প্রত্যেক শনিবারের মতো সেদিনও প্ল্যানচেটে বসেছিল নূপুর, ঝিমলি, প্রদীপ, পানু, মুন্নি, খোকা, পাপু, বনি, হানি, রিন্টিরা। সেদিন ছিল এক বৃষ্টিমুখর দিন। আর সন্ধ্যা থেকে তুমুল ঝড়, বৃষ্টি। তবুও ওরা ফাঁকি দেয়নি ওদের কাজে, কারণ তিনজন কাছের মানুষকে ওরা কথা দিয়েছে প্রত্যেক শনিবার যত সমস্যাই থাক, ওরা ওদের কাজকে ফাঁকি দেবে না, মানে মৃত তিন ব্যক্তির সঙ্গে ওরা কথা বলবেই। আসলে এই তিনজন ব্যক্তি ওদের জীবনের সঙ্গে কোনো না কোনো ভাবে জড়িত। যেমন দীপ্তি, ইনি হলেন নূপুর, ঝিমলি, প্রদীপের দিদিভাই। যে দিদিভাইরে কোলে বসে ওরা গল্প শুনত প্রতিদিন বিকেল বেলায়।
চাটুজ্জে ঠাকুমা, যে ছিল পাপু, মুন্নির প্রাণের পরশ। যেমন বাঘের মতো ভয় পেত, আবার প্রাণের চেয়েও ভালোবাসতে ঠাকুমাকে। দুর্গা পুজোর বিজয়াতে কত সুন্দর নারকেলের সন্দেশ বানাতো ঠাকুমা। কত রকমের যে উৎসব থাকত বাড়িতে, আর কত তার নিয়ম নীতি। গ্রীষ্মে, বর্ষা শুধু নয়, বারোমাস ধরে চলত নানান রকম পুজো অনুষ্ঠান। মঙ্গলচণ্ডী, বিপদনাশিনী, মা মনসা পুজো আরো কত কী! কী সুন্দর শিরনি বানাতো বারের পুজোতে। শনিবার তো শিরনি মাস্ট। তাছাড়াও নারায়ণ পুজো বা লক্ষ্মীপুজোতে শিরনি। দুধ, কলা, নারকেলকোরা, চিনি, সুজি, সন্দেশ আর নানান রকম ফল দিয়ে বানানো হতো এই শিরনি ঠাকুরের নিবেদন স্বরূপ। ঠাকুমা প্রতিদিন একটা বিশাল বড় কাঁসার থালায় পাঁচ রকমের ফুল গোল গোল করে ভাগ করে সাজিয়ে রাখত। জবা, নীলকণ্ঠ, শিউলি, পদ্ম আরো কত কি!
অন্য দিকে ইংরেজিতে কী সুন্দর কথা বলতো কাকুসোনা। বিদেশ থেকে পাস করে এসে কেমন যেন সাহেব সাহেব হয়ে গিয়েছিল বনি, হানির কাকুসোনা। বাচ্চাদের সাথে মজা, হাসি-ঠাট্টা নিত্য নতুন গল্প, ব্যাডমিন্টন খেলা কী ছিল না। আর কথায় কথায় হো হো করে হাসত। প্রতিটি বাচ্চার খুব প্রিয় ছিল এই মানুষটি। ঝিমলি তো রীতিমতো বিদেশীদের মতো কথা বলবে বলে প্রতি তিনদিন অন্তর হাজির হতো কাকুসোনার ফ্ল্যাটে। কাকুসোনার ফ্ল্যাটে কাকুসোনা একা থাকত, কাকুসোনা বিয়ে করেনি। রান্না করে দিত বাচ্চু। প্রথমে কাজের ছেলে হিসেবে এসেছিল কাকুসোনার কাছে। রান্না ছাড়াও ঘরছাড়া, ঘরমোছা, বাসন মাজা সবকিছু করত। পরে অবশ্য নিজের ছেলের মতোই হয়ে গেছিল। এরপর স্কুলেও যেতে শুরু করল এবং কাকুসোনার অধীর আগ্রহে বেশ ভালো রেজাল্টও করতে লাগল।
