আমার জন্ম হয়েছে চট্টগ্রামের রাউজান পৌরসভার কদলপুর গ্রামে। জন্মের পর এখানে অবশ্য আমরা অল্প কিছুদিন মাত্র ছিলাম। এখান থেকে চট্টগ্রাম শহরে এসে যাই। আসার কারণ ছিলো আমার বাবার চাকরি। বাবা তখন চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষক হলেন। যেহেতু তিনি চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষক সেহেতু আমাদেরকেও তার সাথে চলে আসতে হয়েছে। ফলে আমরা গ্রাম থেকে শহরে এলাম। একইসাথে নিজের জন্মস্থান থেকে বেরিয়ে এলাম। সেই যে বের হলাম আর গ্রামে বসবাসের জন্য ফেরা হয়নি। মাঝখানে মাত্র ছয় মাসের জন্য থেকেছি। তারপর থেকে দেশের বিভিন্ন জেলা শহর হয়ে পরে ঢাকায় স্থির হয়ে গেলাম।
বলছিলাম আমার বাবা কলেজ শিক্ষক হলেন। শিক্ষকতা করা অবস্থায় ১৯৫৬ সালে তিনি পরীক্ষা দিয়ে মুন্সেফ হয়ে গেলেন। মুন্সেফ হিসেবে তার প্রথম পোস্টিং হলো লক্ষ্মীপুর। লক্ষ্মীপুর তখন মহকুমা। আমার বয়স তখন তিন কি চার হবে। আব্বার সাথে আমরাও চলে গেলাম লক্ষ্মীপুর। লক্ষ্মীপুরে সরকারি বাংলো। বেশ গাছগাছালি, মাঠ এবং একটি পুকুরও ছিলো। আমার বড় বোন তখন স্কুলে যেতো। আমি তখনও ভর্তি হইনি। কিন্তু বোন আমাকে মাঝে মাঝে নিয়ে যেতো ওর স্কুলে। নিয়ে আমাকে টেবিলের ওপর বসিয়ে দিতো। আমি কিছুটা অবাক হয়ে সবাইকে দেখতাম। দেখতাম ওরা কিভাবে লেখাপড়া করে। টিচার কিভাবে পাঠদান করে। এসব দেখে দেখে আমার মনেও স্কুলে ভর্তি হওয়ার আগ্রহ জাগলো।
আমরা মোটামুটি দুই বছর লক্ষ্মীপুর ছিলাম। ১৯৫৮ সালে আব্বা বদলি হয়ে ঢাকার মুন্সেফ হলেন। এই আমাদের শুরু হলো ঢাকা মহানগরীর যাত্রা। আজিমপুর কলোনিতে- যাকে বলা হতো আজিমপুর দক্ষিণ কলোনি, এখানেই হলো আমাদের বাসা। ঢাকায় এসেই আমি ভর্তি হলাম স্কুলে। শুরু হলো আমার লেখাপড়ার জীবন। পলাশী প্রাইমারি স্কুল আমার প্রথম বিদ্যালয়। এখানে তিন বছর ছিলাম। এরপর আব্বা আবার বদলি হয়ে গেলেন। বদলি হলেন ঈশ্বরগঞ্জে। এখানে এসে ভর্তি হলাম ঈশ্বরগঞ্জ স্কুলে। আমাদের বাসা হলো মুন্সেফ কোর্টের ভেতরে। খুব মজার ছিলো সময়গুলো। এসময় আমার বয়স ছিলো সাত কিংবা আট। তখন থেকেই রোজা রাখা শুরু হলো আমার। রোজা রাখতে খারাপ লাগতো না মোটেই। খুব মজা পেতাম ইফতারির সময়। রোজার দোয়া শিখেছিলাম তখন।
ঈশ্বরগঞ্জ স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। তিনি লেখাপড়ার বিষয়ে ছিলেন খুব কড়া। আদব-কায়দার বিষয়েও কড়া ছিলেন।
এই স্কুলে আমার একটি আলাদা পরিচয় বেড়ে উঠলো। ছাত্র-শিক্ষক সবাই জানতো আমি মিথ্যা কথা বলি না। ফলে সবাই আমাকে সত্যবাদী বলে জানতো। এতে আমার কিছুটা লাভ হয়েছে। আমাকে সবাই সম্মান এবং আদর স্নেহ করতো।
