২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের এক রৌদ্রোজ্জ্বল দিন। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের মিরপুর শাখায় ২ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে টিকিট সংগ্রহ করে সবেমাত্র মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের ইস্ট গ্যালারিতে বসেছি বাংলাদেশ বনাম শ্রীলঙ্কার প্রথম দিনের টেস্ট খেলা দেখতে। সময় বেলা এগারোটা। গ্যালারিতে বসতে না বসতেই হঠাৎ ফোনে আমার দাদীর মৃত্যুসংবাদ পেলাম। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ বয়সজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন, তাই মৃত্যু সংবাদটা অনাকাক্সিক্ষত ছিলো না। কিন্তু জানাজায় অংশগ্রহণ করতে হলে আমাকে সন্ধ্যার পূর্বে খাগড়াছড়িতে পৌঁছাতে হবে। এদিকে সকাল নয়টার পর এবং রাত আটটার আগে ঢাকা থেকে খাগড়াছড়ির সরাসরি কোনো বাস নেই। ফেনী হয়ে ভেঙে ভেঙে গেলেও জানাজার আগে পৌঁছাতে পারবো কিনা নিশ্চিত নয়। তবে দাদীর জানাজায় অংশগ্রহণ করার প্রবল ইচ্ছা আর শেষবার দেখার আগ্রহ উপেক্ষা করতে পারলাম না। স্টেডিয়াম থেকে বের হয়েই সিএনজি নিয়ে ছুটলাম সায়েদাবাদের উদ্দেশে। মিরপুর-বিজয়সরণি-শাহবাগ-পল্টনের ট্রাফিক জ্যাম আমার অপেক্ষার প্রহর আরো বাড়িয়ে দিতে লাগলো। সায়েদাবাদ কাউন্টার থেকে চট্টগ্রামগামী শ্যামলী পরিবহনের বাসে বারৈয়ারহাটের টিকিট নিয়ে উঠে বসলাম। ততক্ষণে যাত্রাবাড়ীর বিখ্যাত যানজটও আতিথেয়তা দিতে শুরু করেছে। যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা পার হয়ে বাস যখন হাইওয়েতে উঠলো ঘড়ির কাঁটায় সময় সাড়ে তিনটা ছুঁইছুঁই। হাইওয়ের কাঁচপুর ব্রিজ, মেঘনা-গোমতী সেতু সবখানে চলছিল জ্যামের খেলা। দাউদকান্দির পর কিছুটা গতি পেলো বাস। পদুয়ার বাজার হোটেল নূরজাহানে উদরপূর্তি আর মাগরিবের নামাজ আদায় করার সুযোগ পাওয়া গেলো। ওই দিকে মাগরিবের পরপরই জানাজা অনুষ্ঠিত হবে। জানাজায় অংশগ্রহণ করার আশা ততক্ষণে বাদ দিয়ে দিলেও বাড়িতে যাওয়ার আশা বাদ দিলাম না। এই সময়ে বাড়ির মুরুব্বিদের সাহচর্যে থাকা খুব দরকার। কুমিল্লা-ফেনী পার হয়ে বারৈয়ারহাট পৌঁছালাম রাত সাড়ে আটটায়। বাস থেকে নামতেই প্রচ- ঠা-া বাতাস গায়ে ঝাপটা দিলো। ঢাকা শহরে গতকাল রাতে সিলিং ফ্যান চালিয়ে ঘুমানো আমি আজ রাতে মফস্বলে এসে শীতে কাঁপছি। কতটা পার্থক্য আমাদের শহর আর গ্রামগুলোর মধ্যে!
