে চলে যাওয়া, পুকুরে গিয়ে গোসল সেরে শান্ত ছেলের মতো রসুই ঘরে ঢুকে ছোট চাটাই কিংবা পিঁড়িতে বসে পড়তাম খাবারের জন্য।
আটপৌরে বনেদি পরিবার আমাদের। বড় বড় ডেকচিতে ভাত, মাছ, সালুন, ডাল রান্না করা হতো।
ছোট-বড় কত সদস্য! হাল চাষের লোক, গরু-গোথান দেখার লোক, আরো কত লোক লস্কর! লঙ্গরখানার মতো একে একে আসছে, খাচ্ছে, খেয়ে চলে যাচ্ছে।
কখনো কখনো দুই-তিনবার রান্না করতে হতো। দাদি-মা-চাচি ও কাজের মেয়েদের দেখতাম তারা বেশ পড়ন্ত বেলায় খেতে বসছেন।
আমরা বড়দের আদরও কাড়তে জানতাম। ঘরের কাজকর্মে আমরা কিছু কিছু সাহায্য করতাম। বড়দেরকে কৃষিকর্মে এবং ঘর-গেরস্থালির সেসব কাজে সহযোগিতা করতে পারলে আমাদের ভীষণ আনন্দ হতো।
জেনে তোমাদের খুব হাসি পাবে যে ছেলেবেলায় আমি কিন্তু ছাগল পালতাম। ছাগলটির সাথে আমি কথা বলতাম। তার ছিল তিনটি বাচ্চা। সেই বাচ্চাগুলোকে আমি জড়িয়ে ধরতাম। সম্ভাব্য ছায়াযুক্ত সবুজ ঘাসময় জায়গায় ওদের বেঁধে রেখে আদর করে ঘাস খাবার অনুরোধ জানিয়ে তারপর স্কুলে চলে যেতাম। কখনো কখনো স্কুল থেকে যখন একা ফিরতাম তখন আকাশকে বানাতাম আমার লেখার অবারিত খাতা। আকাশের মধ্যে বড় বড় করে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে লিখতাম অ- আ- মি- ক- দ- হ…। তখন আমি নিজের সাথে নিজেই কথা বলতাম। বলতাম- একদিন আমি অনেক বড় হবো। কত্ত বই হবে আমার। অনেক লেখাপড়া করবো আমি।…
জানি না সেই অতিকল্পনা আর ভাবনার জোরেই শেষমেশ বোধ হয় একজন ছোটখাটো কবি ও গীতিকার হয়েছি। জানো, আমার ঘরে অনেক বই আছে সত্যি। আলমিরা ঠাসা। তবে সেসব বইয়ের জ্ঞান তো আর এক জনমে অর্জন করা হলো না! আর অনেক বড় হওয়ার স্বপ্নও পূর্ণ হলো না শেষ পর্যন্ত। হায়, সত্যিকার অর্থেই একজন অখ্যাত এবং ছোটখাটো মানুষের মধ্যেই আমার জীবন-স্বপ্ন লুকিয়ে রইলো। অনেক বিকশিত হবার সেই সুযোগ হলো কই! এই ব্যর্থতা ও দায় কেবল আমারই। অন্য কারো নয়।
তোমরা কিন্তু অবহেলায় সময় হারাইও না। শেষে আমাদের মতোই পস্তাতে হবে। জীবন যখন ফুরিয়ে আসবে তখন কেবলই মনে হবে নিউটনের সেই কথাটি। নিউটন কি বলেছিল জানো?
আচ্ছা তার আগে বলতো, নিউটন কে? তিনি কী ছিলেন?