ঈশ্বরগঞ্জ থেকে আব্বা ট্রান্সফার হয়ে গেলেন তখনকার পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে। ফলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হলো আমাদের গ্রামের বাড়ি। গ্রামে এসে স্কুলে ভর্তি হলাম। স্কুলটি ছিলো বেশ দূরে। কিন্তু আমি হেঁটেই স্কুলে যেতাম। এখানে ছয় মাস ছিলাম। এরপরই আব্বার বদলি হলো গাইবান্ধা। এখানে খুব সুন্দর বাসা পেয়ে গেলাম আমরা। বাসার চারপাশে গাছগাছালি। সামনে মাঠ। আর মাঠের পাশে বয়ে যাওয়া এক নদী। এ নদীতে কত সাঁতার কেটেছি। নদীর পাড়ে খেলাধুলা করেছি। বিকেলবেলা মাঠে খেলাধুলা হতো খুব। সন্ধ্যার কিছু আগে আগে বাসায় ফিরতাম। মাগরিবের নামাজ আদায় করেই পড়তে বসতে হতো আমাদের। দেরি না করেই আমরাও বসে যেতাম পড়ার টেবিলে।
গাইবান্ধা থেকে আবার ঢাকায় বদলি হলেন আব্বা। ঢাকায় প্রথমে সংসদ ভবন- যেটি এখনকার সংসদ ভবন নয়, এখানে আমাদের বাসা হলো। উপরে টিনের ছাউনি। বাসাটি ছিলো এল সাইজের। এখানে আব্বা-আম্মা আর আমরা তিন ভাই-বোন। কিছুদিন পর আজিমপুরে বাসা পেলেন বাবা। এখানেই আমার জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় কেটেছে। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি জীবন এমনকি শিক্ষক হওয়া পর্যন্ত এখানে এই আজিমপুরেই। কৈশোরের চমৎকার সময়গুলো এখানে কেটে গেছে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনও।
এখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি আরও কিছু কাজ করেছি। মসজিদ ছিলো আমাদের নিয়মিত আসা-যাওয়ার স্থান। মসজিদকেন্দ্রিক একটি আদর্শ পাঠাগার করলাম আমরা। এখানে ইসলামি বই এবং চরিত্র গঠনমূলক অনেক গুরুত্বপূর্ণ বই ছিলো প্রচুর। কলোনির অনেক ছেলেরা, কিশোর-যুবকেরা এখান থেকে বই নিতো। রেজিস্ট্রেশন করে নিতো। পড়ে আবার ফেরত দিয়ে নতুন বই নিয়ে যেতো। কেউ কেউ পাঠাগারে বসেই বই পড়তো। বিভিন্ন অনুষ্ঠানও করতাম এখানে। কলোনির পরিবেশ খুব ভালো ছিলো। সবাই শিক্ষিত, শিক্ষিত ছিলো সব পরিবার। জুমার নামাজ, ঈদের নামাজ একসাথে আদায় করতাম। ঈদের নামাজ শেষে কোলাকুলি তো হতোই। সেই সাথে একজন আরেকজনের খোঁজখবর নিতাম। কেউ সমস্যায় আছে কিনা! কারো অভাব অনটন আছে কিনা! এতে আমাদের পরস্পরের প্রতি আন্তরিকতা যেমন বৃদ্ধি পেলো, তেমনই একটি স্ট্রং ইসলামি গ্রুপ তৈরি হলো। আমরা একসাথে চলতাম। কাজ করতাম। এরমধ্যে কিছু সামাজিক কাজও করতাম।
আরও একটি কাজ করতাম আমরা। রমজানে তারাবির নামাজের ইমাম অর্থাৎ হাফেজ সাহেবের জন্য টাকা কালেকশন করতাম। বাসায় বাসায় গিয়ে দরজায় নক করতাম। তিনতলা চারতলা বাসা। হেঁটে উঠতাম। হেঁটে নামতাম। কারণ কোনো বাসায়ই লিফট ছিলো না তখন।