ফুলহাতা শার্টের হাতাগুলো নামিয়ে দিয়ে শীত নিবারণের বৃথা চেষ্টা করতে করতে সামনে এগিয়ে একটা লোকাল সিএনজি ড্রাইভারের রাম গ, রাম গ ডাক শুনতে পেলাম। খাগড়াছড়ি জেলায় প্রবেশের প্রথম উপজেলা ‘রামগড়’ এর ‘ড়’ বাদ দিয়েই উনি ডেকে চলেছেন। দরকষাকষির পর আমিসহ পাঁচজন যাত্রী নিয়ে সিএনজি ড্রাইভার বারৈয়ারহাট হাইওয়ে ছেড়ে করেরহাট বাজার হয়ে খাগড়াছড়ি অভিমুখী পাহাড়ি রাস্তায় ঢুকে গেলেন। করেরহাট- হেঁয়াকো-চা বাগান হয়ে যাত্রী ওঠানামা করতে করতে সিএনজিটা রামগড় পৌরসভা বাজারে পৌঁছাতে রাত পৌনে দশটা বেজে গেলো। নিজ জেলার সীমানায় প্রবেশ করতে পেরে কিছুটা স্বস্তি অনুভব করলাম। এই শীতের রাতে সিএনজি স্ট্যান্ডের পাশে একটা টঙদোকান দেখে চায়ের কাপে ধোঁয়া উড়ানোর লোভ সামলাতে পারলাম না। রঙচায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে দেখলাম একটা কটকটে হলুদ রঙের মাইক্রোবাস দোকানের সামনে এসে দাঁড়ালো। যাত্রীবাহী সাদা, কালো বা লাল রঙের মাইক্রোবাস অনেক দেখেছি। কিন্তু হলুদ দেখে একটু অবাক হয়ে আরেকবার তাকালাম। কালো কাচের জানালায় মোড়ানো গাড়িটার ভিতরের দৃশ্য কিছুই দেখা গেলো না। এ সময় সামনে ড্রাইভিং সিটের পাশে জানালার কাচ নেমে গেলো। আপাদমস্তক শীতের কাপড়ে মোড়ানো মাইক্রোবাস চালকের; মাথা-কান-মুখ-নাক সবকিছু কালো মাফলারে ঢাকা। চোখ দুটো আর নাকের ফুটো ছাড়া কিছুই দেখা যায় না।
যাই হোক আমার জালিয়াপাড়া অথবা পারলে সরাসরি মাটিরাঙ্গা পর্যন্ত আবারো সিএনজিতে যেতে হবে, মাথায় শুধু বাড়ি পৌঁছানোর চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। বাড়ি থেকেও বারবার ফোন আসছে কতদূর পৌঁছালাম জানার জন্য। অন্যকিছু ভাবার সময় পেলাম না। দোকানপাট প্রায়ই বন্ধ হয়ে গেছে। সারি সারি দোকানের আলো নিভে যাচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর। চা শেষ করে সিএনজি পাওয়ার আশায় রাস্তায় হলুদ মাইক্রোবাসটার পাশে এসে দাঁড়ালাম। একটা সিএনজিও নেই স্ট্যান্ডে। এ সময় মাইক্রোবাস চালক গাড়ির জানালার ফাঁক দিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন:
Ñ ভাই কোথায় যাবেন?
আমি বললাম:
Ñ মাটিরাঙ্গা যাবো।
Ñ চলেন। আমি খাগড়াছড়ি যাবো। আপনাকে মাটিরাঙ্গা নামাই দিবো। আমাকে একশো টাকা দিয়েন।
এ কথা শুনে খুব খুশি হলাম। এত রাতে সর্বোচ্চ জালিয়াপাড়া চৌরাস্তা পর্যন্ত যাবে সিএনজিগুলো। মাটিরাঙ্গা পর্যন্ত অসম্ভব। একশো টাকায় এই শীতের রাতে মাইক্রোবাসে আরামেই যেতে পারবো। আমি বাড়ি ফেরার তাগিদে উঠে বসলাম। এবং হয়তো জীবনের সবচেয়ে বড় একটা ভুল করে বসলাম।
আমি ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠে বসতেই মাইক্রোবাস স্টার্ট নিলো। আমি বললাম:
Ñ আর যাত্রী নিবেন না?