দিনগুলো কাটছিল ওদের বেশ ভালোই। এই তিনটে মানুষ আবার কোনো না কোনোভাবে প্রত্যেকের সঙ্গে যুক্ত। এরা প্রত্যেকে পাশাপাশি থাকত। তাই ঝিমলির দিদিভাই বা পাপুদের ঠাকুমা বা বনিদের কাকুসোনা যেন প্রত্যেকেরই দিদিভাই, ঠাকুমা বা কাকুসোনায় পরিণত হয়েছিল একে অপরের। ঝিমলি, প্রদীপ, নূপুর এই তিন ভাই বোন মিলে একটি পরিবার। হানি, বনি, খোকা এই তিন ভাই বোন মিলে আরো একটি পরিবার। অন্যদিকে পাপু, মুন্নি, পানু এরা আবার তিন ভাই বোন। রিন্টি শুধু একটিই সন্তান। এই চারটি পরিবার ছিল পাড়ার মধ্যে এক আত্মা, এক প্রাণ। অনেকগুলো পরিবার মিলে একটা পাড়া, আবার অনেকগুলো পাড়া মিলে ওদের নিজস্ব একটি জমজমাট জীবন। কিন্তু হঠাৎ করে পাড়াটার মধ্যে অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল।
একের পর এক মৃত্যু এসে যেন গ্রাস করল পাড়াটার মধ্যে। সুস্থ দীপ্তি হঠাৎ কয়দিনের জ্বরে মারা গেল। অদ্ভুত ব্যাপার তার কিছুদিনের মধ্যেই কাকুসোনার হার্ট অ্যাটাক। আরো অদ্ভুত আশ্চর্য ব্যাপার পাপুদের ঠাকুমাকে ঘিরে। কি রহস্যময় তার মৃত্যু। বিষ খেয়ে আত্মহত্যা! ঠাকুমা এসিড খেয়ে ফেলেছিল। কারো কারো ধারণা কেউ জোর করে ঠাকুমার গলায় অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছিল। ঠাকুমা হঠাৎ অ্যাসিড খেতে গেল কেন? কী তার রহস্য তা মাথা ঘামিয়ে কিছুতেই বের করতে পারছিল না পাড়াপ্রতিবেশীরা।
অন্যদিকে কাকুসোনা তো দিব্যি সুস্থ, তাহলে কাকুসোনাই বা হঠাৎ মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ল কেন? আর অমন সুন্দর মিষ্টি দীপ্তি, তারই বা ওমন জ্বর হলো কেন? আর এই তিনজনের মৃত্যুই সবাইকে চমকে দিলো। কাকুসোনা যদিও ওই পাড়াতে থাকত না। তার ফ্ল্যাট একটু দূরে হলেও বেশির ভাগ সময়টাই ওদের পাড়াতেই কাটত তাঁর।
পাড়াটা কেমন যেন থমথমে নিস্তব্ধ হয়ে পড়ল। এক মাসের মধ্যে তিন তিনটে মৃত্যু, ভাবা যায়! ছোট-বড় প্রত্যেকের মধ্যে কেমন যেন একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হলো। ঘর থেকে বেরোতে কেমন যেন ভয় লাগত।
একদিন সন্ধ্যাবেলা অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটল। ওদের পাড়ার গলির পাশটা বেশ ফাঁকা ফাঁকা, পাশেই একটা মাঠ। সন্ধ্যেবেলা বনিরা পড়তে যাচ্ছিল ওদের স্যারের বাড়ি। সেদিন ছিল শীতলা পুজো। হঠাৎ ঐ মোড়টার সামনে আসতেই দেখল একটা সুন্দর মেয়ে লাল শাড়ি পরে, বড় লাল টিপ পরে, হাতে একটা থালা নিয়ে কেমন সুন্দর ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, আর সেই থালার মধ্যে কিছু ফুল। একজন বলল, আরে! শীতলা ঠাকুর স্বয়ং আমাদের দেখা দিলেন! একজন বলল, যা: ঠাকুর কোথায়? এ যে একটা সুন্দরী মেয়ে।
ওরা সামনে যেতেই চমকে উঠল, আরে এতো ঝিমলিদের দিদিভাই দীপ্তিদি! কী সুন্দর হাসছে মিটমিট করে। তাই দেখো ওরা ভয়ে একেবারে চুপসে গেল। মুখ চোখ ঘোলাটে হয়ে গেল। এক জায়গায় সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল। গলার আওয়াজ বন্ধ হয়ে এলো। দীপ্তি বলল ‘আমায় প্ল্যানচ্যাটে আনবি বল।’
ওরা ভয়ে কাচুমাচু হয়ে মাথা নেড়ে বলল ‘হ্যাঁ আনব।’
— কথা বলবি তো?
