সব মানুষেরই কিছু না কিছু প্রিয় জিনিস থাকে। যা তার কাছে খুবই ভালো লাগে। যেটি সে সব সময় কাছে রাখে। আর সবাই চায়- তার প্রিয় ব্যক্তি বা বস্তু তার সাথে সারাক্ষণ রাখতে। প্রিয় কোন কিছুর অনুপস্থিতির অভাব কেমন তা তখনই অনুভব করা যায় যখন তা কাছ থেকে দূরে কোথাও অবস্থান করে। তেমনি একটি প্রিয় জিনিস ছিল হাবিবের। যাকে সে বন্ধু বলে ডাকতো। তাকে দিয়ে হাবিব সব কিছু করত। সব জায়গায় যেতো। সার্বক্ষণিক তার সহযোগিতাই যেন তার জন্য বন্ধুর আত্মত্যাগ। সেটি আর কিছুই নয় তার প্রিয় সাইকেল। তাকে হাবিব হুন্ডা মনে করত। সাইকেলটি তার এতই প্রিয় ছিল যে, একটা মুহূর্ত তাকে ছাড়া কাটত না। এমন কোন দিন ছিল না যে দিনটিতে সে তার প্রিয় বন্ধু সাইকেলকে নিয়ে কোথাও যেতো না। এ ছাড়া আর কোন বন্ধু ছিল না হাবিবের। সাইকেল বন্ধুই তার সব কিছু।