Ñ এত রাতে আর যাত্রী নাই। আমি রিজার্ভ ভাড়া শেষ করে ফিরতেছি, যাত্রী না পাইলেও অসুবিধা নাই।
আমি আর কথা বাড়ালাম না। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। গাড়ির ভেতর কেমন কটকটে আতর বা এয়ার ফ্রেশনার জাতীয় কিছুর বোঁচকা গন্ধ। অসহ্য লাগছিল গন্ধটা। কিন্তু কিছু করার নেই। আমি কেন যেন একবারের জন্যও পিছনের সিটে তাকিয়ে দেখলাম না আর কেউ আছে কিনা গাড়িতে। ড্রাইভারের পাশের সিটে উঠেই হেলান দিয়ে বসে গেলাম। কেন তাকালাম না সেটা এখনো বুঝে আসে না আমার। মাইক্রোবাসের ভেতরটা বেশ গরম হওয়ায় শীত থেকে বাঁচতে পেরে খুব আরাম লাগছিল।

রামগড় বাজার ছাড়িয়ে বিজিবি ক্যাম্প পর্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই চললো মাইক্রোবাস। তারপরের রাস্তায় আঁকাবাঁকা মোড় আর বাড়িঘরবিহীন ঘনজঙ্গল। চলতে চলতে হঠাৎ লক্ষ করলাম মাইক্রোবাসটা পাহাড়ি রাস্তার বাঁকগুলোতে গতি না কমিয়ে খুব দ্রুতগতিতে পার হচ্ছে। কিন্তু আমি এতে সিট থেকে একটুও নড়ছি না। আবার সিট বেল্টও লাগাইনি। স্বাভাবিকভাবে কোন গাড়ি দ্রুতবেগে মোড় ঘুরলে যাত্রীরা সিট থেকে একটু নড়ে যায়। পাহাড়ি সরু রাস্তার বাঁকে সেটা আরো বেশি অনুভব হওয়ার কথা। অস্বাভাবিক লাগলেও গুরুত্ব দিলাম না ব্যাপারটায়। কিন্ত ধীরে ধীরে গতি আরো বাড়তে লাগলো মাইক্রোবাসের। রাস্তার বামপাশে একটা শালবন পড়লো। শালবন ফেলে বামে মোড় নিয়ে একটা যাত্রী ছাউনি পার হয়ে সামনে চললো গাড়ি। কিছুক্ষণ পর সেই একই শালবন আবারো পার হলাম। ভাবলাম হয়তো এটি আরেকটি বাগান। কিন্তু না, একই যাত্রী ছাউনি, একই বামে মোড়। কিছুক্ষণ চলার পর আবারো একই শালবন পার হতে লাগলাম। উঁচু উঁচু সেগুন গাছের সারি রাস্তার দু’পাশে। গাছের ফাঁকফোকরে আবছা চাঁদের আলো এসে পড়ছে। জায়গায় পার হয়ে চতুর্থবারের মতো একই শালবন, যাত্রী ছাউনি এবং বামে মোড় নিলো মাইক্রোবাস। আমার শিরদাঁড়া বরাবর ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেলো। হেলান দেয়া থেকে উঠে পিঠ টানটান করে বসলাম। চোখজোড়া কি যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে আশপাশে। একসময় প্রচ- গতিতে ছুটতে শুরু করলো গাড়িটি। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে দেখলাম স্পিডোমিটারের কাঁটা মিটারের সর্বডানপ্রান্তে এসে থরথর করে কাঁপছে! অর্থাৎ মিটারের সর্বোচ্চ সীমা ২২০ পার হয়ে আরো বেশি গতিতে ছুটছে সেটি। এই পাহাড়ি রাস্তায় এত গতিতে একটা গাড়ি কিভাবে চলছে! এ সময় খেয়াল করলাম আমি রাস্তার কোন ঝাঁকুনি অনুভব করছি না। কেমন যেন উড়ে চলেছে গাড়িটা। আমি ভয়ে ভয়ে ড্রাইভারকে আস্তে চালাতে বলার জন্য ডান দিকে মুখ ফেরাতে গিয়ে উপরের রিয়ার ভিউ মিররের দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলাম। ভয়ানক দর্শন জ্বলন্ত একজোড়া চোখ চালকের পেছনের সিটটায় বসা। চোখ ছাড়া দেহের বাকি অংশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। ঐ মুহূর্তে ড্রাইভারও আমার দিকে মুখ ফেরালেন। একি! তার চোখ দু’টিও তেমনই ভয়ানক দর্শন। চারজোড়া চোখ থেকে যেন আগুন ঠিকরে বেরুচ্ছে। এরকম চোখ কোন মানুষের হতে পারে?