মেজদির কথায় ওরা ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল,
‘বলব।’
– ঠিক তো?
এবারে ওরা আরো ভয় পেল। কোনোরকম ভাবে মাথাটা নাড়ালো।
– ঠিক আছে, আমি খুব খুশি হলাম। আসলে তোদের ছেড়ে থাকতে আমার যে কত কষ্ট হয়। তোরা সবাই কী সুন্দর একসাথে আছিস…
তারপর হঠাৎ ওরা খেয়াল করল সামনে যে দীপ্তিদি দাঁড়িয়েছিল সে কোথাও নেই। ভয়ে কারো মুখ দিয়ে কোনো কথা বেরোচ্ছে না। কোথায় দীপ্তিদি? কোথায় চলে গেল? এতক্ষণ তাহলে কাকে দেখছিলাম? কার সাথে কথা বলছিলাম?
ওরা কোনোরকমে ওখান থেকে ঘরে ফিরে এসে কাঁদতে কাঁদতে বড়দের সব কথা বলল কিন্তু ওদের কথা কেউই বিশ্বাস করল না।’

ঠিক কিছুদিন পর ফুল পাড়তে গিয়ে মুন্নিরা দেখল ঠাকুমা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে আর বলছে ‘আমায় কে মারল জানিস তোরা? আমি তোদের সব বলতে চাই, আমায় প্ল্যানচ্যাটে আনবি বল? কথা দে…’
মুন্নি আর পানু শুকনো গলায় বলল ‘তোমায় ডাকবো, ঠিক তোমায় ডাকব…’ এই বলে ঘরে ছুটে গিয়ে মাকে ডেকে আনতেই ওরা দেখল গাছের তলায় কেউ নেই। মা রেগে গিয়ে বলল ‘আর কক্ষনো এমন মিথ্যে বলবে না।’
কেউ ওদের কথা বিশ্বাস করছে না। অগত্যা কিছুদিন চুপ করে থাকল। কিন্তু কী আশ্চর্য! হঠাৎ ওরা একদিন বিকেলবেলা খেলতে খেলতে দূরে ওই ফাঁকা গলিটার মধ্যে আবার চলে গেল। পাশেই উঁচু ঐ মাঠটা। সব বন্ধুরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে। রিন্টি আর হানি আরো কিছু দূরে যেতেই খেয়াল করল কে একজন ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। আরো একটু সামনে যেতেই ওরা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। অনেক চেষ্টা করছে উল্টো হয়ে ছুটতে কিন্তু কিছুতেই পারছে না। কাকুসোনা মাঠের মধ্যে কেমন রাজকীয় স্টাইলে দাঁড়িয়ে বলছে, ‘বাচ্চু সেদিন আমায় কী করেছিল জানিস? শুনবি তাহলে? আমায় প্ল্যানচ্যাটে আনবি বল? তোদের সব কথা জানাতে চাই। তোদের আসল সত্যটা জানা উচিত।’
এই বলে কাকুসোনা কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। রিন্টি কোনোরকমে হানির দুটো হাত ধরে একটা জোরে টান দিতেই হানি সম্বিত ফিরে পেল। পেছন ফিরে দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কোনোরকমে ছুটতে লাগল।
বন্ধুদের সাথে দেখা হতেই সব কথা বলল। ওরা একটা জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে বেশ কিছু কথা আলোচনা করে নিলো। ঠিক করল বড়দের সঙ্গে এসব বিষয়ে আর কিছুই আলোচনা করা যাবে না। কাউকে কিচ্ছু আর বলা যাবে না। বাড়ির কেউই বিশ্বাস করতে চাইছে না এসব বিষয়। কিন্তু প্ল্যানচ্যাট না করলে ওদের আত্মার শান্তি পাবে না, আর মৃত ব্যক্তিকে কথা দিয়েছে ওরা, সুতরাং কথা রাখতেই হবে। আর জানতে হবে ওদের মৃত্যুরহস্য।
