ঘরের বাইরে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শব্দ কানে আসতেই ছুটে বাইরে বেরিয়ে এলো রাফি। শাফিন নতুন সাইকেল কিনেছে। কালো আর সোনালী রঙের মিশেলে দারুণ দেখতে লাগছে সাইকেলটাকে।
‘দেখ রাফি, কাল নতুন সাইকেল কিনে দিয়েছে বাবা। দেখ তো কেমন হয়েছে?’ বলল শাফিন।
‘বাহ, মা-শা-আল্লাহ। খুব সুন্দর তো!’
‘রঙটা বাবাই পছন্দ করে দিয়েছে।’
‘কত নিয়েছে রে?’
‘প্রথমে পনেরো হাজার বলেছিলো, বাবা অনেক দরাদরি করার পর তেরো হাজার টাকায় রাজি হয়।’
‘আচ্ছা বাকি কথা পরে হবে, এখন পিছনের সিটে বোস। প্রথম ড্রাইভটায় তোকে নিয়েই যাবো।’ বলল শাফিন।
‘মা আমি একটু পরে আসছি। দরজাটা লাগিয়ে দিয়ো।’ বলেই শাফিনের সাইকেলের পেছনের সিটটাতে বসে পড়লো রাফি। শাফিন, রাফির সবচে ভালো বন্ধূ। দুজনের পরিবারের আর্থিক অবস্থা এক না হলেও, খুব মিল তাদের মধ্যে।
রাফির মায়ের নাম রাশেদা বেগম। দুই ছেলে আর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে শহরের এই বাসাটাতে ভাড়া থাকেন তিনি। রাফির বাবা থাকেন বিদেশে। মধ্যপ্রাচ্যে এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। তাদের নিজ বাড়ি গ্রামের হলেও রাফি আর মেয়ে সোহানার জন্যেই শহরে থাকা। দুজনেই খুব মেধাবী। বড় ছেলে রাফির পড়াশোনা, বোর্ডসেরা স্কুলে। আর সোহানা এই বছর সরকারি স্কুলে ভর্তি পরীক্ষা দেবে। দুজনের ব্যাপারেই খুব আশাবাদী বাবা-মা। ছোট ছেলে তুহিন কিছুদিন আগেই মাদরাসার নূরানী বিভাগে ভর্তি হয়। আর্থিক অবস্থা খুব বেশি ভালো না হলেও, তেমন মন্দও না। খারাপ কিছু না ঘটলে অনায়াসেই তাদের দিন চলে যায়। মাস শেষে তেমন একটা সঞ্চয় থাকে না এই আরকি।
জানালার ফাঁক দিয়ে এতক্ষণ রাফিদের কথোপকথন শুনছিলেন মিসেস রাশেদা। রাফিরা বেরিয়ে যেতেই দরজাটা লাগিয়ে দিলেন তিনি। কথাগুলো শোনার পর, মনের কোথায় জানি একটু বেদনার মেঘ এসে হাজির হয়। খারাপ লাগাটা শাফিনের সাইকেল কেনার আনন্দে নয়, বরং খারাপ লাগাটা বড় ছেলের আবদার পূরণ করতে না পারার। গত বছর রাফিটা বলেছিলো নতুন দেখে একটা সাইকেল কিনে দিতে। কিন্তু বাজারে যে নতুন সাইকেলের অনেক দাম। পুরনো সেকেন্ড হ্যান্ড সাইকেলও রাফির পছন্দ নয়। দু-একবার বায়না করার পর মায়ের দীর্ঘশ্বাস দেখে আর কিছুই বলেনি রাফি। একবার শুধু বলেছিল, ‘সমস্যা নেই মা, তোমরা যখন পারবে তখন কিনে দিলেই হবে।’