হাবিব বেশির ভাগ সময় তার এই সাইকেল বন্ধুকে নিয়ে তার সংস্থার কাজ করতো। অনেক দূর পর্যন্ত তার সফরের বড়সঙ্গী। কারো প্রিয় বন্ধুর যদি কিছু হয় তাহলে কি সে তা সহ্য করবে? হাবিব অনেক ব্যথা পায় যখন তার বন্ধুর কোন অসুখ হয়। সাইকেলের প্রতি হাবিবের ভালোবাসার যেন শেষ নেই। একদিন তার সংস্থার উদ্যোগে খেলার আয়োজন করলে তার অধীনস্থ খেলোয়াড়দের নিয়ে খেলায় সে অংশগ্রহণ করে। খেলার দল পরিচালনা করতে গিয়ে বন্ধুর তালার একমাত্র একটি চাবি হারিয়ে পেলে। তার একটু অন্য মনস্কের কারণে বন্ধুর পায়ের শিকলের চাবি সে হারিয়েছে। খেলা শেষ, বাড়ি যাবে। খোঁজা-খুঁজি করেও চাবি পায়নি হাবিব।
শিকলমুক্ত করার জন্য অবশেষে, সে কাছ থেকে একটি ইট নেয় এবং নাভি তালা ভেঙে শিকলমুক্ত করে। দুই দিন পর চাবির খোঁজ পাওয়া যায়। কিন্তু, এখন আর কি হবে! তালাতো নেই। তার এই অসচেতন হয়ে চাবি হারানোই তাকে ইঙ্গিত দিয়ে ছিল এমন কিছুর যার কিছুটা টের পেয়েছিল সে। কিন্তু, টাকা না থাকার কারণে দ্বিতীয় বার আরেকটি তালা কিনার মতো টাকা হাবিবের কাছে ছিল না। তার এই বন্ধুকেও কিনেছিল অনেক কষ্টে। গ্রামীণ ব্যাংক থেকে যখন তার বাবা-মা ঋণ নেয় তখন সেখান থেকে টাকা দিয়ে সাইকেল কিনে দিয়েছিল তাকে। আর সেই হয়ে গেল হাবিবের বন্ধু। এরই মধ্যে তার ৬ মামার মধ্য থেকে ছোট মামা তার সাইকেল চালিয়েছিল এক মাস ধরে। কারণ, হাবিবের তখন দাখিল পরীক্ষার্থী বলে কেন্দ্রের পাশে রুম ভাড়া নিয়ে থাকত। কেননা- পরীক্ষা কেন্দ্র তার বাড়ি থেকে বহু দূরে। পরীক্ষা শেষে তার বন্ধুর শরীরের দুর্বলতা দেখে কিছুটা মর্মাহত হল। কিছুই বলেনি তার মামাকে।
হাবিব তার বন্ধুকে নিয়ে রীতিমত আবার কাজ শুরু করে দিয়েছিল। এবং প্রাইভেটও পড়াত। পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা দুর্বল বলেই সাইকেলেই ছিল হাবিবের কাছে মোটরসাইকেল-এর মতো। অবশেষে একদিন হাবিব সকালে সংস্থার কাজে বের হয়। স্থানীয় বাজারে আসে হাবিব। আর এটাই ছিল বন্ধুকে নিয়ে বাজারে আসা শেষ দিন। প্রতিদিন বন্ধু সব জায়গায় তার সাথে সাথে থাকত কিন্তু ঐদিন সে একটি বই দোকানের সামনে রেখে যায়। দোকানের কর্মচারীকে বলে যায় যেন তার তালাহীন বন্ধুকে দেখে রাখে। পঁচিশ থেকে ত্রিশ মিনিট পর বন্ধুর জন্য এলে আর তাকে খুঁজে পায়নি। চারদিকে খোঁজাখুঁজি চলতে থাকে। কিন্তু কোথায়, যে তার বন্ধুকে চুরি করেছে সে কি আর তাকে ফেরত দিবে? হাবিবের চোখে পানি চলে আসে। বাজার মসজিদে প্রবেশ করে দু’রাকাত নফল সালাত আদায় করে। শরীরের মাঝে প্রচ- দুর্বলতা বোধ করলে মসজিদে ঘুমের মাধ্যমে একটু বিশ্রাম নেয়। কিছুক্ষণ পরে উঠে আবার খোঁজা-খুঁজি শুরু হয়ে যায়। একদিন পার হয়ে গেল বন্ধুর কোন খবর নেই। পরের দিন রাত্রে বাজার থেকে কম্পিউটার ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফেরার পথে তার সাইকেল দেখতে পায়। আশ্চর্য হয়ে মামাকে ডেকে নেয় হাবিব। লোকটার কাছে গিয়ে সাইকেলটি দেখলে হাবিব নিজেই বুঝে ফেলেছিল তার ভুল হয়েছে। আসলে এটি তার নয়। সাইকেলের মত দেখতে সাইকেল বহু জনের আছে। বন্ধুর প্রতি অতি ভালোবাসা বলেই অন্যের সাইকেল নিজের বলে মনে হচ্ছে। সবার সামনে লজ্জিত হয়ে পড়ে হাবিব। লোকটির কাছে ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চেয়ে নেয় সে।
চোখে অশ্রু চলে আসে। কান্নাভরা হৃদয় নিয়ে রওনা হয় বাড়ির উদ্দেশে। পুরো পথটা কান্না করতে করতে বাড়ি ফিরে সে। আর কখনো সাইকেল চালাবে না বলে ভাবতে থাকে। তার প্রিয় বন্ধুর নিরাপত্তা যেখানে দিতে পারেনি সেখানে আরেক জনের নিরাপত্তা কিভাবে দিবে। শুধু এতেই নয়, নানান ধরনের অস্থিরতায় ভোগতে থাকে তার চুরি হয়ে যাওয়া বন্ধুকে নিয়ে। একটু অসচেতনতা আজ তার জন্য দুঃখের কান্নার যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে এলো। যেখানে সে তাকায় তার প্রিয় বন্ধুর কথা মনে উঠে। মনে হয় যেন সে আশপাশেই আছে। চোর কি আর মানুষ দেখতে পেল না? আমি গরিব তাই আমাকে আরো গরিব বানালো…।

Share.

মন্তব্য করুন