আমি ভয়ে আর্তচিৎকার দিয়ে উঠলাম, কিন্তু কোনো আওয়াজ বের হলো না মুখ দিয়ে। শত চেষ্টা করেও মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের করতে পারলাম না। অদৃশ্য কোন শক্তি আটকে দিয়েছে আমার বাকশক্তি! রাস্তার উঁচু-নিচু কিংবা মোড়ের টার্ন কিছুই অনুভব করছি না আমি। শুধু শোঁ শোঁ শব্দে বাতাসের বেগে মাইক্রোবাসের ছুটে চলা দেখছি। প্রচ- ঘামছে আমার শরীর। আমি দরজা দিয়ে লাফ দিয়ে বাইরে পড়তে চাইলাম, কিন্তু নড়তে পারলাম না একচুলও। এ সময় হঠাৎ পেছন থেকে বড় কোন গাড়ির হেডলাইটের তীব্র আলোর ঝলকানি এসে পড়লো। মাইক্রোবাসের চেয়েও অধিক গতিতে ছুটে আসছে আর অনবরত আপার-ডিপার দিচ্ছে সেটা। যেন বলছে- সরো, সরে যাও সামনে থেকে, যেতে দাও আমাকে। একসময় আমাদের বাম পাশ দিয়ে প্রচ- বেগে ওভারটেক করলো সেটা।

একটা বড় বাস। কী বাস, কোন রঙের, কোন রুটের কিছুই বোঝা গেলো না। আমাদের মাইক্রোবাসটা রাস্তার ডান পাশে সরতে সরতে একটা আমগাছের সাথে প্রচ- বেগে সংঘর্ষ হলো। ড্রাইভার আর পেছনের সেই জ্বলন্ত চোখওয়ালা আমগাছের সাথে আঘাত খেয়ে গুঁড়ো হয়ে যাওয়া শরীর নিয়ে কোথায় ছিটকে গেলো। ডান পাশ পুরোটাই ঝাঁঝরা হয়ে গেলো মাইক্রোবাসের। থেমে গেলো মাইক্রোবাসের ইঞ্জিনের শব্দ। বাম পাশে বসা আমি মাথায় গাড়ির ছাদে আঘাত খেয়ে টলতে লাগলাম। একসময় বুঝলাম আমি জ্ঞান হারাতে চলেছি।
জ্ঞান ফিরে এলো রামগড় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের পুরুষ ওয়ার্ডের চার নম্বর বেডে। ঠিক যেন বাংলা সিনেমার দৃশ্য। পরিবারের সদস্যরা আমার চারপাশে ঘিরে রেখেছেন। রামগড় থানা থেকে দু’জন পুলিশ সদস্যও এসেছেন আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে। আমার এমন অবস্থা কী করে হলো জানতে চাইলেন। কিন্তু আমার বর্ণনা অনুযায়ী ঘটে যাওয়া ঘটনার সাথে বাস্তবের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া গেলো না। সেই টঙদোকানদার গত রাতে আমাকে দেখলেও কোন হলুদ মাইক্রোবাস দেখতে পাননি, সেই আমগাছের আশপাশে কয়েক মাইলের মধ্যে মাইক্রোবাস দূরে থাক কোন গাড়ির ধ্বংসাবশেষও খুঁজে পাওয়া যায়নি। আবার আমাকে সে রাতে রাস্তার পাশ থেকে জ্ঞানহীন অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসা খাগড়াছড়ি থেকে ঢাকাগামী এস আলম নাইটকোচের ড্রাইভার-স্টাফরাও রাস্তায় তখন কোনো বাস বা মাইক্রোবাসকে অতিক্রম করে আসেননি। তাহলে রামগড় বাজার থেকে সেই আমগাছতলা পর্যন্ত আমি কিভাবে গেলাম?

Share.

মন্তব্য করুন