রান্নাঘরে বিরিয়ানী রান্নায় ব্যস্ত মিসেস রাশেদা। বিরিয়ানি রাফির খুব পছন্দের। কোনো বিশেষ উপলক্ষ ছাড়া খুব একটা বিরিয়ানী খাওয়া হয়না রাফিদের। কিন্তু তাদের বাসায় আজ বিরিয়ানি রান্না হচ্ছে। রান্নার সুগন্ধে পুরো ঘর মো-মো করছে। রাফি রান্না ঘরের দরজার এক কোণায় এসে দাঁড়ালো।
‘মা, আজ বিরিয়ানী রাঁধছ যে? আজ কি কোনো বিশেষ দিন?’
‘কেনো, কোনো বিশেষ দিন ছাড়া বুঝি বিরিয়ানি রান্না করা যায় না?’
‘না, তা কেনো হবে। সচরাচর তো তুমি এমন করো না তাই বললাম আর কি।’
‘আজ করলাম, যা তোরা তিন ভাইবোন মিলে খাবার টেবিলে গিয়ে বোস। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিরিয়ানী রান্না হয়ে যাবে।’

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে গল্পের বই নিয়ে বসেছে রাফি। গল্পের বই রাফির খুব প্রিয়। বইপোকা বললেও খুব একটা ভুল হবে না। আজকের বইটার গল্পও দারুণ। পড়তে পড়তে গল্পে হারিয়ে গিয়েছিলো রাফি। একফোঁটাও নড়াচড়া নেই তার। বাইরে জোনাক পোকার মিট মিট আলো, ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা বেসুরো আওয়াজ, তুলসী গাছের বুনো গন্ধ কোনো কিছুই রাফির ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ভেদ করতে পারছে না। কখন যে মা পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন ওর টের পেলো না সে। অতঃপর কাঁধে মায়ের হাতের স্পর্শ পেতেই পিছন ফিরে তাকাল রাফি।
‘সাইকেল তোর খুব পছন্দের, না?’ বললেন মা।
‘হ্যাঁ, কিন্তু সাইকেলের তো অনেক দাম মা।’
‘আজ বিকেলে তোর বাবা কল দিয়েছিলো। বললো, এই মাস থেকে নাকি তোর বাবার বেতন বাড়ানো হয়েছে। ব্যবসায় অত্যন্ত সৎ হওয়ার কারণে কোম্পানি নিজ থেকেই এই উদ্যোগ নেয়। তোর সাইকেলের কথা বলতেই, বললো, ‘প্রথম মাসের অতিরিক্ত পাঁচ হাজার টাকা আমি এখনই পাঠিয়ে দিচ্ছি। তুমি কারো কাছ থেকে কিছু টাকা ধার করে ওর সাইকেলটা কিনে দাও। ধার পরিশোধের টাকা আমি পরের মাসে পাঠিয়ে দেবো। রাফিকে বলো ভালো করে পড়াশুনা চালিয়ে যেতে। আরও বলবে জেএসসি পরীক্ষায় বৃত্তি পেলে ওর জন্য বিশেষ পুরস্কার থাকবে।’
‘কিন্তু মা, এখন টাকা ধার দেবে কে?’
‘সেটাই ভাবছিলাম। তবে তুই চিন্তা করিস না। টাকা জোগাড় হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।’

স্কুলের পাশের দীঘির পাড়ে বসে গল্প করছে শাফিন আর রাফি। মাত্র আসরের নামাজ পড়ে এসে এখানে বসে আছে ওরা।
‘জানিস শাফিন, মা বলেছে কিছুদিনের মধ্যেই টাকা জোগাড় করে নতুন দেখে একটা সাইকেল কিনে দেবে আমায়।’
‘বাহ তাহলে তো খুব ভাল হবে। সাইকেল নিয়ে দুই বন্ধু ঘুরে বেড়াতে পারবো সারাদিন।’
‘অলরেডি বাবা পাঁচহাজার টাকা পাঠিয়েছে। এখন বাকি টাকাটা জোগাড় হলেই হয়।’
‘যেদিন তুই সাইকেল কিনতে যাবি, সেদিন আমাকে আগে থেকেই একটু বলে রাখিস। আমি পারলে বাবাকেও সঙ্গে নিয়ে যাব।’
ঠিক এই সময়ে স্কুলের মাঠ থেকে ডাক এলো একটা। রাফিদের ক্লাসের বন্ধুরা খেলার জন্য ডাকছে তাদের। রাফি ও শাফিন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো, অতঃপর এগিয়ে চললো মাঠের উদ্দেশ্যে।