অনেক ভাবনাচিন্তার পর ঠিক হলো শনিবারই সঠিক দিন। ঐদিন মৃত ব্যক্তিরা তাড়াতাড়ি সাড়া দেন।
ওরা সবাই মিলে পরিষ্কার জামা কাপড় পরে সন্ধ্যাবেলা এক জায়গায় হলো। নিস্তব্ধ একটা ঘরকে পরিষ্কার করে মুছে নিয়ে আয়োজন করল প্ল্যানচ্যাটের। ঠিক করাই ছিল প্রথমদিন আনা হবে দীপ্তিদিকে, তারপরের শনিবার কাকুসোনাকে, আর ঠিক তার পরের শনিবার ঠাকুমাকে। দেখতে দেখতে প্রথম তিনটে সপ্তাহ ঘোরের মধ্যে কেটে গেল। প্রত্যেকেই বলল দ্বিতীয় দিন জানাবে তাদের মৃত্যুরহস্য। এই মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, আর ওদের আত্মা তাই সবসময় ঘুরে বেড়াচ্ছে ওই পাড়াতে, দোষীদের শাস্তি যতক্ষণ পর্যন্ত না হচ্ছে ততক্ষণ ওরা এইভাবে ঘুরে ফিরে আসবে। ওরা চোখ মুখ লাল করে বলল ‘নাম বলো, আমরা দোষীদের নাম জানতে চাই।’
প্রত্যেকের আত্মাই জানালো ‘আগামী শনিবার জানাবো খুনির নাম।’
সেইমতো সেই সন্ধ্যায় ওরা মিলিত হলো আবার। কাকুসোনার বাড়ির বাচ্চুও এসেছিল ওদের একান্ত আহ্বানে। আসলে কাকুসোনার মৃত্যুর পর বাচ্চু তার গ্রামের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। আবার এসেছিল সবার সাথে দেখা করতে। যাইহোক ঘরের মধ্যে সবাই প্রবেশ করে দরজা, জানালা বন্ধ করল। মৃত তিন ব্যক্তির ছবি সাজানো ছিল আগে থেকেই। মোমবাতি জ্বালানো হলো তিনটে, বন্ধ করে দেওয়া হলো ঘরের আলো। হঠাৎ অঝরে বজ্র বিদ্যুৎ সহকারে বৃষ্টি আরম্ভ হলো। ততক্ষণে সত্যিসত্যিই চারদিকে লোডশেডিং। ওরা চোখ বন্ধ করে মৃত ব্যক্তিকে স্মরণ করতে লাগল। কিন্তু ওরা আগে থেকে ঠিক করেনি কাকে ডাকা হবে। আসলে আজ মৃত ব্যক্তিরা প্রত্যেকেই আসতে চেয়েছিল ওদের কাছে তাদের মৃত্যুর সঠিক কারণ তুলে ধরবে বলে। ওরা যে যার নিজের লোককে চোখ বন্ধ করে ডাকতে লাগল। আকাশে ততক্ষণে প্রবল বজ্রবিদ্যুতের ঝলকানি, কারো কোনো কিছুতেই খেয়াল নেই। অঝোর ধারায় আর তীব্র বাতাসের ধাক্কায় দরজা জানালা খুলে যেতে লাগল। বাইরে গভীর অন্ধকার। ধুমধাম আওয়াজে ওরা চমকে উঠল। তিনটে মোমবাতির মধ্যে দুটো মোমবাতি তখন জ্বলছে। একটা অনেক আগেই নিভে গেছে। কিছুক্ষণ পর আরও একটা নিভে গেল। আর মাত্র একটা মোমবাতি, সেই মোমবাতিটাও নিভতে নিভতে আবার জ্বলে উঠল, আর সেই জ্বলে ওঠা মোমবাতির ক্ষীণ আলোতে দেখতে গেল সারা ঘরে বাচ্চু নেই। বাচ্চুর জায়গায় বসে আছে একটা আস্ত কঙ্কাল…

Share.

মন্তব্য করুন