তো এই টাকা কালেকশনে গেলে নানাজন নানান কথা বলতো। প্রশ্ন করতো, আমরা জবাবও দিতাম। কেউ কেউ বলতো তোমরা কি ফকির! টাকা চাও! আমরা তারও জবাব দিতাম। আমরা বলতাম- এ টাকা তো আমরা নিজেদের জন্য নিচ্ছি না। বা চাচ্ছি না। সুতরাং কি অসুবিধা! আর কারো কাছে জোরও নেই। ইচ্ছে করে যে যা দেন তাই তো নিচ্ছি আমরা। তখন চুপ হয়ে যেতো লোকগুলো। যারা টাকা দিতেন- কেউ এক টাকা, কেউ দুই টাকা, কেউবা তিন টাকা দিতেন। চার বা পাঁচ টাকা দিতেন এমন লোক ছিলো খুব কম।
আমার আম্মা খুব ধার্মিক ছিলেন। আমার আব্বাও ধার্মিক মানুষ ছিলেন। আব্বা লেখাপড়ার বিষয়ে খুব কড়া ছিলেন। তিনি বলতেন, নামাজ রোজা এবং ধর্মীয় কাজ আর লেখাপড়ায় কোনো রকম ফাঁকি দেয়া যাবে না। আমারও একটি স্বপ্ন ছিলো- আমি একজন ভালো ছাত্র হয়ে বেড়ে উঠবো। ফলে লেখাপড়ায় আমিও এতটুকু ফাঁকি দেইনি। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর লাইব্রেরিতেই আমার সময় কাটতো। বিভিন্ন রেফারেন্স কালেকশন করে নোট করতাম। সেই নোট পড়ে হজম করে নিতাম।
লেখাপড়ার বিষয়ে একদম আপডেট থাকতাম। খেলাধুলা করতাম ঠিক, কিন্তু যাকে বলে দুরন্ত- তা ছিলাম না। কিছুটা গল্প-গুজব এবং আড্ডা ছিলো। আলহামদুলিল্লাহ, সবার সাথে একটি ভালো সম্পর্কও ছিলো। আমাদের বাসায় আব্বার বন্ধুরা আসতো। উনাদের কাকা ডাকতাম। উনারা আমাদের খুব আদর করতো। তিন ভাই-বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট ছিলাম। ফলে আমার আদরও বেশি ছিলো। দশ-এগারো বছর বয়সেও আমি আম্মার কোলে বসে থাকতাম।
এখানে একটি ভালো পরিবেশ ছিলো। আমাদের পরিবারেও, আবার কলোনিতেও। আসলে ছোটবেলায় ইসলামি পরিবেশ পাওয়াটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বড় হলেও এই পরিবেশ কাজে দেয়।
আমার সাথে আলেম-ওলামাদের বেশ ভালো সম্পর্ক ছিলো। তাদের সাথে কিছুটা সময় কাটাতাম। মানুষের প্রতিও এক ধরনের ভালোবাসা অনুভব করতাম। দান-সদকা করার অভ্যাসটি গড়ে উঠেছে সেই কৈশোরেই। মানুষকে সাহায্য করার বিষয়টিও।
আসলে পারিবারিক শিক্ষা একটি শিশুর জন্য খুব জরুরি। পরিবার থেকে নৈতিক শিক্ষা পেলে সারা জীবন কাজে লাগে। আমাদের পারিবারিক শিক্ষা আমাদের কাজে লেগেছে।
আমরা যখন কৈশোরে বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন মসজিদগুলোতে মুসল্লিদের বেশির ভাগই ছিলো বৃদ্ধ মানুষ। কিশোর-যুবক ছিলো খুবই কম। এখন কিন্তু একেবারে উল্টো চিত্র। এখন যুবক-কিশোরদের উপস্থিতি অনেক বেশি। বৃদ্ধ কম।
যাই হোক, আমার শৈশব-কৈশোর এক আনন্দময় এবং হাসিখুশির ছিলো। নানা জায়গার স্কুল। নানান ছাত্র-শিক্ষকের সাথে মেলামেশা এবং প্রকৃতির নানা সৌন্দর্য আমাকে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছে। আমার জীবন গঠনেও পড়েছে এর প্রভাব। এখন পেছন ফিরে তাকালে ভালোই লাগে। মনে হয় একটি ভালো শৈশব-কৈশোর ছিলো আমার। নিজের কাছে নিজের ভালো লাগে।

Share.

মন্তব্য করুন