‘হ্যালো শাফিন, যেদিন সাইকেল কিনতে যাবো সেদিন একটা কল দিতে বলেছিলি না, তাই দিলাম। একটু পরেই ঘর থেকে বের হবো। তুই, তোদের বিল্ডিংয়ের নিচে এসে দাড়া। আমি আসছি।’
‘ওকে দোস্ত। এই ফাঁকে বাবাকেও একটা কল দিয়ে রাখি। তবে, তার আসতে একটু দেরি হতে পারে।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে, এখন রাখলাম।’ বলেই ফোন কেটে দিলো রাফি।
বাবার পাঠানো পাঁচ হাজার, নিজের দুই হাজার আর মায়ের জমানো দুইহাজার টাকা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো রাফি। রাফির মা অল্প অল্প করে প্রতি মাসেই কিছু টাকা জমানোর চেষ্টা করেন। এভাবেই পাঁচ হাজার টাকা জমিয়ে ফেলেন তিনি। প্রথমে পুরো টাকাটাই রাফিকে দিয়ে দেন মিসেস রাশেদা বেগম। রাফি সেখান থেকে দুই হাজার টাকা নিয়ে বাকি টাকাটা মায়ের হাতে দিয়ে বললো, ‘মা এর চেয়ে বেশী লাগবে না। তাছাড়া আমার নিজের কিছু জমানো আছে। বাবার পাঁচ হাজার তো আছেই।’
‘কিন্তু এগুলো দিয়ে হবে তো তোর? টাকা যদি শর্ট পরে যায়?’
‘তুমি কোন চিন্তা করো না মা। এগুলোতেই হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।’
‘ঠিক আছে, সাবধানে যাস।’
‘আচ্ছা, মা।’

রাফি বাসা থেকে বেরিয়েছে প্রায় আধ ঘন্টা হলো। শাফিনদের বিল্ডিংয়ের নিচে, তার সাথে দেখা হলে দুজনেই একটা রিকশায় উঠে পড়ে। তাও প্রায় বিশ মিনিট আগে। রিকশা এখনো চলছে। আর কিছুদূর গেলেই সাইকেল মার্কেট।
‘হ্যাঁ রে শাফিন, আজ তোর সাথে তোর বাবারও আসার কথা না?’ প্রশ্ন করলো রাফি।
‘বাবাকে বলেছিলাম আসার জন্য। বাবা বললো তার অফিসে গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিং আছে আজ। তাই আজ সময় দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।’
‘আচ্ছা, তাহলে কি আর করা। আঙ্কেল থাকলে একটু সুবিধাই হতো।’
‘হুমম…।’
‘এইতো চলে এসেছি। চল, নেমে পড়।’
রিকশা থেকে নেমে পড়লো রাফি আর শাফিন।
‘এই নিন মামা আপনার ভাড়াটা।’ ৩০ টাকার একটা নোট রিকশাচালকের দিকে এগিয়ে দিলো রাফি।