– বিজ্ঞানী।
– ইয়েস। ভেরি গুড। তোমরা তো দেখি সবই জানো। ১৬৪৩ সালে জন্ম নেয়া ইংরেজ গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী স্যার আইজ্যাক নিউটন কী আবিষ্কার করেছিলেন, কেন বিখ্যাত হয়েছিলেন… তাও জানো নিশ্চয়ই।
নিউটন তখনও ছাত্র। একদিন এই খুদে বিজ্ঞানী বসেছিলেন আপেল বাগানে। তখন একটি আপেল হঠাৎ গাছ থেকে ঝরে পড়লো মাটিতে। নিউটন ভাবলেন, আপেলটি মাটিতে কেন ছুটে এলো? গাছ থেকে আকাশের দিকেও তো উড়ে যেতে পারতো..! আর এই ভাবনা থেকেই তিনি গভীর গবেষণা করে আবিষ্কার করে ফেললেন মহাকর্ষ ও মাধ্যাকর্ষণ শক্তির। তাঁর এই অসামান্য অবদানের জন্য তিনি হয়ে রইলেন জগদ্বিখ্যাত। কী অবাক করা কাণ্ড তাই না?
এবার বলি নিউটনের সেই গুরুত্বপূর্ণ কথাটি যেটি তিনি বলেছেন জ্ঞান সম্পর্কে : “ঞড় সুংবষভ ও ধস ড়হষু ধ পযরষফ ঢ়ষধুরহম ড়হ ঃযব নবধপয, যিরষব াধংঃ ড়পবধহং ড়ভ ঃৎঁঃয ষরব ঁহফরংপড়াবৎবফ নবভড়ৎব সব.” তিনি বলেছেন, “আমার নিজের কাছে মনে হয় (জ্ঞান আহরণে) আমি যেন সৈকতে ক্রীড়ারত এক শিশুমাত্র, সত্যের জ্ঞান সুবিশাল সমুদ্রের মতই আমার কাছে এখনো অনাবিষ্কৃত।”
এবার তাহলে বলো জ্ঞানের অসীম বালুকাতটে দাঁড়িয়ে এখনো মানুষ কতটুকুই-বা অর্জন করতে পেরেছে?
এই দেখো, তোমাদেরকে বলতে চাইছিলাম গ্রামে আমার শিশুকালের কিছু কথা। তা না বলে কোথা থেকে কোথায় চলে গেলাম!
বলছিলাম গ্রামে সেই ছেলেবেলার স্মৃতি নিয়ে। বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের মতই সুন্দর সবুজঘেরা ছায়াময় মায়াময় গ্রাম আমার। গ্রামের নাম নবাবপুর হলেও নবাব শায়েস্তা খান কিংবা আলীবর্দী খাঁর কোনো প্রতিনিধি কিংবা নবাব পরিবারের বংশধরেরা কেউ এই গ্রামে কখনো এসেছেন বা থেকেছেন কিনা তা জানা যায়নি। তবে গ্রামের হিন্দু-মুসলিম সমস্ত পরিবারের ইতিহাস ও অবস্থান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গ্রামে আমাদের পরিবারটিই ছিল একটি নবাব পরিবারের মতো। ১৮০০ সালের শেষ ভাগ থেকেই গ্রামের সবচেয়ে নাম ডাক, শিক্ষা, বংশমর্যাদা, জায়গা-জমি ও অর্থ-সম্পদে প্রভাবশালী পরিবার ছিল দানশীল রিয়াজউদ্দিনের পরিবার। কলকাতা বন্দরে সরদার হিসেবে কাজ করতেন বলে তাঁর পরিচিতি হয়েছিল রিয়াজউদ্দিন ‘মাঝি’ নামে।
মরহুম রিয়াজউদ্দিন গ্রামে তাঁর নিজের জায়গা ও অর্থ দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নবাবপুর জামে মসজিদ, মক্তব ইত্যাদি। তিনি যখন হজব্রত পালনের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন, তখন গ্রামের লোকেরা তাঁর কাছে আবদার করে বলেছিল- হজ্বের সওয়াব তো শুধু আপনি একাই পাবেন। কিন্তু আমাদের গ্রামে একটি মসজিদ নেই। আপনি যদি একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে দিতেন।
মসজিদ প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে জীবনে পরবর্তীতেও তাঁর আর হজ্ব পালন করা হয়নি। এখনো তাঁর বংশধর অর্থাৎ আমরা এবং এলাকাবাসীর উদ্যোগে অনেক সংস্কারের পর এই মসজিদ একটি দৃষ্টিনন্দন দোতলা মসজিদ হিসেবে রয়েছে। মসজিদ প্রাঙ্গণ ঘেঁষেই রয়েছে জান্নাতবাসী রিয়াজউদ্দিন ও তাঁর সন্তান ওসমান আলীর কবর।
বংশ পরম্পরায় পরবর্তীতে আসেন মরহুম ওসমান আলীর ছেলে হাজী আলী আজম পণ্ডিত। এই আলী আজমই হচ্ছেন বংশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি। কবি নজরুল ইসলামের মতো তিনিও জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৮৯৯ সালে। অতীব সুদর্শন, দীর্ঘ ও বলিষ্ঠ সুঠাম দেহধারী এবং এক জাঁদরেল ব্যক্তিত্ব। মাত্র ৩৭ বছর বয়সে হজ্ব করেন তিনি। খুব বেশিদূর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া না থাকলেও তাঁর ধার্মিকতা, বুদ্ধিমত্তা, সালিশ নালিশ ও বিচার কর্মে তাঁর দক্ষতা ও বিচক্ষণতার কারণেই এলাকাবাসী তাঁকে পণ্ডিত উপাধি দিয়েছিলেন।
ছেলেবেলায় দেখেছি তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর সমবয়সী বা ছোটরা তো দূরে থাক- তাঁর চেয়ে বয়সে বড়রাও কথা বলার সাহস হারিয়ে ফেলতেন। এলাকার এমপি বা নেতাদের (মরহুম মওদুদ আহমদ, ওবায়দুল কাদের…) দেখেছি তাঁর কাছ থেকে দোয়া নিতে তাঁর পা ছুঁয়ে কদমবুসি করতে। যুবক বয়সে এলাকায় তিনি মেম্বার ছিলেন কয়েক দফা। ভাইস-চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
এই বিপুল প্রভাববিস্তারী মানুষটির অনেক স্মৃতি রয়েছে আমার জীবনে যা পরবর্তীতে এখানে তুলে ধরতে চাই। ১৯৮৩ সালে প্রায় ৮৬ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন।
মরহুম আলী আজম-ই হচ্ছেন আমার দাদা। আমার আপন দাদির মৃত্যুর পর তিনি আরও দুটি বিয়ে করেন। তার সন্তানাদির সংখ্যা ১৮ জন। এর মধ্যে ১২ জনকে আমি জীবিত দেখেছি। ছেলেদের মধ্যে আমার পিতা মরহুম আব্দুল আউয়াল (১৯৭৩) ছিলেন তাঁর প্রথম ছেলে। মাত্র ৭ বছর বয়সে আমার পিতা মাতৃহারা হন। পেশায় ছিলেন শিক্ষক। পরবর্তীতে ব্যাংকিং পেশায় নিয়োজিত ছিলেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। শাসন ও সোহাগের এক অনুপম দৃষ্টান্ত ছিলেন এই মহান শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের কাছে- যাদের অনেকেই এখন অতিবৃদ্ধ কিংবা বেঁচেও নেই। চিত্রশিল্প এবং বাংলা ক্যালিগ্রাফিতে তিনি ছিলেন অত্যন্ত দক্ষ। কবিরহাট বাজারে তাঁর ছিল বিশালাকার একটি বুক স্টল। এখানেই ছিল তাঁর শিল্পকর্ম ও ক্যালিগ্রাফির প্রদর্শন ও বিক্রয় স্থান। ১৯৬৬ সালে এক তুমুল ঝড় তুফানে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় তাঁর সেই ব্যবসাকেন্দ্র। সেইসাথে লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় তাঁর মনের অবস্থাও। এরপর পেশা বদল করে ব্যাংকিংয়ে এলেন। ১৯৬৮-এর শেষ দিকে তিনি আমাদেরকে অর্থাৎ তাঁর পরিবারকে নিয়ে যান রংপুরে তাঁর কর্মস্থলে।
আজ তবে এইটুকুই থাক।

Share.

মন্তব্য করুন