‘দেখ তো শাফিন, সাইকেলটা খুব সুন্দর না!’
‘আরে হ্যাঁ, তাই তো। একদম হুবহু আমার সাইকেলটার মতো, শুধু রংটা লাল এই যা।’
‘এটার দাম জিজ্ঞেস করে দেখি, কী বলিস!’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, অবশ্যই।’
‘আঙ্কেল, এটার দাম কত পড়বে?’ দাম জিজ্ঞেস করলো রাফি।
দোকানদার বললেন, ‘ফোনিক্স সাইকেলের দাম আঙ্কেল একটু বেশি। এটার দাম পড়বে চৌদ্দ হাজার টাকা।’
‘আঙ্কেল একটু কমিয়ে বলুন। কিছুদিন আগেও তো আপনার কাছ থেকে একটা সাইকেল কিনলাম।’ বলল শাফিন।
‘হ্যাঁ আঙ্কেল, তুমি আগেও একটা সাইকেল নিয়েছিলে বলেই দামটা একটু কম বললাম। আচ্ছা সমস্যা নেই, আরও এক হাজার টাকা কম দিলেও হবে।’
কথাটা শোনার পর রাফি ও শাফিন পরস্পর মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো। শাফিন মনে মনে বললো, বাবাটা থাকলে ভালোই হতো। ‘আঙ্কেল, একটা শেষ দাম বলুন তো। আমাদের বাজেট নয় হাজার টাকা। এর চেয়ে বেশি আর পারবো না।’ বললো শাফিন।
‘দেখো, দশ হাজার টাকার মধ্যে আমার দোকানে অনেক সাইকেল পাওয়া যাবে। কিন্তু তোমাদের পছন্দের সাইকেল ঐ একটাই, আর সেই সাইকেলটা ছাড়া অন্য কোন সাইকেল নিতেও তোমরা রাজি নও। তাই শেষ একটা দাম বলছি- এগারো হাজার পাঁচশ টাকা। এর চেয়ে কম আমিও পারবো না আঙ্কেল।’
চরম হতাশ হয়ে পড়লো রাফি। সে চাইলে মায়ের জমানো টাকাগুলো নিয়ে আসতে পারতো। কিন্তু রাফি জানে, মায়ের কিছু শখ আছে। সেই শখগুলো তার অনেকদিনের। তার জন্যেই মা এতদিন টাকা জমিয়ে আসছিলো।
‘কি ভাবছিস এভাবে?’ রাফিকে একধ্যানে চিন্তামগ্ন দেখে প্রশ্ন করলো শাফিন।
‘না, কিছু না। চল শাফিন, মনে হয় আজ আর সাইকেল কেনা হবে না।’
শাফিনকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো রাফি।
ঠিক এমন সময়ই, কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করলো রাফি। ফিরে তাকালো দুজন। সৌম্য চেহারার শুভ্র দাঁড়ির চশমা পরা লোকটিকে দেখেই শাফিন চমকে গেল ওরা দুজন।
‘বাবা তুমি? তোমার না একটা জরুরী মিটিং ছিলো?’
‘মিটিং একটা ছিলো, কিন্তু একটু আগেই সেটা বাতিল করা হয়। তাছাড়া অফিস থেকে মার্কেট খুব একটা দূরে না। পায়ে হেঁটে আসা যায়। তাই ভাবলাম, তোমাদের ওখানে একবার গিয়ে দেখি।’

এতক্ষণ পিছনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রাফিদের কথা শুনছিলেন শাফিনের বাবা। কথাগুলো কানে যেতেই ছোটবেলার স্মৃতিগুলো এক এক করে মনের পর্দায় ভেসে উঠল তার। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা কিশোর শফিক (শাফিনের বাবা) কত শত আবদার জুড়ে দিতো তার বাবা-মাকে। সেগুলোর অধিকাংশই ফিরে আসত কষ্টের দীর্ঘশ্বাস নিয়ে । একবার একদিন সেই তেরো চৌদ্দ বছর বয়সের কিশোর শফিক, তার বৃত্তির টাকা জমিয়ে লাল টুকটুকে একটা জামা কিনতে এসেছিল শহরের দোকানে। শুধুমাত্র অল্প কিছু টাকার জন্য সেই টুকটুকে লাল জামা গায়ে তোলা হয়নি তার। অথচ সেই শফিক আজ শহরে বিল্ডিং তুলেছে, তার আছে নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শহরের একটি নামকরা কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজিং ডাইরেক্টর সে।
কষ্টের কথাগুলো মনে পড়তেই মনটা ভরে উঠলো তার। আসলেই কিছু কিছু কষ্ট শুধু দুঃখ পাওয়ার জন্য নয়, সেই কষ্টগুলোকে পুঁজি করে ডুব দেওয়া যায় হৃদয়- আনন্দের অসীম সাগরে।
মানিব্যাগ থেকে দ্রুত পাঁচশ টাকার পাঁচটি চকচকে নোট বের করে, রফির হাতে গুঁজে দিলেন শফিক সাহেব। যেনো তার নিজের পুরনো শখগুলোর স্বপ্নপূরণ হলো আজ। আর ঠিক তখন রাফির চেহারায় একরাশ বিস্ময়, আর শাফিনের মুখে শোভা পাচ্ছে পুলক ভরা একরাশ হাসি।’

Share.

মন্তব্য করুন